হারেমের কাহিনীঃ জীবন ও যৌনতা - সাযযাদ কাদির

হারেমের কাহিনীঃ জীবন ও যৌনতা - সাযযাদ কাদির
আরবি ভাষার 'হারাম' শব্দ থেকে এসেছে 'হারেম' শব্দটি। বই থেকে উল্লেখ করে বিষয়টিকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। বলা হয় 'হারেম' শব্দটি এসেছে আরবি 'হারাম' (অবৈধ) কথাটি থেকে। তুর্কিরা কথাটিকে সহনীয় করে নেয়, তারপর যোগ করে 'লিক'। ফলে তুর্কি ভাষায় বাড়ির যে অংশে মহিলারা থাকেন তার নাম হয় 'হারেমলিক'। ইউরোপীয়রা 'হারেম'কে জানে 'সেরালিয়ো' নামে। এখানে ইতালিয়ান ও ফারসি ভাষার এক অদ্ভূত সংমিশ্রণ ঘটেছে। ইতালিয়ান ভাষায় 'সেররালিয়োন' কথাটির অর্থ 'বন্য প্রাণীর খাঁচা'। এর উৎপত্তি লাতিন 'সেরা' (গরাদ) থেকে। তবে ফারসি 'সরা' ও 'সরাই' (ভবন, বিশেষ করে প্রাসাদ, কিন্তু উপমহাদেশে অর্থ দাঁড়িয়েছে বিরতিস্থল ও পান্থশালা) শব্দের সঙ্গে কাকতালীয় সাদৃশ্যের কারণে এমন অর্থান্তর ঘটেছে এর।..... পালি ভাষায় মহিলাদের আবাসস্থলকে বলা হয় 'ইত্থাগারা' (স্ত্রী আগার)'। পুরুষের বহুগামিতাকে প্রশয় ও লালন করার জন্য হারেমের উৎপত্তি। এই হারেমের বিভিন্ন কাহিনীকে বর্ণনাই আলোচ্য বইয়ের মূল বিবেচ্য বিষয়। বেশ কিছু ঐতিহাসিক তথ্য আছে এতে।

ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র বেদে এক পুরুষ কর্তৃক বহু নারীভোগের বিষয়টি উল্লিখিত হয় নি। এ-প্রথা বেদ-উত্তর কালের। ব্রাহ্মণ্য উপনিষদে (আনুমানিক ৫০০ পূর্বাব্দ) অবশ্য বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। 'জাতক'কে যদি প্রাক-বৌদ্ধযুগের সমাজচিত্র বলে গ্রহণ করা যায় তা হলে বলতে হয় বুদ্ধের আবির্ভাবের আগে, পূর্বাব্দের পঞ্চম শতকে, বিশেষভাবে পুরুষদের বহুগামিতা প্রচলিত ছিল। 'মহাপদ্মজাতক'-এ ১৬ হাজার রমণী-অধ্যুষিত এক রাজকীয় 'সেরালিয়ো'র উল্লেখ আছে। সংখ্যাটি হয়তো অতিরঞ্জিত, কিন্তু এই উল্লেখ প্রাকবৌদ্ধ যুগে 'ইত্থাগারা' থাকার অকাট্য প্রমাণ। অবন্তীর' রাজা প্রদ্যেৎ, মগধের রাজা বিম্বিসার (আনুমানিক ৫৪৬-৯৪ পূর্বাব্দ), বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু (আনুমানিক ৪৬২-৯৪ পূর্বাব্দ) এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব (আনুমানিক ৫৬৬-৪৮৬ পূর্বাব্দ) -এর সমসাময়িক রাজা উদয়নের শাসনকালে হারেম ছিল বলে উল্লেখ আছে ওই বৃত্তান্তে।

বইয়ে উদ্ধৃত তথ্যমতে "মুসলিম যুগের হারেম সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় ১৪শ শতাব্দী থেকে"। দাক্ষিণাত্যের গুলবর্গ রাজ্যের অধিপতি ফিরোজ শাহ বাহমিনি এক দিনে তিনশত পত্নী গ্রহণ করেছিলেন। মুগল আমলে জেনানা বিভাগ নামে একটি আলাদা বিভাগই ছিল হারেমকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। আবুল ফজল তার লেখায় জানিয়েছেন-

আকবর এক বিশাল প্রাচীরবেষ্টিত ভবন তৈরি করিয়েছিলেন- যেখানে তিনি প্রায়ই বিশ্রাম নিতেন। তাঁর হারেমে পাঁচ হাজারের বেশি রমণী ছিল-যাদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত ছিল আলাদা-আলাদা কক্ষ।

হারেমের ভিতর যে অসহায় মেয়েরা ছিল তাদের দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত ছিল শুধুমাত্র খোজা পুরুষ। তারা ছাড়া আর কেউ জেনানামহলে প্রবেশ করতে পারত না। পুরনারীদের বিনোদনের জন্য হারেমের ভেতর বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। বিভিন্ন রীতি ও নিয়মনীতির বেড়াজালে বন্দী ছিল হারেমের নারীরা। তাদের জন্য যে কক্ষগুলো বরাদ্দ ছিল তার সামনে ছিল ফুল বাগান, ঝরণা, চৌবাচ্চা, ছায়াবীথি, ফোয়ারা, নকল গুহা ইত্যাদি। নিজস্ব দাস ও দাসী ছিল তাদের।

রাজা-বাদশাদের চোখে যাদেরকে ভাল লাগত সেইসব নারীদেরকে হারেমে নিয়ে আসা হত।

হারেম পরিপূর্ণ থাকত নানা দেশের নানা জাতির রমণীতে। তাদের যাচাই-বাছাইয়ের ব্যাপারটি পুরোপুরি নির্ভর করতো রাজা-বাদশাহর খামখেয়ালের ওপর। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের আমলে এই যাচাই-বাছাই চলতো কিভাবে তা জানা যায় না। তবে পরবর্তীকালের অবস্থা দেখে মনে হয় সেকালেও চলেছে একই নিয়ম: সুন্দরী মেয়েদের যোগাড় করা হয়েছে দালাল, উমেদার ও বিদেশী বণিকদের মাধ্যমে, যুদ্ধবন্দিরেদ মধ্যে তল্লাশি চালিয়ে, পিতা-মাতাদের কাছ থেকে কিনে এবং অন্যান্য উপায়ে। হঠাৎ কোথাও দেখে ভাল লেগে-যাওয়া মহিলাদেরও রাজা-বাদশারা নিয়ে এসেছেন হারেমে।

হারেমের জীবন রাজাদের জন্য সবসময় আনন্দ বয়ে আনত তা নয়। কখনও কখনও হারেমের অভ্যন্তরে সংঘটিত ষড়যন্ত্র রাজার জন্য প্রাণঘাতী রূপ লাভ করত।

হারেমের কাহিনী বইটিতে কোন সূচিপত্র নেই। ধারাবাহিকভাবে ঐতিহাসিক তথ্যগুলো আলোচনা করা হয় নি। ছোট ছোট পর্বে বিভক্ত করে বিভিন্ন বিষয়কে অল্প করে আলোচনা করা হয়েছে। ফলে স্বল্প আয়তনের লেখায় বইটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দেয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়।

এক পৃষ্ঠা বা দুই পৃষ্ঠাব্যাপী ছোট ছোট রচনাগুলোর কয়েকটির শিরোনাম উল্লেখ করি:

  • মহলের অভ্যন্তরে
  • অন্য ধরনের হারেম
  • মহলের বৈশিষ্ট্য
  • শাহজাহানের আমলে জেনানা
  • বারনিয়ের -এর পর্যবেক্ষণ
  • সপ্তদশ শতাব্দীর জেনানা
  • অষ্টাদশ শতাব্দীর হারেম
  • জেনানায় আয়োজন
  • শ্রেণীবিভাগ
  • উপপত্নী
  • ক্রীতদাসী
  • প্রেম-জীবন
  • রাজরুচি
  • ষোড়শ শতাব্দীর জেনানা
  • হারেম যখন আশ্রয়
  • খাদ্য ও পানীয়
  • যৌনসঞ্জীবনী
  • কেশবিন্যাস
  • পোশাক
  • সুগন্ধি
  • অনুলেপন ও সাজসজ্জা
  • মুগল হারেমে সুগন্ধি
  • হারেম রমণীদের অলঙ্কার
  • ষোড়শ শতাব্দীর অলঙ্কার
  • মুগল শাহজাদিদের রত্ন-অলঙ্কার
  • বেগম-শাহজাদিদের আদব-কায়দা
  • হারেমের সংগঠন
  • বিভাগীয় প্রধান
  • অন্যান্য কর্মকর্তা
  • নারী কর্মচারী
  • মুগলদের জেনানা মহল
  • মহলের প্রশাসন
  • দাসী
  • প্রহরা
  • খোজা
  • খোজাদের দৈহিক পরিবর্তন
  • হিজড়া
  • খোজা-প্রহরী ও রক্ষী
  • নারী প্রহরী
  • মাতৃকা গুপ্তচর
  • মুগল হারেমের মাতৃকা গুপ্তচর
  • হারেমে নারী-কর্মকর্তা
  • হারেমের নারী-সৈনিক
  • মুগল আমলে নারী-সৈনিক
  • পরবর্তী কালের নারী-সৈনিক
  • রন্ধনশালা
  • বিষাতঙ্ক
  • ব্যাভিচার
  • নগরশোভিনী
  • কুড়িয়ে পাওয়া শিশু ইত্যাদি।

আসলে লেখক নিজে ঐতিহাসিক নন। ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থও তিনি লেখেননি। বিষয়ের আকর্ষণেই তিনি এই গ্রন্থটি রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। তাই হয়ত জায়গায় জায়গায় ঘটনাক্রম কিছুটা খাপছাড়া মনে হয়েছে। তবে সে ত্রুটি তিনি স্বীকার করে নিয়েছে গ্রন্থারম্ভেই। লেখকের ভাষ্যে:-

আশির দশকে পাক্ষিক 'তারকালোক'- এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল 'হারেম' ও 'মহারাজা' নামের দু'টি ইতিহাস-নির্ভর রচনা। সেই রচনা দু'টিরই পরিমার্জিত রূপ এই 'হারেমের কাহিনী" জীবন ও যৌনতা'। বিভিন্ন ইতিহাস ও গবেষণা গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এর সমুদয় তথ্য। যদি কোনও ত্রুটি ঘটে থাকে তার ভাষান্তরের ও উপস্থাপকের। সে দায়িত্ব আমার।

সীমাবদ্ধতাগুলোকে উপেক্ষা করলে দেখা যাবে বইটিতে অনেক অজানা ও রোমাঞ্চকর তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। এই বিশেষ তথ্যগুলোকে সংগ্রহ করতে লেখকের বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে।

মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

  1. সুন্দর রিভিউ। মনে হলো, এক ঝলকে বইয়ের ভেতরটা দেখে নিলাম।

    উত্তরমুছুন

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম