“মাসুদ খানের পাখিতীর্থদিনেঃ এক প্রত্ননিমগ্ন গভীর অন্তর্লোক” - কাব্য পরিচয় কিংবা আলোচনা

মাসুদ খানের পাখিতীর্থদিনেঃ এক প্রত্ননিমগ্ন গভীর অন্তর্লোক - সুশান্ত বর্মন

মাসুদ খানের পাখিতীর্থদিনেঃ এক প্রত্ননিমগ্ন গভীর অন্তর্লোক
সুশান্ত বর্মন

পাখিতীর্থদিনে
মাসুদ খান

প্রকাশকঃ নদী, ঢাকা
প্রচ্ছদঃ শিশির ভট্টাচার্য
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৯৩
মূল্যঃ ৪০/=
পৃষ্ঠাঃ ৬০
ISBN: 984-8103-03-1

দর্শনের প্রধান দুটি শাখাতেই মানুষের প্রাচীন ইতিহাসের প্রশংসা করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ভাববাদী মতে সুদূর অতীতে ‘সত্যযুগ’ নামে এক কাল ছিল। সেসময় সবাই ছিল সত্যবান। কেউ কোনো মিথ্যা কথা বলতো না, কোনো অসৎ কাজ করতো না। এখনও এদেশের সান্তাল, গারো, ওঁরাও প্রমুখ প্রত্নমানুষদের অভিধানে ‘পরশ্রীকাতরতা’, ‘ধর্ষণ’ প্রভৃতি শব্দ অপরিচিত। আধুনিক বস্তুবাদী মতে ইতিহাসপূর্বকালে ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজ’ নামে একটি প্রাকৃতিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সে সমাজে সকল মানুষ সমান ছিল। কেউ কারও তুলনায় কোনো অজুহাতে বিশিষ্ট ছিলনা। প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে এর কোন ক্ষণ স্বীকৃত নয়, তাই বলে সুস্থ সমাজের এই ধারণাটি আমাদের কল্পলোক পরিত্যাগ করেনি। এই চিরনতুন, চিরকাক্ষিত, আনন্দময় ও ধ্রুপদী স্বপ্নলোকের রশ্মিপ্রকাশ স্বদেশে সমকালে বিলুপ্ত। স্বকালের যাবতীয় মিথ্যাচার, প্রবঞ্চনা, অনৈতিকতা, অসঙ্গতি, সহিংসতা অর্থাৎ সার্বিক স্ববিরোধীতা মানুষের মানসলোকে আজ বেকেটের দুঃস্বপ্নগুলোকে মূর্ত করে তুলেছে। ফলে শিল্পজগতের সবখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক বিরান মরুভূমি। বাংলাদেশের কাব্যজগতও এই প্রভাবের বাইরে থাকতে পারেনি। আশির দশকের শেষাংশে এবং নব্বই দশকে এসে এই বন্ধ্যাত্বের কিঞ্চিত উপশম আমরা অনুভব করি। চারপাশের উষর কাব্যমাঠের মাঝে মাঝে কিছু মরুদ্যানসদৃশ সবুজ বাগান আমাদের দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। এরকমই একটি তৃণভূমি সৃজন করেছেন মাসুদ খান তাঁর ‘পাখিতীর্থদিনে’ কাব্যগ্রন্থে।

বাংলাদেশ অঞ্চলের হাজার বছরের পুরনো মানুষের প্রতি ভালোবাসা মাসুদ খানের কবিতায় মর্মবাণীরূপ ধারণ করেছে। তিনি জানেন তাঁর রক্তে যে ডিএনএ জেগে আছে তা বৈদেশিক নয়; কোনো মরুভূমির রুক্ষ্ম নির্জীবতায় তাঁর রক্তকোষ বেড়ে ওঠেনি। বাংলার ভূমিজাত মানুষেরা তাই তাঁর কবিতায় কথা বলে ওঠে। প্রতিবেশের ভেজা মাটি, ভেজা বায়ু, ভেজা আকাশ ও আর্দ্র মানুষ তার মননে কখনো ঘুমায় না। তিনি দেখেন হাজার বছরের কালো মানুষের উত্তররক্ত বহন করছে তাঁর শরীর। এ ইতিহাস অবিস্মরণীয়। মাসুদ খানের মননে প্রত্নঐতিহ্য ধূসর নয়। তাঁর মানসভূমির সম্পূর্ণ আলোকিত করে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, বিজ্ঞানচেতনা, নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব ও ভবিষ্যতের স্বপ্নিল সাম্যসমাজ। প্রতিষ্ঠানের সেবাদাসদের মতো তিনি সমাজের বহিরঙ্গ দেখে মুগ্ধ নন। রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদের শিকলে নিজেকে তিনি অন্যদের মতো বিকিয়ে দেননি। তাঁর জীবনমুখী দু'চোখে ভবিষ্যতের সাম্যসমাজ ধোঁয়াটে হয়ে যায়নি। মাসুদ খানের কবিতাপাঠে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তিনি যেন কবিতার জন্যই কবিতা লিখেছেন। তিনি যেন Art for Arts shake এর বীজকে নিজের মগজে গেঁথে নিয়েছেন। কিন্তু সন্ধানীপাঠক মাত্রই জানেন মাসুদ খান এতটা বিবাগী নন। বরং ত্রিকালদর্শী প্রজ্ঞা নিয়ে তিনি এঁকেছেন ভবিষ্যতের কাল। শুধু শিল্প নয় সমাজের প্রতিও প্রবল দায়িত্ব নিয়ে রচনা করেছেন কবিতার কথামালা।

এই ভারতভূমির সার্বিক অসামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রথম প্রমূর্ত বিদ্রোহ করেন গৌতমবুদ্ধ। এ ইতিহাস তাঁর কবিমনে একটি অন্যতম দৃশ্যকল্পের সৃষ্টি করেছে। মাসুদ খান দেখেন গৌতম বুদ্ধের কালে-

সার্থবাহ নিয়ে আসে ঝলমলে বাসকপাতার কোলাহল
দুঃখ সেরে যায়, অসুখ সারে না।-(বৈশ্যদের কাল)

এই বাস্তবতায় বুদ্ধ নির্ভার-নিশ্চিত থাকতে পারেননি। মানুষের জীবন আঁকড়ে থাকা সমস্যা সমাধানের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা তাঁকে জাগিয়ে তোলে বিলাস জীবন থেকে। এক সুন্দর স্বপ্নের আশায় তিনি বেড়িয়ে পরেন রাজপুত্রের খোলস থেকে।

...একদিন ঘুমন্ত স্ত্রী আর পুত্র রেখে ঘন রাত্রে
নিরুদ্দেশে যায়
নিরঞ্জনা নদীকূল শুধু কাঁপে অকূল তৃষ্ণায়।- (বৈশ্যদের কাল)

মাসুদ খান কল্পনায় যেন অনুভব করেন এরপর-

ধীরে ধীরে এই ভূমিপৃষ্ঠে ফিরে এলো বৈশ্যদের কাল।- (বৈশ্যদের কাল)

কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। মানুষের সার্বিক মুক্তির আশা বিবর্ণ করে দিয়ে-

...ধুলিঝড় হলো, হিমবাহ গেলো শতযুগ।- (বৈশ্যদের কাল)


তারপর বোধহীন বোধির আক্রমণে বুদ্ধের বোধি এই ভূখণ্ডে ক্রমাগত রঙহীন নির্জীব হয়ে যায়। শুধু ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকে-

ঐখানে হৈ হৈ রৈ রৈ পঞ্চকাণ্ড মেলা বসতো
হাজার বর্ষ আগে
আজ শুধু এক জোড়া নিরিবিলি জলমগ্ন বৃক্ষ বাস করে।- (বৈশ্যদের কাল)

মানুষ প্রথমত এবং প্রধানত বস্তু। তাই সে বেশিরভাগ সময়ই চরম বস্তুবাদী। বস্তুকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে; শ্বাস হিসেবে শরীরের ভিতরে প্রবেশাধিকার দেয়। বস্তু দিয়ে লেখে, বস্তু পড়ে, বস্তু ব্যবহার করে; তাঁর চারপাশের যা কিছু গ্রহণযোগ্য তার সব কিছুই বস্তু। এমন চরম বস্তুবাদী মানুষকে আধ্যাত্মবাদ বিচার করে ভিন্নভাবে। প্রাণীজগতের সবচাইতে বুদ্ধিমান জীব মানুষের দিকে কবি তাকাতে চান যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে। কিন্তু তিনি দেখেন সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন দর্শন মানুষকে বিশ্লেষণ করতে চায় ভিন্ন উপায়ে। মাসুদ খান মানুষের প্রচলিত ও বহুল বিবৃত কোন কোন সংজ্ঞায় বিব্রত বোধ করেন। মানুষ সম্পর্কিত দার্শনিক তত্ত্বগুলো তাঁর মনে ভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বহির্জগতের ভিত্তিতে নয় অন্তর্জগতের ভিত্তিতেই মানুষকে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। আর এ লক্ষ্যেই তিনি ‘মানুষ’ নামে উপস্থাপন করেছেন তিনটি কবিতা। প্রথম কবিতায় তিনি মানুষকে সেমেটিক মীথের প্রতিফলনে খুঁজেছেন। ব্যর্থ ইঁদুরশিকারী (যে আবার ইঁদুরছানার কাতর চোখ দেখে শিকারে ক্ষান্ত দেয়), দুধমাছচোর, উঞ্ছজীবী বিড়ালকে উত্যক্ত প্রতিপালক দূর বালিচরে বস্তাবন্দি করে ছেড়ে দেয়। বিতাড়িত বিড়াল নিরিবিলি জীবন থেকে উৎপাটিত হয়ে নির্বাসিত হয় মরুরঙ চরভূমিতে। তার মগজে শুধু ভেসে বেড়ায় প্রাক্তন প্রভূর দূরনিয়ন্ত্রিত সংকেত। কিন্তু উপায় নেই। চারপাশের অথৈ জলরাশি তাকে অনিচ্ছাকৃত জীবন যাপনে বাধ্য করে তোলে। মানুষ নামাঙ্কিত দ্বিতীয় কবিতাতেও তিনি মানুষকে দেখেন সেমেটিক আয়নায়। এখানে মানুষ চিহ্নিত হয়েছে আপেল চোর হিসাবে। পেছনে তাড়া করা সাপের ফণা ক্লান্ত চোর মানুষটিকে শান্ত থাকতে দেয়না। কবি মানুষের এমন হীন সংজ্ঞায় বিব্রত; এমন বিকটভাবে বিশেষায়িত নিজেকে স্থাপন করবার জন্য পাত্র খুঁজে পাননা। ‘মানুষ’ শীর্ষক তৃতীয় কবিতাটিতে কবি মানুষের এমন পূর্বনির্ধারিত অপমানকর বিশেষণকে প্রত্যাখ্যান করেন। সরাসরি অস্বীকার করেন নিজের আরোপিত চোরবংশজাত ঐতিহ্যকে।

তোমাদের এই বংশের কেউ নই,
না তস্করকুলের কেউ।- (মানুষ)

নিবিড় পর্যবেক্ষণে তিনি জেনেছেন প্রাতিষ্ঠানিক দাসদের মানসদিগন্ত। প্রতিষ্ঠানপ্রেমিক আমরা দাসখত লিখেছি জীবন ও সমাজের কাছে। জেনেছি মর্ম সত্য নয় রূপ সত্য। আমাদের কাছে এযুগে প্রকল্পব্যবসা মর্যাদা পায় সমাজসেবা বলে। ফলে-

বীজায়ন প্রক্রিয়া, তারও পূর্বপার থেকে
জন্মদিন ভেঙেচুরে, দেহ তো হয়ই নি, দৌড়ে আসে সীমারেখা।
প্রকল্পের প্রভাবে জোরালো সোডিয়াম জ্বলে।- (প্রতিষ্ঠান)

মাসুদ খান পেশায় একজন প্রকৌশলী। যন্ত্রজীবী কবি যন্ত্র, ধাতু, বস্তু, জড়, কৃত্রিম, অপ্রাণজ বিজ্ঞানের দিকে তাকালে দ্বিধাহীন হয়ে যান। যন্ত্রের ভিতরের যন্ত্রটিকে তিনি নিমেষে বুঝে ফেলেন। তবে তিনি যন্ত্রবাদী নন। তাই তাঁর রচনায় বিজ্ঞান উপস্থিত হয় নিজস্ব সত্যবোধ ও ন্যায়নিষ্ঠতা নিয়ে। ফলে তাঁর কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে, লাভ করেছে আধুনিক যুগের নৈকট্য। তিনি বাংলা কবিতার গতিপথে একটি নতুন পথ যেমন তৈরি করতে পেরেছেন তেমনি কবিচরিত্র বা কবিত্বের সংজ্ঞা সম্পর্কেও তৈরি করেছেন নতুন দর্শন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন আধুনিক যুগের কবিদের ভাববাদী হওয়াটা ততোটা জরুরি নয় যতোটা জরুরি প্রয়োজন বিজ্ঞানসচেতন হওয়ার। বিজ্ঞানের যুগে বাস করে যে কবি ভাববাদী হয়ে ওঠে সে তো পুরনোবাদী, তাকিয়ে থাকে অতীত গহ্বরের দিকে। তিনি জানেন এমন কোনো শর্ত নেই যে কবিদের বিজ্ঞানসচেতন হওয়া যাবেনা। তাহলে একালে বাস করে কেনো বিজ্ঞানবিমুখ থাকা; কেনোই বা বিজ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচীন চেতনার দাসত্বে নিজেকে বন্দি করা। সমকাল সম্পর্কে যে মানুষ অসচেতন সে নিজেই তো যান্ত্রিক, মৃত। এই সচেতনতার জন্যই তাঁর কবিতায় বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট শব্দ বারবার এসেছে। প্রতিদিনের যাপিত জীবনকে তিনি এড়িয়ে যেতে চাননি। ‘অকটেন’, ‘ম্যাঙ্গানিজ’, ‘প্রাণীবিজ্ঞান’, ‘স্বর্ণ’, ‘প্লাস্টিক’, ‘ফ্লাডলাইট’, ‘পারদস্তম্ভ’, ‘অম্লজান’, ‘সোডিয়াম’, ‘সিলিকন’, ‘রেডিও তরঙ্গ’, ‘ইঞ্জিন’, ‘গিয়ার’, ‘স্পিডোমিটার’, ‘ভূগোল’, ‘ইলাস্টিক’, ‘সুপারনোভা’, ‘গ্রাফাইট’, ‘ব্লাকহোল’, ‘ইলেকট্রন’ প্রভৃতি শব্দগুলি জীবনের প্রাত্যাহিক পরিচিতি নিয়েই তাঁর কবিতায় এসেছে। তিনি জানেন বিজ্ঞানচেতনা মানে যন্ত্র ব্যবহারে পারদর্শীতা নয়, যন্ত্রের মৌলদর্শনকে ধারণ করা। তাঁর বিজ্ঞানসচেতনতা কোনো লোকদেখানো বিষয় নয়। তাই আধ্যাত্মিক নয় বরং বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্বকে তিনি ধারণ করেন মনেপ্রাণে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন সমাজকে। এজন্যই তিনি অকপটে বলে যান প্রাণীর সৃষ্টিতত্ত্ব ও মানুষের সামাজিক ইতিহাস-

ডাঙায় প্রথমে খ'সে গেলো বাঁকা লেজের অহং
ধীরে ধীরে গুল্মীভূত হলো দেহ।- (ত্রিজ)

সমাজ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় শিকারী জীবন কাটিয়ে মানুষ একে একে চলে আসে বর্তমানের পারমাণবিক জীবনে।

কামারশালার গনগনে কান্তলোহা, আগুনের ফুল আর ফুলকার অক্সিজেনে সখ্য হলো।-  (ত্রিজ)

এই ইতিহাস আমাদের অচেনা নয়। কিন্তু একালে বসে মাসুদ খান বেদনার সাথে দেখেন-

কংকালের লোভে ব'সে ব'সে ঝিমোচ্ছে
পৃথিবীর নিঃস্ব প্রাণীবিজ্ঞান।- (ত্রিজ)

এবং

পাঠাগার থেকে চোখ মুছে ফেরে ব্যাধ।- (ত্রিজ)

মহাকালের সামনে দাঁড়িয়ে কবি দেখেন¬

ধর্ম ও বীর্যবাসনা প্রবল হ'লে জাগে টান.......
ক্ষুধায় ধর্মলালায় যৌনে ও প্রেমে
হরিণ ও চিতার রূপচিত্রগতি অবিরল
চকচকে যুগ্ম ট্রাজেক্টরি।- (একটি চিত্রিত হরিণের পেছনে একটি চিত্রিত বাঘ ছুটছে)

আপাতদৃষ্টিতে মানুষ যূথপ্রেমী হলেও প্রধানত সে নিঃসঙ্গ। সমাজের একক মানুষের জীবন জীবনব্যাপী সঙ্গীহীন সাথীহীন। শত কোলাহলের মাঝেও মানুষের একাকিত্ব কাটেনা। পরিজন বেষ্টিত জীবনেও মানুষ নিরন্তর একা হয়ে থাকে। আত্মবাদী বর্তমানকালে মানুষ নিরন্তর নিজেকে আবিষ্কার করতে চায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যের চূড়ায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতিও মানুষের অন্তর্মুখীতা দূর করতে পারেনা। সাফল্যছোঁয়া মানুষ তাই বুঝে ফেলে এই বিজন জীবন তার নিজেরই মাত্র। এই মিত্রহীন মানুষ অনবরত খুঁজে বেড়ায় একাকিত্ববিরোধী বিভিন্ন বস্তুমালা। একাকিত্বের নিঃসীম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মানুষ খুঁজে নেয় যূথধারণার মৌলিক দর্শনটিকে।

ঐ বাঁধে নির্জন সভাপতি থাকে।
সন্ধ্যাভাষা জানে।- (ঐ বাঁধে নির্জন সভাপতি থাকে)

মাসুদ খানের কবিকীর্তির অনবদ্য উপহার উপমা বৈচিত্র। তাঁর কবিতার উপমা ও রূপকগুলো বাংলা শব্দভাণ্ডারে একাধিক নতুন শব্দবন্ধ সংযুক্ত করেছে। ‘কীটপুত্র’, ‘ঐশী পর্যটন’, ‘অণ্ডআত্মা’, ‘আলকাতরার জলাশয়’, ‘ক্রোমোজমের উল্লাস’, ‘রাত্রিগ্রস্ত’, ‘শাদা হিংসা’, ‘ছাইরঙা সন্ন্যাস’, ‘অগ্নিপাহাড়’, ‘অন্তরঙ্গ রোম’, ‘ঘন চৈত্রদুপুর’ প্রভৃতি উপমা/ রূপক বাংলা সাহিত্যে একেবারে মৌলিক । ‘চেরাগজন্ম’ কবিতায় সমসময়ের চাপে বাংলার এক চারণের জন্ম বৃথা যায়। এর ফলে যে মহাবিপর্যয় ঘটে তার রূপক অভিনব ও অভূতপূর্ব।

চারণ, তোমার চেরাগজন্ম বৃথা যায়
মন্দ গাহিছে লোকে দিকে দিকে পুনর্বার
...............................................
চিমনি চিড় খায় আজ উন্মার্গ জলের ছিটায়
চিমনি চিড়ে যায় আজ চক্রবাল থেকে
তেড়ে আসা অভিশাপে, ভর্ৎসনায়।- (চেরাগজন্ম)

মাসুদ খানের রচনায় ‘চারণ’, ‘শ্রমণ’, ‘নিষাদ’, ‘ব্যাধ’, ‘শুদ্র’, ‘হরপ্পা’, ‘ধীবর’, ‘টোটেম’ প্রভৃতি প্রত্নইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো বারবার এসেছে। এই শব্দগুলো শত অতীত মনে হলেও তা পুরান, রূপকথা, অলৌকিক, মীথ বা পরকালবাসী কোনো শব্দ নয়। এই শব্দগুলো প্রাক্তন মনে হলেও পরদেশী নয়। সেমেটিয় নীতিবোধের অবাধ প্রচলন আমাদের প্রান্তিক সমাজে যে স্থায়ী রাত্রিকালের সৃষ্টি করেছে তার প্রতি তিনি আশরীর ক্রোধ ও আমাদের নিজস্ব অর্থাৎ নিষাদ, শবর, অষ্ট্রোলয়েডদের জীবনের প্রতি প্রবল কাক্সক্ষা বোধ করেন। তাই তাঁর মননে প্রতœইতিহাস কোনো সেমিনার কেন্দ্রিক শব্দচিত্র সাজায় না। তিনি নিজের রক্তের দিকে, কোষের দিকে, ক্রোমোজম-ডিএনএ’র দিকে তাকিয়ে নিজেকেই খোঁজেন। প্রতিষ্ঠিত স্ববিরোধীতা ও ভণ্ডামোর রাজত্বে বাস করতে করতে ক্লান্ত তিনি অতঃপর সচকিত হয়ে ওঠেন। দেখেন প্রত্নমানুষেরা আজ আর পরাজিত নয়। কারণ আজ এসেছে ‘উর্ধ্বগমনের দিন’-

পুরাতন বস্তু থেকে উত্থিত সেই কবেকার
ব্রাত্য সংকেতেরা এতোদিন পর আজ কেন ধেয়ে আসছে
তীব্র জ্বরকম্পন নিয়ে রেডিও তরঙ্গে তরঙ্গে।- (উর্ধ্বগমনের দিন)

কিন্তু দারিদ্র্যক্লিষ্ট সমাজে বাহিত নিজের ‘উপবাসে উপবাসে অনঙ্গ হয়ে যাওয়া, স্বচ্ছ হয়ে যাওয়া শরীর’ নিয়ে তিনি বিব্রত বোধ করেন। উর্ধ্বগমনের দিনে তো আর বসে থাকা যায় না।

আজ উর্ধ্বগমনের ।
এই কায়া, এই নিঃসীম বিভ্রান্তি,
ছায়াসহ, কোথায় লুকিয়ে রেখে
তবে যাই উর্ধ্বগমনে ?- (উর্ধ্বগমনের দিন)

প্রত্নপ্রেমিক কবি জানেন-

হরপ্পার কোষে খুব হাতুড়ি-গর্জন, হ্রেষা, সিংহের বৃংহণ
শাবল মোহর শিশু সিন্ধু সুরকি পাখি লেদ লায়ারের মিশ্রিত কূজন
আরো বহু শব্দ ছিলো।- (লাল)

কিন্তু ইতিহাস বলে এরপর এদেশে-

হৈমবালা ছোটভাইকোলে মির্জাপুর চ'লে যায়
মোরগশীর্ষের লগ্নে
গোধূমের দিনশেষে...দাঙ্গা... - (লাল)

এমন বিপর্যস্ত সমাজে বাস করেও কবি মোটেও আশাহীন নন। কারণ-

শ্রীকৃষ্ণকে মাঝে মাঝে তাই লীলাকৃত্য ফেলে
উষাকাল থেকে
বিবিধ আমিষ ও অ্যামিনো অম্লের সামনে দাঁড়াতে হয়
নিষ্পলক, নিয়তিবাধিত।
দেখে যেতে হয় - 
আমিষে এসিডে ঠিক কখন উন্মেষ, প্রথম স্পন্দনের।- (স্রোত)

এই সমসময়ের বাস্তবতা হচ্ছে-

ইতিহাস-কারাভাঁচ্যুত পশু ও মানুষ
আবার নতুন কার কাটা মুষ্ককোষ ঘিরে আবর্তিত
....................................................
কালে কালে হাড়ের কাঠামো অতিক্রম ক'রে
ছলকে ছলকে ওঠে মাংশ
পচনপ্রবণ, শুধু মাংশের ছোবল।- (স্বকাল)

তিনি যে কালে বাস করছেন সেই নির্মম বর্তমানের আর্থসামাজিক চিত্র তাঁর কাছে-

পঙ্গু ভিখারির বিষন্ন আত্মমৈথুনের মতো
কাঁটাতারে হঠাৎ আটকে যাওয়া ভুবনচিলের
লালদীর্ঘ চিৎকারের মতো। (স্বকাল)

এই অপার্থিব অমানবিকতার ধারাবাহিকতা ক্রমান্বয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করছে। মানুষ এখন আর মানুষের নেই। শত হিংসাজর্জর আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তবুও কবি নিরাশ নন। তিনি জানেন যুগে যুগে ভূমিজ মানুষেরা অপশক্তির হাতে নির্যাতিত হয়েছে, প্রতারিত হয়েছে। বিভিন্ন রঙের-ঢঙের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা ভূমিপুত্রদের ধ্বংস করতে চেয়েছে। তাই বলে তারা কখনও পরাজিত হয়নি। কালের ইতিহাস আমাদের এই সত্যই শেখায় যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি সবসময়ই জয়ী হয়। তাই তিনি প্রত্যাশা করেন-

সব উদ্বৃত্ত নিদ্রা আর আচ্ছন্নতা
পরিত্যাগ ক'রে কন্যা একসময় গাত্রোত্থান করবে,
সকন্যা আমাদের উজ্জ্বল গৃহযাত্রা হবে-
সেই দুর্মর অভিলাষ ঘিরে এই সাধ্যসাধনা নিরন্তর।- (কন্যাসংহিতা)

তাঁর এই আশাবাদ কোন অলৌকিক স্বপ্ন নয়। কষ্টকল্পিত চেতনার বহিঃপ্রকাশও নয়। তাঁর একান্ত প্রার্থনা-

এইবার এই অবেলায়, হে জ্ঞাতি, হে রহস্যের উপজাতি,
অন্তহীন শিবলিঙ্গের প্রহরী,
গলমান গ্রাফাইট স্তরের ওপর গড়াগড়ি দাও
পুনর্বার পাপ ক'রে ফিরে এসো
পুনর্বার মুদ্রণযন্ত্র ভেঙে ভূমিসাৎ ক'রে দাও হে অর্জুন
স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যাধ, স্মরণকালের হে অবিস্মরণীয় ব্যাধি।- (সার্কারামা)

মাসুদ খান মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নটিকে অনিশ্চিত ভাবেননা। তিনি জানেন এই হিংসাকাতর যাপিত জীবন মূলত বৃত্ত মাত্র। এক মহাকালিক বৃত্তের ফাঁদে বন্দি আমরা-

বৃত্ত ঘোরে মহাবৃত্ত
বিনাশ, মহামারী নৃত্য
মনুকুলের শেষকৃত্য
প্রাণী এবং পতঙ্গের সাথে।- (সার্কারামা)

বস্তুবাদী কবির উপলব্ধি বড়ই অমোঘ ও নির্মোহ। তাই প্রাত্যাহিক জীবনের শত দুঃখ-ক্ষোভ-যন্ত্রণা থেকে আড়াল পেতে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত জপ করার জন্য প্রদান করেন একটি সত্যমন্ত্র-

শ্রবণ বধির ক’রে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া।- (সার্কারামা)

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ