'সাঈদ বিলাস' এর "শ্রমদাস" পাঠশেষে অবুঝ পাঠক 'লাবণী মণ্ডল' এর মতামত

'সাঈদ বিলাস' এর "শ্রমদাস" পাঠশেষে অবুঝ পাঠক 'লাবণী মণ্ডল' এর মতামত

সাঈদ বিলাস লিখিত ‘শ্রমদাস’ কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল, মিছিলে হাঁটা সে সমস্ত দিনগুলোর কথা। জোটবদ্ধ কাজ। মে দিবস, ৮ই মার্চ, ইস্যুভিত্তিক নানান কর্মসূচির কথা। এখন আমাদের তেমন একসাথে হাঁটা হয় না, মিছিলে শ্লোগান মেলানো হয় না। হয়তো সামনে আবারও হবে। সেই মানুষটির গ্রন্থ নিয়ে কিছু লেখা, ঠুনকো অনুভূতিও বলা যায়! সাধারণত কবিতার বই পড়ে অভ্যস্ত নই, যদিও গত দুই বছর ধরে খুব বেছে বেছে পড়ছি। এবারও গ্রন্থমেলা থেকে কিনেছি এবং পড়া শুরু করেছি। ইতোমধ্যে তিনটা কবিতার বই পড়ে শেষও করেছি। ব্যস্ত জীবন। এর মধ্যদিয়ে ফুরসত পেয়ে পড়াশুনা।

[‘লাশ চাই’, ‘উন্নয়ন ও অধিকার’, ‘সংসার’, নবারুণের প্রতি’, ‘অস্তিত্ব’, ‘অনুভূতির খেলা’, ‘কাঁটাতার’, ‘শ্রমদাস’, ও ‘স্মৃতি’ কবিতাগুলো আমার পাঠক মনে দোল লাগিয়েছে। কতটা ছন্দ আছে, সুর আছে সেটার চেয়ে বড় বিষয়-মানুষের কথা আছে, জীবনসংগ্রাম আছে, শ্রেণীচরিত্রের ছাপ আছে।]

‘শ্রমদাস’ গ্রন্থের নামকরণ নিয়ে গ্রন্থমেলায় এক বন্ধুর সাথে আলাপ করেছিলাম। কেন এমন নামকরণ? বন্ধু বেশ সহজভাবেই উত্তর দিয়েছিলেন, সাঈদের এটাই হয়তো শ্রেণীচেতনা, রাজনৈতিক শিক্ষা, মতাদর্শিক শিক্ষা। ওই বন্ধুটিও কবির পরিচিত, দর্শনের বন্ধুত্ব তাদের দুজনের।

যাইহোক, গ্রন্থ প্রসঙ্গে আসি। গ্রন্থটিতে মোট কবিতা রয়েছে ৩৮টি। প্রতিটি কবিতাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছে। কোনোটাকে বাদ দিয়ে কোনোটা পড়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। কবি তার নিজের কবিসত্তাকেই একেবারে ঢেলে সাজিয়েছেন। যেখানে শব্দচয়ন, বাক্যচয়ন, বুদ্ধগিরী ভাবের চেয়ে চেতনার অভিব্যক্তির প্রকাশটা গুরুত্ব পেয়েছে। কত বড় বড় শব্দ দিয়ে গাঁথুনী তৈরি করতে পারলাম তার চেয়েও বড় কথা কতজন মানুষের ভেতরে একেবারে প্রবেশ করতে পারলাম। কবি তার রাজনীতি জীবনেরই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তথাকথিত প্রেম, ভালোবাসা, প্রকৃতিপ্রেম, ভাববাদ, বস্তুবাদ, নারীবাদ, নাস্তিকতাবাদ কবির কবিতায় নেই। কবি যেহেতু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী, তার কবিতায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে। যাতে এ সমাজের অনেক পাঠকই আকৃষ্ট হবেন না, সুড়সুড়ি পাবেন না। তাতে কবির কিইবা করার আছে! কবি যে এই শিখছেন! কবি এর বাইরেই বা যান কিভাবে!

শ্রমদাস গ্রন্থটি মানুষের কথা, মানুষের ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছে কিনা তা আমার মতো পাঠক বললেই হবে না, কারণ আমি কবির দর্শনের বন্ধু। কবির একেবারেই অপরিচিত জন তা বলুক বা সেই চর্চাটা গড়ে উঠুক। একজন পাঠক হিসেবে এই আশা ব্যক্তই করতে পারি।

কবি খুব স্পষ্টভাবে উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘জনগণ, কেবলমাত্র জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করেন।’ কবির এই একটি লাইন-ই হয়তো পুরো কবিতার বইটি পড়তে একপ্রকার বাধ্য করতে পারে। যদিও সেই বোধোদয়ের বড়ই অভাববোধ করি আমরা।

‘শ্রমদাস’ গ্রন্থটিতে প্রথম কবিতা ‘দখল’ দিয়ে শুরু করে, শেষ করেছেন ‘স্মৃতি’। কবির এই শুরু-শেষের ব্যাখ্যা দেওয়া আমার সাধ্যে কুলোচ্ছে না। তবে কবির নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা আছে, যা আমরা হয়তো জানতেও পারবো।

‘পাওয়া-না পাওয়া’ কবিতাটি পড়তে গিয়ে কবির চিন্তাশক্তির প্রতি অনেকটা ভালোবাসাই বেড়ে গেল। কবি বলেছেন, ‘তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা, তোমাকে পেয়ে যাওয়ার আনন্দের থেকেও গভীর!’ লাইন দুটো আমার পাঠক মনে ছাপ ফেলতে পেরেছে কিছুটা হলেও।

‘লাশ চাই’, ‘উন্নয়ন ও অধিকার’, ‘সংসার’, নবারুণের প্রতি’, ‘অস্তিত্ব’, ‘অনুভূতির খেলা’, ‘কাঁটাতার’, ‘শ্রমদাস’, ও ‘স্মৃতি’ কবিতাগুলো আমার পাঠক মনে দোল লাগিয়েছে। কতটা ছন্দ আছে, সুর আছে সেটার চেয়ে বড় বিষয়-মানুষের কথা আছে, জীবনসংগ্রাম আছে, শ্রেণীচরিত্রের ছাপ আছে।

[‘শ্রমদাস’ গ্রন্থের নামকরণ নিয়ে গ্রন্থমেলায় এক বন্ধুর সাথে আলাপ করেছিলাম। কেন এমন নামকরণ? বন্ধু বেশ সহজভাবেই উত্তর দিয়েছিলেন, সাঈদের এটাই হয়তো শ্রেণীচেতনা, রাজনৈতিক শিক্ষা, মতাদর্শিক শিক্ষা। ওই বন্ধুটিও কবির পরিচিত, দর্শনের বন্ধুত্ব তাদের দুজনের।]

কবি বলেছেন, ‘চুপ থাকা মানেই শেষ হয়ে যাওয়া নয়’... কবির এই একটি লাইনের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেই বলতে চাই। সবকিছুরই শেষ বলে একটা আছে। মানুষের ক্ষোভের, আবেগ, অনুভূতির বিস্ফোরণ ঘটেই। যে বিস্ফোরণে তাপ নেওয়ার মতো শক্তি এই রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থার নেই। তাদের আছে দমানোর, যে দমানোর বিরোধিতা করার ভাষা কবিতাও হতে পারে। আমরা সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পাঠ করলে বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট হতে পারবো। এর চেয়ে বেশি কিছু লেখা, সাহিত্য সমালোচনা করার মতো উপযুক্ত সময় এখনও নয় বলেই মনে করছি। তবে সাঈদ বিলাসদের মতো কবিদের বড় আকাল- এই সমাজে। এখানে তেলবাজ, আড্ডাবাজ, জুলুমবাজ, শোঅফবাজ কবিদের ভীড়। যে ভীড়ে সাঈদ বিলাসদের হারিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়! কিন্তু, আমরা চাই ‘শ্রমদাস’ বেঁচে থাকুক, মানুষের মননজগতে। আরো শ্রমদাস ভূমিষ্ট হোক। যার পিছনে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে বলেই মনে করি।

সাঈদ বিলাস আপনি লিখুন, মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য, প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে লিখুন। ভাব-ভণিতা, বুদ্ধগিরীর বাইরে এসে লিখুন। দেখবেন মানুষ তার প্রয়োজনেই ভালো কিছু বেছে নেয়, খুঁজে নেয়। ভালোরও শ্রেণীচরিত্র রয়েছে। আপনার ভালো শ্রমিকশ্রেণীর। এই চিন্তা ধারণ করেই লিখুন। একেবারেই অবুঝ পাঠকের এই মতামত ভেবে দেখতে পারেন।

ভালো থাকুক শ্রমদাসের সাথে যুক্ত সঙ্গীরা, ভালো থাকুক ‘শ্রমদাসের’ সাঈদ বিলাস।

আরও পড়ুন



মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ