আকিমুন রহমানের গল্প 'জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ' : এক ভুলমানুষের আখ্যান - মোহাম্মদ আলি

আকিমুন রহমানের গল্প 'জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ' : এক ভুলমানুষের আখ্যান - মোহাম্মদ আলি

মানবাংলার একচেটিয়া অত্যাচারে বাংলা কথাসাহিত্যের জান যায়-যায়। বাংলাসাহিত্য এখন রাজপথ থেকে নামতে নামতে এলাকার গলিঘুপচি বেয়ে কানাগলির দিকে প্রায়। নতুন আর কোনো পথ, নতুন গল্প বলা বা 'না-বলা'র পথ সে আর পাচ্ছে না; এক 'নতুন ভাষা'র নির্মিতি তাকে দিয়ে অসম্ভবপ্রায়। কথাসাহিত্যশিল্পের নতুনত্ব সাহিত্যিকের প্রধানতম অন্বেষা—এ কোনো নতুন বিষয় নয়। কে না জানে, শিল্পী নিজেকে দাঁড় করান তাঁর মাঠের অন্য অনেককে ভেঙে দিয়ে—অন্যের প্রতিষ্ঠিত চিন্তার ধরনকে নতুনত্ব দিয়ে, কিংবা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে। অন্যকে ভেঙে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যেমন, আবার নিজের প্রতিষ্ঠিত কর্মকে ভেঙেও নতুনকে সৃষ্টি করেন তেমনি। এটা তাঁর শিল্পঅহংকে পৃথিবীর কাছে জানান দেয়া যেমন, তেমনি রয়েছে শিল্পের কাছে তাঁর দায়বদ্ধতা জানানোর ভাবল্পটিও।

আকিমুন রহমানের অন্যান্য সৃষ্টিকর্মসহ 'জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ' গল্পবইয়ের নামগল্পটা পড়ে খুব শক্তভাবে ওপরের কথা-কয়টা মনে গেঁথে গেল। জানি, আমাদের অঞ্চলসংস্কৃতিবৈচিত্র্য অনেকের চাইতে উন্নত। অঞ্চলসাহিত্য এখানে দুর্ধর্ষ, মানুষের গভীরতম উপলব্ধির স্মারক এর ছত্রে ছত্রে। আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্য এখানে নরনারীর প্রেমপাগলামির চাইতেও দুরন্ত। কিন্তু মানবাংলার একচেটিয়া সম্রাটিপনার কাছে এখন পর্যন্ত পরাজিত তা। মধ্যবিত্তসৃষ্ট মূলধারার সাহিত্য দিয়ে এই কৌমসামাজিক চিন্তাকে ধাক্কা দিতে হবে। এই কথাগুলোর ধারক হয়ে আছে আকিমুন রহমানের 'জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ' নামীয় ৩২ পৃষ্ঠার গল্পটি। গল্পটির ভাষা অভিনব। গল্প বলায় আছে শিল্পচাতুরি। আছে গল্পের ঘটনা-উন্মোচন সবার শেষে। যে মহৎ ভাবের উদয় হয় গল্পশেষে তা অবিশ্বাস্য করুণার, তা প্রবল কান্নার ও নিদারুণ কষ্টের। মানুষ হয়ে দিন গুজরানোর বিষম প্রতিফল তা।

পাঠকমাত্রই জানা, লেখকের বয়ানভাষা অভিনব। এবং তা পুরাতনি কোনো বয়ানভাষা দিয়ে নয়, আকস্মিক ও নতুন বলার ভঙ্গি দিয়ে—নিজের কাছে তাঁর যে দায়, তা দিয়ে, বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পাঠকের দায় নিয়ে। তাঁর অন্যান্য রসসাহিত্যকর্মের চাইতে 'জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ' গল্পটা কিছুটা অন্যরকম। একই মলাটের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন ৬ গল্পে দারুণ এক ঐক্য ঘটিয়েছেন তিনি; যে ঐক্য আমাদের এখানকার গল্পসাহিত্যে দেখাই যায় না প্রায়। এই যে আমাদের উপরিতলের সহজ জীবনের মধ্যে ভুল জীবনগুলি ঠাসা আছে, এবং তা আমাদের জানাশোনার একেবারেই গণ্ডির ভেতরে এবং যাকে এতকাল উপেক্ষা করে আছে আমাদের সাহিত্য, তারই মিলমিশ আছে এই বইতে, এ গল্পগুলিতে। এ গল্পগুলির প্রধান চরিত্রের কেউ কেউ জন্মান্ধ, কেউ ল্যাংড়াখোড়া, মনোবৈকল্যধারী, কেউবা পাগল। এরা সবাই লেখকের 'জলের সংসারের ভুল বুদবুদ'।

বদ্ধোন্মাদ এক গ্রাম্য মেয়ে দিলরুবা। অভাব-অনটনের, বহু পরিবারসদস্যবিশিষ্ট এক মানুষ সে। ৪ বছর বয়স পর্যন্ত জলের সংসারের মানুষই ছিল সে। এরপর ঘটনাক্রমে রূপান্তরিত হয় ভুল বুদবুদে। আর ২২ বছর বয়সে যে তার মহা-লয় হবে, গল্পশেষে তা অনুমেয়।

গল্পটা কেমন একটা ভয়মেশানো, আমরা যাকে বলি ভয়ানক রসের। মায়ের সাথে ৯ মাসব্যাপী দিলরুবা যায় তার নানিবাড়ি। বাবার অভাবী সংসারে টিকতে না পেরে বছর-বছরে পরিবারটির এ ব্যবস্থা। দিলরুবার বয়স যখন ৪, একবার নানি তার মেয়ে, মানে দিলরুবার মাকে বলে নির্ধারিত সময়ের চাইতে একটু দেরি করে আসতে। কেননা, বাড়িঘর ঠিকঠাক তো করতে হবে।  শুনে বদরাগি মেয়েজামাই খেপে ওঠে। এ কেমন শাশুড়ি, মেয়েকে নাইওর নিতে চায় না, অলক্ষুণা! অভিশাপ দেয় সে। বিড়ম্বিত শাশুড়ি মেয়েজামাইকে হাতেপায়ে ধরে নির্ধারিত সময়েই দিলরুবা তার মা ও বড়ভাইসহ আসতে বলে তার বাড়িতে। ঘটনা ঘটতে দেরি হয় না মোটেও। ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা। শুকনা, খটখটা দিনে হুট করে ঝড় ওঠে। দুই ভাইবোন ভয় পেয়ে খেলা থেকে দ্রুতপায়ে ঘরে ঢোকার পরপরই ঠাটা পড়ে ভাঙচোরা ঘরে, যে ঘর তাদের আসার আগে আগে ঠিক করতে চেয়েছিলেন নিঃসঙ্গ নানি। দুর্দৈবে পড়ে দুই ভাই-বোন অজ্ঞান হয়ে যায়। বড় ভাইটি ঠিকই সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু দিলরুবা মাথায় বড়সড় ঘা নিয়ে সুদীর্ঘকাল অজ্ঞান হয়ে থাকে। এ দেখে পাড়াপ্রতিবেশীরা ধিক্কার দেয় নানিকে, কেন তারা মেয়েটাকে কবর দিচ্ছে না। একদিন জ্ঞান ফিরে পায় সে। কিন্তু মা আর নানি বুঝতে পারে, জ্ঞান না ফিরলেই বরং ভালো হতো তার। মস্তিষ্কবিকৃতি তাকে পেয়ে বসে, পা বেঁকে যায়, কথার শক্তি হারিয়ে ফেলে। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়। সবাই এক কথায় বলে—এভাবেই বাকি জীবনটা তার কাটাতে হবে। এলাকার কবিরাজি ডাক্তার হাল ছাড়েন না। তিনি বিধান দেন, এটা-ওটা করে পুকুরের পানিতে গলা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এবং তা যেনতেন সময়ে নয়, জমজমাট অন্ধকার থেকে ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত। এই ব্যবস্থার প্রথম দিন থেকেই দিলরুবা তার বন্ধুদের আহ্বান পায় ঐ ঘুটঘুট্টা অন্ধকারেই। প্রতিদিনই এরকম পায় সে। একদিন তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুকুরের পানি থেকে উঠে আসে। এ ঘটনার পর থেকেই সে পাগল হয়ে যায়। তার বন্ধুরা সে সময় থেকেই তার সঙ্গী হয়ে পড়ে। আর দিলরুবা হয়ে পড়ে অসহায়।  নির্দয় পৃথিবীতে বিচ্ছিন্ন এক মানুষ। যতদিন নানি বেঁচে ছিল তার যত্ন হয়েছিল, এর পরে যা হয় 'ভুল বুদবুদ'-দের—মা, বাবা, ভাইবোনরা তার মৃত্যুর জন্য অহরহ কামনা করতে থাকে। তার নানিও তাকে শিখিয়ে যায় কীভাবে তার নিজের মরণকে ডেকে আনা যায়। একসময় তার ২২ বছর পূর্ণ হয়। পরিবারসদস্যদের কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে তার গায়ে সার্বক্ষণিক বাঁধা শিকলটি আলগা হয়ে পড়ে। তার অশরীরী বন্ধুদের এদ্দিন বাধ্য হয়ে উপেক্ষা করতে হয়েছিল শিকল দিয়ে বাঁধা থাকার কারণে, এবার মুক্ত হয়ে তাদেরই প্ররোচনায় সে এক বাস ধরে চলে যেতে উদ্যত হয় কোনো এক দূরদেশে, যেখানে কেউই তাকে উৎপাত করতে আসবে না, সবাই তার ভাষা বুঝবে, সবাই তাকে সমাদর করবে।

ভুল মানুষ, ভুল সময়, ভুল সিদ্ধান্তে দিলরুবার যে কাল হল, আমরা বুঝি। সে তো স্বাভাবিক মানুষ হয়েই জন্মেছিল। অনেকগুলো ঘটনার শিকার হয়ে তার যে এ অবস্থা হয়, তা আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না। তাকে অবহেলার, তাকে উপেক্ষার, তাকে অযত্নের খুব খুব বয়ান আছে গল্পটাতে। এবং সেটা একবার লেখকের বয়ানের মাধ্যমে, আরেকবার দিলরুবার নিজের বয়ানে। কিন্তু পরিবারের লোকদের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বয়ানে তিনি যান না। দিলরুবার মন ও শরীরই তাঁর অন্বিষ্ট। এ এক আশ্চর্য কৌশল লেখকের। মানবাংলা ও আঞ্চলিক ভাষার মিশেলে নিজের বয়ান এগোয় একবার, তারপর চলে দিলরুবার নিজের মুখের বয়ান। আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপারে লেখকের চলন ধীরস্থির প্রথমে। ক্রমে তা চড়তে থাকে। আঞ্চলিক ভাষাতেই তিনি যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, পাঠ-অভিজ্ঞতা বলে, সে-ই স্বাভাবিক। কিন্তু লেখক এরপর খোলা তরবারি চালিয়ে, ক্রমে ক্রমে আঞ্চলিক ভাষাপ্রধান বয়ানে ঘটনা ও গল্পের মূলভাবকে চিত্রিত করতে থাকেন। এ শুধু অভিনব সাহিত্যকর্মই নয়, এক নতুন সাহিত্যচাঞ্চল্য তা।

গল্প-সময়কে ভেঙেচুরে, গল্পকে লম্ব-প্রতিলম্ব করে, কাহিনিকে নির্দিষ্ট একটা বিন্দুতে ঝুলিয়ে রেখে, শক্ত গাঁথুনি দিয়ে বলাতে লেখক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন—এ তাঁর কোনো নতুন করণকৌশল নয়; কিন্তু যে ধরনধারণ দিয়ে গল্পটিকে আমাদের মাধ্যমে পাঠ করিয়ে নেন, তা নির্বিষ নয় মোটেও, পাঠশেষে এক অন-উপম বিষব্যথা রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন তিনি—তা একই সাথে বেদনার যেমন, তেমনি আনন্দের—গল্পপাঠের আনন্দ তা, রস-আস্বাদনের আনন্দ তা।  

'কে না জানে সকল শেকলই জলের কাছে গিয়ে হেলেঞ্চার লতা হয়ে যায়'—এরকম একটা রোমহর্ষক কথার অনুরণন তুলে গল্পটি যখন শেষ হয়, তখন মহাকালের জমানো দুঃখমেঘ এই ভুলজন্মগুলির জন্য টপটপ করে পড়তে থাকে মন বেয়ে। যেন প্রতিটা বিন্দু বলতে থাকে, বলতেই থাকে—ভুল বুদবুদগুলি যদি অঙ্কুরেই নষ্ট হত তাহলে মহাকালকে খুব করে দোষ দিতে পারত না এই পৃথিবীর জলের সংসারের এই মানুষেরা।

-----------------------------------------------
জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ
আকিমুন রহমান

 
খড়িমাটি, চট্টগ্রাম
ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রচ্ছদ : জন মহম্মদ
মূল্য : ২৫০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ