লোকসঙ্গীতের উৎস সন্ধানে - অনিল সেন

লোকসঙ্গীতের উৎস সন্ধানে - অনিল সেন
মানুষের মনের ভাব প্রকাশের একটি মাধ্যম হল সংগীত। আনন্দে, উৎসাহে, শোকে-দুঃখে মানুষের হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে সংগীতের ঝর্ণাধারা। আবহমানকাল ধরে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে সংগীতের যে ধারাটি প্রবাহিত হয়ে আসছে তার নাম লোকসংগীত। খেটে খাওয়া গ্রামীণ মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার প্রতিফলন থাকে এই ধারার সঙ্গীতে। এটা প্রান্তিক গ্রামবাংলার নিজস্ব গান। বাংলাদেশ অঞ্চলের লোকগীতিগুলোর রয়েছে বিভিন্ন ধারা। বাংলার নিজস্ব দর্শনবোধ ও যাপিত জীবন বহু বৈচিত্র্যে ও বর্ণিলভাবে এগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে। আর এসব নিয়ে স্বল্প কথায় তথ্যবহুল  আলোচনা রয়েছে অনিল সেন রচিত “লোক সংগীতের উৎস সন্ধানে” বইতে। মাত্র ১১২ পৃষ্ঠার এই  বইতে কোন গভীর তত্ত্বের জাবরকাটা নেই। একাডেমিক পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের বাহুল্য নেই। বরং সহজ ভাষায় সরল চিন্তার ছোঁয়ায় নির্মেদ রচনাগুলোয় রয়েছে চৌম্বক উপাদান। যা পাঠককে উপস্থাপিত বিষয়ে করে তুলবে সন্ধিৎসু, উৎসাহী। প্রসঙ্গের পরিধি বুঝতে রচনার শিরোনামগুলোর পাঠ আবশ্যক। সে লক্ষ্যে সম্পূর্ণ বিষয়সূচি উল্লেখ করা হল।
  • লোকসঙ্গীতে অপার্থিব ভাবধারা
  • লালন ও ঔপনিবেশিকতা
  • ভাওয়াইয়া ও নজরুল
  • লোকসঙ্গীত কথাটির উৎস সন্ধান
  • লালন চেতনা ও প্রাসঙ্গিকতা
  • লোকসংস্কৃতি চর্চাঃ সেকাল একাল
  • বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও বাংলার লোকসঙ্গীত
  • বাঙলার লোককবি ও লোকগান
  • লোকসাহিত্য চর্চার সঙ্কট
  • রাধারমণ দত্তের জীবন ও দর্শন
  • যাত্রা আমাদের আদি উৎসব
  • বাংলার লোকসঙ্গীত এবং পাগলা কানাই
  • আর তো বাজে না সোনারায়ের পদাবলী
  • একলিম রাজাঃ বাংলার মরমি সঙ্গীতের প্রেমিক
  • ভরা পাগলার জীবন-সাধনা
  • বিলুপ্ত এক লোকদেবতা শীতলা
  • হারিয়ে যাওয়া লোকনাটক কুশান গান
  • ভাওয়াইয়া ও তার গীতিবৈচিত্র্য

মোট ১৮টি শিরোনামে লেখক লোক গীতির বিভিন্ন দিককে স্পর্শ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে লোকসাহিত্যের বিষয়বৈচিত্রের বিবিধ বৈশিষ্ট্য নিয়েও আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছেন। জানিয়েছেন বিষয়সমূহের অন্তরালের ভাবনা ও সংশ্লেষসমূহ।

প্রতিটি রচনা স্বল্পায়তনের। কিন্তু তাতে মূল বিষয়টি উপস্থাপনের কোন ঘাটতি চোখে পড়ে না। রূপসন্ধানী মানুষ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য থেকে নিত্য নতুন ভাবনার মসলা সংগ্রহ করে। আমাদের দেশীয় চেতনায় প্রকৃতির বিপুল বৈচিত্র্যকে প্রকাশের উপায় হল সঙ্গীত ও নৃত্য। অবশ্য একথা সকল দেশের লোকজ সংস্কৃতিজীবনের জন্য সত্য। আমাদের দেশে সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকৃতিকে বর্ণনা ও বন্দনার পরিমাণ বেশি। এখানে বাণী নয় সুর পেয়েছে প্রাধান্য। অর্থাৎ বুদ্ধির শাসন নয় অনুভূতির আবেদন সঙ্গীতকে আশ্রয় করে মানুষের হৃদয় ছুঁতে চেয়েছে।

প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতগুলোতে স্থান পেয়েছে। “লোকসঙ্গীতে অপার্থিব ভাবধারা” নামক প্রথম রচনাটিতে লেখকের ভাষ্যে জানা যায় -
বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয় আকাশ, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, মেঘ, বৃষ্টি, বজ্রপাত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত, সাগর, নদী, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়, চর, উঁচু ভূমি, পাহাড় টিলা, নিমফল, লেবু-বাতাবি লেবু ও ম্যাথি, আম, জাম, কাঁঠাল, খেজুর, বট, পাকুড়, বাঁশ, পেয়ারা, ডালিম, পাঠ, ধান, কলা, লাউ, আলু, শসা, পান, বক, পেঁচা, বাদুড়, চাতক, বাবুই, রুই, কাতলা, টাকি, পুঁটি, বানর, কুমির, সিংহ, ভোমরা, মৌমাছি, জোনাকি প্রকৃতির এসব উপাদান কখনও এসেছে সরাসরি, আবার কখনও এসেছে প্রতীক, উপমা বা রূপক হিসেবে। এসব শব্দ বা নাম কখনও কখনও মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।  পৃষ্ঠা- ১২

মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য আশ্রয় নেয় সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানের। সঙ্গীত তার মধ্যে একটি। মনের ভাব বা ভাবনা বা অনুভূতির প্রকাশ সমভাবনার সকলের হৃদয়ে স্পর্শ করে। সঙ্গীতের মাধ্যমে এই আবেদন সাবর্জনীন রূপ গ্রহণ করে। লোকসঙ্গীতে গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ভাব ভাষা ধ্যান ধারণা ধর্ম দর্শন মানবিক বোধ বিবেচনা সবকিছুর প্রতিফলন ঘটে। লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মত বাংলাদেশের মানুষও নিজের মনের আকুতি প্রার্থনা নৈবেদ্য প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের নিজস্ব দর্শনচেতনা বা মরমীয়াবাদ বা ধর্মবোধগুলোও প্রকাশ পেয়েছে সঙ্গীতের হাত ধরে। ভজন, বৈষ্ণব, বাউল, ফকিরালি প্রভৃতি লোকজ ধর্মমত দর্শনবোধ প্রকাশিত হয়েছে লোকসঙ্গীতকে আশ্রয় করে।

ভাওয়াইয়া গান নিয়ে নজরুল ইসলামের আগ্রহ ও ভালবাসা আলোচিত হয়েছে “ভাওয়াইয়া ও নজরুল” রচনাটিতে। ভাওয়াইয়া গান উত্তরবঙ্গের মানুষের হৃদয় নিঃসৃত গান। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের প্রকাশ ঘটে ভাওয়াইয়া গানের মাধ্যমে। সাধারণ কৃষক শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষের মর্মলোককে এই গানের করুণ সুর যেমন আপ্লুত করে তেমনি চটুল সুর অপার্থিব আনন্দলোকে অভিভূত করে। আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে ভাওয়াইয়া গান শুনে নজরুল ইসলাম এর প্রতি আগ্রহী হন। তার সহায়তায় আব্বাস উদ্দিন অনেকগুলো গান রেকর্ড করতে সক্ষম হন। এই প্রবন্ধে ড. ওয়াকিল আহমদ রচিত 'বাংলার লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া' থেকে কাজী নজরুলের একটি উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। যা থেকে ভাওয়াইয়া গানের প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের আন্তরিক শুভেচ্ছার কথা জানা যায়।
ভাওয়াইয়া গান শুনলেই আমি চঞ্চল হয়ে উঠি; জানি না এ গানের সুরে কী মায়া, আমার মন চলে যায় পাহাড়িয়া দেশে সবুজ মাঠের আঁকাবাঁকা আলোর প্রান্তিকে, উপ-প্রান্তিকে। পৃষ্ঠা- ২১

অনিল সেন বেশ পরিশ্রম করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে এই রচনাগুলো প্রস্তুত করেছেন। সবগুলো লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাময়িকী পাতায়। রচনাগুলো পাঠ করলে লেখকের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার মাত্রা আঁচ করা যায়। তাঁর রচনাশৈলী আকর্ষনীয়। বুদ্ধির সাথে সহৃদয়তার মিশ্রণ ঘটলে যে রকমের বাক্য তৈরি সম্ভব, তার প্রমাণ রয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। তিনি আলোচ্য প্রসঙ্গের প্রতি যে নিষ্ঠা প্রকাশ করেছেন তা বিরল; যত তথ্য উপাত্তের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন তা মূল্যবান। লোকসঙ্গীত সম্পর্কে তিনি যে মননশীলতা প্রকাশ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। এই বইটি ফোকলোরের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়ার মত মানসম্পন্ন বলে আমার মনে হয়েছে। প্রত্যাশা করি লেখক তার আন্তরিকতার যথাযথ মূল্যায়ন পাবেন।

বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মিজান রহমান। নকশী কাঁথার অলংকরণ ও একটি দোতরার চিত্রকে পাশাপাশি রেখে তিনি লোকসংস্কৃতিকে দৃশ্যমান করতে চেয়েছেন। তার এই আইডিয়া প্রশংসাজনক। দেশের পাঠককে লোকগীতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে বইটির ব্যাপক প্রচার আবশ্যক।

~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~
লোকসঙ্গীতের উৎস সন্ধানে
অনিল সেন


প্রচ্ছদঃ মিজান রহমান
প্রকাশকঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ ২০০৭
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১১২
মূল্যঃ ১২০ টাকা
ISBN: 984-8309-182-5

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ