সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণপিপাসু ও কৌতুকপ্রবণ মনের খবর আমরা জানি। তিনি সশরীরে উপস্থিত থেকে যা জেনেছেন, বুঝেছেন তাই প্রকাশ করেন নিজের ভাষায়। তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বেশ সমৃদ্ধ। বিশ্বের অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। দেখেছেন বিভিন্ন ধরনের জনপদ ও তার মানুষ। পথে চলতে গিয়ে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন সহজে। সহৃদয় ও সরস মানসিকতা থাকার জন্য আশেপাশের মানুষের সাথে আন্তরিকভাবে মিশতেন। ফলে সৈয়দ মুজতবা আলী যা বর্ণনা করেন, তাতে একজন বিদগ্ধ পর্যবেক্ষকের বিবরণ থাকে।
তাঁর "জলে ডাঙায়" বইয়ের ভ্রমণ শুরু হয়েছে মাদ্রাজ বন্দর (বর্তমানে চেন্নাই বন্দর) থেকে। এবার রওনা হয়েছেন জাহাজে করে। জাহাজ ছাড়ার সময়কালে পরিপার্শ্বের চিত্র বইয়ের সূচনা প্রসঙ্গ। বিভিন্ন উদাহরণ, উপমা, বক্রোক্তি দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন যে বিশ্বের সব দেশের জাহাজ বন্দরের খালাসীদের ভাষা একইরকম। এই সিদ্ধান্তটুকু নেবার আগে কতজনের কতরকমের যে দোহাই পারলেন তার ইয়ত্তা নেই। সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটকে স্মরণ করেছেন। তবেই তো প্রমাণিত হল জাহাজ খালাসীরা পৃথিবীর সব দেশে একই ভঙ্গিতে কথা বলে। বিশেষ করে জাহাজ ছাড়ার সময়টুকুতে। এই বিশেষ সময়কালে পৃথিবীর সব বন্দরের চিত্র প্রায় একইরকম।
"জলে ডাঙায়" বইয়ে তেইশটি অধ্যায় ও একটি পরিশিষ্ট রয়েছে। এই বইয়ের অর্ধেকের বেশি অংশে রয়েছে জাহাজ ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতা। কোন অধ্যায়ের নামকরণ করা হয় নি। ফলে কোন সুচিপত্রের প্রয়োজন পরে নি।
এই বইতে আলোচ্য ভ্রমণের যাত্রাপথটি এরকম। লেখক মাদ্রাজ বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে কলম্বো বন্দর হয়ে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে জিবুতি বন্দরে পৌছান। এরপর সুয়েজ বন্দর হয়ে সুয়েজ খাল পার হয়ে সঈদ বন্দরে যাওয়ার কথা। জাহাজ সুয়েজ বন্দরে পৌঁছার পর লেখক সঙ্গীসাথীসহ নেমে পরেন। জাহাজ সুয়েজ খাল পার হতে থাকবে। সময় লাগবে ২০-২২ ঘন্টা। এই সময়টাতে মিশরের কায়রো শহর ও পিরামিড দেখে নিতে পারবেন। বইয়ের শেষে লেখক বন্ধুদেরকে সঈদ বন্দরে পাঠিয়ে দেন। একই জাহাজে ইউরোপ ভ্রমণের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে চলে যান জেরুজালেম ভ্রমণে। সে অবশ্য অন্য কাহিনী।
সুয়েজ বন্দরে জাহাজ ছেড়ে লেখক তাঁর বন্ধুদের সাথে ভাড়া করা ট্যাক্সিযোগে কায়রো রওনা হন। ট্রেনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অল্পের জন্য ট্রেন মিস করেন। ট্যাক্সিতে করে কয়েকঘন্টা পরে পোঁছান কায়রো শহরে। রাত তখন এগারোটা। রাতের কায়রো শহরের চিত্র লেখকের রচনায় বেশ বর্ণিল।
ছ-তলা বাড়ির উপরে – অবশ্য বাড়িটা দেখা যাচ্ছে না – দেখি, লাল আলোতে জ্বালানো শেলাইয়ের কলের ছুঁচ ঘন ঘন উঠছে, নামছে, আর সবুজ আলোর চাকা ঘুরেই যাচ্ছে ঘুরেই যাচ্ছে। নিজে এক বিলিতি কোম্পানীর নাম। আমার মনে হল হায়! কলটার নাম যদি 'ঊষা' হত। সেদিন আসবে যেদিন ভারতীয়-- যাক্ গে।সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাশৈলী অসাধারণ। একথা শাব্দিক অর্থেই। কারণ তাঁর মতো বর্ণনাভঙ্গি আর কোন ভ্রমণকাহিনীতে পাওয়া যায় না। নিজস্ব রচনাভঙ্গিতে তিনি অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। পরিপার্শ্বের দৃশ্যমান জগত থেকে যা তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন, সেসব প্রসঙ্গও অন্যদের রচনায় দুর্লভ। কয়েকটি বিশেষ মুহূর্ত উল্লেখ করি।
আরো কত রকমের প্রজ্বলিত বিজ্ঞাপন। এ বিষয় কলকাতা কাইরোর পিছনে।
করে করে শহরতলীতে ঢুকলুম। কলকাতার শহরতলী রাত এগারোটায় অঘোরে ঘুমোয়। কাইরোর সব চোখ খোলা-- অর্থাৎ খোলা জানালা দিয়ে সারি সারি আলো দেখা যাচ্ছে। আর রাস্তার কথা বাদ দাও। এই শহরতলীতেই কত না রেস্তোরা কত না 'কাফে' খোলা; খদ্দেরে খদ্দেরে গিসগিস করছে।…… আবার বলছি রাত তখন এগারোটা। আমি বিস্তর বড় বড় শহর দেখেছি কিন্তু কাইরোর মতো নিশাচর শহর কোথাও চোখে পড়ে নি।
কাইরোর রান্নার খুশবাইয়ে রাস্তা ম-ম করছে। মাঝে মাঝে নাকে এসে এমন ধাক্কা লাগায় যে মনে হয় নেমে পড়ে এখানেই চারটি খেয়ে যাই। অবশ্য রেস্তোরাঁগুলো আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানেরই মতো নোংরা। তাতে কি যায় আসে? কে যেন বলছে, ‘নোংরা' রেস্তোরাঁতেই রান্না হয় ভালো; কালো গাই কি সাদা দুধ দেয় না? পৃষ্ঠা- ৭০
কলম্বো বন্দর থেকে জাহাজে ওঠা "আবুল্ আস্ফিয়া, নূর উদ্দীন, মুহম্মদ আব্দুল করীম সিদ্দীকী" নামের একজন যাত্রীর বর্ণনা এরকম-
ভদ্রলোকে কোট-পাতলুন-টাই পড়েছেন ঠিকই কিন্তু সে পাতলুন ঢিলে পাজামার চেয়েও বোধ করি চৌড়া, কোট নেবে এসেছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত আর মান-মুনিয়া দাড়ির তলায় টাইটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে মাত্র। ওঁর বেশভূষায় – 'ভূষা' জাতীয় কোন বালাই ওঁর বেশে ছিল না--- অনেক কিছুই দেখবার মত ছিল কিন্তু প্রথম দর্শনেই আমি সব-কটা লক্ষ্য করি নি, পরে ক্রমে ক্রমে লক্ষ্য করে অনেক কিছুই শিখেছিলুম। উপস্থিত লক্ষ্য করলুম, তাঁর কোটে ব্রেস্ট্ পকেট বাদ দিয়েও আরো দু সারি ফালতো পকেট। তাই বোধ হয়, কোটটা দৈর্ঘ্যে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। পৃষ্ঠা- ২৩জিবুটি বন্দরে নেমে রেস্টুরেন্টে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হল তা এরকম-
… কাফেতে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়ে এ দেশের মাছি। 'চোখে পড়ে' বাক্যটি শব্দার্থেই বললুম, কারণ কাফেতে ঢোকার পূর্বেই এক ঝাক মাছি আমার চোখে থাবড়া মেরে গেল।কায়রোতে পৌঁছে তিনি যে সব খাবার খেয়েছেন তার বর্ণনা একইসঙ্গে কৌতুহলোদ্দীপক এবং বেশ মজার।
কাফের টেবিলের উপর মাছি বসেছে আলপনা কেটে, ‘বারের' কাউন্টারে বসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে, খদ্দেরের পিঠে, হ্যাটে, --- হেন স্থান নেই যেখানে মাছি বসতে বয় পেয়েছে। পৃষ্ঠা- ৩৮
পাশের টেবিলে দেখি, একটা লোক তার প্লেটে দুটি শসা নিয়ে খেতে বসেছে। দুটি শসা--- তা সে যত তিন ডবল সাইজই হোক না-- কি করে মানুষের সম্পূর্ণ ডিনার হতে পারে, বহু চিন্তা করেও তার সমাধান করতে পারলুম না।… এমন সময় দেখি, সেই লোকটা শসা চিবুতে আরম্ভ না করে তার মাঝখানে দিলে দুহাতে চাপ। অমনি হড়হড় করে বেরিয়ে এল পোলাও জাতীয় কি যেন বস্তু, এবং তাতেও আবার কি যেন মেশানো। আমি অবাক। হোটেলওলাকে গিয়ে বললুম, ‘যা আছে কুলকপালে, আমি ঐ শসাই খাব। পৃষ্ঠা- ৭৪পিরামিড দেখতে গিয়ে লেখকের প্রথম অনুভূতি এরকম-
পিরামিড! পিরামিড!! পিরামিড!!!শুধু এই বই নয় সৈয়দ মুজতবা আলী'র যে কোন রচনা পড়তে গিয়ে যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হল রবীন্দ্রনাথকে বারবার বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্মরণ করা। যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভালবাসেন তারা জানেন যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পর্বে খুঁজে পাই; তাঁর সদয় ভালবাসার সান্নিধ্য পাই। সৈয়দ মুজতবা আলীর সৌভাগ্য যে তিনি সরাসরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র ছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ ও সমসাময়িক বহু লেখকের নৈকট্য লাভের সুযোগ হয়েছিল তাঁর। এর প্রভাব রচনার ছত্রে ছত্রে বিদ্যমান। ভ্রমণ বর্ণনার বিভিন্ন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন তিনি। তাঁর বিভিন্ন বাণী বা রচনাকে সঠিক জায়গায় যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছেন।
কোনো প্রকাশের আশ্চর্য প্রকাশ করতে হলে আমরা তিনটে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন -!!!- দিই। তাই কি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তিনটে পিরামিড? কিংবা উল্টোটা? তিনটে পিরামিড ছিল বলে আমরা তিনবার আশ্চর্য হই? পৃষ্ঠা- ৮৩
তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালী। তাইতো গৃহকোণ তাঁর প্রিয়। এত দেশ ঘুরে বেড়াতে হলেও তাঁর মন পরে থাকত আপন গাঁয়ে। তিনি অকপটে স্বীকার করেন:-
আমি কিন্তু যেখানে থাকি সেখানেই থাকতে ভালোবাসি। নিতান্ত বিপদে না পড়লে আমি আপন গাঁ থেকে বেরতে রাজী হইনে। দেশভ্রমণ আমার দু চোখের দুশমন। তাই যখন রবিঠাকুর আপন ভূমির গান গেয়ে উঠেন তখন আমি উদ্বাহু হয়ে নৃত্য আরম্ভ করি। পৃষ্ঠা- ৫৩শুধু তাই নয় আড্ডায় গল্প বলার ভঙ্গি এবং ঝোলভাত খাওয়ার লোভ তাঁকে বাঙালীর হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছে। মিশরের রেস্টুরেন্টে বসে তাঁর অনুভূতি-
আমার প্রাণ তখন কাঁদছিল চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য--- অত শত বলি কেন, শুধু ঝোলভাতের জন্য--- পৃষ্ঠা-৭৪এই হল সৈয়দ মুজতবা আলী। আধুনিক মনন, রসিকতাপ্রিয় মন এবং সাহিত্যিক বোধ এই তিনে মিলে তাঁকে দিয়েছে বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদিত ভ্রমণ লেখকের মর্যাদা। তাঁর "জলে-ডাঙায়" বই শুধু নয় যে কোন ভ্রমণ কাহিনী পড়তে গিয়ে পাঠক যাত্রাপথের ভৌগলিক বিবরণের পাশাপাশি সহযাত্রীদের অন্তরের চিত্র, সমকালীন ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনা ইত্যাদি জানার সাথে সাথে সাহিত্যপাঠের আনন্দ লাভ করেন।
তাঁর রচনার সরসতা বোঝার জন্যেও দরকার একটি বুদ্ধিদীপ্ত সরস মন। কৌতুকপ্রিয়তা কত অনায়াসলব্ধ হলে তিনি নিজের মৃত্যু নিয়েও রসিকতা করতে পারেন, তা বুঝতে উৎসর্গপত্রটি একবার পড়া দরকার। পুত্রকে উৎসর্গ করে তিনি লিখেছেন-
বাবা ফিরোজ,জলে ডাঙায় বইয়ের ছাপার মান ভাল। বোর্ডবাইন্ডিং বই হওয়ায় বেশ শক্তপোক্ত। সহজ ছিঁড়ে যাবে না। সাধারণ সাদা কাগজে ছাপানো হওয়ায় দাম হাতের নাগালে। ভ্রমণকাহিনী পড়তে পছন্দ করেন, বইয়ের পাতার ডানায় চড়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসেন এমন পাঠকের সৈয়দ মুজতবা আলীকে ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাংলা ভ্রমণসাহিত্যকে চিনতে হলে নতুন প্রজন্মের পাঠকের নিকট এখনও তাঁর বইপাঠ শুধু প্রয়োজনীয় নয় আবশ্যকও বটে।
ভ্রমণ-কাহিনী তুমি যেদিন প্রথম পড়তে শুরু করবে সেদিন খুব সম্ভব আমি গ্রহ-সূর্যে তারায়-তারায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। সে বড় মজার ভ্রমণ--- তাতে টিকিট লাগে না, ‘ভিজার'ও দরকার নেই। কিন্তু, হায়, সেখান থেকে ভ্রমণ-কাহিনী পাঠাবার কোনো ব্যবস্থা এখনো হয়নি। ফেরবারও উপায় নেই।
তাই এই বেলাই এটা লিখে রাখছি।
০০-০-০-০-০০
জলে ডাঙায়
সৈয়দ মুজতবা আলী
প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশকঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা।
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১০৪
মূল্যঃ ১৫০৳
ISBN: 978-984-406-631-1
আরো পড়ুনঃ-
পঞ্চতন্ত্র - সৈয়দ মুজতবা আলী
8 মন্তব্যসমূহ
কালো গাই কি সাদা দুধ দেয় না?
উত্তরমুছুনসৈয়দ মুজতবা আলি আমার প্রিয় লেখক৷
উত্তরমুছুন@ শাফায়াত রনি- সৈয়দ মুজতবা আলী আমারও প্রিয় লেখক। মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
মুছুনআমার প্রাণ তখন কাঁদছিল চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য--- অত শত বলি কেন, শুধু ঝোলভাতের জন্য-- আহা! এই না হলে বাঙালি
উত্তরমুছুনঠিক বলেছেন, ধন্যবাদ।
মুছুনআমার প্রাণ তখন কাঁদছিল চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য--- অত শত বলি কেন, শুধু ঝোলভাতের জন্য-- এই না হলে বাঙালি
উত্তরমুছুনবইটা কিভাবে পেতে পারি? বললে একটু ভালো হত।
উত্তরমুছুনদুঃখিত, আমরা কোনরকম বই বিপণনের সাথে জড়িত নই।
মুছুনমন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা ও সম্পাদকের স্বীকারোক্তি পড়ুন। ই-মেইল ফর্ম।