নাহার তৃণা অনূদিত 'সুলা' | টনি মরিসনের বিচরণ - নৈতিকতার দ্বান্দ্বিক সমচ্ছেদে - দীপেন ভট্টাচার্য

নাহার তৃণা অনূদিত 'সুলা'


 

বিংশ শতাব্দীর কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন কবি ল্যাংস্টন হিউজ লিখেছিলেন,
 

আমি চিনেছি বহু নদী,
আমি চিনেছি সেসব নদী যারা পৃথিবীর মতো প্রাচীন
                        আর মানব শিরায় মানব রক্তের চেয়ে যারা পুরোনো,
আমার আত্মা হয়েছে নদীর মতো গভীর।


নদীর মতো গভীর একটি রেখা, সাহিত্যের একটি রেখা, বয়ে চলে পৃথিবীর ইতিহাসের মধ্য দিয়ে আমাদের সবাইকে একটি নিগড়ে বেঁধে। সেই সুবর্ণ শৃঙ্খলে বাঙালী পাঠকও নিজেকে বেঁধে নেন, পরিচিত হন কোন সুদূরের এক সমাজের সাথে। ল্যাংস্টন হিউজের হৃদয় টনি মরিসন ধারণ করেন, কিন্তু হিউজের সরল কাব্যিক গভীরতাকে উত্তোরণ করেন এক আপোষহীন গদ্যে যে গদ্য পাঠককে সহজে স্বস্তি দেয় না। মরিসনের এই ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা ইচ্ছাপ্রোণোদিত, তিনি স্বঘোষিত মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নারী মানসের প্রতিনিধি, কিছুটা হয়তো সার্বিক নারী মননের উপস্থাপক। তাঁর লেখা একটি নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থানকে চিত্রিত করলেও সেটি হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন, তাই এই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মানুষটি আধুনিক সময়ে বিশ্বসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত। নাহার তৃণার এই অনুবাদটিও তাই মূল্যবান।

অনেকেই মনে করেন সময়ের হিসেবে বিংশ শতাব্দীর মার্কিন সাহিত্যে উইলিয়াম ফকনারের পরে টনি মরিসন হলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক, কিন্তু শুধু লেখক হিসেবে নয়, তাত্ত্বিক সাহিত্য-সমালোচনায়ও তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। আমরা কথা বলি, কথা লিখি, আমাদের জীবনের মূল্য সেই কথার ভাষাই নির্ধারণ করে দেয়। মরিসনের মতে ভাষার দখলদারিত্ব যার হাতে থাকবে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সমাজ, আইন, শিক্ষা। লেখকের কর্তব্য হল সেই নিয়ন্ত্রণ খর্ব করা, ভাষা দিয়ে জীবনের বৈচিত্র‍্য, জীবনযাপনের পার্থক্য তুলে ধরে একক নিয়মের কর্তৃত্বকে ভেঙে ফেলা। তাই তাঁর ভাষাকে তিনি কীভাবে উপস্থাপনা করবেন এবং সেটি কীভাবে ব্যবহৃত হবে তা নিয়ে মরিসন চিন্তিত ছিলেন। ভাষার বিশেষ ব্যবহারে তিনি তাঁর চরিত্রদের মধ্য দিয়ে নারীত্বকে প্রকাশ করেছেন, প্রকাশ করেছেন তাঁদের কৃষ্ণাঙ্গতা, আবার কোন সময়ে বর্ণ উহ্য রেখেছেন, আর এসবই করেছেন মার্কিন দেশের জটিল সামাজিক দর্পণের পাত্রে। তাঁর কাছে ভাষা ছিল আধ্যাত্মিক সাধনার উপাদান, তাঁর নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন -

Language alone protects us from the scariness of things with no names. Language alone is meditation.

      
টনি মরিসন Random House প্রকাশনা সংস্থায় একজন জ্যেষ্ঠ এডিটর হিসেবে কাজ করতেন, দুটি সন্তানের ভরণপোষণেরও ভার ছিল, দিনের বেলা কাজ করে রাতে গল্প লিখতেন তাঁর মত মানুষদের নিয়ে। কিন্তু তাঁর প্রথম উপন্যাস The Bluest Eye প্রথমে প্রায় অলক্ষিতই থেকে গিয়েছিল। সাহিত্যে মূল মার্কিন ধারা বলতে যা বোঝায় সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ লেখনীর যে ভিন্নতা এবং বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের অস্তিত্বকে স্থাপন করানো কঠিন ছিল। কিন্তু মরিসন তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যিক পরিচয়কেই তুলে ধরতে চেয়েছেন পৃথিবীর কাছে, সেই পরিচয়টা ছিল তাঁর কাছে মুখ্য, তাঁর প্রতিটি লেখাই সেই সাক্ষ্য বহন করে। এই কাজটি তিনি করেছেন অতীব গুরুত্ব নিয়ে, একটা তাত্ত্বিক পটভূমি সৃষ্টি করে। বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে একক ব্যক্তির দ্বন্দ্ব এবং সেই ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করার প্রক্রিয়ায় সামাজিক প্রথাকে লঙ্ঘন করার জন্য সেই ব্যক্তির যে স্পৃহা সেটি তাঁর লেখায় বারে বারে এসেছে। এই দ্বান্দ্বিক কাঠামোতে যেমন শ্বেতাঙ্গ সমাজের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে, তেমনই আছে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের ওপর আরোপিত রীতিনীতির সঙ্গে আভ্যন্তরীন সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ কোনোভাবেই প্রীতিকর বলা যাবে না, টনি মরিসন পড়তে গিয়ে পাঠকের মধ্যে কদাচিৎ প্রীতির ভাব উদয় হবে। এর মূল কারণ হল মরিসন তাঁর কাজের প্রতি সৎ থেকেছেন, সত্য থেকে নিজেকে কখনই ফিরিয়ে নেননি।

বাঙ্গালী পাঠকের জন্য টনি মরিসনের রচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগতকে নিয়ে আসবে। ঊণবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও বিংশ শতাব্দীর একটা বড় অংশ জুড়ে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ তার সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। ইতিহাসের সেই বঞ্চনা ওই সমাজকে এমন গভীরভাবে আঘাত করে যে তার উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হয়, মরিসনের আখ্যান এই প্রেক্ষাপটে রচিত। কিন্তু সেটি কোনো রাজনৈতিক নথি নয়, বরং সত্যের সুতো থেকে সূক্ষ্ণভাবে বোনা এক জটিল নকশি কাঁথা যা কিনা কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ ও তার অনুষঙ্গ হিসেবে শ্বেতাঙ্গ সমাজের স্তরগুলোকে একে একে উন্মোচন করেছে। তাঁর চরিত্ররা পরিশীলিত নয়, তাঁদের আবেগ আদিম, তাদের দুর্বলতা হৃদয়বিদারক, অসহায়তা অসহনীয়। মরিসনের অন্বেষণে এই জটিল নকশি বুননের এক পাশে আলো, অন্য পাশে অন্ধকার, যেখানে নিপীড়ণের আইডিয়া ছাড়িয়ে কৃষ্ণাঙ্গ-মার্কিন অভিজ্ঞতার এক বহুমাত্রিক বর্ণালী উপস্থাপনা রচিত হয়েছে, যাকে transcendental বলা যায়। সেখানে একদিকে রয়েছে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব, প্রেম, হঠকারি সিদ্ধান্ত অথবা বিশ্বাসঘতকতা, অন্যদিকে আছে পারিবারিক ও সামাজিক গতিময়তার মধ্যে সমন্বয় ও সংঘর্ষ। আমার বিশ্বাস এই অনুবাদ বইটি আমাদেরকে অনেক বাঁধাধরা ধারণার বাইরে নিয়ে আসবে, বাঙালী পাঠকের জন্য এটি যেমন প্রাসঙ্গিক তেমনই প্রয়োজনীয়, তাঁর নিজের সমাজটিকে আতস কাচ নিয়ে দেখার জন্য।

নাহার তৃণা টনি মরিসনের ‘সুলা’ উপন্যাসটি বাংলা ভাষার পাঠকের জন্য অনুবাদ করেছেন।  ‘সুলা’ উপন্যাসটি আফ্রিকান-আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়। উপন্যাসটি ১৯৭৩ সনে প্রকাশিত, দুজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী সুলা পিস এবং নেল রাইটের বন্ধুত্ব ও দ্বন্দ্বকে ঘিরে, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের কাহিনী। তাঁর চরিত্রদের দ্বৈততা অন্বেষণ করতে গিয়ে মরিসন দেখিয়েছেন বন্ধুত্ব কেমন করে একই সাথে মুক্তি এবং বাধার উৎস হতে পারে। এখানে ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে নীতিগতভাবে ঠিক বা বেঠিকের প্রশ্ন এসেছে – ‘ভালো’, ‘মন্দ’, ‘বন্ধুত্ব’, ‘ভালোবাসা’ এই সব বোধের অর্থ কী হতে পারে সেসব প্রশ্ন জাগবে, একজন দক্ষ গল্পকার হিসেবে এর উত্তর দার্শনিক যুক্তির আকারে মরিসন দেননি, পরিবর্তে তাঁর চরিত্র চিত্রায়ণে চিন্তার খোরাক রেখে গেছেন। কারণ শেষ পর্যন্ত জীবন রৈখিক নয়, এথিক্সের প্রশ্নেও অনেক সময় সঠিক উত্তরটি জীবনে প্রযোজ্য হয় না।

উপন্যাসটিতে নেল সামাজিক নিয়ম এবং প্রত্যাশা মেনে চলে যেখানে সুলা সেসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, প্রায়শই এমন আচরণ করে যা শহরের রক্ষণশীল মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে। সুলার জীবনে পাঠক পাবেন এক ধরনের অসঙ্গতি, কিন্তু মনে করা যেতে পারে সেটি তার আত্ম-আবিষ্কারের পথে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে অর্জন করার জন্য বিদ্রোহ, একজন নারী যিনি সামাজিক বিধিনিষেধকে অস্বীকার করে নিজের ইচ্ছাকে অনুসরণ করছেন। নাহার তৃণার অনুবাদে সুলার চরিত্রটি আমাদের কাছে মূর্ত – 

 

সুলা অন্য সবার চেয়ে একেবারেই আলাদা। তার মধ্যে ইভার গোয়ার্তুমি এবং হান্নার স্বেচ্ছাচারিতা দুটোরই সহাবস্থান রয়েছে। এছাড়া রয়েছে তার অদ্ভুত সব কল্পনা বিলাস, সে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতা কিছু চিন্তাধারা আর আবেগ নিয়ে দিন কাটায়। কাউকে খুশি করার প্রয়োজনবোধ করে না, যেটা তার নিজেকে আনন্দ দেয় সে তাই করে। সে যদি কষ্ট পেতে চায়, তাহলে কষ্ট পাবার পথ বের করে, সে যদি আনন্দ পেতে চায়, তাহলে আনন্দের পথ খুঁজে নেয়।

নৈতিকতা এবং সামাজিক নিয়মের সীমানা সম্পর্কে কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন করে মরিসন আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন সঠিক ও ভুলের জটিলতা বিবেচনা করতে, নৈতিক বিধিমালার সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে।

মার্কিন একাডেমিক মহলে সুলা উপন্যাসটি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। ‘Form Matters: Toni Morrison’s Sula and the Ethics of Narrative’ নামে একটি গবেষণাপত্রে Alex Nissen লিখেছেন যে, মরিসন লেখার জন্য যে গঠনটি বেছে নিয়েছেন যেখানে কিছু নৈতিক প্রশ্নের পরোক্ষ উত্তর রয়েছে, যেমন কীভাবে মানুষ সমাজে একসাথে বেঁচে থেকে জীবনের নানান অনিশ্চয়তা এবং শূন্যতার মোকাবিলা করতে পারে। নৈতিকতার জন্য কোন ভিত্তিটি শক্তিশালী – ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, নাকি সমাজের সাধারণ নৈতিক শর্তাবলি? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাঠক মরিসনের লেখার সাথে এমন একটি ব্যাখ্যানির্ভর প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়বেন যেখানে তিনি বুঝতে পারবেন দৈনন্দিন জীবনে সঠিক নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়াটা সব সময় সহজ নয়।
     
‘সুলা’র কাল্পনিক শহরে মানুষের জীবনে বর্ণবাদ, দারিদ্র্য এবং সামাজিক প্রত্যাশার প্রভাব বর্তমান। এই প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটিকে বিংশ শতাব্দীর কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সমাজের সামগ্রিক সাফল্য ও ব্যর্থতার রূপক হিসেবে গণ্য করা যাবে কি না জানি না, তবে ব্যক্তি ও ব্যক্তি এবং ব্যক্তি ও সমাজের সমচ্ছেদে যে সংঘাত সৃষ্টি হয় সেটি সর্বজনীন, সেই আবিষ্কার আমাদের জন্য এখানে অপেক্ষা করছে। সেই সংঘাতগুলো অনেক সময় বর্ণিত হয়েছে কিছু করুণ হিংস্র ঘটনার মধ্য দিয়ে যে ঘটনাগুলোকে মরিসন সাহিত্যের যন্ত্র (ডিভাইস) হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার মধ্যে একটি, ছোটবেলার এক মর্মান্তিক ঘটনা, যার জন্য সুলা এবং নেল দুজনেই দায়ী ছিল, নৈতিকতার প্রশ্নে এই উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেয়।  এই প্রক্রিয়ায় মরিসন যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা একাধারে কাঁচা ও কাব্যিক, প্রাণবন্ত ও উদ্দীপক। সেই ভাষাকে ভাষান্তরিত করা সহজ নয়, নাহার তৃণা অত্যন্ত মুন্সীয়ানায় তা করতে পেরেছেন।     

তাঁর নোবেল বক্তৃতায় টনি মরিসন এক জায়গায় বলেছিলেন –

 

আমরা মারা যাই। সেটাই হতে পারে জীবনের অর্থ। কিন্তু আমরা ভাষাও করি (ভাষার চর্চা করি)। সেটা হতে পারে আমাদের জীবনের মূল্যায়ণ।

 

মরিসনের কাছে ভাষার ব্যবহার খুব মূল্যবান, সেটির অনুবাদও। নাহার তৃণা সেই দুঃসাহসিক কাজে ব্রতী হয়ে আমাদের কাছে সফলতার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মরিসনের কাজ।

**********
বই: সুলা
মূললেখক: টনি মরিসন
অনুবাদ: নাহার তৃণা



প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: কবি প্রকাশনী
আইএসবিএন: 978-984-98813-7-7
মূল্য: ৪০০টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ