ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী নদিয়া, হুগলী ও পূর্ব বর্ধমান জেলার মিলনস্থল অম্বিকা কালনা। ইতিহাস- সূত্রে জানা যায়- সেখানকার উপাস্য দেবী অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতার নামানুসারে অম্বিকা কালনা নামকরণ হয়েছে। অনেকেই, ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এই শহরকে- 'মন্দিরের শহর' নামে অভিহিত করে থাকেন। এখানকার রাজবাড়ি ও ১০৮ শিবমন্দির পর্যটকদের সবিশেষ আকর্ষণ হিসাবে সুখ্যাত। রাজবাড়ি প্রবেশপথের বাঁদিকে টেরাকোটা কারুকার্যে নির্মিত সুবিশাল খাঁজকাটা গম্বুজাকৃতি প্রতাপেশ্বর মন্দির। এই মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা শিল্পকর্ম থেকে এই গ্রন্থের প্রচ্ছদচিত্রটি নেওয়া হয়েছে।
ভূমিকা
বিচিত্র অভিজ্ঞানে বাংলা কবিতার ভাণ্ডার আজ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। হে ঈশ্বরপ্রতিম পাঠক, আমরা পাঠ করতে পারি আমাদের অতীত অভিজ্ঞান; যে- অভিজ্ঞানের আলোতে হয়তো আমাদের কুহেলিকাময় পথ সরল হয়ে উঠতে পারে। আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও প্রত্নকথার জ্ঞানের দীপ্তিতে হয়তো উঠে আসতে পারে নব-চেতনার উন্মেষ। এই প্রজ্ঞা ও মননে স্থিতধী হয়ে কবি অমিতাভ গুপ্ত অন্তরস্থিত আত্মার আকুতি ও আর্তনাদ কবিতার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করে চলেছেন। কখনো-বা তীক্ষ্ণভাবে তীরবিদ্ধ করেছেন আমাদের মস্তিকের ক্ষয় ও পতনকে। কখনো-বা অতীত ইতিহাসের প্রেক্ষিতে আমাদের চৈতন্যকে নতুন আলোতে আলোকিত করেছেন তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সপ্তপর্ণী গ্রন্থমালার চতুর্দশতম পুঁথি-পরিচয়ে কবি অমিতাভ গুপ্তের এগারোতম কাব্যগ্রন্থ 'গৌরীপট' (ছাতিমতলা প্রকাশনী) প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটির 'শ্রম', 'মায়া' ও 'লীলা' শীর্ষক তিনটি অংশ সম্পর্কে প্রথম সংস্করণের 'নিবেদন' অংশে কবি লিখছেন-
ঐতিহ্যের প্রতি ইতিহাসের প্রতি মহাবিশ্বকালের সামগ্রিক সংশ্লেষণের প্রতি অপ্রতিরোধ্য কোনো আকর্ষণ থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল এ' তিনটি পালাগান।
তবে এই তিনটি পালাগানের সাদৃশ্য এই যে, তিনটিরই কেন্দ্রীয়ভূমি প্রত্নকথা। 'শ্রম'-এ এসেছে জরুৎকারের কাহিনি, 'মায়া'-য় এসেছে কচ ও দেবযানীর কাহিনি এবং 'লীলা'য় এসেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও ছোটগল্পের ছত্রিশটি চরিত্র- যারা মর্ত্যপৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাদের কাহিনি।
'গৌরীপট' কাব্যগ্রন্থে উৎপাদন-ব্যবস্থায় শ্রমনিয়োজনের পদ্ধতি সম্পর্কে আদি প্রত্নকথাকে অবলম্বন ক'রেই 'শ্রম' পালাগানটি রচিত হয়েছে। নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের পাশাপাশি এই আখ্যানের সঙ্গে কবি সচেতনভাবে যোগ করেছেন নাগজাতির সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদীর বিবাদের বিষয়টিও। কিন্তু, সমস্ত বিবাদ ভুলে কবি মানবিক প্রেমের জাগরণ চেয়েছেন, প্রসঙ্গত জরুৎকারের কথাতেই সেই বার্তা উঠে এল:
হয়ত প্রেমই দিগন্তের বধূ
হয়ত প্রেমই দিনান্তের চাওয়া
যখন সব দীপ্ত অবসান
সিঁদুর হয়ে ওঠে
ধূসর অতীত থেকে মানুষের কল্পনা যখন রোম্যান্টিক প্রাক্-ইতিহাসের যুগে প্রবেশ করছে, সেই প্রত্নকথা 'মায়া'য় লক্ষ করা গেল। যে-প্রত্নকথার মুখ্য চরিত্র হলো মহাভারতের কচ ও দেবযানী। প্রত্নকথায় দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র হলেন কচ আর অসুরগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা হলেন দেবযানী। শুক্রাচার্যের কাছে ছদ্মবেশে কচ মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শিখতে এসে বুঝতে পারেন- দেবযানীর সাহায্য ছাড়া এই বিদ্যালাভ অসম্ভব। ফলত, নিজ স্বার্থচরিতার্থে গুরুকন্যা দেবযানীর সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের সম্পর্কে জড়ান, কিন্তু দেবযানী তার সমস্ত সত্তা দিয়ে কচকে ভালোবেসেছেন। প্রতিমুহূর্তে শুক্রাচার্যের হাত থেকে কচকে রক্ষা করেছেন। এমনকি দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যালাভের সুযোগ তাঁকে দিয়েছেন। কিন্তু, বিদ্যালাভের পরই কচ প্রেমের সম্পর্ক অস্বীকারই ক'রে দেবযানীর ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি কোনো ঋষিকুমার দেবযানীকে বিয়ে করবে না এমন নির্দয় অভিশাপ দিয়ে কচ পুনরায় দেবলোকে ফিরে যান। দেবযানীও অভিমানে কচকে অভিশাপ দিয়েছেন। তবে রবীন্দ্রনাথের 'বিদায় অভিশাপ' কবিতায় দেবযানীর প্রতি কচের নিষ্ঠুরতা দেখা যায়নি। কচ বিদ্যালাভের পর দেবযানীর প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করে অভিশাপ নয় বরং আর্শিবাদ দিয়েছেন। ফলত 'বিদায় অভিশাপ' কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাতের কারণে কচ চরিত্র অনেকাংশে নিষ্কলুষ হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ কচ চরিত্রের পুনর্নির্মাণ করেও দেবযানীর যন্ত্রণার কথা এড়িয়ে গেলেন। ফলত, প্রত্নকথার ভাবধারায় আস্থা রেখে দেবযানীর উক্তিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন- 'তোমা 'পরে। এই মোর অভিশাপ- যে বিদ্যার তরে। মোরে কর অবহেলা সে বিদ্যা তোমার/ সম্পূর্ণ হবে না বশ, তুমি তার/ ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোেগ,/ শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।' অন্যদিকে অভিশাপ বাণী শোনবার পর কচ বললেন- 'আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে। ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে'। রবীন্দ্রনাথ প্রত্নকথার বিনির্মাণে কচ কতটা উদার ও মহৎ দেখানোর জন্য সচেষ্ট হলেও, দেবযানীকে প্রত্নকথার মধ্যে আবদ্ধ রেখে নারীর প্রতি বঞ্চনা করেছেন ব'লেই আমাদের মনে হয়। কিন্তু, প্রত্নকথার গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায়- নিজস্বার্থের জন্য কচ প্রতিমুহূর্তে দেবযানীকে ব্যবহার করেছেন। কচের জীবন ফিরে পাওয়া ও মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যালাভ দেবযানীর ভালোবাসার ওপর ভর ক'রেই কচকে অর্জন করতে হয়েছে। কিন্তু, বিদ্যালাভের পর দেবযানীর ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যানই নয়, অভিশাপ দিয়ে কচের পুনরায় স্বর্গলোকে ফিরে যাওয়ার মধ্যে বর্ণভেদে দেবযানীর বঞ্চিত হওয়ার প্রশ্নই কি সূচিত হয় না আমাদের মনে? যে তাড়নায় নারায়ণ মণ্ডল-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কবি অমিতাভ গুপ্ত বলেন-“রবীন্দ্রনাথের 'বিদায় অভিশাপ' পড়ার পর নিদারুণভাবে আহত ও অভিমানে বিদ্ধ হই। পুরাণকথায় দেবযানী আরও সংকুচিত। 'মায়া'-র নির্মাণ সেই অভিমান থেকেই, একথা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত নই।” ফলত, অমিতাভ গুপ্ত 'মায়া' পালাগানে কচ ও দেবযানী চরিত্রকে উত্তরচেতনায় উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই পালাগানে পৌরাণিক কচের নবজন্ম ঘটেছে। দেবলোককে প্রত্যাখ্যান ক'রে প্রতিমুহূর্তে দেবযানীকে লুকানো গান দিয়ে সাজাতে চেয়েছেন এবং কচকে বলতেও দেখি-
বাসব এসেছিলেন গতকাল তার গুরুর
আনন্দভিক্ষায়
রেখে গিয়েছেন সহস্রচোখের একটি চোখ এখানে আমি আর চাই না মেঘবর্ষী বিদ্যা
চাই না বজ্রবর্ণ আত্মোচ্চারণ
শুধু চাই সহস্রচোখের একটি
অবলোকন ও অন্তহীনতা
প্রত্নকথা ও রবীন্দ্রনাথের 'বিদায় অভিশাপ' কবিতার অপূর্ণতা, অমিতাভ গুপ্ত 'মায়া' শীর্ষক পালাগানে কচ ও দেবযানী চরিত্রের মিলন ঘটিয়ে পূর্ণতা-প্রদানে প্রয়াসী হয়েছেন। তার পাশাপাশি 'মায়া' পালাগানটি উৎসর্গ করলেন পৌরাণিক চরিত্র মৈত্রেয়ী, গার্গীসহ স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রীতিলতা ওহদেদার, একালের বাসন্তী গ্রামের অহল্যা বাঈয়ের বোন শিখা ও তেরো বছরের মেয়ে তামাংকে। এখান থেকেই বোঝা যায়- উৎসর্গপত্রে অমিতাভ গুপ্ত তাঁর নতুন ভাবনাকে আলোকিত করতে চেয়েছেন। একদিকে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির পৃথিবী, যেখানে নারীর অধিকার সংকীর্ণ- আর অন্যদিকে যেখানে নারী পুরুষের মধ্যে বিভাজন রেখা নেই, নারী-নির্যাতন নেই, সেখানে সব মানুষ সমান, সব মানুষের ধর্ম হবে— মানবধর্ম। যেখানে যাজ্ঞবন্ধ্য ঋষি তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে প্রশ্ন করতে দেননি, সেখানে অমিতাভ গুপ্ত নারীকে সমান মর্যাদা দিয়ে বললেন- 'প্রশ্ন করো, গার্গী, প্রশ্ন করো'
'লীলা'র অবলম্বন একালের সমাজবাস্তবের প্রতিফলন, যা বাঙালি পাঠক মাত্রই অর্জন করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ছোটগল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে। এই পালাগানে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও ছোটগল্পের চরিত্রগুলি, যেমন বিশ্বেশ্বর, মণিয়া, প্রশান্ত, কণা ও বনোজ... মোট ছত্রিশটি চরিত্র মৃত্যুর পর কোনো এক অজ্ঞাত জায়গায় মিলিত হচ্ছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা মানুষের এই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন কিনা। অপু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফিরে আসবেন, লীলাও হয়তো ফিরে আসবেন। যার জন্য তাঁরা একটা বিপরীত যজ্ঞ করছেন। যেখানে মর্ত্যপৃথিবী থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যজ্ঞ করা হয়। কিন্তু, এখানে মৃত্যুর পর পুনরায় মর্ত্যপৃথিবীতে ফিরে আসবার জন্য যজ্ঞের আয়োজন দেখা গেল। সেই যজ্ঞের ঋত্বিক হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান এবং নিজেই যজ্ঞে আহুতি দিচ্ছেন। কিন্তু লক্ষ করা যায়, ভগবান নিজে ইতিমধ্যেই লীলার কিছুটা প্রেমিকও হয়ে উঠছেন। যদিও এই ভগবানের উপস্থিতি আমরা কচ ও দেবযানীর মাঝখানেও লক্ষ করেছি। এখানে একথা বলা দরকার অপু ও লীলা মর্ত্যপৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইলেও অন্যান্য চরিত্রেরা আর ফিরবে না। কারণ, মর্ত্যপৃথিবীতে তাঁরা এতই দুঃখ কষ্ট পেয়েছেন, যেমন মতি ও বিশ্বেশ্বরের কথা অলাদা ক'রে বলতেই হবে।
'দুঃখমহুল', 'রুদ্রপলাশ'; ও 'কনারকের মেয়ে' তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে মূলত কবির ভারত-পরিক্রমার অভিজ্ঞতা উঠে এল। কবি মনে করেন- আমরা তো এমন ভারতবর্ষ চাইনি, যেখানে শংকর গুহনিয়োগীর মতো মানব-দরদী মানুষের এমন করুণ পরিণতি হবে। 'জাহাঙ্গীরের মা' কবিতায় জাহাঙ্গীর নামক একটি ছেলেকে এমন মানবিক রাষ্ট্রেও এমন অমানবিক অত্যাচারের স্বীকার হতে হয়, কবি কোনোভাবেই তা মেনে নিতে পারেননি। পাশপাশি 'রুদ্রপলাশ' কাব্যগ্রন্থের 'রাহুল' কবিতাটিতে সন্তান পরিবারের কাছে কতটা বোঝা হতে পারে, তার দৃষ্টান্তও রেখেছেন:
আমার জন্মলগ্নে বাবা ক্ষুব্ধ মাথা নেড়ে বলেছিলেন 'আবার পথের কাঁটা'
প্রাসাদভরা অন্ধকারে কেঁপে
উঠল তখন না-পাওয়া কোন্ মায়া
সেই-যে আমার মা
একটি বিশাল ভিক্ষাপাত্রে আমায় ধরে না
নিরন্ন দেশ রইল পড়ে তারই ছায়ার দানে
সঙ্ঘঘেরা উপাখ্যানের টানে
রাজ্যত্যাগী রাজপুত্রের ছেলে ব'লেই জানে আমায়, হাজার পণ্ডিতদের জাতকসন্ধানে
নই সে আমি, না
যশোধরার মতন ছিন্না
ফসলভূমি অপেক্ষাতুর, কখন আমি লাঙল নিয়ে যাব
এই তো আমার মায়ের স্বদেশ একেই আমি শস্যে সাজাব
মুছিয়ে দেব ছিন্নপথের সীতা
তুমিও এসো, পিতা
কবিতাটির নামকরণের মধ্যেই তীব্র উপেক্ষা আছে। জাতকে আমরা পাই, রাহুলের যখন জন্ম হ'ল- একজন দাসী ছুটে এসে বুদ্ধদেবকে খবর দিলেন, রাজ্যবর, আপনার ছেলে হয়েছে। তখন বুদ্ধদেব বলে উঠলেন, রাহুল, অর্থাৎ আবার কাঁটা কিংবা আবার পথের কাঁটা। একজন বাবা নিজের সন্তানকে কাঁটা মনে করছেন। আমরা জানি, এই উপেক্ষা নিয়ে প্রতিদিন ভারতবর্ষে সন্তান জন্ম নিচ্ছে। এমনকি নারীসন্তানের ভ্রুণহত্যা অহরহ ঘটে চলেছে। এভাবেই আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী সন্তানের প্রতি অন্যায় করে যাচ্ছি, তারই বিরুদ্ধে কবি রুদ্রপলাশ ফোটানোর বার্তা দিচ্ছেন।
'কনারকের মেয়ে' কাব্যগ্রন্থের নামকবিতাটিতে কবি কনারক-বাণগড়- মহাস্থানগড়কে নিয়ে বাঙালীর বিরাট প্রাচীন সংস্কৃতির কথা তুলে আনলেন। যে সভ্যতাগুলি একসময় মানুষের হাতেই গ'ড়ে উঠেছিল। কিন্তু নানারকম সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আক্রমণে মানুষের হাতেই অচিরে কীভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। এগুলি দেখে কবির মনে হয়েছে- এই যুদ্ধে হানাহানিতে অসহায়, করুণ ও ক্লান্ত হয়ে যাওয়া একটা ভারতবর্ষ যেন, ভারতবর্ষেরই উপমা হয়ে আছে- এই কনারক এই বাণগড় এই মহাস্থানগড়। কবি লিখছেন:
আঁধার ভাঙে গড়ে। পাথর কৃষ্ণাভ রাধিকা হয়ে পথে লুটিয়ে
এ-পথপ্রান্তেই বজ্রপদ্মের মন্দিরের মতো মহায়তন
হয়ত এখানেই শবররাজা বাণ মাটির কেল্লায় মাটির মানুষের
মুক্ত পৃথিবীকে গড়তে চেয়েছিল, হয়ত ঊষা-অনিরুদ্ধ আখ্যানে
প্রেমের অনধিক কুশলী রাজনীতি লুকিয়ে আছে পাঁচহাজার বছরের
প্রত্নইতিহাসে- দ্বারকা থেকে যেন বঙ্গদুয়ারের দিনাজপুর পার হয়ে
একই ধ্বংসের অধীনে বিস্তারে অথবা রাজসূয়যজ্ঞে
তুমি ক্লান্ত কনারক, ভারতবর্ষের
কোন্
উপমার প্রতিমার মতো
সূর্যমন্দিরের চিহ্নে, বাণগড়ধ্বংসঅবশেষে
তবে কবিতাটিতে যে উষা-অনিরুদ্ধের নাম এসেছে- এঁরা কিন্তু মনসামঙ্গল কাব্যের চরিত্র নন। এঁরা হলেন বাণ রাজার কন্যা ঊষা আর শাম্বের ছেলে অনিরুদ্ধ। এখনো বাণগড়ের একটি রাস্তার নাম ঊষাহরণ সরণি। বলা হয়, ওই রাস্তা দিয়ে বাণ রাজার কন্যা ঊষাকে নিয়ে শাম্বের ছেলে অনিরুদ্ধ পালিয়ে গিয়েছিলেন। বাণগড়ের এই প্রত্নকথাটিও কবিতাটিতে কবি সযত্নে লালন করেছেন।
'মাধুর্য ও শোণিত' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি মূলত সমকালীন সময়ের নানা অভিঘাতকে কেন্দ্র ক'রে রচিত হয়েছে। গুজরাট-দাঙ্গার প্রসঙ্গ উঠে এল 'বৃষ্টি' কবিতায়।
২০০১ সালে কোনো এক অজ্ঞাত-কারণে হঠাৎ একদিন ন্যাশনাল লাইব্রেরির বাইরে লাইব্রেরির অজস্র বইয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হ'ল। যে ঘটনাটি কবিকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। কবির মনে হতে থাকে, কত রাত্রি জাগরণে কত মেধায় বইগুলি রচিত হয়েছিল। সেই যন্ত্রণা থেকেই কবি লিখলেন, 'ন্যাশনাল লাইব্রেরি' কবিতাটি:
আগুন আকাশ আর রুদ্রপলাশের মতো এইসব প্রতিবাদ কোনওদিন সম্পূর্ণ
হবে না
যদি-না লাইব্রেরি তার রূঢ় পাথরের দিকে
ছায়ার অস্বচ্ছে আজ ঝরে পড়ে। ঝরে যাক। কী আর সন্ধান
বাকি আছে, মানুষের? এতদিন খুঁজে খুঁজে ঈর্ষা লোভ ঘৃণাকেই
মেধা আর মননের সারাৎসার বলে মনে হয়
কবিতার অনিশ্চয় ছুঁয়ে যায় বমির ঝলক
যেভাবে বিচূর্ণ গঙ্গা- সেতুবন্ধনের মতো আলটপকা বিরিজের
ফুটো দিয়ে দেখা যায়- ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে ওঠে
যেভাবে চিড়িয়াখানা পাশবিক খাঁচা মেলে দেয়
যেভাবে আবার ওই আকাশের পরিণামে আগুনের আঁচলের ঘেরাটোপ,
রুদ্রপলাশের সিঁথি, সিঁথির সিঁদুর
ভস্মকেই বিদ্যা মনে করে
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, 'স্পর্ধা' কাব্যগ্রন্থটিতে মূলত দু'টি দিক বিশেষভাবে প্রতিভাত হয়েছে। এই সময়ে পারিবারিকভাবে কবি যন্ত্রণায় থেকেও প্রতিদিন কবিতা লিখেছেন, এরই মধ্যে কবি হয়তো অনুভব করেছেন, এ পৃথিবীতে মানুষ কত যন্ত্রণার মধ্যে থেকেও শিল্পরচনা করেন- এই বিষয়টি কবির কাছে স্পর্ধা ব'লে মনে হয়েছে। আরেকটি দিক হ'ল, চারিদিকে এত অশুভ এত অমঙ্গল তার মধ্যেও পরস্পরের প্রতি কবি যে টান অনুভব করেন— একজন মানুষ আরেকজন অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় এটাও একটা স্পর্ধা।
'কল্পনা এবং একাকীর কিংবদন্তী' কাব্যগ্রন্থে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম-প্রসঙ্গে কবিতা রচিত হয়েছে। বিশেষ ক'রে মহাকাশচারী কল্পনা চাওলার মৃত্যু কবিকে বিশেষভাবে মর্মাহত করে। কবি লিখলেন:
কল্পনা চাওলার আগে জন্ম নিয়ে শূন্যতাকে কিছু কিছু প্রশ্ন করেছি
তারপর, স্মৃতি ও মায়ার শেষে তারপর, কোনো এক রাতে
সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপে ঝুঁকে পড়েছিল তবু উত্তরোদ্যত এই
দীর্ণ, যাকে কল্পনা চাওলার মতো সৌন্দর্যও সম্পূর্ণ মানেনি
শান্তিময় সপ্রতিভ পরিণামহীন চরাচরে
তাই তারা মুক্ত যারা অযাচিত। পৃথিবীর সমুদ্রে দোলানো
দিনের প্রহরগুলি স্তবে সূর্যান্তরে
ভিখারির গান হয়ে কখন গিয়েছে ঝরে। আঁধারে, গভীরতর নক্ষত্রের মতো
কল্পনা চাওলার মূঢ় রূপভস্ম পুনর্বার আমার প্রশ্নকে স্পর্শ করে
এছাড়া এই কাব্যগ্রন্থে পল্লী কবি জসীমউদ্দিন, নান্দিকারের অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীর জীবনকথা এসেছে কবিতার মধ্য দিয়ে এবং শেষ কবিতাটি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে স্মরণ ক'রে লেখা হয়েছে।
২০২৪ সালে কবি অমিতাভ গুপ্তের দশটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে 'কবিতাসংগ্রহ ১' ধানদূর্বা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এবারে সাতটি কাব্যগ্রন্থ একত্রিত ক'রে 'কবিতাসংগ্রহ ২' প্রকাশিত হ'ল। উল্লেখ্য, পূর্বে প্রকাশিত 'কণারকের মেয়ে' কবিতায় 'কণারক' বানানটি ভুল ছাপা হওয়ার কারণে এই সংস্করণে 'কনারক' করা হ'ল, কবির নির্দেশানুসারে। আশা করি, 'কবিতাসংগ্রহ ২' পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠবে।
- অসীম সরকার
শান্তিপুর, ০২.০১.২০২৫
গ্রন্থক্রম
- গৌরীপট
- দুঃখমহুল
- রুদ্রপলাশ
- কনারকের মেয়ে
- একটি ভোরবেলা
- মাধুর্য, শোণিত
- স্পর্ধা
- কল্পনা এবং একাকীর কিংবদন্তী
অমিতাভ গুপ্তের জন্ম
১৯৪৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর, হুগলী জেলার ব্যাণ্ডেল-এ
মা: মাধবী গুপ্ত
বাবা : বীরেন্দ্রকুমার গুপ্ত
বৃত্তি: ওয়েস্ট বেঙ্গল এডুকেশান সার্ভিস।
২০০৭ খ্রিস্টাব্দে মৌলানা আজাদ গভর্নমেন্ট কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর নেওয়ার পরে ঐ কলেজের স্নাতকোত্তর এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বিভাগের আংশিক ও আমন্ত্রিত অধ্যাপক ছিলেন।
::::::::::
কবিতাসংগ্রহ ২
অমিতাভ গুপ্ত
প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল ২০২৫
প্রচ্ছদসজ্জা: আদিত্য সিংহ
প্রকাশক : ধানদূর্বা
দাম: ৬৫০ টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম