একটি কল্যাণকর দুর্ঘটনা- সেলিনা শাহজাহান ও শাহজাহান তপন এর বর্ণনায় বিজ্ঞানের মজার ঘটনা ও গল্প

একটি কল্যাণকর দুর্ঘটনা- সেলিনা শাহজাহান ও শাহজাহান তপন এর বর্ণনায় বিজ্ঞানের মজার ঘটনা ও গল্প

একটি কল্যাণকর দুর্ঘটনা

সেলিনা শাহজাহান
শাহজাহান তপন
মুক্তধারা, ঢাকা।
প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জ্বাঃ শওকাতুজ্জামান
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৬
পৃৃষ্ঠাঃ ১০৪
মূল্যঃ বোর্ড বাঁধাইঃ সাদাকাগজঃ ২২.০০ টাকা
সুলভ সংস্করণঃ নিউজপ্রিন্টঃ ১৩.০০ টাকা

শিশু-কিশোরদের মনে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জাগানোর জন্য দারুণ উপযোগী “একটি কল্যাণকর দুর্ঘটনা” বইটি। বিজ্ঞানের বিভিন্ন রকমের বিস্ময়কর আবিষ্কার ও ঘটনার প্রতি শিশু-কিশোররা যেন কৌতুহলী হয়ে ওঠে তার সবকটি উপাদান এই বইতে রয়েছে। লেখকদ্বয় শিশু-কিশোরের মনের রঙিন জগতকে চেনেন; এই কল্পনার জগতকে আরেকটু রাঙিয়ে দেয়ার জন্য হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা মিশিয়ে বইটির পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুলেছেন।

নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হলে বিজ্ঞানীদের কঠোর অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বারবার চেষ্টা করে ভুলগুলো শুধরে নিতে হয়; আবার চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু কখনও কখনও বিজ্ঞানের জগতে কোন কোন আবিষ্কার হঠাৎ করে হয়ে যায়। হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা বিজ্ঞানের জগতে নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে। সেরকম একটি ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছে এই বই। আর সেই কাহিনীর শিরোনামটি ব্যবহৃত হয়েছে বইয়ের নামকরণে। বইয়ের পাতাগুলো ওল্টাবার আগে একবার সূচীপত্রটি দেখে নেই।

সূচীপত্র:
  • একটি কল্যাণকর দুর্ঘটনা
  • বড়, কত বড়
  • চলো যাই মহাশূন্যে
  • সৌরশক্তি
  • আঙ্গুল দিয়ে গোনা
  • আকাশ তড়িৎ
  • ঝড় বাদলের কথা
  • কত বুড়ো আমাদের এই পৃথিবী
  • আয়ুস্কার নির্ণয়ে তেজস্ক্রিয় কার্বন
  • সাগরতলার বিচিত্র জীবন
  • সাগরতলার আজব প্রাণী
  • যাদুর রশ্মিঃ এক্স রে

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান প্রদেশের অন্তর্গত ছোট্ট একটা দ্বীপ ম্যাকিনঅ (Mackinac)। মাত্র ৩.৮ বর্গমাইলের এই দ্বীপে ১৮২২ সালের ৬ জুন এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাক্রমে এক পশম ব্যবসায়ীর হাতের বন্দুক থেকে গুলি ছুটে যায়। গুলিটি গিয়ে লাগে আলেক্স সেন্ট মার্টিন নামের ১৯ বৎসর বয়সী এক শিকারীর পেটে। সঙ্গে সঙ্গে পেটের চামড়া ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বেড়িয়ে পড়ে ফুসফুস সহ পেটের নাড়িভুড়ি। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ডাক্তার বিমন্ট ভেবেছিলেন আলেক্স মার্টিন খুব বেশি হলে ৩৬ ঘন্টা বাঁচবে। কিন্তু তার প্রাণশক্তি ছিল অন্যদের চাইতে আলাদা। ডাক্তার বিমন্টের শুশ্রুষায় তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। পেটের ঘা শুকিয়ে যায়। বেঁচে থাকেন ৮৩ বৎসর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু পেটের ক্ষত আর পূরণ হয়নি। একটি ছোট্ট ফুটো আজীবন থেকে যায়। ডাক্তার বিমন্ট অনেক চেষ্টা করেও পাকস্থলীতে হওয়া গর্তটি ঢাকতে পারেন নি। অ্যালেক্সের পাকস্থলীর এই ক্ষতটি ডাক্তার বিমন্টকে এক নতুন গবেষণার দিশা দেয়। তিনি অ্যালেক্সকে নিজের কাছে রেখে দেন। পাকস্থলীর ফুটোটি ডাক্তারের সামনে এক নতুন অনাবিষ্কৃত জগত খুলে দেয়। এর আগে পাকস্থলীতে কীভাবে খাদ্য হজম হয়, তা সরাসরি দেখার কোন সুযোগ ছিল না। পরবর্তী কয়েক বৎসর ধরে ডা. বিমন্ট মানুষের শরীরে খাদ্য হজমের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। বিভিন্ন ধরণের খাবার কীভাবে হজম হয়, তার বিবরণ তিনি লিখে রাখেন। খাবার হজমে পাকস্থলীর হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের ভূমিকাই যে প্রধান তা তিনি বুঝতে পারেন। অসুস্থতার সময়ে খাদ্য হজমের কার্যক্রম ধীর হয়ে যায় এটাও তিনি আবিষ্কার করেন নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। এই অদ্ভূতুরে ঘটনা আলোচ্য বইয়ের প্রথম গল্প “একটি কল্যাণকর দুর্ঘটনা”র প্রধান উপজীব্য।

“বড়, কত বড়?” শিরোনামে লেখক পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব দেখার যে যন্ত্র সেই মাইক্রোস্কোপ- এর কথা বলেছেন। মাইক্রোস্কোপ কি কি যন্ত্র দিয়ে তৈরি হয়, কীভাবে এই যন্ত্রগুলো আবিষ্কার হল, তার বিবরণ দিয়েছেন।

মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারক লিউয়েন হুক ছিলেন হল্যান্ডের (নেদারল্যান্ড) এক গির্জার দারোয়ান। ভেলফুট গীর্জার দারোয়ান লিউয়েন হুক- এর শখ ছিল কাঁচ ঘষে লেন্স তৈরি করা। সেই হাতে বানানো লেন্স দিয়ে মাছির চোখ, ভেড়ার লোম এসব ক্ষুদ্র জিনিসের ছবি বড় করে দেখতে এবং অন্যদেরকে দেখাতে  ভালবাসতেন। ছোট জিনিসকে বড় করে দেখানোর এই পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ধীরে ধীরে জটিল মাইক্রোস্কোপ, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার হয়। মানুষের চোখ গত হাজার বৎসরে যা দেখতে পায়নি, লিউয়েন হুকের আবিষ্কার সেই অদৃশ্য জিনিসগুলোকে খুব সহজে দৃশ্যমান করে তুলল।

মহাশূন্যে যাওয়ার জন্য প্রথমে প্রয়োজন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আকর্ষণ ছিন্ন করা। মানুষ ঘন্টায় ২৫ হাজার মাইল বা সেকেন্ডে ৭ মাইল বেগে ছোটার যন্ত্র আবিষ্কার করার পরই সম্ভব হয়েছে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ওঠা। যে যন্ত্রের সাহায্যে এই কাজ সম্ভব তার নাম রকেট। রকেটে চড়ে কীভাবে মহাকাশে যাওয়া যায়, মহাশূন্যে ভ্রমণের কী কী অসুবিধা আছে তার বিবরণ গল্পের ঢঙে লেখক বর্ণনা করেছেন “চলো যাই মহাশূন্যে” নামক নিবন্ধটিতে।

“সৌরশক্তি” নামক নিবন্ধে লেখক সূর্য থেকে পাওয়া শক্তি কীভাবে কত প্রকারে মানুষ ব্যবহার করতে পারে তা আলোচনা করেছেন। সূর্য আমাদের অনেক উপকার করে। তার শক্তি থেকে প্রাকৃতিকভাবেই আমরা আলো ও উত্তাপ পেয়ে থাকি। কিন্তু তার রশ্মিকে ব্যবহার করেও যে রান্না করা বা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় তার খবর বহুদিন পর্যন্ত মানুষের অজানা ছিল। লেখক গল্পচ্ছলে সূর্যরশ্মির নানারকম ব্যবহারের কথা বলেছেন। একটি বিবর্ধন কাঁচ দিয়ে কাগজে আগুন ধরানোর সেই বিখ্যাত মজার পরীক্ষাটি ছবিসহ দেখিয়ে দিয়ে শিশু-কিশোরদেরকে হাতে-কলমে বিজ্ঞান গবেষণায় উৎসাহী করতে চেয়েছেন।

“আঙুল দিয়ে গোনা” নামক রচনাটি বেশ অভিনব। আঙুল দিয়ে যোগ করা বা বিয়োগ করা খুব সহজ। কিন্তু গুণ করা? আগুল দিয়ে গুণ করাও যে যায়, তা অনেকেই জানে না। প্রাচীন কালে মানুষ আঙুল দিয়েই তাদের প্রতিদিনের নানারকম হিসাব নিকাশের কাজ সারত। আঙুল ব্যবহার করত ক্যালকুলেটর হিসেবে। আলোচ্য নিবন্ধে লেখক আঙুল দিয়ে গণনা করার, বিশেষ করে দুটো সংখ্যার মধ্যে গুণ করার কয়েকটি পদ্ধতি উদাহরণসহ আলোচনা করেছেন। যদিও পদ্ধতিগুলো বেশ আদিম এবং একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়, তবে বেশ কৌতুহলদ্দীপক।

পিতা ছিলেন খুব গরীব। তাই ছেলেবেলায় তাকে ফেরিওয়ালার কাজ করতে হয়েছিল। কিন্তু প্রবল কৌতুহল আর সাহস পরবর্তী জীবনে তাকে এনে দেয় বড় রাজনীতিবিদ ও বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সম্মান। আকাশের বিদ্যুৎ চমকানো তাকে বেশ কৌতুহলী করে তুলতো। তিনি এই আলোর ঝলকানি ও তার পরে হওয়া বিকট শব্দের কারণ অনুসন্ধান করতে লাগলেন। একটি ঘুড়ি ও তার সাথে লাগানো একটি সাধারণ তুলার সুতা ও আর একটি সিল্কের সূতা ব্যবহার করে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন আকাশের মেঘ থেকে হওয়া বজ্রপাতের রহস্য। এই অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীর নাম বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। তার বজ্রবিদ্যুতের রহস্য আবিষ্কারের কাহিনীটি গল্পের আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে “আকাশ-তড়িৎ” নামক নিবন্ধটিতে।

সুমন ও তার বড়দা গল্প করছিল। সেদিন ছিল ঝড়-বাদলের দিন। একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। চারপাশে কেমন একটা গুমোট ভাব। এমন একটি দিনে পাঁপড়ভাজা খেতে খেতে সুমন ও তার বড়দা আবহাওয়া নিয়ে গল্প করছিল। বৃষ্টি কেন হয়, ঝড় তৈরি হয় কেমন করে? আবহাওয়ার মেজাজ বোঝার যন্ত্রপাতি কি কি?-- এরকম নানা প্রশ্নের উত্তর সুমনকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল বড়দা। বাতাসের চাপ কেমন করে মাপে, উচ্চচাপ, নিম্নচাপ কীভাবে বোঝা যায়, আবহাওয়া অফিসের যন্ত্রগুলো কীভাবে কাজ করে, বাতাসের বেগ ও গতিমুখ মাপার যন্ত্রের গঠন ও বৈশিষ্ট্য, পুরনো দিনের যন্ত্রের সাথে আধুনিক দিনের যন্ত্রের পার্থক্য-- এরকম অনেক ধরনের প্রসঙ্গ দুজনের গল্প বলার ভঙ্গিতে “ঝড়-বাদলের কথা” গল্পটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। তরুণ পাঠক গল্পের মজা পেতে পেতে আবহাওয়া বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্যগুলো জেনে ফেলবে। বাতাসের চাপ বোঝার একটি প্রাথমিক পরীক্ষা যা খেলার মত করে উপস্থাপন করা যায়, তার বর্ণনা পাঠককে হাতে-কলমে শেখার অনুপ্রেরণা দেবে।

“একটি কল্যাণকর দুর্ঘটনা” বইয়ের বাকী রচনাগুলো বিজ্ঞানের আকর্ষণীয় কয়েকটি দিক নিয়ে রচিত। অল্পবয়সী পাঠকের মনের জগতে বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়গুলো যেন কঠিন বা দুর্বোধ্য না হয় সেরকম শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে বইয়ের পাঠ শেষে বিজ্ঞানের নানা অজানা তথ্য পাঠকের মনের দেয়ালে চিরস্থায়ী দাগ থেকে যাবে। নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানের রহস্যময় মজার জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা লেখক সেলিনা শাহজাহান ও শাহজাহান তপনকে পাঠকের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসনে রেখে দেবে সেকথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নতুন প্রজন্মের জন্য বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য এরকম বই আরও প্রকাশিত হোক- এই প্রত্যাশা করি।