মনোবিশ্লেষণ - সিগমুন্ড ফ্রয়েড

মনোবিশ্লেষণ - সিগমুন্ড ফ্রয়েড


বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড। মানব মনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভাবক। জন্মেছেন ১৮৫৬ সালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের ফ্রেইবার্গ নামে ছোট শহরে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মালেও তার জন্মের অব্যাবহিত পরে পিতার আয়ে ভাটা নামে। কষ্টকর জীবন হলেও ফ্রয়েডের বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমী মানসিকতা ছিল। ফলে লেখাপড়ায় তিনি উৎসাহী ছিলেন। কখনও চিকিৎসক হতে চাননি। তবে প্রকৃতির রহস্য বোঝার একটা অদম্য কৌতুহল ছিল।

স্নায়বিক রোগ বিশারদ হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। রোগীদের মনোঃসমীক্ষণ করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছেন। সমাজে মনোরোগ বিষয়ে কুসংস্কার ছিল। এর বিপরীতে তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুযায়ী রোগ নিরূপনের চেষ্টা করতেন। উদ্ভাবন করতেন বিভিন্ন পদ্ধতি ও তত্ত্ব। চিকিৎসাক্ষেত্রে এসবের প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানের নানা শাখার জ্ঞানভান্ডারে নতুন তত্ত্ব যোগ করছিলেন।‌ তার সম্পর্কে বলা হয়-

প্রথমত ও প্রধানত ফ্রয়েড হলেন মানবমনের বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষার প্রথম আয়ুধটির আবিষ্কর্তা। প্রতিভাধর সৃজনশীল সাহিত্যিকবৃন্দ মানসিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বিচ্ছিন্নভাবে অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় রেখেছেন, কিন্তু ফ্রয়েডের আগে এক্ষেত্রে কোনো সুসংবদ্ধ অনুসন্ধান-প্রণালীর অস্তিত্বই ছিলো না। পৃষ্ঠা- ১৯-২০


বলা যায় মনঃসমীক্ষণের প্রথম প্রসার পর্বের সময়কালে ফ্রয়েড এই শাস্ত্রটির গঠন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

১৯০৯ সালে আমেরিকায় মনোবিজ্ঞানীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রণ পান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবহারিক মনঃসমীক্ষকগণ এই সম্মেলনে এসেছিলেন। এখানে ফ্রয়েড পাঁচটি বক্তৃতা দেন। জার্মান ভাষায় দেয়া এই বক্তৃতাগুলি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্ববাসীর নজরে আসে। ফ্রয়েডের খ্যাতি ছড়িয়ে পরে বিশ্বব্যাপী।

আলোচ্য বই এই পাঁচ বক্তৃতামালার সংকলন। বক্তৃতাগুলো 'প্রথম পাঠ', ‘দ্বিতীয় পাঠ' এভাবে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। বইয়ের শেষে আছে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের জীবন ও কর্ম পরিচিতি।

প্রথম পাঠে হিস্টিরিয়া নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত একাধিক রোগীর কথা বলেন। সাধারণ চিকিৎসকরা একে মস্তিষ্কের রোগ বলে মনে করেন। কিন্তু প্রবীণ মনোচিকিৎসক ডা. জোসেফ ব্রিউয়ার মনে করতেন এই রোগ মানসিক রোগ। তিনি প্রচলিত পদ্ধতি বাদ দিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া শুরু করেন। চিকিৎসা শেষে অনেক রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে।

ফ্রয়েড এই গবেষণার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ডা. ব্রাউয়ারের পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া শুরু করেন। সম্মোহনের মাধ্যমে রোগীর অবচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুঃখ, হতাশা, ভীতিগুলোকে দূর করতে সক্ষম হন।

মানুষের মানসিক উত্তেজনার কারণে শারীরবৃত্তীয় উদ্দীপনা শুরু হয়। এর ফলে ঘটে আবেগের বহিঃপ্রকাশ। আবেগতাড়িত বহিঃপ্রকাশের মাত্রা তীব্রতর হয় প্রকাশের পথ পেলে। আর তা বাধা পেলে মনের উপরে ব্যাপক প্রভাব সঞ্চার করে।

দ্বিতীয় বক্তৃতায় ফ্রয়েড রোগ সৃষ্টিকারী উপাদান নিয়ে গবেষণার কথা বলেন। প্যারিসবাসী মনঃসমীক্ষক শার্কো হিস্টিরিয়ার রোগীদের নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করেছিলেন। তার গবেষণার মাধ্যমে রোগটিকে নতুনভাবে বোঝা গিয়েছিল। ফ্রয়েড বলেন-

আমরা আমাদের রোগীদের রোগসৃষ্টিকারী অভিজ্ঞতাগুলিকে মনস্তাত্ত্বিক আঘাত হিসেবে ধরে নিলাম এবং তাকে শারীরবৃত্তীয় (somatic) আঘাতের সঙ্গে একই পর্যায়গত দৃষ্টিতে দেখলাম-- হিস্টিরিয়াজনিত পক্ষাঘাতের ওপর যার প্রভাব প্রমাণ করেছিলেন শার্কো। পৃষ্ঠা - ৫১


এই সময়ে ডা. ব্রিউয়ারের সাথে তার মতভেদ ঘটে। সম্মোহন করে চিকিৎসা করার পদ্ধতিটি তার কাছে আর অতটা কার্যকরী মনে হচ্ছিল না। তিনি সচেতন অবস্থাতেই রোগীর চিকিৎসা দেয়া শুরু করলেন। সফলতার হার বেড়েছিল অনেক বেশি। বক্তৃতার শেষে তিনি মনোচিকিৎসাকে সহজবোধ করে শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরতে গিয়ে বলেন-

মনোঃসমীক্ষণ বলতে এখানে যে চিকিৎসবা পদ্ধতির বর্ণনা করা হচ্ছে, তার মূল বিষয়টি সম্বন্ধে যদি আমি স্বচ্ছ বোধগম্য ধারণা না দিতে পারি তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। সমস্যাটি শুধুমাত্র বিষয়ের অভিনবত্বের জন্যই নয়। পরস্পরবিরোধী (incompatible) ইচ্ছার বৈশিষ্ট্য-- যেগুলি অবদমিত হওয়া সত্ত্বেও নির্জ্ঞান স্তরে তাদের অস্তিত্বকে প্রকাশ করতে সফল হয় এবং সহজাত (constitutional) বৈশিষ্ট্য-- যেগুলি নির্ধারক (determinants) ভূমিকা নেয় যে কোন অবদমনের সাফল্য ব্যর্থতার পিছনে; এর ফলে বিকল্প হিসাবে উপসর্গ গঠিত হয়-- এই সব বিষয়গুলিই আমি পরবর্তী বক্তৃতায় বিশদভাবে আলোচনা করব। পৃষ্ঠা - ৬০


তৃতীয় বক্তৃতার শুরুতেই তিনি নিজের পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে সম্মোহন পদ্ধতি ছেড়ে দেয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। নিজের পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে শুরু করেন স্বপ্ন নিয়ে গবেষণার কথা বলেন। স্বপ্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে শৈশবে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও ধারণার প্রভাব পরবর্তী জীবনে কত ব্যাপক তা জানা যায়।

নির্জ্ঞান মন, অবদমন প্রভৃতি বিষয়গুলো তার বক্তৃতায় একাধিকবার উল্লেখ করে মানব মনের বৈচিত্র্যপূর্ণ গতিপ্রকৃতির বিবরণ দেন।

চতুর্থ বক্তব্যে তিনি স্নায়ুরোগীদের অবদমিত আকাঙ্ক্ষার আবেগ সম্পর্কে বলেন। তিনি বেশ জোরের সঙ্গে বলেন-

-- রোগসৃষ্টিকারী  আকাঙ্ক্ষার আবেগের ব্যাপারে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই অসুস্থতার পিছনে যার প্রভাব সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো যৌন অস্বস্তি। পৃষ্ঠা- ৮১


তিনি আরও বলেন যে প্রথাগত সংস্কার অনুযায়ী সাধারণ মানুষ তার এই মতামত গ্রহণ করবে না। সেই প্রসঙ্গে ১৮৯৫ সালে যখন ডা. ব্রিউয়ারের সাথে যৌথভাবে The Studies প্রবন্ধ রচনা করছিলেন তখনও তিনি নিজের অনুমানকে মনকে থেকে গ্রহণ করতে পারেননি। পরবর্তীতে অসংখ্য পরীক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বিষয়ের গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন--

স্বপ্ন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রের মতো এখানেও আমরা একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই; অবদমিত অবিনাশী শৈশবকালীন কামনার আবেগই একমাত্র উপসর্গ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। এই আবেগের অনুপস্থিতিতেই পরবর্তী জীবনের মানসিক আঘাতগুলি একটি স্বাভাবিক পথে পরিক্রমা করতো। কিন্তু শৈশবের এই শক্তিশালী কামনার আবেগকে ব্যতিক্রমহীনভাবেই বলা যায় যৌনতামূলক। পৃষ্ঠা- ৮৩


শৈশবকালীন যৌনতা স্বীকার করতে অনিচ্ছুক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০২ সালে প্রকাশিত ডা. স্যানফোর্ড বেল এর একটি গবেষণাপত্রের প্রমাণ দেন। সেই গবেষণায় ১৫ বৎসর ধরে আড়াই হাজারের বেশি শিশুদের পর্যবেক্ষণ করে তাদের মধ্যে প্রেমে পড়ার লক্ষণগুলি লক্ষ্য করেন। গবেষণায় তিন, চার বা পাঁচ বৎসর বয়সী শিশুদের প্রেমে পড়ার কথাও উল্লেখ করা হয়। ফ্রয়েড শিশুদের যৌন পরিতৃপ্তির জন্য আত্মরতির কথাও বলেন। তিনি জানান এই আত্মরতির আনন্দ পরবর্তী বয়স্ক জীবনে প্রচুর তাৎপর্যময় ভূমিকা রাখে এবং সে সারা জীবনেও এই অভিজ্ঞতা থেকে মুক্ত হতে পারে না। প্রসঙ্গক্রমে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' ও শেক্সপীয়রের 'হ্যামলেট' নাটকের উল্লেখ করে তিনি নিষিদ্ধ সম্পর্কের জটিলতার বর্ণনা দেন। এই বক্তৃতার কিছুদিন পরে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে 'ইডিপাস কমপ্লেক্স' পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেন।


পঞ্চম বক্তৃতায় ফ্রয়েড যৌন প্রবৃত্তিমূলক উপাদানের সাথে স্নায়ুরোগের সম্পর্কের কথা বলেন। রোগীর আরোগ্যের পিছনে তার নিজের আগ্রহের প্রয়োজনীয়তাকে উপস্থাপন করেন। তিনি স্নায়ুরোগের সাথে সৃষ্টিশীলতার সম্বন্ধের কথাও বলেন। তিনি জানান অবদমনের চাপের শিকার হয়ে অনেক সময় মানুষ বাস্তব জগৎ থেকে পলায়ন করে কল্পনার জগতে আশ্রয় নেয়। সেই কল্পিত জীবনে আমরা বাস্তব জীবনের ঘাটতিগুলো পূরণ করি বিভিন্ন ইচ্ছা-পূরণের মাধ্যমে। তিনি মনে করেন-

এই কল্পনাগুলি রোগীর ব্যক্তিত্বের মূল সুর এবং তার অবদমিত আবেগেরই অনেকটা অবলম্বনে গঠিত হয়। পৃষ্ঠা- ৯৬


তিনি মনে করেন, মানুষের অবদমিত যৌন আবেগের পরিতৃপ্তি হওয়া উচিত। না হলে মানুষ বাস্তব জীবন থেকে পলায়নী মনোবৃত্তির শিকার হয় এবং বিভিন্নরকম স্নায়ুরোগের সৃষ্টি হয়। আমাদের জীবনে যে পশুসুলভ বৈশিষ্ট্য আছে তা স্বীকার করে নেয়া দরকার। তিনি বলেন-

… যৌনশক্তির সম্পূর্ণটাকেই তার উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের থেকে বিচ্যুত করার জন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত নয়। আমরা কখনোই এমন কোনো প্রচেষ্টায় সফল হবো না এবং যদি যৌনতার ওপর বিধিনিষেধকে খুব বেশি প্রসারিত করা হয়, তাহলে মাটির উর্বরতা হারানোর মতো অবশ্যম্ভাবী বিষময় পরিণতি তার সঙ্গে আসবে। পৃষ্ঠা- ১০২



এই বক্তৃতাগুলো থেকে মনোরোগ বিষয়ে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের গবেষণা ও পরীক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতাগুলোর কথা জানা যায়। মনোঃসমীক্ষণ সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করার একটা চেষ্টা তার মধ্যে সবসময় ছিল। আলোচ্য বক্তৃতাগুলিতে তার সেই প্রচেষ্টার ছাপ রয়েছে। বোঝা যায় তিনি সবসময় পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিজের পূর্বের মতকে যাচাই বাছাই করতেন, কোন একটি নির্দিষ্ট মতবাদ আঁকড়ে থাকতেন না। নতুন নতুন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নতুন চিন্তার চর্চা করতেন।

বোর্ড বাঁধাই মলাট ও সাদা কাগজে সুমুদ্রিত বইটি বেশ শক্তপোক্ত। বহু ব্যবহারে জীর্ণ হবে না। 'সম্পাদকের কথা' শীর্ষক অংশ থেকে বইয়ের মুদ্রণ সাল ১৪০৯ বঙ্গাব্দ দেখা যায়। কিন্তু বইয়ের প্রিন্টার্স লাইনে সে কথার উল্লেখ নেই। বিষয়টি ঠিক বোধগম্য হল না। সাদামাটা প্রচ্ছদটি বইয়ের ভাবগাম্ভীর্য অক্ষুণ্ণ রেখেছে। মানব মনের জটিল সমস্যা নিয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জনে ইচ্ছুক পাঠকের এই বই পড়া প্রয়োজন।


-=-=-=-=-
মনোবিশ্লেষণ
সিগমুন্ড ফ্রয়েড


ভাষান্তর: সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ: হাফিজুর রহমান রোমেল


প্রকাশনী: হাওলাদার প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ২০১৭
পৃষ্ঠা: ১১০
মূল্য: ১৭৫ টাকা মাত্র
ISBN: 978-984-9865-43-6

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ