তানজিনা হোসেনের লেখা কল্পবিজ্ঞান বই 'এলিনা' : আগামী পৃথিবীতে কি সত্যিই অতি বুদ্ধিমান শিশুদের আগমন ঘটবে?

তানজিনা হোসেন রচিত কল্পবিজ্ঞান বই 'এলিনা

খান আলাউদ্দিন

বুদ্ধি কি? খেলাধূলা করার দক্ষতা। নতুন নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা। অভিযোজন ক্ষমতা। পড়াশোনায় ভালো করা। বুদ্ধি নিয়ে নানা ঋষির নানা মত। বুদ্ধি পরিমাপ করার জন্য প্রচলিত পদ্ধতি হলো IQ টেস্ট। যা শুরু হয়েছিল ১৮৭৬সালে।


IQ বা Intelligence Quotient = মনের বয়স÷ সত্যিকার বয়স ।

আইকিউ মানের উপর ভিত্তি করে মনোবিজ্ঞানীরা বুদ্ধির বিভিন্ন অবস্থা নির্দিষ্ট করেছেন। প্রমিত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত যাদের IQ মান ১৩০ এর উপর তাদের বলা হয় সুপার জিনিয়াস, আশীর্বাদপুষ্ট প্রতিভা। ত্রদের মনের বয়স সত্যিকার বয়স থেকে অস্বাভাবিক বেশি থাকে। যুক্তিসঙ্গত চিন্তা, গাণিতিক দক্ষতা, ভাষা দক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে এরা অনন্য সাধারন ।

তানজিনা হোসেনের বিজ্ঞান কল্পকাহিনী এলিনার কেন্দ্রীয় চরিত্র 'এলিনা' এক সুপার জিনিয়াস শিশু । বয়স সবে তিন। সে কথা বলতে শিখেছে নয় মাসের মাথায় । তার ছবি আঁকার শুরু দেড় বছর বয়সে । যেনতেন ছবি নয়। নিখুঁতভাবে রং পেনসিলের টান দিয়ে আঁকা ছবি। তার মা রিয়া একজন বিজ্ঞানী, তাকে নিয়ে চলে এসেছে শহর থেকে দূরে। একটা পুরোনো বাড়িতে। উদ্দেশ্য, লোকচক্ষুর অন্তরালে এলিনাকে বড় করে তোলা। সায়েন্স কাউন্সিল এলিনার ব্যাপারে জানতে পারলে তাকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে যাবে। বিদেশি জার্নালে পেপার বেরুবে। অথচ রিয়া চায় আর দশটা শিশুর মতো এলিনাকে স্বাভাবিক শৈশব উপহার দিতে। কিন্তু বিধিবাম! মানুষ চায় এক, হয় আরেক। বেলা সায়েন্স ইনস্টিটিউটের প্রধান স্নায়ুগবেষক সাব্বির সন্ধান পেয়ে যায় তাদের । অবসরে যাওয়া ড. হুদার বাগানবাড়িতে ল্যাবরেটরি বানিয়ে এলিনাকে নিয়ে চলতে থাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা। একাজে সাব্বিরকে সাহায্য করে বেলা ইনস্টিটিউটের প্রতিভাবান জিন বিজ্ঞানী ফিমা। তারা একটা পি সাইটোটোপ বা ট্রান্সপোজোন তৈরী করে এলিনার খিঁচুনি সৃষ্টিকারী জিনটাকে সাইলেন্ট করে দেয়। ওদিকে ড.হুদা ট্রান্সপোজোন বা ডি.এন.এ প্যারাসাইট ব্যবহার করে সাব্বির ও ফিমার বিশেষ স্মৃতিরক্ষাকারী জিনকে ধ্বংস করে ফেলে । তাদের দুজনের মেমোরী থেকে মুছে যায় এলিনা ও রিয়া সম্পর্কিত সকল স্মৃতি।

এলিনার মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম বিবর্তন (ওর ব্রেনের ফ্রন্টোপ্যারাইটাল রিজিয়ন ছিলো আশ্চর্য রকমের ঘন। এটিই বুদ্ধির লোব। কোঁচকানো ব্রেইনের সারফেস বা জাইরাইয়ে ছিলো অতিরিক্ত ভাঁজ। হোয়াইট ম্যাটারের ঘনত্ব চোখে আটকে পড়ার মতো। ভাঁজ করা জাইরাই বা হোয়াইট ম্যটারের সংখ্যার উপর আই কিউ নির্ভর করে।) প্রাকৃতিক ভাবে ঘটেনি। এলিনা ছিলো রিয়ার স্বামী, সুপার ব্রেইন গবেষক প্রতীকের এক্সপেরিমেন্ট। গিনিপিগ। সবকিছু জানতে পেরে প্রতীককে পরিত্যাগ করে রিয়া। এলিনা নিভৃতে বড় হতে থাকে ডা. হুদা ও রিয়ার সান্নিধ্যে। সে পরিণত হয় ড.হুদার প্রিয় ক্ষুদে ছাত্রীতে ।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর গ্রান্ডমাস্টার আইজ্যাক আসিমভ বলেছেন, 'বিজ্ঞান কল্পকাহিনীকে অবশ্যই বিজ্ঞান প্রযুক্তির সঙ্গে জড়াতে হবে। নিদেনপক্ষে বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে ছুঁয়ে যেতে হবে।’ এলিনা কল্পকাহিনীটি বিজ্ঞানের শক্ত ভূমির উপর গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞানের সঙ্গে যোগ হয়েছে মানবিকতা, যুক্তিতর্ক আর তত্ত্বপ্রমাণ। তবে একটা বিষয়ে লেখকের উদসীনতা চোখে পড়ার মতো। বুদ্ধিবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জিন। বুদ্ধির জন্য দায়ী জিন থাকে ক্রোমোজোম ৪ ও ৬ তে। জিনের সাথে ঐশ্বর্যপূর্ণ পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ায় ধাপে ধাপে শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটে। ‘এলিনা’ কল্পকাহিনীতে পরিবেশের বিষয়টি লেখকের অবহেলাবশত উপেক্ষিত রয়ে গেছে। উল্লেখ্য, এলিনাকে নিয়ে রিয়া নিভৃতে থাকতেই নিরাপদ বোধ করে। তারা যেখানে থাকে সে জায়গাটা নির্জন। আশেপাশে বাড়িঘর নেই। শুধু দক্ষিণ দিকে একটু দূরে একটা সাদা দোতলা বাড়ি। এলিনার খেলার সঙ্গি বলতে টেডি বিয়ার আর জার্মান শেফার্ড কুকুর। নাম পালো। এলিনা বড় হচ্ছে ধরতে গেলে বদ্ধ পরিবেশে। এমন বদ্ধ পরিবেশে চারপাশ সম্পর্কে এলিনার জানার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। পরিবেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ নাও ঘটতে পারে । এদিক ওদিক তাকে বেড়াতে নিয়ে গেলে তাঁর মনের বিকাশ সুষ্ঠুভাবে ঘটবে বলে মনে করি।

আরেকটা বিষয়, এলিনা গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়েই আমরা জানতে পারি, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে জন্ম নিচ্ছে এমন সব শিশু যাদের মাথা অস্বাভাবিক বড়। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল এসব শিশুদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকলে পানি জমে মাথা মোটা হয়ে গেছে। সার্জারি করে পানি বের করে দিতে হবে। কিন্তু পরীক্ষায় ধরা পড়ে মস্তিষ্কে পানি জমেনি। সিটি স্ক্যান পুরোপুরি স্বাভাবিক। এরাই সুপার জিনিয়াস। তবে সবসময় বড় মস্তিষ্ক মানেই বুদ্ধিমত্তা বেশি ব্যাপারটা এমন নয়। মৌমাছি আর আকারে কতটুকু! অথচ ছোট্ট মৌমাছিরাই বিভিন্ন বস্তু, প্রাণী গণনা এবং আলাদা করতে সক্ষম।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিকে বলা হয় আগামি দিনের রূপকথা। সাইফাই লেখক বিজ্ঞান, যুক্তি দিয়ে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ অঙ্কন করেন। অনেক বিজ্ঞান কল্পকাহিনীকার তাদের গল্প, উপন্যাসে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। যেগুলো পরবর্তীতে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, পারমানবিক বোমা, ক্রেডিট কার্ডের কথা। ‘এলিনা’ উপন্যাসে বর্ণনা করা সুপার জিনিয়াস শিশুদের জন্মগ্রহণ করার প্রেডিকশনও হয়তো একদিন বাস্তবে পরিণত হবে। যুক্তির নিরিখেঃ প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর আগের কথা। তখন সমুদ্রে বসবাস করত অতি সরল অমেরুদন্ডী প্রাণীরা। সেসব অমেরুদন্ডী প্রাণীরা কোনোটির শরীরে ঘটেছিলো জিন দুর্ঘটনা। আর তার ফলেই উৎপন্ন হয় মস্তিষ্কের বিভিন্ন জিনের একাধিক প্রতিলিপি। জিনগুলো বাহিত হয়েছিলো অমেরুদন্ডী প্রাণিটির পরবর্তী প্রজন্মেও। এই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রয়েছে মানুষ, জটিল গঠনসম্পন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীরা। গবেষণায় জানা গেছে, পঞ্চাশ কোটি বছর আগের জিন দুর্ঘটনাই মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ চিন্তা ভাবনার ক্ষমতার জন্য দায়ী। তারপর বয়ে গেছে বহু বহু সময়। তাই আজ কিংবা আগামীকাল বিবর্তনের পথ ধরে সুপার জিনিয়াসদের আবির্ভাব ঘটবে বলে মনে হয়। মানুষের খুলির যে আকার তাতে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটলে তা আটবে না। অর্থ্যাৎ মস্তিষ্কের বৃদ্ধি অসম্ভবই প্রায়। নারীদের জননাঙ্গের সীমাবদ্ধতার কারণেই বড় করোটির বিকাশ ঘটেনি। কিন্তু বর্তমানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুদের জন্মগ্রহণ হওয়ায় শিশুরা জন্মাচ্ছে বড় মাথা নিয়ে। সো, ইট হ্যাজ বিন স্টার্টেড। এছাড়াও ব্রেইনের নির্দিষ্ট অংশে ছুরিচালনা বা জিন প্রকৌশল করে মানবপ্রজাতির বুদ্ধিবৃত্তির অভাবনীয় বিকাশ ঘটানো যেতে পারে। কৃত্রিম জরায়ুতে ভ্রুণের বৃদ্ধি নিশ্চিত করা গেলেও মানুষের করোটির আয়তন বাড়বে। ধীরে হলেও বাড়বে।
 
কর্নেল নামে একটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করে যাচ্ছে এমন একটি যন্ত্র উদ্ভাবনের যা মাথার ভেতর বসিয়ে দিলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বেড়ে যাবে একলাফে। এইসব কথা শুনতে অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে অসম্ভব কথাটা আপেক্ষিক। পরিশেষে ‘এলিনা’ এমন একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী যা বাস্তবতার দিক দিয়ে বিচার করা যায়। বিবর্তন, জিন প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যা বিজ্ঞানের সূত্রগুলো অকেজো হয়ে পড়ে না এলিনা পাঠে ।

~:~:~:~:~:~
এলিনা
তানজিনা হোসেন

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল
মূল্য: ১৬০ টাকা
ISBN 978 984 92402 7 3

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ