দীপেন ভট্টাচার্যের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ‘অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো’ : অস্তিত্ব রক্ষায় মহাবিশ্বান্তরে

দীপেন ভট্টাচার্য- অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো

খান আলাউদ্দিন

“তাদের লক্ষ্য ছিল বৃহৎ অভিজিৎ বা আলফালীরা গ্রহমণ্ডল। যুগ যুগ ধরে মানুষ বিমুগ্ধ হয়ে উত্তর আকাশে সেই উজ্জ্বল নীল নক্ষত্রটিকে দেখে আসছে। অভিজিৎ পর্যন্ত দূরত্ব হচ্ছে আট পারসেক।”

_এন্ড্রোমিডা নীহারিকা, ইভান ইয়েফ্রেমভ।


বিজ্ঞান কল্পকাহিনির গ্রান্ডমাস্টার আইজ্যাক আসিমভ বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে সায়েন্স ফিকশন লেখা যায়না। আপাদমস্তক বিজ্ঞানের মানুষ দীপেন ভট্টাচার্য কাজ করেছেন নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে, বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার মরেনো ভ্যালি কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ফলে, তাঁর কল্পকাহিনিতে আমরা বিজ্ঞানের পাশাপাশি, দর্শন, জাদুকরী গল্পবর্ণনা, স্থান ও সময় চেতনা লক্ষ্য করি। শিশুতোষ নয়, তিনি সায়েন্স ফিকশন লেখেন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। তাঁর অভিজিৎ নক্ষত্রের আলোয় আমরা জানতে পারি এমন এক মহাবিশ্বের কথা যেখানে গ্যালাক্সিগুলো, গ্রহ-উগ্রহগুলো ক্রমাগত সংকোচিত হয়ে আসছে মহাসংকোচনের কারণে। সে মহাবিশ্বটাকে লেখক আমাদের কাছে ‘ক’ মহাবিশ্ব বলে পরিচয় করে দিয়েছেন যার এক প্রাচীন সভ্যতার বিজ্ঞানীরা চুপসে আসা মহাবিশ্ব থেকে পালিয়ে আসার উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঘটনাক্রমে এদেরই একজনের সাথে দেখা হয়ে যায় এ বইয়ের প্রোটাগনিস্ট অনীক চৌধুরীর। তারা শেষতক অস্তিত্ব রক্ষার কোনো উপায় খুঁজে পায় কিনা তা জানার আগে আসুন এ কাহিনির চরিত্রাবলি সম্পর্কে জেনে আসি।

চরিত্রাবলি:-

অনীক চৌধুরী: প্রোটাগনিস্ট । আরন্যক। বিভূতিভূষনের ভক্ত বলে এই নাম । পুরো উপন্যাসের বর্ণনাকারী ।
পিয়ের ল্যাবন্তিয়ে: ক মহাবিশ্বর প্রতিভাবান বিজ্ঞানী।
ইসাবেল : খ যন্ত্র পরিচালনা দলের সদস্য।
জেরার্ড স্কাইল : আন্তর্মহাজাগতিক আততায়ী । পৃথীবীতে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে এফ .বি.আই . স্পেশাল এজেন্ট হিসেবে।
রিটা ম্যাকিন্টায়ার : স্কাইলসের উপর নজর রক্ষাকারী ।
ফ্রেডকম্পটন: পুলিশ সার্জেন্ট।
পিয়ের ল্যাবন্তিয়ে, ইসাবেল, স্কাইলস, রিটা ম্যাকিন্টায়ারে _ চারজন আসে ক মহাবিশ্বে থেকে ম মহাবিশ্বে। ইসাবেল ও পিয়েল ছিলো খ যন্ত্রের পরিচালনায়। স্কাইলস ছিলো চারজনের দলের প্রধান।
ক্যাপ্টেন মোরেনো: কি ওয়েস্ট পুলিশ স্টেশনের, অনীক চৌধুরীর গাড়ি দুর্ঘটনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন।
দীপেন ভট্টাচার্য: ভূমিকা ও পরিশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে লেখকের জবানে।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং, পারমাণবিক যুদ্ধ, জৈব অস্ত্র, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই), রোবট, ন্যানো টেকনোলজি ইত্যাদি নানাবিধ কারনে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এবং ইতোমধ্যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। মানবজাতির, মানবসভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমাদের পাড়ি জমাতে হবে গ্রহান্তরে। স্টিফেন হকিং এক স্বাক্ষাৎকারে বলেন,

‘আগামী ১ হাজার বছর মানবজাতির টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই। তাই আমাদের মহাজগতে ছড়িয়ে যেতে হবে’।


ভালো কথা কিন্তু এই মহাবিশ্বটাই যদি ক্রমান্বয়ে ধুঁকে ধুকে নিঃশেষ হতে থাকে তখন আমরা কোথায় যাব? মহাবিশ্ব  ধ্বংস হয়ে যাবার কারণ হিসেবে বলা হয় হিট ডেথ, মহাসংকোচন বা বিগক্রাঞ্চের কথা। এই দৃশ্যমান মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে গেলে আমাদের যাওয়ার জায়গা হবে যে অসংখ্য সমান্তরাল মহাবিশ্ব রয়েছে সেগুলো। দীপেন ভট্রাচার্যের বিজ্ঞান কল্পকাহিনী অভিজিৎ নক্ষত্রের আলোর প্রসঙ্গগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে সমান্তরাল মহাবিশ্ব ও মহাসংকোচনের প্রসঙ্গ। অভিজিৎ নক্ষত্রের আলোয় ঘটনা আবর্তিত হয়েছে দুটি সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়ে। মানব অধ্যুষিত ‘ম’ মহাবিশ্ব ও অন্যটি হলো এলিয়েন ‘ক’ মহাবিশ্ব । ‘ক’ মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে চুপসে যাচ্ছে। গ্যালাক্সীরা ছুটে আসছে একটি বিন্দুতে। অর্থ্যাৎ মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিলো একটি একক বিন্দুতে এবং শেষও হয়ে যাচ্ছে একটি একক বিন্দুতে। ‘ক’ মহাবিশ্বের এক প্রাচীন টাইপ ৩ সভ্যতা অন্যান্য মহাবিশ্বে বাসযোগ্য গ্রহ খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে পৃথিবীকে খুঁজে পায় তারা। কার্ল সাগানের সূত্রানুসারে মানব সভ্যতা টাইপ ০ ও টাইপ ১ সভ্যতার মাঝামাঝি সভ্যতা। টাইপ ৩ সভ্যতা আমাদের চেয়ে কয়েক লক্ষ বছর এগিয়ে থাকবে। এরূপ সভ্যতার দেখা পাওয়া আমাদের জন্য ভালো ফলাফল নাও বয়ে আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি ১৫২১ সালে স্পেনীয়দের হাতে ধ্বংস হওয়া অ্যাজটেক সভ্যতার ইতিহাস। যদিও স্পেন ও অ্যাজটেকদের মধ্যে প্রাযুক্তিক বিস্তারের পার্থক্য খুব বেশি ছিলো না। প্রাযুক্তিকভাবে এগিয়ে থাকা দুটি সভ্যতার মধ্যকার দ্বন্দ্বও চমৎকারভাবে রূপায়িত হয়েছে অভিজিৎ নক্ষত্রের আলোয়। ‘ক’ মহাবিশ্বের অন্যতম বিজ্ঞানী জেরার্ড স্কাইলস পৃথিবীর মানব অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ‘পৃথিবীকে মানুষের জন্য সংরক্ষণের কথা ভাবেনি’। শেষ পর্যন্ত স্কাইলসের অভিলাষ বানচাল হয়ে যায় এই কল্পকাহিনীর অন্যতম প্রোটাগনিস্ট অনিক চৌধুরীর কাছে।

ভন নিউম্যান প্রোব: বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, তারা একদিন নিজের প্রতিলিপি করতে সক্ষম রোবট তৈরি করতে পারবে।সেই রোবট মাইক্রোস্কোপিকই হোক বা টেবিল আকৃতিই হোক। আমাদের মতো সভ্যতার জন্য তা তৈরি কঠিনই বটে। তবে টাইপ৩ সভ্যতার জন্য এটা জলের মতো সহজ। ‘ক’ মহাবিশ্বের ক্ষ্যাপাটে বিজ্ঞানী পিয়ের ল্যাবন্তিয়ে এমনি এক যন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়। প্রতিলিপি করতে সক্ষম রোবটের যে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন দীপেন ভট্টাচার্য তা অত্যান্ত সাহসের দাবিদার। আমরা জানি জাত সায়েন্স ফিকশন লেখকরা কল্পনার বাতাসে গা ভাসিয়ে কোনো কিছু বর্ণনা করে না। করেননা বলেই ক্রেডিট কার্ড, আর্টিফিসিয়াল কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট,সাবমেরিন কল্পকাহিনীর পাতা থেকে বাস্তবে রুপ লাভ করেছে। আর দীপেন ভট্টাচার্য একজন বিজ্ঞানী। তার লেখার রয়েছে অনুসন্ধিৎসা তত্ত্বীয় ভিত্তি ও গবেষণার সারাংশ।দীপেন ভট্টাচার্যের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, প্রতিলিপি সক্ষম রোবট নীল বাক্স হবে ঘনক্ষেত্র, নিখুঁত প্রতিসম। ভারী ধাতুর তৈরি। এক সচেতন অস্তিত্ব। এবার দেখার পালা অপেক্ষা। হয় কি!

হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদহীন জটিল গবেষণাকে বলা হয় তত্ত্বসাহিত্য। তাত্ত্বিক রচনা । বাউল শিল্পীরা সন্ধান করেন পরমাত্মার, সন্ধান পেতে চান অদেখা স্রষ্টার। বাউল মত ও পথ হলো অরুপের। অভিজিৎ নক্ষত্রের আলোর পরিশিষ্টের লেখক সুকৌশলে বাউল গান জুড়ে দিয়েছেন:-

আমি একদিন না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর
এক পড়শি বসত করে ।।
ওরে গ্রাম বেড়ে অগাধ পানি তার নাই
কিনারা নাই তরণি পারে, মনে করি
দেখব তারই, আমি কেমনে সেথা যাইরে ।।


সায়েন্স ফিকশনে বাউল গানের ব্যবহার লেখকের উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। উল্লিখিত বাউল গানের ভেতরে প্রবেশ করলে আমরা দেখতে পাবো, বাউল তত্ত্ব ও সমান্তরাল মহাবিশ্বতত্ত্ব জড়াজড়ি করে আছে গানটির মাঝে। পরমাত্মার, স্রষ্টার সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ নেই আমাদের এই মহাবিশ্বের পাশাপাশি বিরাজমান অসংখ্য মহবিশ্বের সাথে।

স্টোরি টেলিংয়ে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন লেখক। বইয়ের মুখ বন্ধ ও পরিশিষ্ট বাদে পুরো কাহিনীই বলা হয়েছে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অনীক চৌধুরী বা আরণ্যকের জবানে।

-+-+-+-+-+-+-+-+-+-
অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো
দীপেন ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার
প্রকাশক : মফিদুল হক, সাহিত্য প্রকাশ
প্রথম প্রকাশ : মে ২০০৬
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১০৭
দাম : ১০০ টাকা
ISBN: 984-465-452-1

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ