বাঙ্গাল: একটি তাৎক্ষণিক পাঠপ্রতিক্রিয়া: মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর

বাঙ্গাল পত্রিকা ম্যাগাজিন


কুরিয়ারে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'বাঙ্গাল' হাতে পেলাম। করোনাময় এ দুঃসময়ে, বিশেষ করে চলমান লকডাউনের মাঝে এ ধরণের একটি পত্রিকা বের করা দুঃসাহসিকতাই বটে। সাধুবাদ জানাই সম্পাদনা পরিষদ সহ যে সব কুশীলবদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাঙ্গাল আলোর মুখ দেখলো তাদের সবাইকে।

বাঙ্গালের সূচনা সংখ্যায় স্থান পেয়েছে চারটি প্রবন্ধ, দুটি অনুদিত কবিতা সহ বেশ কটি মৌলিক কবিতা, ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠভ্রাতা পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লিখিত বাংলাভাষার 'প্রথম গল্প' (?) সহ পাঁচটি ছোটগল্প, একটি গদ্য আলেখ্য এবং পাঁচটি গ্রন্থ আলোচনা।

প্রমিত বাঙলা বানান বিষয়ে বেগম জাহান আরার প্রবন্ধটি বেশ তথ্যসম্বলিত। যারা বাংলাভাষার বানান নিয়ে গবেষণা করেন তারা এটি পাঠ করলে সমৃদ্ধ হবেন বলে আশা করা যায়। নারীবাদ নিয়ে বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক মঈন চৌধুরী তার প্রবন্ধে নারীবাদের ঐতিহাসিক নৃতাত্বিক পর্যালোচনা এবং সাহিত্যতত্বে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে প্রবন্ধটি আরো বিশ্লেষণাত্বক হতে পারতো, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে নারীবাদের ইতিহাস ও ব্যাপ্তি সংক্ষেপে হলেও আলোচনা করার সুযোগ ছিল এখানে। এছাড়া বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সামগ্রিকভাবে নারীর উন্নয়নের লক্ষে নারীবাদ সাহিত্যকে কীভাবে উজ্জীবিত করতে পারে সে দিকনির্দেশনা হয়তো দিতে পারতেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, প্রবন্ধটির 'নারীবাদ' এবং 'নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব' এই দুটি পর্বের শুরুতে দৃষ্টিকটুভাবে একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, যা সম্পাদনার সময় এড়িয়ে যাওয়া সঙ্গত হয় নাই।

মধ্যযুগে উপমহাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বাঁক এনেছেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব হলেন আমির খসরু, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আজো তার প্রভাব ভাস্বরিত। আমির খসরুকে নিয়ে জাভেদ হুসেনের বিশ্লেষণাত্বক প্রবন্ধপাঠে নিঃসন্দেহে পাঠক সমৃদ্ধ হবেন। কলকাতার কড়চায় সাহিত্যিক-সাংবাদিক হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের নিবন্ধটিতে কিংবদন্তিতুল্য কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের অজানা একটি দিক উন্মোচিত হয়েছে। 'প্রদীপের নিচে অন্ধকার' পদবাচ্যটি হয়তো মিথ্যে নয়।

বিদেশী আবহে আনিসুজ জামানের ছোটগল্প 'ভালোবাসার গাছ' পাঠকদের মন ছুঁয়ে যাবে আশা করা যায়। ফয়জুল ইসলামের 'লয়ে যাও আমায়' গল্পটি আবর্তিত হয়েছে ব্যক্তিমানুষের সাথে বানরের ভাষাগত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার আবহে। গল্পটিতে একধরণের মনোস্তাত্বিক দার্শনিকতা রয়েছে। বানরের সাথে কমিন্যুকেশনের সমান্তরালে বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রেমিকার প্রসঙ্গ চলে আসায় গল্পটি এক ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। তবে গল্পটির প্রলম্বিত বাক্য বিন্যাসে শহিদুল জহিরের সরাসরি প্রভাব বলেই মনে হয়েছে। ফজলুল কবীরী ও মুহিম মনিরের গল্পদুটো সুখপাঠ্য।

জাকির তালুকদারের পুস্তক সমালোচনায় নিঃসন্দেহে পাঠক আলোড়িত হবেন এবং আলোচিত পুস্তক পাঠে উৎসাহিত হবেন এ আশা করা যায়। ফজলুল আলমের 'সংস্কৃতি-গঠন' বইটির সারাংশ সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। এছাড়া সমালোচিত হয়েছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের 'ল্যু সালোমে - সাহিত্যভূবনের অগ্নিশিখা', আব্দুর রউফের 'কর্কট কন্যা' এবং কবি আবুল হাসানের উপর মোশতাক আহমেদ প্রণীত ডকু-ফিকশন 'ঝিনুক তুমি নীরবে সহ' ।

কবিতা মাপনের কোনো নিক্তি নেই। ভালোলাগা কিংবা না লাগা অনেকটা আপেক্ষিক বিষয়। বাঙ্গালে প্রকাশিত কবিতাগুলো মানোত্তীর্ণ অভীধা দেওয়া যায়। তবে চমকপ্রদ কিংবা পাঠকের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলার মতোন কি না সে প্রশ্নটিও প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। কবিতার পাশাপাশি মাসুদ খানের 'একগুচ্ছ গদ্য-আলেখ্য' নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য।

প্রচ্ছদটিতে বাঙ্গালী সংস্কৃতি শৈল্পিকভাবে ফুটে উঠেছে। এজন্য শিল্পী আসলাম লিটন বিশেষভাবে ধন্যবাদ পেতেই পারেন।

পরিশেষে সার্বিকভাবে আশা করা যায় বাঙ্গালের উদ্বোধনী সংখ্যাটি ক্ষুদে পত্রিকার ইতিহাসে অনন্য সংযোজন হিশেবে চিহ্নিত হবে। তবে সম্পাদকীয়তে যে প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে তা বাস্তবায়নে বাঙ্গালকে অনেকদূর যেতে হবে। আরো বেশী যত্নবান হতে হবে সম্পাদনায়।

বাঙ্গালের জন্য রইলো একরাশ শুভ কামনা।

----------

* জাকির তালুকদার সম্পাদিত 'বাঙ্গাল' পত্রিকা প্রকাশের খবর পড়ুন বাংলা সাহিত্যবার্তা পত্রিকায়

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ