বিশ্বজিৎ চৌধুরীর 'অভিযুক্ত' - বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুবিধাবাদীতা ও হীনম্মন্যতার মুখোশ উন্মোচন | আলমগীর মোহাম্মদ

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর অভিযুক্ত উপন্যাসের প্রচ্ছদচিত্র


বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে দেশের  মানুষের মধ্যে একটা ইতিবাচক উচ্চ ধারণা আছে। ছিলো। তবে ভবিষ্যতে সেই ধারণা কেমন থাকবে এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ আছে।  সন্দেহের উল্লেখযোগ্য কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ, পদ-পদবী, পদোন্নতির জন্য শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, শিক্ষকদের মধ্যে দলীয়করণ, একই মতাদর্শের শিক্ষকদের মধ্যে নানা উপ-গ্রুপে বিভাজন, ভাইস-চ্যান্সেলরের পদত্যাগের জন্য শিক্ষক সমিতির আন্দোলন, সাংবাদিক সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত দুর্নীতি নিয়ে হওয়া সংবাদ প্রতিবেদনের প্রদর্শনী আয়োজন, শিক্ষক নিয়োগে নগ্ন দলীয়করণ এবং শিক্ষকদের হাতে শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া ইত্যাদি বিষয়ের কথা আমরা সরাসরি বলতে পারি। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর  অভিযুক্ত এমন একটি উপন্যাস যার থিম খুঁজতে গেলে পাঠক উপরেল্লিখিত সবগুলো খারাপ বিষয়ের উল্লেখ পাবেন।  

একজন শিক্ষককে জ্যেতির্বিদের সাথে তুলনা করেছেন খলিল জিবরান। জার্মান প্রবাদে আছে, একজন শিক্ষক দুটি বইয়ের সমান। শিক্ষকতাকে এখনো সঙ্গত কারণে মানুষ সবচেয়ে সম্মানের চোখে দেখে। যদিও শিক্ষকরা ‘সম্মানজনক দারিদ্র্য’র শিকার তবুও তাদের আলোয় আলোকিত হচ্ছে সমাজ। মানুষ গড়ার এই কারিগরদের  শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ জীবনে নায়কের মতো লালন করে।  কথায় আছে, যিনি বিদ্যা দেন, তিনি স্তন্যও দেন। সেই বিদ্যাদাতা শিক্ষকের স্নেহ, মমতা, উতসাহ, অনুপ্রেরণা লাভের প্রত্যাশা প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই থাকে। একজন প্রকৃত শিক্ষকের সান্নিধ্য একজন শিক্ষার্থীর জীবনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনে। তবে, নিয়তির নিষ্ঠুরতম দিক হলো বাতির নিচেও অন্ধকার থাকে। একজন খুনীর খুনের ব্যাখ্যা হতে পারে নানা রকম, কিন্তু একজন নৈতিক স্খলনের দায়ে দায়ী শিক্ষকের কোনো ব্যাখ্যা বা যুক্তি থাকতে পারে না। ’চাঁদেরও কলংক আছে’ কথাটা আমরা মুখে আওড়াই ঠিক; কিন্তু মানি না,  বা আমাদের পক্ষে মানতে কষ্ট হয়। একজন শিক্ষক সমাজের কাছে চাঁদের মতো। চাঁদের আলো উপভোগ করে আমরা পুলকিত হয়। আর একজনের শিক্ষকের জ্ঞানের আলোয় আমরা আলোকিত হই। তাই তাঁদের চরিত্রে ‘কলংক’ থাকতে নেই।

 ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইরিশ কবি নিকিতা গিল তাঁর “লেখকরা ভয়ংকর মানুষ” কবিতায় বলেছেন, 

কখনো কোনো লেখককে নিশ্চিতভাবে /ভালো মনে করবেন না। /তারা স্নাইপার /শব্দ-সস্ত্রে সজ্জিত। /তাঁরা জানেন/ কিভাবে লক্ষ্য করতে হয় / বাক্যের মাধ্যমে, / কিভাবে প্রোজ্জ্বলিত করতে হয় /অনুচ্ছেদের মাধ্যমে, /এবং / কিভাবে তাঁদের দক্ষতাকে অক্ষয় রূপ দিতে হয়/ কবিতায়।

 

বিশ্বজিৎ চৌধুরী তেমন একজন লেখক। নাগরিক জীবনের অলিগলি হাতড়ে কলাম লেখেন মানুষের কথা তুলে ধরে। খুন ও আনন্দ কুসুম নামক একটা উপন্যাস লেখেন তিনি সম্প্রতি। সেটা পড়ার  মাধ্যমে  আমরা জানতে পারি তিনি নগরের মানুষের দুর্দশা নিয়ে ভাবেন। নাগরিক জীবনে ঘটে যাওয়া নানাবিধ দুঃখজনক ঘটনা, মানুষের মনের উপর লোভের প্রভাব, রিপুর তাড়নায় মানুষ কী জঘন্য আচরণ করতে পারে তার বাস্তব চিত্র দেখতে আমরা এই উপন্যাসে। সদ্য প্রকাশিত অভিযুক্ত কে আমরা সেই উপন্যাসের ধারাবাহিকতা বলতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের হীনম্মন্যতা, লাম্পট্য, নিজেদের মধ্যে হীন প্রতিযোগীতা, নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা, প্রয়োজন শেষে ছুঁড়ে ফেলা, যৌন হয়রানি, এবং শিক্ষক রাজনীতির নষ্ট দিক সাবলীলভাবে এই উপন্যাসে  চিত্রিত করেছেন লেখক।

'অভিযুক্ত' লেখা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। টাকা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ, দলীয় লেজুড়বৃত্তি, ভিসি হওয়ার জন্য  শিক্ষকদের লাগামছাড়া দৌড়, নিজেদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মারামারি লাগানো, আন্দোলন গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজে শিক্ষকরা প্রত্যক্ষভাবে ইন্দন যোগান। সে কথা লেখক তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে৷ সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা করা লোকজনের আসল রূপ উন্মোচিত করার কাজটাও যথাযথভাবে করেছেন লেখক। আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত, মুহম্মদ জাফর ইকবালের মহব্বত আলীর একদিন, গাজী সালেহ উদ্দীনের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আমি‘র সাথে  বিশ্বজিৎ চৌধুরীর 'অভিযুক্ত' নবতর সংযোজন।

বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা একজন তরুণ শিক্ষকের  ভারতে উচ্চ শিক্ষার্থে যাত্রা, সেখানে বছর তিনেক অবস্থান, নিগার নামের এক তরুণীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ানো, শারিরীক উদ্দামতার চূড়ায় পৌঁছে যাওয়ার পরিণতি হিসেবে নিগারের পেটে বাচ্চা আসা, দায়িত্ব নেওয়ার অনীহা থেকে এবোরশন করিয়ে নেওয়া, সেই প্রেমের সলিল সমাধি ঘটার কথা আমরা জানতে পাই উপন্যাসের শুরুর দিকে। শাহজাহান নামের এই উচ্চাকাঙ্খী অথচ লোভী শিক্ষকের পরবর্তী জীবনের ঘটনা জানতে পাই আমরা তাঁরই নিজস্ব ন্যারেটিভে। বাংলা বিভাগের খ্যাতিমান এই অধ্যাপক ভিসি হওয়ার দৌড়ে যখন অন্যদেরকে ফেলে উসাইন বোল্টের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই বাধ সাধে তারই একজন প্রিয় ছাত্রী, বিভাগের টপার দেবযানী। দেবযানী প্রফেসর সাহেবের প্রিয় ছাত্রী। সেই সুবাদে তাঁর বাসায় আসা যাওয়ার সুযোগ পান সেই শিক্ষার্থী।  ভদ্রলোকের নিঃসন্তান স্ত্রীর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা একসময় গড়ায় বিছানা পর্যন্ত। শুধু তাই নয় তাঁকে ‘প্রথম শ্রেণীতে প্রথম’ করার জন্য প্রফেসর সাহেব তাঁরই কোর্সের প্রশ্ন দিয়ে দেন ছাত্রীকে। ঘটনা এতটুকুতে চুকে যেতে পারতো। কারণ সেই শিক্ষার্থী প্রশ্ন পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে নিজ গ্রামে চলে যাওয়ার পরের ঘটনাই উপন্যাসের প্লটের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি অন্তঃসত্তা হলে শিক্ষক দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দেবযানী তাঁর কাছে সহযোগিতা চান অন্তত এবোরশন করার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে এগিয়ে আসতে। ভদ্রলোক তাতেও অসহযোগিত্তা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ণ প্রতিরোধ সেলে লিখিত অভিযোগ করেন সেই শিক্ষার্থী।

 ক্ষমতার লোভ দিনকে রাত বানায়, রাতকে দিন। কার্ল মার্ক্স তাঁর ‘লোভের টান’ তত্ত্বে ঠিক এমন কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছেন। ভিসি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা জনাব শাহজাহান আপাত দৃষ্টিতে খুব সংসারী ও স্ত্রী অনুগত হলেও তাঁর অন্তরে লুকিয়ে থাকা পশুকে তিনি বাগে আনতে পারেননি। যা তাঁর স্ত্রীর কাছে অবিশ্বাস্য  ঠেকেছে। দেবযানীর সাথে সাক্ষাতে তিনি সবকিছু পরিষ্কার জানতে পেরে ভদ্রলোকের কাছে কৈফিয়ত চান। অনুগত স্বামীর প্রতারণা মানসের সাথে আগে পরিচয় না থাকায় ভদ্রমহিলার জন্য  বিষয়টা একটা বড়ো মানসিক যাতনা হয়ে দাড়ায়। তিনি আত্মহত্যা করেন। এখানেও আমরা ক্ষমতাসীন শিক্ষকদের নোংরা মানসিকতার পরিচয় পাই । আত্মহত্যা করা স্ত্রীকে মানসিক ভারসাম্যহীন বা মানসিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন বলে চালিয়ে দেওয়ার সমস্ত আয়োজনে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক সাহেব ও তাঁর  সুহৃদ সহকর্মী জনাব রেজিস্ট্রার সাহেব।

শিক্ষক কতৃক শিক্ষার্থী নিপীড়িত হওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন  বিরোধী সেলে অভিযোগ জমা হওয়ার পর আমরা শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন, নিজেদের স্বার্থে একে অপরের বিরুদ্ধে আপাত নৈতিক অবস্থান নেওয়া, নিজ দলের শিক্ষককে বাঁচাতে জোট বেঁধে মিটিং করা, ক্ষমতাসীন ছাত্র নেতাদের ব্যবহার করে ন্যায় বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শারিরীক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করার মতো কলুষ দিকের সাথে আমরা পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই ধরণের হীন প্রতিযোগিতার কথা শুনে অভিযুক্ত অধ্যাপক সাহেবের অল্প শিক্ষিত অথচ নীতিবান বড় ভাইয়ের করা প্রশ্ন আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে মানুষ আসলে এত লোভী কেন?

কী আশ্চর্য ইউনিভার্সিটি টিচারদের মধ্যেই যদি এসব লাগালাগি থাকে, তাহলে শিক্ষিত- অশিক্ষিতের তফাতটা আর কী থাকল?


  তখন অধ্যাপক সাহেব বড় ভাইকে জবাব দেন,

স্বার্থের জায়গায় শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব সমান। কোনো তফাত নেই।


স্বার্থের প্রয়োজনে কতিপয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না।  বাইবেল সূত্রে আমরা সাতটি নারকীয় পাপের কথা আমরা জানতে পাই। ভারতের বিখ্যাত কবি বিজয় কান্তে ডুবের “দ্য সেভেন ডেডলি সিন্স” কবিতাটি উল্লেখ করা এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

“ নারকীয় সাত পাপ,/ এগুলো কি আবার, /জানো,/ সাতটি/ সংখ্যায় সাত?/ লোভ ব্যঙের,/ হিংসা সাপের,/ রাগ সিংহের,/  শ্লথগতি শামুকের,/  পেটুকপনা শূকরের, / লাম্পট্য ছাগলের,/ অহংকার ময়ূরের।/  এগুলোই সাত পাপ,/ নরকের সাত বোন, / বিশ্বজনীন বোন, রূপক?/  কিন্তু এখনো ব্যাপারটা  পরিস্কার নয়,/  আরো ব্যাখ্যা প্রয়োজন।“
( অনুঃ আলমগীর মোহাম্মদ)


অভিযুক্ত উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধ্যে আমরা উপরোক্ত বেশ কয়েকটি পাপের অস্তিত্ব খুঁজে পাই।   নীতিহীন শিক্ষক শাহজাহান ক্ষমসাঈন দলের দুইজন  ছাত্র প্রতিনিধিকে নিজেদের স্বার্থে সময়ে অসময়ে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে তিনি যখন শিক্ষক সমিতির নেতা ছিলেন। এই বর্ণনা আমরা পাই তারই নিজস্ব বয়ানে। উপন্যাসের শেষের দিকে একজন নেত্রীর বক্তব্য আমাদের সামনে লোভী, লম্পট, আদর্শহীন শিক্ষক শাহজাহানকে আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে;

 আপনারা নিজেদের স্বার্থে ছাত্রছাত্রীদের নানাভাবে ইউজ করেন। আর আমরা হইলাম ভেড়ার পাল। বুঝে না বুঝে…। ইউ আর ডিজার্ভিংলি একিউজড। আসি স্যার।



অভিযুক্ত  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করে। এই উপন্যাস যখন পড়ছিলাম তখন পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তঁর অধীনে গবেষণা করা এক ছাত্রী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছেন। শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছেন। বর্তমান যেনো উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রাজনীতি কতটা ভয়াবহ, শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে তাঁরা কতটুকু হীন আচরণ করতে পারেন, এবং শিক্ষকদের মধ্যে  রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কুৎসিত রূপ সম্পর্কে জানতে অভিযুক্ত পড়া জরুরি।

* আলমগীর মোহাম্মদ। শিক্ষক ও অনুবাদক। তিনি বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লায় ইংরেজি সাহিত্য পড়ান।

 

**********
অভিযুক্ত
বিশ্বজিৎ চৌধুরী

 
ধরন: উপন্যাস
প্রকাশকাল: ২০২৪
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১২৫
মূল্য: ৩৪০ টাকা
ISBN: 9789849869962

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ