সুকুমার রায়ের সেরা গল্প - সম্পাদনা: আমীরুল ইসলাম

সুকুমার রায়ের সেরা গল্প - সম্পাদনা: আমীরুল ইসলাম


সুকুমার রায়ের সেরা গল্প
সম্পাদনা: আমীরুল ইসলাম
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৯, চতুর্থ মুদ্রণ: ১৯৯২
প্রচ্ছদ: হাশেম খান,
পৃষ্ঠা: ৬১,
মূল্য: ৪০ টাকা

বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসাত্মক রচনার পরিমাণ খুব বেশি নেই। অল্প যে কয়েকজন হাস্যকৌতুক রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে সুকুমার রায় অন্যতম। স্থূল কৌতুক নয়, বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যভঙ্গি, আকর্ষণীয় শব্দচয়ন, শব্দবন্ধন, মজার কাহিনী মিশিয়ে তিনি যা রচনা করেছেন তা বাংলা সাহিত্যে একেবারে অনন্য। তিনি যেমন রচনা করেছেন তা আগে বাংলা সাহিত্যে কেউ করেনি। তিনি যা ভেবেছেন, যা লিখেছেন তা এক কথায় বললে বলতে হবে 'ননসেন্স'। অসংগতি ও অসংলগ্নতার মিশ্রণে তিনি যা প্রকাশ করেছেন, তা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ দ্বারা রাঙানো হলেও উপেক্ষণীয় নয়। এমন সব অর্থহীন তুচ্ছ বিষয়কে সুকুমার রায় শিশু-কিশোরদের জন্য এমন মজার করে উপস্থাপিত করেছেন যে অবাক হতে হয়। তাঁর 'ননসেন্স রাইমস' বাংলা সাহিত্যে এক নবতর সংযোজন।

ভাবনাকে একই সাথে ভাষা ও চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করার সামর্থ তার আছে, আর সেজন্য এমন অদ্ভুত মজার ছবি তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য এঁকেছেন তার তুলনা বিরল। শিশু কিশোরদের মনের উপযোগী ছড়া, গদ্য আর ছবি তিনি দুহাতে বাংলা সাহিত্যে উপহার দিয়ে গেছেন। সাহিত্যবোধ, কৌতুকবোধ, চিত্রবোধ বহুমুখী প্রকাশভঙ্গির বলেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য মহিমায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত আমীরুল ইসলাম সম্পাদিত এই বইয়ের শিরোনামহীন সম্পাদকীয়তে সুকুমার রায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের তাৎপর্যমণ্ডিত মন্তব্য আছে। সুকুমার রায়ের গল্পগ্রন্থ 'পাগলা দাশু'র প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুকুমার রায় সম্পর্কে লিখেছেন-


সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলাসাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছল অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল। সেইজন্যেই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গেছে, কিন্তু সুকুমারের হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকালমৃত্যুর সকরুণতা পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে থাকবে।

 

জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এর সন্তান সুকুমার রায় পিতার মতোই সাহিত্য বৈদগ্ধে, চিত্রশিল্পে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সম্পাদিত 'সন্দেশ' পত্রিকাকে ঘিরেই প্রধানত সুকুমার রায়ের সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। হাসির কবিতা ও ছড়া লিখে কৌতুককর ছবি এঁকে আর সেসব নিজের পত্রিকায় প্রকাশ করে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।

সম্পাদক আমীরুল ইসলাম সুকুমার রায় সম্পর্কে মুক্তকণ্ঠে বলেছেন-


তাঁর  বহুমুখী প্রতিভার প্রদান বিকাশ ঘটে শিশুসাহিত্য রচনায়। এক উদ্ভট, অবিমিশ্র অট্টহাস্য সমৃদ্ধ কৌতুকপ্রিয় অনাস্বাদিত জগতের স্রষ্টা তিনি। বাংলা শিশুসাহিত্যে তাঁর অবস্থান প্রায় অনন্য। খেয়ালরসের মন মাতানো আপাত তরল কিন্তু সুগভীর বক্তব্য ও বিচিত্র ভাবধারার এক সুউচ্চ মিনারে তাঁর অধিবাস। ছন্দ ও শব্দ তাঁর অলংকার রচনার বিষয় সামগ্রিকভাবেই মৌলিক, মেজাজে তিনি খাঁটি ননসেন্স; যার বঙ্গানুবাদ করেছেন নিজেই,--- খেয়ালরস। যা তিনি সোজা চোখে দেখেন তা ঠিক সোজা নয়। যা কিছু আপাতত তুচ্ছ তাই হয়ে ওঠে ভাব গভীরতায় সমৃদ্ধ। হাস্যকৌতুক, উদ্ভট চরিত্রের কার্যকলাপ, অনায়াস ব্যঙ্গ ও বিচিত্র রসসিঞ্চিত বিষয়াবলী নিপুণ শব্দ-ছন্দ-মিল ও ভাষাশৈলীর ব্যবহারে কল্পনাতীত সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার সমগ্র রচনায়। এমন কী তার চিত্রাংকনে। ভাব ও রস বিচারে, কল্পনার উজ্জ্বলতায়, ব্যাখ্যাতীত ব্যাপ্তিতে সুকুমার রায়ের রচনার অধিকাংশই বুদ্ধিদীপ্ত, প্রভাময় এবং দীপ্যমান। উদ্ভট রসের শাণিত দীপ্রতায় সুকুমারের রচনা সমগ্রে খুঁজে পাওয়া যায় অযৌক্তিকতার যুক্তিনিষ্ঠতা, অবাস্তবের বাস্তবতা এবং সাধারণের অসাধারণত্ব।

 

সুকুমার রায়ের রচিত ছড়াগুলোই বেশি জনপ্রিয়। তাই তাঁর গল্পগুলো অনেকটা অপরিচিত থেকে গেছে। অথচ সুকুমারের বুদ্ধিদীপ্ত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় গল্পগুলোতেও স্পষ্ট। পিতা উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সুকুমার রায় 'সন্দেশ' পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পত্রিকাটিকে ঘিরে সুকুমার রায়ের প্রতিভাব বিচ্ছুরণ হতে থাকে। ছড়া, কবিতা ছাড়াও তখন তিনি গদ্য লিখতে আরম্ভ করেন। গল্প, প্রবন্ধ, রূপকথা, কৌতুক, জীবনী ইত্যাদি অবিরাম লিখে গেছেন। শিশুদের মনের রঙিন রঙিন বাগানগুলোর সন্ধান সুকুমার রায় জানতেন। তিনি ঠিক ঠিক জানতেন কোন কথায়, কোন ঘটনায় শিশুরা অবাক হয়, চমকে যায়, বিস্মিত হয়, উৎফুল্ল হয়। এজন্য অল্পবয়সী নবীন পাঠকরা সুকুমার রায়কে চিরদিন ভালবেসে যাবে।

বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক 'স্কুল স্টোরি' ধারাবাহিকভাবে লেখার কৃতিত্ব তাঁর। পাগলা দাশু, তার সহপাঠী ও অন্য বন্ধুরা ও শিক্ষকগণ মিলে এক এক পর এক মজার মজার গল্প নিয়ে হাজির হয়।

অভাবিত ও অদ্ভূত প্রাণীর রাজ্যে শিকারীর সদলবলে হারিয়ে যাওয়া কিংবা বিড়াল ও কাকেশ্বর নামক কাকের সাথে এলোমেলো পরম্পরাহীন কাহিনীর ঘোরপ্যাঁচে মাথা ঘোরা,দাশুর উদ্ভট ও অসংগত ঘটনা, দ্রিঘাংচু নামক কাকের না জানি কী এক অবাক ঘটনার জন্য বিস্ময় নিয়ে প্রতীক্ষা করা একমাত্র সম্ভব সুকুমার রায়ের গল্পগুলিতেই।

মাত্র সাতটি গল্পে সাজানো এই বইয়ের সূচীপত্রটি নিম্নরূপ-

  • হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি
  • হ য ব র ল
  • পাগলা দাশু
  • দাশুর খ্যাপামি
  • দাশুর কীর্তি
  • দ্রিঘাংচু
  • রাজার অসুখ

 

প্রথম গল্প 'হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি'তে এক শিকারীর অদ্ভূত বনে গিয়ে কিম্ভুতকিমাকার প্রাণীদের মুখোমুখি হওয়ার কাহিনী আছে।

প্রফেসর হুঁশিয়ার শিকারে গিয়ে এক অদ্ভূত বনে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে দেড় হাত লম্বা সাদা ফুল ফোটে। ঝিঙের মত এক ধরণের ফল ধরে যার ঝাঁঝাঁলো গন্ধ পঁচিশ হাত দূর থেকে পাওয়া যায়। এই বনে গিয়ে তিনি 'হ্যাংলাথেরিয়াম', 'গোমরাথেরিয়াম', 'বেচারাতেরিয়াম', 'চিল্লানোসরাস', 'ল্যাগব্যাগর্নিশ', 'ল্যাংড়াথেরিয়াম' নামের কিম্ভুতকিমাকার কিছু প্রাণীর দেখা পান। প্রফেসর হুশিয়ার আর তার ভাইপো চন্দ্রখাই এইসব প্রাণীদের ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু এক বিশাল ঝড় তাদের যন্ত্রপাতি, বড় বড় তাঁবু, সংগ্রহীত বিভিন্ন নমুনার বাক্স, ছবি সবকিছু কাগজের মতো উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদের কুকুরটা কোথায় যে হারিয়ে গেছে তা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্মৃতি থেকে তারা সেই প্রাণীদের যে ছবি নিজেরা এঁকেছে তা খুবই কৌতুহলজনক।

সুকুমার রায় গল্প বেচারাথেরিয়াম ও চিল্লানোসোরাস
বেচারাথেরিয়াম ও চিল্লানোসোরাস

সুকুমার রায় গল্প ল্যাংড়াথেরিয়াম ও ল্যাগবাগর্নিশ
ল্যাংড়াথেরিয়াম ও ল্যাগবাগর্নিশ

সুকুমার রায় গল্প হ্যাংলাথেরিয়াম ও বেচারাথেরিয়াম
হ্যাংলাথেরিয়াম ও গোমরাথেরিয়াম


তাঁর 'হযবরল' গল্পটি খুবই বিখ্যাত। কাহিনী কোথা থেকে যে কোথায় যায়, তা বুঝে ওঠার জন্য যুক্তির দ্বারগুলোকে ভেঙে ফেলে এই গল্প পড়তে বসতে হবে।


বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্তির। ঘাসের উপর রুমালটা ছিল; ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল, ‘ম্যাঁও!’ কি আপদ! রুমালটা ম্যাও করে কেন?
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টকটকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট প্যাট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি বললাম, ‘কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।

 

বেড়ালের সাথে সাথে এসে হাজির হয় 'কাকেশ্বর কুচকুচে গণিতবিদ আদিবংশীয় দাঁড়কাক'। হিসাব করাই তার কাজ। তাই সে সারাক্ষণ হাতে শ্লেট নিয়ে অংক কষতে থাকে। এই কাক যে হ্যান্ডবিল বিলি করছিল তাতে বিজ্ঞাপনের ভাষা এরকম-


আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী, খুচরা ও পাইকারী, সকল প্রকার গণনার কার্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করিয়া থাকি। মূল্য এক ইঞ্চি ১।/০। CHILDREN HALF PRICE অর্থাৎ শিশুদের অর্ধমূল্য। আপনার জুতার মাপ, গায়ের রং, কান কটকট করে কিনা, জীবিত কি মৃত, ইত্যাদি আবশ্যকীয় বিবরণ পাঠাইলেই ফেরত ডাকে ক্যাটালগ পাঠাইয়া থাকি।
সুকুমার রায় কাকেশ্বর কুচকুচে গণিতবিদ আদিবংশীয় দাঁড়কাক
কাকেশ্বর কুচকুচে গণিতবিদ আদিবংশীয় দাঁড়কাক

 

ব্যাকরণশিং ছাগলের প্রতিবাদ একটাই যে ছাগলেরা সবকিছু খায় এ জাতীয় কথা বলা ঠিক না। বলা হয় যে "ছাগলে কি না খায়", কিন্তু কথাটা সত্যি নয়। কারণ কোন ছাগল কখনও কোন টিকটিকি খায়নি। তারা সাবানের ঠোঙা, নারকেলের ছোবড়া, খবরের কাগজ, লেপ, তোশক, বালিশের একাংশ খায় বটে, তবে কখনো কোন একটিও খাট-পালং, টেবিল-চেয়ার খেয়ে ফেলেনি।। 'হিজিবিজবিজ' নামক লোকটার নানারকম কান্ড, ন্যাড়ামাথা লোকটার অযাচিতভাবে বিদঘুটে গান শোনানো, শেয়াল , সজারু, কুমিরের মানহানির মামলা নিয়ে তর্কবিতর্ক শেষে রায় হল যে- “ন্যাড়ার তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি"। হ য ব র ল নামক এই গল্পে ঘটনা বা কাহিনী এতটাই অবান্তর ও অসংলগ্ন যে মূল গল্প না পড়লে বোঝা কঠিন হবে। আর পড়ার সময়ও সুকুমার রায়ের মানসিকতা মনে রাখতে হবে।

সুকুমার রায়ের লেখা হযবরল গল্পের দুটো ছড়া বেশ বিখ্যাত। এই গল্পের ন্যাড়ামাথা লোকটার কোন গান মানহানিকর তা নিয়েই মামলার কথা এসেছিল। ন্যাড়ার গাওয়া গানগুলোই পরে ছড়া হিসেবে বিখ্যাত হয়ে যায়। সুখপাঠ্য, হাস্যরসাত্মক দুটি গান বা ছড়া উল্লেখ করছি-

“একের পিঠে দুই
চৌকি চেপে শুই
পোঁটলা বেঁধে থুই
গোলাপ চাঁপা জুঁই
ইলিশ মাগুর রুই
হিনচে পালং পুঁই
সান বাঁধানো ভুই
গোবর জলে ধুই
কাঁদিস কেন তুই?”


 

আর একটি মজার গান বা ছড়া হল-


“চাঁদনি রাতের পেতনীপিসি সজনেতলায় খোঁজনা রে---
থ্যাঁতলা মাথা হ্যাংলা সেথা হাড় কচাকচ ভোজ মারে।
চালতা গাছে আলতা পরা নাক ঝোলানো শাঁখচুনি
মাকড়ি নেড়ে হাঁকড়ে বলে, আমায় তো কেঁউ ডাঁকছনি।
মুণ্ডু ঝোলা উলটোবুড়ি ঝুলছে দেখ চুল খুলে,
বলছে দুলে, মিনসেগুলোর মাংস খাব তুলতুলে।"


 

অনুপ্রাস অলংকারের এমন মজার উদাহরণ আর কোন কবিতায় পাওয়া যাবে?

দাশু তার সহপাঠী ও শিক্ষকদেরকে নিয়ে একাধিক গল্প লিখেছেন সুকুমার রায়। স্কুলকে ঘিরে ছাত্র শিক্ষকের নানান ঘটনা নিয়ে গল্প বাংলা সাহিত্যে খুব কম। দাশু কিছুটা কান্ডজ্ঞানহীন, আত্মপ্রেমিক মেধাবী ছেলে। 'পাগলা দাশু' গল্পে তার কিছুটা পরিচয় আছে। লেখকের ভাষ্যে দাশুর চেহারা দেখলে মনে হয়-


“ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ডু তাহে ভারি
যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারি।"


 

দাশুর সম্পূর্ণ নাম দাশরথি। অঙ্কে তার মাথা খুব ভালো। সে প্রতিভাবান। সে নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য বুদ্ধিদীপ্ত উপায় বের করে। তার ঘটানো নানারকম অভাবনীয় ঘটনা নিয়েই রচিত 'পাগলা দাশু', ‘দাশুর খ্যাপামি', ও 'দাশুর কীর্তি' নামক গল্প তিনটি।

দ্রিঘাংচু গল্পে এই নামের একটি কাকের জন্য রাজাসহ সবাই অপেক্ষা করে। কাকের দেখা পেলে তাকে একটি নির্দিষ্ট মন্ত্র বলতে হবে। তাহলে কী যে আশ্চর্যকর কান্ড ঘটবে তা কেউ জানে না। কারণ তার কথা কেউ কোনদিন কোন বইয়ে লেখেনি। দ্রিঘাংচুর দেখা পেলে যে মন্ত্রটি বলতে হবে সেটা হল-


“হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইট পাটকেল চিৎ পটাং
মুস্কিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।"


 

‘রাজার অসুখ' গল্পটি হাস্যরসাত্মক নয়। শিক্ষামূলক উদ্দেশ্য নিয়ে গল্পটি লেখা। রাজার অসুখ হয়েছে। সন্ন্যাসী বলেছেন- যে লোক সব সময় হাসিমুখে থাকেন, যার মনে কোন ভাবনা নেই, যে সবসময়ে সব অবস্থাতে হাসিখুশি থাকে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তার গায়ের জামা পড়িয়ে এক দিন পরে থাকলে ও থাকবার তোষকে এক রাত ঘুমালে রাজার অসুখ সেরে যাবে। মন্ত্রীমশাই অনেক খুঁজে এমন একজনকে পেলেন। সেই লোকটি সবসময় হাসিখুশি থাকেন। মনে কোনরকম উদ্বিগ্নতা, দুর্ভাবনা বহন করেন না। কিন্তু তার গায়ে কোন জামা নেই, কেউ একজন একটি শাল উপহার দিয়েছিল কিন্তু তাও এক ভিখারীকে দান করে দিয়েছেন। চল্লিশ বছর ধরে তিনি বিছানাই চোখে দেখেননি। অতএব তার তোষক বা গদি কিছুই নেই। রাজামশাই এ কথা শুনে নিজের মনে ভাবতে বসেন-


আমি থাকি রাজার হালে, ভাল ভাল জিনিস খাই, কোন কিছুর অভাব নেই, লোকেরা সব সময়ে তোয়াজ করছেই-- আমার হল অসুখ! আর ঐ হতভাগা ফকির, যার চাল-চুলো কিচ্ছু নেই, জামা নেই, কম্বল নেই, গাছতলায় পড়ে থাকে, যা পায় তাই খায়--- সে কিনা বলে, অসুখ-টসুখ কিছু মানেই না। সে ফকির হয়ে অসুখ উড়িয়ে দিতে পারল, আর আমি রাজা হয়ে পারব না?


এই সাতটি গল্প সুকুমার রায়ের কৌতুকবোধ, মানবিক বোধ ও সামাজিক চেতনাকে একই অঙ্গে স্থান দিয়েছে।  শিশুদের মনের মতো করে যে কথাগুলো বলেছেন তা বয়স নির্বিশেষে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। এজন্যই শুধু শিশু-কিশোর নয় সব বয়সের মানুষ সুকুমার রায়ের রচনা পড়ে আনন্দিত হয়, তৃপ্ত হয়। অন্য এক ভিন্নজগতে রোমাঞ্চকর মুহূর্তে হারিয়ে যায়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সুকুমার রায়ের গল্পগুলি ছোটদের কাছে পরিচিত করে দেয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলা ভাষা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই বইটি কিশোর-কিশোরীদের মনের রঙিন জগতকে আরও বর্ণিল করে তুলবে, আরও বহুমুখী কল্পনায় ভরিয়ে তুলবে একথা নির্দিধায় বলা যায়। সম্পাদকের ভাষ্য ধার করে নিয়ে বলতে হয়-


তাঁর গল্পের নির্মাণবৈচিত্র, ভাষাশৈলী, উদ্ভাবনকৌশল এবং দক্ষতাকে শ্রদ্ধা না করে উপায় নেই। এই গল্পগুলো ছোটদের আনন্দ দেয় আর বড়োদের ভাবতে শেখায়। যুগপৎ এই সম্মিলনের কারণেই তাঁর সাহিত্যকর্ম মহত্ব্বের দাবীদার হয়ে ওঠে। তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম স্থপতি, আমাদের চির-প্রণম্য ব্যক্তিত্ব।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ