নিষুপ্ত - জয়দীপ দে

প্রত্যেকটা মানুষই নিদ্রামগ্ন
 বিকাশ রায়
নিষুপ্ত - জয়দীপ দে শাপলু

নিষুপ্ত
জয়দীপ দে


প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশক: অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা।
প্রকাশকাল: ২০১৮
মূল্য: ২০০ টাকা
পৃষ্ঠা: ১২৮
ISBN: 978-984-526-187-6

১।
গণতন্ত্র নামক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে একই সাথে দুটো বিপরীত বৈশিষ্ট্য ক্রিয়াশীল। একদিকে এটি যেমন সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন একই সাথে সংখ্যা লঘিষ্ঠেরও। সাধারণত ধর্ম, বর্ণ কিংবা জাতিগত দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। আবার, অর্থনৈতিক ভাবে বিবেচনা করলে কতিপয় পুঁজিপতি কিংবা পুঁজিবাদের রক্ষক শ্রেণিই এই শাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক রূপে অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা যখন এই মানুষগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন অর্থনৈতিক ভাবে নিম্নস্তরে অবস্থান করা মানুষ হয় এর প্রথম শিকার। কিন্তু এর নিষ্ঠুরতম অভিঘাতটি সহ্য করতে হয় ধর্মীয় কিংবা জাতিগত পরিচয়ের নিম্নবিত্ত সংখ্যালঘুদের। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠান কিংবা টিকে থাকার স্বার্থে ক্ষমতার কুশীলবরা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। আপাত প্রগতিশীল মানুষের অবচেতন মনে যুগপৎ ভাবে বাসা বেধে থাকে  পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি এবং সাম্প্রদায়িক চেতনা। মানুষ যখন কোনোভাবে আক্রান্ত হয় তখন তার সাম্প্রদায়িক চরিত্রটি জেগে ওঠে। ‘নিষুপ্ত’ উপন্যাসটি বুঝি তারই আখ্যান।

২।
নিষুপ্ত উপন্যাসটিতে দু’জন ব্যক্তির গল্প সমান্তরালভাবে বহমান। একটি চপলের অন্যটি স্নিগ্ধার। চপল উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র। গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছেদ পড়ে ‘সুপল’ নামক মেজদার একটি মিথ্যা মামলায় আসামি হয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর। মেজদাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি নিজের অর্থনৈতিক সাবলম্বিতার জন্য চেষ্টা করতে হয় তাকে। উপন্যাসের শেষে চপল নিজেই আক্রমণের শিকার হয়। সমগ্র উপন্যাসটি চপলকে ঘিরে আবর্তিত। সুতরাং একই সমান্তরালে বয়ে চলা স্নিগ্ধা চরিত্রটি লেখকের বাড়তি মনোযোগ পেয়েছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আরেকটু গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, গল্পটি স্নিগ্ধারও। চপল আক্রান্ত হচ্ছে সে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলে এবং স্নিগ্ধা আক্রমণের শিকার সে শুধু নারী বলেই। তাই গল্প দুটো ব্যক্তির থাকে না, চপলের গল্পটিতে প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির সাথে সাম্প্রদায়িক অনুষঙ্গ যুক্ত এবং স্নিগ্ধার গল্পটি পুঁজিপতি শ্রেণির অর্থনৈতিক উত্থান ও তাদের জীবনাচরণের একটি খণ্ডিত চিত্র।

৩।
নিষুপ্ত উপন্যাসটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস হয়ে উঠতে পারতো। কারণ, এর গল্পটি শুরু হয়েছে সুপল নামক মেজদা’র চরিত্র দিয়ে যে কিনা একটি মিথ্যা হত্যা মামলার আসামি হয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে। এই উপন্যাসে উল্লিখিত ঘটনাগুলো একটি রাজনৈতিক দলের সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে হয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেকোনো সরকারের পালাবদলে এমন মিথ্যা মামলার শিকার হওয়াটা এখন স্বাভাবিক দৃশ্য। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা এমন মামলার শিকার হয়ে থাকেন। কিন্তু এখানে সুপলের মামলাটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয় এর সাথে যুক্ত হয়েছ সাম্প্রদায়িক উপাদান। ধর্মীয়ভাবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের রাজনীতি করাকে স্পর্ধার চোখে দেখে।  সেজন্য এম পি সাহেবের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়-
“ ছেলেটারে আমি এত করে বললাম, তুমি বাবা হিন্দুর ছেলে, রাজনীতি দিয়া তোমার কী কাজ। ব্যবসাপাতি করো। জীবনে উন্নতি করো। আমি নিজেই তারে একটা কন্ট্যাক্টারি দিলাম। কিন্তু ছেলেটা হইছে নিমকহারাম কিসিমের।” (পৃষ্ঠা- ১১৩)  
৪।
অরণ্য ওবায়েদ চরিত্রটির আলোচনা ব্যতীত এই উপন্যাসের যেকোনো ধরণের আলোচনাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন মেধাবী যুবক সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন তার মনে। কিন্তু বিভাগের শিক্ষকদের পক্ষপাতের শিকার হয়ে তার স্বপ্ন হারিয়ে যায়। তখনো পথ হারায় নি ওবায়েদ। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে যে সহিংসতার ফলে তার মনে যে প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয় তার ফলে সে একটি কবিতার বই লিখে ফেলে। নাম ‘বিরূপাক্ষের বিলাপ’। চপল বইটির নাম প্রসঙ্গে আলাপ তুললে ওবায়েদ বলে- 
“গত নির্বাচনের পর রাজনৈতিক শিবঠাকুররা দেশজুড়ে যে তাণ্ডব শুরু করেছে তা দেখে তো পুরাণের শিব ঠাকুর একেবারেই থ’। তিনি নিজে তাণ্ডব ভুলে এখন বিলাপে বসেছেন। ইটস মাই ইমাজিনেশন……” (পৃষ্ঠা-৬৫)
সাহিত্যের বিষয় কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে অরণ্যের একটি বিশ্বাস রয়েছে। সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সচেতন ভাবে  সাহিত্যিকরা এড়িয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ সে। এজন্য সে বলে- 
“সাহিত্য তো সমাজের আয়না। আমি যে সমাজ দেখছি, এর  অস্থি মজ্জায় মিশে আছে দুষ্টু রাজনীতির বীজাণু, কবিতায় তা থাকবে না! একটা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উপরে বসে ইডিয়টগুলো কী করে আকাশ, পাতাল, নারী নিয়ে কবিতা লিখে আমি বুঝি না।” (পৃষ্ঠা-৬৫)
অথচ এই অরণ্য ওবায়েদই একসময় বদলে যায়। চিন্তা-চেতনায় প্রগতিশীল এই যুবকটি দ্রুততম সময়ে অর্থ উপার্জনের জন্য বেছে নেয় অন্ধকার পথ। বিরোধ আসে সংসারে। এর জন্য ত্যাগ করে স্ত্রী স্নিগ্ধাকে। চপলসহ অন্যান্যদের বন্ধুত্বও ত্যাগ করে সে। যখন এই কালো ব্যবসার কথা পত্রিকায় উঠে আসে তারপর শারীরিক ভাবে আক্রমণের শিকার হয় চপল। ভাড়াটে গুণ্ডাদের হাতে চপল মার খেতে খেতে দূর থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বরের হুংকার শুনতে পায় চপল; “অই মালাউনের বাচ্চারে মার”। লেখক নাম উল্লেখ না করলেও পাঠকের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না কণ্ঠস্বরটি কার।

প্রগতিশীলতার মুখোশ পরা অরণ্য ওবায়েদের মনের গহীন অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা লোভ কিংবা হীন সাম্প্রদায়িক চেতনাকে সে নিজেই কি চিনতে পারবে! নাকি তার বিবেক নামক বস্তুটি গভীর নিদ্রায় মগ্ন!

৫। মানুষ কিংবা ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করার একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি লেখক জয়দীপ দে’র মধ্যে বিদ্যমান। যে কোনো ধরণের পরিবর্তনের কার্যকারণ বিশ্লেষণ কিংবা এর পরিণাম উপলব্ধির সক্ষমতার নিদর্শন তাঁর লেখার মধ্যে বিস্তর। এজন্য তাঁর লেখায় দেখি- 
“নিচুতলা থেকে উঠে এলে মানুষ একটা সাংস্কৃতিক শূন্যতায় ভোগে। তার আচরণে তা ধরা পড়ে। কথাবার্তা-চালচলনে একটা ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। লোকটা হয় খুব রগচটা, নইলে তেলবাজ। কিংবা দুটো বৈশিষ্ট্যই থাকে চরিত্রে, স্থান ও পাত্রবিশেষে উন্মোচিত হয়।” (পৃষ্ঠা-১০৩)
কিংবা
“সাপ কিন্তু গর্ত খুঁড়তে পারে না, ইঁদুরের গর্তে লুকোয়। ইঁদুর নিজের জন্য ঘর বানায়। পরে ঘরও হারায়, প্রাণও।” (১২২)
জয়দীপ দে মূলত একজন গল্পকার। ছোটগল্পের মেজাজটা তাঁর উপন্যাসেও বিদ্যমান। এজন্য তাঁর উপন্যাসের চরিত্রসমূহের রূপান্তরগুলো দেখি কিন্তু এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় চরিত্রসমূহের আত্মদ্বন্দ্বের ডিটেইলিংটা আঁকা হয় না। বিশেষ একটি রাজনৈতিক আমলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সংক্ষিপ্ত উল্লেখ দেখি কিন্তু এর আর্থসামাজিক বা ধর্মীয়-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং এর বিবর্তনগুলোর বিবরণ এতে নেই। এই বিবর্তনগুলো উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মনোজগতে কী ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে তাও আঁকা হয় না। লেখক এসব বিষয়গুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন কিনা সেটা অস্পষ্ট। তবে এসবগুলো থাকলে আমরা একটি অধিকতর শিল্পসম্মত উপন্যাস পেতাম।

৬।
‘নিষুপ্ত’ শব্দটির অর্থ ‘গভীর নিদ্রামগ্ন’। প্রত্যেকটা মানুষই নিদ্রামগ্ন। একমাত্র কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলে তার ভিতরের বৈশিষ্ট্যগুলো জেগে ওঠে। অরণ্য ওবায়েদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা লোভ এবং সাম্প্রদায়িক চেতনা,  নিশ্চিত আর্থিক সহাতয়ার আশা ত্যাগ করে রুহি’র মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা মানবিক চেতনা জেগে ওঠে। জেগে ওঠে চপলের মনের ক্ষতগুলোও। কিন্তু কিশোরী রুহির প্রতি বিতৃষ্ণ চপলের মধ্যে একসময় রুহির জন্য জেগে ওঠা প্রেম কী আবার নিষুপ্তির আড়ালে হারিয়ে যাবে!

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ