সাদিয়া সুলতানা'র উপন্যাস 'নীলগর্ভ' : নারীর মনোজটিলতার বয়ান | শামসুল কিবরিয়া

সাদিয়া সুলতানা'র উপন্যাস 'নীলগর্ভ' : নারীর মনোজটিলতার বয়ান | শামসুল কিবরিয়া


সাদিয়া সুলতানার নতুন উপন্যাস 'নীলগর্ভ'। এক নারীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা বিশ্লেষণই এ উপন্যাসের মূল কেন্দ্র। অকালে গর্ভপাতের ফলে একজন নারী কী রকম মনোজটিলতায় পড়তে পারে তা দেখাতে চেয়েছেন লেখক। এমন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে একজন নারী নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন। নিজের মনের সাথে লড়াই তো করতেই হয়, এমনকি মোকাবিলা করতে হয় নিকট মানুষদের বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তারও। 'সুরভি' নামের নারী যে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, তাকেও এগুলো মোকাবিলা করতে হয়েছে।

সুরভি কর্মজীবী নারী। সাহিত্য পাঠেও তার আগ্রহ রয়েছে। তার জীবনে চলমানতা আছে। কিন্তু গর্ভপাতের ঘটনাটি তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে স্বাভাবিক জীবনও এতে ব্যাহত হয়। সুরভি নিজেই নিজের কথা বলছে। ঔপন্যাসিকের এ চিন্তাটা বেশ ভালো হয়েছে। মনে হয় পরিকল্পিতভাবেই তিনি এ 'পয়েন্ট অব ভিউ' নির্মাণ করেছেন। নারীর এ অবস্থার কথা সে-ই সবচেয়ে ভালো করে উপলব্ধি করতে পারবে। ফলে সে নিজেই ভালো করে বলতে পারবে তার নিজের মনের কথা। আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে বলা যায় বহু নারী নিজের করুণ অবস্থার কথা চেপে যায়। সে নিজে যেমন বলতে চায় না। সমাজও তাকে বলতে দেয় না।

সুরভির বয়ানে লিখিত উপন্যাসে আরও একটি চরিত্র রয়েছে 'অপর্ণা' নামে। তার সাথে সুরভির বন্ধুত্ব আছে। একটি বিষয়ে দুজনের অনেক  মিলও রয়েছে। উভয়েই মানসিক যাতনার স্বীকার। যদিও দুজনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। অপর্ণার স্বামী তাকে আর গ্রহণ করছে না। বরং পুত্র আর্যকে সে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চায়। অথচ অপর্ণা পুত্রকে কোনোভাবে কাছছাড়া করতে চায় না। এসবের পাশাপাশি অফিসেও হ্যারেসমেন্টের শিকার হয়। এগুলো মোকাবিলা করেই সে টিকে থাকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাকে পরাজিত হতে হয়। খুব নির্মম এ পরাজয়।

দুইজন নারীর জীবনের সমান্তরাল যন্ত্রণায় কে কাকে সান্ত্বনা দিবে? তবু তারা চিঠি লেখা, বই পড়ার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।

সুরভির স্বামী হাসান। পুরো উপন্যাসেই তার দেখা মেলে। তবে তার অবস্থান প্রায় ইনেক্টিভই বলা যায়। সুরভির মাধ্যমে সে একটিভ হয়েছে। তাকে সবচেয়ে বেশি একটিভ দেখা যায় মেয়ে 'আস্থা' হারিয়ে গেলে। মিসড অ্যাবরশনের পর হাসানকেও তার দূরের মনে হয়। হাসান যেন দিনে দিনে কেমন হয়ে যাচ্ছে! অথচ তারা প্রেম করেই বিয়ে করেছিল।

সবচেয়ে করুণ অবস্থা দেখা যায় শ্বাশুড়ির দ্বারা সুরভি মানসিকভাবে আঘাত পেলে। বাচ্চাটা গর্ভেই নষ্ট হওয়ার জন্য যেন সুরভিই দায়ি। আমাদের সমাজ বাস্তবতা একটি নির্মম চিত্র পাওয়া যায় এ দৃশ্যের মাধ্যমে। নারীরা এখনো সমাজে অবহেলিত। সংসারের কোনো সমস্যার জন্য যেন তারাই দায়ি। অথচ সুরভি বা অপর্ণা -তারা কোনো কিছুই নিজেরা তৈরি করেনি। কিন্তু তাদেরকে এজন্য ভুক্তভোগী হতে হয়েছে।

উপন্যাসের কাহিনি সুরভিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তাকে ছেড়ে কাহিনি দূরে যায়নি। অর্থাৎ কোনো উপকাহিনি তৈরি হয়নি। সুরভি তার পরিপার্শ্বের প্রেক্ষিতে কেমন আচরণ করছে বা পরিপার্শ্ব তাকে কিভাবে প্রভাবিত করছে তার বিবরণ উপন্যাসের বহিরঙ্গ গঠিত হয়েছে। ফলে এ উপন্যাস একমাত্রিকতার দিকে ধাবিত হয়েছে বলা যায়।

নানা মোড় ঘোরে উপন্যাস এন্ডিং এ আসে। উপন্যাস জুড়ে যদিও কেন্দ্রীয় চরিত্রের মনোবেদনা প্রকাশিত হয়েছে, শেষে এসে অবশ্য ইতিবাচকতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জীবনের জয়গান ঘোষিত হয়। 'সুরভি'র মেয়ে 'আস্থা'র মুখ দিয়ে বলা হয়-

এই দ্যাখো কোনো কষ্ট নেই। কোনো ব্যথা নেই। আমি আছি না।



**********
নীলগর্ভ
সাদিয়া সুলতানা

প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশনী: জলধি, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
পৃষ্ঠা: ১৪৮
মূল্য: ৩৫০/-
ISBN : 978-984-96906-5-8

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ