কবিতার ইন্দ্রজাল পিয়াস মজিদের ‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ — অন্তর চন্দ্র

কবিতার ইন্দ্রজাল  পিয়াস মজিদের ‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ — অন্তর চন্দ্র

কবিতা বিষয়টি আমাদের কাছে অন্যরকম হয়ে গেছে। আমরা যে সময়টায় এসে পৌঁছেছি, সেই সময়টায় কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমার নিজের লেখাও অন্যের কাছে দুর্বোধ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। সে দোষ লেখককে দিব না। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায়, ‘যে-দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে , তার জন্য কবির উপরে দোষারোপ অন্যায়।’ কবিতার পাঠক হয়ে ওঠার যোগ্যতা হয়তো এখনো হয়ে ওঠেনি! তাই বলে যে কবিতা নিয়ে চিন্তা করতে পারবো না তা নয়। কবিতা বিষয়টিকে যত সহজ করে দেখা যায় আমার মতে ততই ভালো। আজকাল যে বিষয়টিকে আমরা কঠিন বলে ভাবছি কাল হয়তো সেটি‌ই সহজ বলে গণ্য হবে।

কবি পিয়াস মজিদ তাঁর ‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ কাব্যগ্রন্থে জীবনের আনুষঙ্গিকতাকে নানাভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এখানে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন প্রত্যেকটি বিষয় পাঠকের জন্য নতুন কিছুর সমাহার।  ‘আমি, তুমি, আপনি’ কবিতায় তিনি প্রশ্ন তুললেন নিজের প্রতি...

  বাজারে কি পাওয়া যায়
 ন্যায্যমূল্যে আমার নিঃশ্বাস?


এই দুটি বাক্যের মাধ্যমে তিনি পুরো কবিতাটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন। আমাদের চারদিকের মানুষজন হিংস্র হয়ে উঠছে। আজকাল মানুষ শব্দটি নিয়েও অনেক খামখেয়ালি প্রশ্ন থেকে যায়। মানুষের স্বভাব-চরিত্র পশুর চেয়েও অধম হয়ে যাচ্ছে। আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়ে গেছি? আমাদের পদে পদে বিপদ। আমরা এগোতে পারিনা, পিছন থেকে সবাই টানতে থাকে। তাইতো কবি বলেন যে শ্বাস নিতেও তাঁর অসুবিধা হচ্ছে। অমানুষের বিষাক্ত ছোবলে একটা সভ্যতা ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে বিশৃঙ্খলা প্রবণ মানুষজন। ভালো মানুষেরা সব সময় অমানুষের কবলে পড়ে জীবনকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ত রাখছেন।

এভাবেই মানুষ
ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে চলে
ঝোপ বুঝে কোপ মারে .....


এই যা দশা! কোথাও ঠিক মতো চলা যায় না। দিন দিন আধুনিকতার আলোকে উন্নত জীবন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে অথচ মানুষ হতাশায় ভুগছে। মানুষের মন থেকে অমানুষের ছায়া দূর করার প্রক্রিয়া আমাদের মনে তৈরি হয়নি। আমাদেরকে সেই আবছা ছায়াটি থেকে দূরে সরে আসতে হবে। কবি পিয়াস মজিদ মনে হয় আক্ষেপ করেই বলেছেন...

মানুষ, তুমি কেন আসলা
এই সাধের দুনিয়ায়—
খুশিতে না ঠেলায়?


এই কথা বললে আর পরেরবার কিছু বলার থাকে না। মানুষ সম্পর্কে যে ধারণাটি ইতিমধ্যেই উপস্থাপন করা হলো দ্বিতীয়বার বলে আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না। কবি তবুও মনে মনে ভাবেন যে সবকিছু যদি নষ্ট ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়, তবু মাটির ভাষা মাটির গান উকিল মুন্সী, লালন শাহ্, হাসন রাজা এদের জড়িয়ে সারা জীবন কাটাতে চান। বাংলা গানের জগতে বাউল এর মত চলে যেতে চান নিজের আত্মসন্ধানে। নিজেকে তিনি কাছে থেকে দেখতে চান। বাড়ির পাশে সেই আরশিনগরের আয়োজনে মেতে থাকতে চান। এখানেই কবি সত্তার পূর্ণ অভিপ্রায়। কবি সুখ চান না দুঃখ চান, মৃত্যু চান না অমৃত চান, সফলতা চান না সার্থকতা চান। কবি মনের দোলায় দোলায়িত হতে থাকে শৈল্পিক ব্যঞ্জনার অনুভূতি।

রাস্তাকে হাতে রাখতে হলে
পায়ে পায়ে খোঁজ নিতে হয়।


জীবনের অস্থিতে অস্থিতে দ্রোহ। সেখান থেকে উদগীরনের পথ খুঁজে ফিরে কবির সংসার। ‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে যে কবিতাগুলো গ্রন্থিত হয়েছে তা পাঠক হৃদয়ে ভিন্নমাত্রার অনুভূতি যোগাতে সক্ষম। পাঠক কবিতায় রসাস্বাদনে যে সময়টুকু ব্যয় করবেন তা পাঠক হৃদয়ে প্রথম প্রথম বোঝা বলে মনে হবে এবং পরবর্তীতে যখন বারবার পড়ার চেষ্টায় থাকবেন ঠিক তখন পাঠকের মনে ভিন্নমাত্রার ব্যঞ্জনা শুরু হয়ে যাবে। মনে হবে এখানেই যেন শেষ নয়। কবি মানুষের চারদিকটা যেভাবে উপস্থাপন করলেন, তাতে সুন্দরের বিচ্ছুরণ যাথাসাধ্য প্রকাশ পেয়েছে।

ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি
মনে আসা হু হু বেয়ে
বিস্মৃতিও এতটা সুন্দর
পার্পল-প্রহেলি;


কবি তাঁর গ্রন্থের নামকরনের ব্যাখ্যাটা যেভাবে তিনি দিলেন সেটা অনেকটা কঠিন আবার অনেকটা সহজ। খুব ছোট্ট একটি কবিতায় অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য-কল্পের মাধ্যমে কবিসত্তাকে তুলে এনেছেন। এখানে তিনি হতাশার কথা তুলে ধরলেন। নিজের থেকে তিনি কেন ছিটকে পড়লেন এও প্রশ্ন থেকে যায়? কবিরা কি সবসময় ছিটকে পড়বে? শব্দের দোলায় ধাবমান কালচক্রে সাম্প্রতিক শব থেকে কি আমাদের বেরিয়ে আসার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে? একজন কবি কতটা হতাশায় ভুগলে নিজেকে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। কেন তাঁর কাছে সবকিছু মিথ্যা মনে হয়! আসলে কবি কি চাচ্ছেন তা পরিষ্কার নয়। সব সময় যে তিনি দুঃখের বোঝা বয়ে বেড়াবেন এমনটা নয়! যতদূর সম্ভব, ‘কবি’ কবিতায় তিনি নিজেকে একটা স্তম্ভে দাঁড় করে রেখে বিচার করতে চাইছেন।

‘হাসপাতাল থেকে’ কবিতায় তিনি যে অনুভূতি ব্যক্ত করলেন তা সাধারণত একজন ভীষণ অসুস্থ রোগীর হাসপাতালে ঢুকে আহাজারি করা পরে প্রেসক্রিপশন, সিরিয়াল, ইনভেস্টিগেশন, ডেলিভারি ইত্যাদি শেষে  সুস্থ সবল জীবন নিয়ে আবার নতুন করে শুরু করাকে দেখিয়েছেন। এই কবিতার কেন্দ্রবিন্দু হাসপাতালকে তিনি ‘হাঁস’ শব্দটির চন্দ্রবিন্দু না থাকা নিয়ে মাটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা পাতাল বলে অবিহিত করলেন। কারণ সেখানে মানুষের আহাজারি, হাহাকার, কান্না সব সময় লেগে থাকে, ঠিক তেমনি সুচিকিৎসার ফলে জীবন ফিরে পাওয়া যায়। এবং পরবর্তীতে সেই মানুষটি হাঁসের মতোন ত‌ই ত‌ই করে ছুটে বেড়ান এদিক-ওদিক। এই কবিতায় শুধু হাসপাতাল না, কবিতার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ফুটে উঠেছে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অসম্ভব পরিস্থিতি। আসলে, পুরো কবিতাটা জীবন দর্শন নিয়ে লেখা। যদিও তিনি হাসপাতালের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন কিন্তু আদতেই এটা হাসপাতাল নিয়ে নয়! পৃথিবীতে আমরা সাধারণত যেভাবে  যাপন করছি তাঁর একটা লৌকিক চিত্র।

‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ এই কাব্যগ্রন্থটিতে বর্তমান সময়ের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। আমাদের চলাফেরা থেকে শুরু করে যাপন অবধি প্রত্যেকটি জিনিস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সমাজে বর্তমান সময়ে যা হচ্ছে, তাঁরও একটা রূপায়ণ দেখতে পাই পিয়াস মজিদের কবিতায়। কবিতা পড়ার আগ্রহকে পাঠকের হৃদয়গ্রাহী করতে এরকম সব কবিতা অনায়াসেই পাঠকের মনোজগতে তোলপাড় তোলে। যদিও বর্তমান সময়ের কবিতা পাঠে পাঠকের মনে একটা অস্বস্তিকর বোধ কাজ করে। কিন্তু ‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ একদম সেই ধারণাটা পাল্টে দিয়েছে। যদিও এখানকার কবিতাগুলো খুব গভীরতম ভাবনার সাথে জড়িত। তবুও কবিতাগুলো একজন সাধারণ এবং সচেতন পাঠকের চিন্তাধারাকে সুদৃঢ় করে তুলবে।

আমরা বর্তমান সময়ে কবিতা নিয়ে যে বাক্যগুলো সদা-সর্বদা শুনতে পাই, তাতে আমাদের সাধারণদের ভিতরে একটা অস্বস্তিকর বোধ জন্মে। এটা কথা ঠিক যে কবিতা সব সময় এক থাকবে না, প্রত্যেকটি বস্তুরই পরিবর্তন অনিবার্য। এই সময়কার কবিতা নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাই না।

দেখা যাচ্ছে, আমরা কাউকে ঠিকঠাক মূল্যায়ন করতে পারি না। এবং কেউ যদি কাউকে মূল্যায়নও করে তবে সেই ব্যক্তিকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টায় থাকি। এই রোগটি আমাদের মাঝে যতদিন থাকবে, আমরা ততদিন এগোতে পারবো না। ‘ডেড পয়েটস সোসাইটি’ কবিতায় কবি দুঃখ নিয়ে বললেন...

পৃথিবীর ০১ কবি
আর ০১ কবিকে
০২ পয়সার দামও দেয় না।


এই একই কথা আমরা ১৫ শতকের একজন হিন্দি কবি তুলসীদাসের কবিতায় পাই। তিনি সেই সময় বলেছেন,

“স্বরচিত সরস-নিরস কবিতা সকলেরই ভালো বলেই মনে হয়। ‌ কিন্তু অপরের লেখা কবিতা শ্রবণ করে আনন্দ অনুভূতি লাভ করেন এমন সজন ব্যক্তি তো জগতে বিরল।”


কিন্তু তাই বলে যে, কবিরা থেমে থাকবেন তাও নয়! নিঃস্বার্থভাবে কবিতার সাধনা করে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় থাকেন একজন কবি। কবিদের কখনোই থেমে থাকা শোভা পায় না। কবিতা তো সেই জীবন বিন্দুরই একাংশ।

পৃথিবীর কবিরা গোপনে
এপিটাফের মতো
০১টা-০২টা কবিতা লিখে জমায়
জঘন্য জীবন শেষে
যেন মৃত্যুর পর তার কবরটা
একটু আলাদা দেখায়।


কবি কিছুই চান না, কার‌ও ভালোবাসার‌ও অপেক্ষায় থাকেন না। শুধু কবিতার জন্ম দিতে দিতে কয়েকটা প্রজন্ম ভোগ করেন। এখানেই কবির সার্থকতা। সব ব্যর্থতাকে সময়ের কাছে এনে প্রশ্ন করে বসেন এবং নিজেই সেই প্রশ্নের উত্তর রূপে আবির্ভূত হন। কাঁচা কাঁচা ব্যর্থতা নিয়েই পরিপক্ক যাপনের সুখ খোঁজেন। 


‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ বইটি পড়ার সময় প্রথমে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। এই বইটায় কয়েকটি কবিতা শুধুমাত্র দুই লাইনের। প্রত্যেকটি লাইনে এতটাই গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে আছে যা পাঠকের মনোজগতে ছাপ রেখে যেতে সক্ষম। স্বল্প কথায় বিশ্লেষণ করা যদিও কঠিন হয়ে পড়ে তবু একজন কবির কাছে এটি জটিল ব্যাপার নয়! তাইতো পিয়াস মজিদ পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন। তাঁর কবিতায় একদিকে যেমন প্রেমঘটিত ব্যাপারগুলো এসেছে ঠিক তেমনি জীবন যাপনের একটা স্ট্রাকচার দেখতে পাচ্ছি। সবমিলিয়ে পুরো বইটা ভিন্নমাত্রার ব্যঞ্জনা তৈরি করতে সক্ষম।


**********
ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি
পিয়াস মজিদ


প্রকাশক: ঐতিহ্য
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ( দ্বিতীয় মুদ্রণ)
মূল্য: একশত আশি টাকা।
ISBN : 978-984-776-945-5
পৃষ্ঠা: ৭২

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ