চট্টগ্রাম এক প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদ। চট্টগ্রাম শহরও অনেক প্রাচীন এক শহর। কোনো কোনো ঐতিহাসিক সূত্রমতে চট্টগ্রাম শহর দু'হাজার বছরের প্রাচীন এক নগর। রোমান ইতিহাসবিদ প্লিনি ৬৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর 'পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান' গ্রন্থে চট্টগ্রামের কথা বর্ণনা করেছেন। অনেক বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক তাঁদের ভ্রমণ বিবরণে চট্টগ্রামের সৌন্দর্য ও প্রাচুর্যের কথা গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু চট্টগ্রামের উপর এককভাবে রচিত গ্রন্থের সংখ্যা বেশি নয়। ফারসি ভাষায় রচিত 'আহাদিসুল খাওয়ানিন' বইটিই আমাদের জানামতে, চট্টগ্রামের উপর এককভাবে লেখা প্রথম বই। খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ্ খান বইটি রচনার কাজ শেষ করেন ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৮৭১ সালে সেটি কলকাতা হতে প্রকাশিত হয়। অনেকের কাছে বইটি 'তারিখে হামিদ' নামেও পরিচিত। বাংলা ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসচর্চায় বইটির নাম বিগত শতকে বহুবার বহু জায়গায় গুরুত্বের সাথে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু বইটি প্রকাশের পর প্রায় দেড়শো বছর অতিবাহিত হলেও সেটি এতকাল বাংলা ভাষায় অনূদিত হয় নি। মূল ফারসি বইটিও বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। ড. খালেদ মাসুকে রসুল চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ক এ বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তরুণ গবেষক অধ্যাপক তানবীর মুহাম্মদ দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে সে অনুবাদ সংশোধন ও সম্পাদনা করেছেন এবং তাতে টীকাভাষ্য সংযোজন করেছেন। ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কাছে বইটির বঙ্গানুবাদ প্রয়োজনীয় বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে এ-কথা বলা যায়।
লেখকের কথা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লহামদু লিল্লাহে রাব্বিল আ'রশে ওয়াল কুরসি ওয়াল মালায়েকাতি ওয়াল আরদে ওয়াস্ সামায়ে ওয়া খালেকে কুলু মা' ফিল আ'লমে মিনাল জিন্নে ওয়াল ইছে ওয়াল হাইওয়ানে ওয়াল জেবালে ওয়াস্ সুহুলে ওয়ান্ নুজুমে ওয়াল ক্বামারে ওয়াদ্ দিয়ায়ে। ওয়াস্ সালাতু ওয়াস সালামু আ'লা খায়রে খালকিহি মোহাম্মদ সাইয়েদেল আম্বিয়া। ওয়া আলায়হিম ও আ'লা আলেহি ওয়া আসহাবেহি ইলা ইয়াওমিল বাকায়ে।
অতঃপর যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে প্রচণ্ড বেগে। ইসলামাবাদ ও চট্টগ্রামের সন্নিহিত অঞ্চলের পুরানো অবস্থা আজ আর নেই। মহাকালের খাতা হতে মুছে গেছে এ এলাকার প্রধান ইতিহাস, দ্রুত মুছে যাচ্ছে আবেগ। যাঁরা যুগ-জামানার খবর রাখেন, পুরাকীর্তি সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকেবহাল, তাঁরা সবাই একে একে আত্মগোপন করছেন ভূপৃষ্ঠের অন্তরালে। ইতিবৃত্ত যাঁরা জানতেন তাঁরাও একে একে চলে যাচ্ছেন। পুরাকীর্তির কিছু কিছু নিদর্শন, প্রাচীন বিবরণ ও ইতিহাস, প্রবাদ আর উপকথা আজো মহাকালের প্রবল আক্রমণ উপেক্ষা করে টিকে আছে। এগুলোর সদ্ব্যবহার না হলে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এ অঞ্চলের অতীত ইতিহাস।
ভবিষ্যতের এসব ভাবনা ভেবে পেরেশান হয়ে পড়েছি এ বান্দা। আমি আল্লাহ্র রহমতের আশা রাখি। আশা রাখি প্রাচীন জামানাকে নও-জামানার আরশিতে বিম্বিত করতে। খাকসারের নাম হামিদুল্লাহ্ ইসলামাবাদী, পিতার নাম মরহুম খান বাহাদুর ওবায়দুল্লাহ্। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মর্যাদা ও উচ্চ পদের অধিকারী হিসেবে এ অঞ্চলে প্রখ্যাত। তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ আকবর এখন তাঁর স্থলাভিষিক্ত দারোগা বা জেলা প্রশাসক। তিনি আজ আদালতে ইসলামাবাদের সাহেবে দেওয়ান। অন্যতম ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ মোহাম্মদ হাসেম চট্টগ্রামের মীর বখশী ও সাহেবে দেওয়ান। নবাব সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খান বাহাদুর মোজাফফর জং (তাঁর ওপর আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হোক) ইসলামাবাদের রাজত্বকালে এঁরা ছিলেন বিশেষ প্রভাব-প্রতিপত্তির লোক।
এ গ্রন্থের লেখক হামিদুল্লার মনে বাসনা জাগে এ সময়কার অবস্থা সম্বলিত একটা তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ রচনার। মহান আল্লাহ্র তওফিকে তিনি এ গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এ অঞ্চলের ভূমির প্রকার, সমভূমি, পাহাড়- পর্বত, মাঠ-ঘাট, কবরস্থান, ভূমির উৎপন্ন দ্রব্যাদি, অধিবাসী, কর্তৃপক্ষ, ভদ্রসমাজ, প্রবীণ ও প্রধান বিজ্ঞলোক, প্রভৃতির ওপর আলোকপাত করে এ গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন। এ অঞ্চলের পশুপাখি, গাছপালা, জলবায়ু প্রভৃতিও তিনি বর্ণনা করেছেন। বৃটিশ আমলের ঘটনাবলী, শ্বেতাঙ্গ-শাসনের অত্যাচার, নিপীড়ন প্রভৃতির আলোচনা লেখক তাঁর বর্তমান গ্রন্থে বাদ দিয়েছেন। কারণ, সেসব বিষয় আধুনিক পত্র-পত্রিকায়, বই-পুস্তকে এবং জনগণের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে।
লেখক স্থির করেন, ইসলামাবাদের এবং চট্টগ্রাম নগরীর এমন একটা ইতিবৃত্ত তিনি লিপিবদ্ধ করবেন যাতে এ অঞ্চলের বিভিন্ন সময়ের অবস্থা ও বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী লেখার মাধ্যমে গ্রন্থিত থাকে। এ উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ্ তায়ালার করুণায় তিনি এ অঞ্চলের প্রাচীন নিদর্শনাদি, ইতিবৃত্তমূলক বই- পুস্তক, প্রাচীন সভ্যতার চিহ্নাদি, পূর্ববর্তী মুরুব্বিবৃন্দ ও বিজ্ঞ সমাজ হতে এবং নিজে প্রথম থেকে নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নানাস্থানে পর্যটন ও পরিভ্রমণ করে যেসব তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন এবং প্রাচীন নিদর্শন, ঘর-বাড়ি, মাঠ-জংগল দেখে ও লোকজনের সাথে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে যা জেনেছেন ও অনুমান করতে পেরেছেন প্রধানত তার ওপর ভিত্তি করেই এ গ্রন্থ রচনা করেছেন।
তিনি তাঁর গ্রন্থের নামকরণ করেছেন 'আহাদিসুল খাওয়ানিন' বা খানদের ইতিবৃত্ত। তার কারণ, এ গ্রন্থে কতিপয় প্রাচীন খান বংশের ইতিবৃত্তই স্থান পেয়েছে। অক্ষরের অংক দিয়ে হিসেব করলে গ্রন্থের রচনাকালও আবিষ্কৃত হবে ১২৭২ হিজরি। গ্রন্থটিকে বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে বিভিক্ত করে আলোচ্য বিষয়সমূহ যথাযথ স্থানে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। “তারিখে হামিদ”১ শব্দটিতে ও গ্রন্থের রচনাকাল লিখা হলো ১২৭২ হিজরি সাল।
এ ইতিহাসের নাম "তারিখে হামিদ” শব্দে যে বছরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার অর্থ ১২৭২ সালে এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়। পরবর্তী কালে এ পাণ্ডুলিপি পুনর্বার দেখা ও সংশোধনের তারিখ দেয়া হয় এমন লিখা হবে "তারিখে হামিদ” বা তারিখ-ই- হামিদ। সে শব্দটিও তাৎপর্যময় হবে। তার মানে হবে হামিদউল্লাহ্ খাঁর রচিত ইতিহাস, ১২৭২ হিজরি সাল।
"লেখকের নাম আর রচনার সন,
তারিখে হামিদে আছে যতনে গোপন।"
যেসব ঘটনা ও অবস্থা এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে তাদের মধ্যে কোনো অসংগতি ও ভুলভ্রান্তি দৃষ্টিগোচর হলে আশা করি সহৃদয় পাঠকবর্গ তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কারণ মানুষের জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসা নিতান্ত সীমাবদ্ধ, একমাত্র আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা। তিনিই সঠিক ঘটনাবলী বর্ণনার একমাত্র তওফিকদাতা। আমরা এ গ্রন্থে সঠিক ঘটনাবলী ও তথ্যাদি সম্বলিত অবস্থাদি বর্ণনা করার প্রয়াস পেয়েছি।
গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলীর সূত্রপাত ও সত্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলাচনা করা হয়েছে। এসব ঘটনার ইতিহাস কোথা হতে সংগৃহীত হয়েছে, কোন্ কোন্ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হতে উদ্ধৃত হয়েছে, বর্ণিত ঘটনাবলীর প্রামাণ্যতা প্রভৃতি সম্পর্কে আমরা সঠিক তথ্যাদি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।
গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হবার পরে কতিপয় বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন- যেসব সূত্র ও সনদের ওপর নির্ভর করে এ গ্রন্থ রচিত হয়েছে সেগুলো সঠিক ও নির্ভরযোগ্য কি না। প্রত্যুত্তরে বলেছিলাম, এসব ইতিবৃত্ত যাঁরা বর্ণনা করেছেন এবং শুনিয়েছেন তাঁরা সেসব কোথায় পেয়েছেন ও কোন প্রামাণ্য ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে সেসব লিপিবদ্ধ করেছেন সেসব বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই বইখানি পড়ে বুঝতে পারবেন। এ গ্রন্থের উপজীব্য ঘটনাবলী ও তথ্যাদি একটু অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করলে তার সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে বর্ণিত বিষয়ের মৌল উপাদান সম্পর্কে এ গ্রন্থে বাহ্যত কোনো উল্লেখ সুস্পষ্টভাবে নেই। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, লেখক এই এলাকার অধিবাসী, এ অঞ্চলের অবস্থাদি, জমির উর্বরতা ও অনুর্বরতা, উৎপন্ন ফসলের প্রকার ও পরিমাণ, ফলমূল তরি-তরকারী প্রভৃতি, স্থানীয় অধিবাসীদের ঘর-বাড়ি, তাদের বংশ-গোেত্রাদি, বর্ণিত ভূখণ্ডের অবস্থান ও সীমানা, সমতলভূমি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা প্রভৃতি তাঁর নিজের চোখে দেখা এবং নিজের প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণিত বিষয়াদি উপস্থাপন করা হয়েছে। অবশ্য বিচার-বিশ্লেষণে যদি কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে তবে তা স্বতন্ত্র কথা। লেখক মনে করেন, যেসব ঘটনা তাঁর চোখের সম্মুখে ঘটেছে, যে বিষয়ের তিনি প্রত্যক্ষদর্শী সেগুলোর কোনো সনদ বা সূত্র প্রদানের আবশ্যকতা নেই। ইসলামাবাদ নামে চিহ্নিত ভূখণ্ডে এখনো সে কালের অনেক নিদর্শন চোখে পড়ে। অনেক মূল্যবান নিদর্শন ইতোমধ্যেই মহাকালের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো কোনোটা লেখক ছেলেবেলায় চোখে দেখেছেন। সেসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্পর্কে লেখকের ঔৎসুক্য ছিল। তিনি তাঁর সমকালীন প্রাজ্ঞ ও প্রাচীন ব্যক্তিদের কাছে সেসব নিদর্শন সম্পর্কে অনেক কাহিনী শুনেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা, অনুমান ও পুরানো দিনের ইতিবৃত্তের আলোকে তিনি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাই আলোচ্য গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। লেখকের অশ্রুত ও অজ্ঞাত বিষয়ের প্রতি তিনি ইংগিত করেছেন, কিন্তু সেগুলোকে প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে গ্রহণ করেননি।
লেখক বনেদি অভিজাত পরিবারের উত্তরপুরুষ। তাঁর পিতা-পিতামহ ছিলেন এ দেশের সম্ভ্রান্ত জমিদারদের সমগোত্রীয়, বাদশাহী ও বৃটিশ আমলে তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন উচ্চ রাজ-কর্মচারী। এক কালে লেখকদের বাড়িতে মামলা-মকদ্দমা ও আপিলের বিচার হতো। ছোট-বড় সব শ্রেণীর মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল তাঁদের বাড়ি। লেখক ছোটবেলায় অনেক বিদগ্ধ লোকের সংশ্রবে আসার সুযোগ পেয়েছেন। সর্বোপরি তাঁর ছিল একটি অনুসন্ধিৎসু মন। কাজেই স্থানীয় ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে তিনি যতটুকু জানতে পেরেছেন, এমন আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।
বর্তমান গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন ও তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস সিয়ারে মুতাখরীনের উল্লেখ করা হয়েছে। সিয়ারে মুতাখরীনের আভিধানিক অর্থ পরবর্তীদের ইতিবৃত্ত। এ গ্রন্থ অত্যন্ত তথ্যবহুল। অভিনিবেশ সহকারে এই একটি মাত্র গ্রন্থ পাঠ করলে সমকালীন ইতিহাসের মাল-মসলার জন্যে অন্য কোনো গ্রন্থ পাঠ করার প্রয়োজন হয় না। এ গ্রন্থে সমকালীন ঘটনাবলী দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গোলাম হোসেনের বিচার-বিশ্লেষণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হয়েছে। সম্রাট আকবরের স্বনামধন্য পারিষদ আবুল ফজলকে কোনো এক প্রসঙ্গে গোলাম হোসেন উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করেছেন। আবার অন্য প্রসঙ্গে তাঁর কুৎসা ছড়াতেও তিনি কুণ্ঠা বোধ করেন নি। তিনি লিখেছেন, আবুল ফজল সম্রাট আকবরকে ধর্মীয় ও পবিত্র জীবনে রীতিমতো গোমরাহ্ ও পথভ্রষ্ট করে তুলেছেন। তাঁরই প্রভাবে আকবর যে নিজের পৈত্রিক ধর্মের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়েছিলেন সে-কথা স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ করেছেন গোলাম হোসেন। তিনি নিজে ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। তবু সত্যের অনুরোধে তিনি তাঁর গ্রন্থে ইসলামের দাবি তুলে ধরেছেন; ইসলামী মতাদর্শ ছাড়া অন্য কোনো সত্যের অনুসারী হতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন তাঁর পাঠকবর্গকে।
গোলাম হোসেন আলমগীর বাদশাহ্ সম্পর্কে বিপরীত মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ বাদশাহের যেসব দোষ- ত্রুটি বর্ণনা করেছেন সেগুলো ছিল তাঁর চরিত্রের সত্যিকার গুণ। অবশ্য গ্রন্থের শেষ দিকে তৈমুরী শাসনের গুণাবলী, কল্যাণ ও সুবিচারের নিদর্শনসমূহ অকপটে তুলে ধরেছেন। সুশাসন ও ন্যায়বিচারের এসব নিদর্শনের অধিকাংশই সম্রাট আলমগীর সম্বন্ধে প্রযোজ্য এবং সেগুলো সংগৃহীত হয়েছে এ প্রথিতনামা বাদশাহের ইতিবৃত্ত হতে। অভিনিবেশ সহকারে 'সিয়ারে মুতাখেরীন' পাঠ করলে লেখকের ইচ্ছাকৃত সত্য গোপনের ভেতর থেকে প্রকৃত সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং বাদশাহ্ আলমগীর তাঁর অসাধারণ চরিত্রিক মাহাত্ম্য নিয়ে আমাদের চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠেন। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
গোলাম হোসেনের এসব পরস্পরবিরোধী বর্ণনার অবশ্য কতকগুলো কারণ নিরপেক্ষ সমালোচকের কাছে অজানা নয়। তিনি কোথাও তাঁর মাযহাবী বিরোধের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, কোথাও বা ব্যক্তিগত মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, আবার কোথাও বা বল্লাহীন কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। ঐতিহাসিক হিসেবে লেখক নিজের ব্যক্তিগত প্রবৃত্তির অনুসরণ যতখানি করেছেন, সত্যানুসন্ধানের চেষ্টা তাঁর ততখানি জোরদার ছিল না। ভিন্ন মাযহাবের ঐতিহাসিক ব্যক্তির চরিত্রনিধনে তিনি একটা বিজাতীয় বিদ্বেষের পরিচয় দিয়েছেন, অথচ সত্য-মিথ্যার একটা জগাখিচুড়ি পাকাতে যেয়ে শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক সত্যকে ধামাচাপা দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।
উপমহাদেশে এক সময় সুলতান মাহমুদ গজনভী সহ অনেক ধর্মনিষ্ঠ মুজাহিদ বাদশাহ্ ও আমীর ওমরাহের আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁরা ছিলেন আত্মত্যাগী, ইসলামের পায়বন্দ আর জেহাদী মনোভাবের অমর প্রতীক। শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যে তাঁরা জেহাদ করেছেন, হাসিমুখে শাহাদাৎ বরণ করেছেন, বুকের রক্ত দিয়ে ইসলামের ইমারতকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু গোলাম হোসেন তাঁর গ্রন্থে সম্ভবত মাযহাবী বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে তাঁদের সেসব ঐতিহাসিক অবদানকে কুৎসিত আকারে চিত্রিত করতে প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর সজ্ঞান প্রয়াস ঐতিহাসিক সত্যকে চাপা দিতে পারেনি। অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাঁর বর্ণনা-চাতুর্যের ভেতর থেকে সত্যিকার ইতিহাসের সন্ধান সহজেই পেতে পারেন।
অবশ্য প্রকৃত ইতিহাসনির্ভর গ্রন্থাদিরও অভাব নেই। শেখ আবদুল কাদির বদায়ূনীর (রঃ) 'মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ' ও 'তাওয়ারিখে দুমালাহে আলমগীরি' প্রভৃতি গ্রন্থে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সঠিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপ আরো অনেক গ্রন্থে ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের জীবনবৃত্তান্তে সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব গ্রন্থ বিরচিত হয়েছে গ্রন্থোল্লেখিত ব্যক্তিদের নিকটবর্তী যুগে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মশহুর বিদগ্ধজনেরা এসব গ্রন্থের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। এসব গ্রন্থের আলোকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় গোলাম হোসেন কোথায় সত্য গোপনের চেষ্টা করেছেন।
ইসলামাবাদ বা চট্টগ্রামের ইতিহাস লিখতে গিয়ে লেখক যে স্থানে শাহী মসজিদ অবস্থিত সে স্থানের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে উক্ত মসজিদের ভিত্তি ও উপকরণাদি ইসলামাবাদ বিজয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এ মসজিদের ভিত্তি যাঁরা স্থাপন করেছিলেন তাঁরা এবং সমকালীন মানুষের পরিচয় তাঁর ইতিবৃত্তে স্থান পেয়েছে। তিনি তাঁদের সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা সমীচীন বলে মনে করেছেন।
- মৌলভী হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর
.....
- ১. মূল পাণ্ডুলিপিতে তারিখে হামিদ শব্দটি আরবীতে লেখা। এ শব্দটির অক্ষরগুলো বিশ্লেষণ করলে আবজড এর মান হয় ১৮৫৫।
- ২. ১২৭২ হিজরি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ।
উত্তরপুরুষদের কথা
আমরা মরহুম খান বাহাদুর হামিদ উল্লাহ্ খানের অযোগ্য উত্তর পুরুষ। মরহুম খান বাহাদুর তাঁর কীর্তির চেয়েও মহৎ ছিলেন। আমরা তাঁর অমর কীর্তি 'তারিখ ই হামিদ' এর অনুবাদের দুরূহ কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারি নি। এ জন্যে আমাদের মর্মবেদনার অন্ত ছিল না।
সেকাল বাংলার এক বিরল প্রতিভাবান সাহিত্যিক ছিলেন মরহুম খান বাহাদুর। তিনি মোট কয়টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করাও আজ আর আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি অবশ্য ফারসি ভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর রচিত অধিকাংশ গ্রন্থই ফারসি ভাষায় রচিত। তিনি তৎকালীন বাংলায়ও তিনটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কিন্তু সেসব দুর্লভ গ্রন্থের কোনো সন্ধান আজ আমাদের কাছে নেই।
এ গ্রন্থের অনুবাদে আমাদের নিকটতম আত্মীয় অধ্যাপক ড. খালেদ মাসুকে রসুল যে কষ্টস্বীকার করেছেন তা অতুলনীয়। তাঁর এ অসাধারণ ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার জন্যে আমাদের পরিবারের তরফ থেকে জানাই আন্তরিক শুকরিয়া। অনুবাদ নিরীক্ষণ, সম্পাদনা, সংশোধন, টীকাভাষ্য সংযোজনে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের 'ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের' তরুণ অধ্যাপক, গবেষক ও লেখক তানবীর মুহাম্মদ দীর্ঘদিন কঠিন পরিশ্রম করেছেন। সত্যিকার অর্থে তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ, আন্তরিক প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় না থাকলে এই সুবিশাল গ্রন্থটি প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। এই গ্রন্থখানি প্রকাশের নিঃশর্ত অধিকার ও স্বত্ব আমরা তাঁকে প্রদান করলাম। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতন এই তরুণের জন্য রইলো দোয়া ও মুবারকবাদ।
-- এ, এস, এম আমানত দ্দৌলা খান এর পক্ষে
জনাব সাইয়েদ খান, জনাব কে. এম আশরাফ সিদ্দিকী,
এ, এস, এম আজিম দ্দৌলা খান এর পক্ষে
জনাব মোঃ রাশেদ দ্দৌলা খান।
তারিখ : ২২ আগস্ট, ২০১২
অনুবাদকের কথা
ইসলামাবাদের কৃতি সন্তান খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ্ খান অষ্টাদশ শতকের মুসলিম বাংলার একজন অবিস্মরণীয় মনীষী। তৎকালীন রাষ্ট্রভাষা ফারসিতে তাঁর ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য। তিনি ফারসি ভাষায় কবিতা রচনা করে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। তৎকালীন চট্টগ্রামের একটি প্রামাণ্য ইতিহাস রচনা করে তিনি সুধীসমাজের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে এই গ্রন্থে প্রচুর আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি সমকালীন ইসলামাবাদের ইতিবৃত্ত নিয়ে রচিত তাঁর 'আহাদিসুল খাওয়ানিন' বা 'তারিখে হামিদ'-এ অবশ্য সর্বত্র ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে পারেন নি। তবু একথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে যে, বাংলার ইতিহাসের একটা বিস্মৃত অধ্যায়ের অনেক মূল্যবান উপকরণ তাঁর এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে।
'তারিখে হামিদ' এখন দুষ্প্রাপ্য। আমরা অনেক চেষ্টায় এই মূল্যবান গ্রন্থের একটি খণ্ডিত কপি সংগ্রহ করে তার অনুবাদে হস্তক্ষেপ করি। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে ফারসি ভাষায় অভিজ্ঞ লোকের অভাবে আমরা বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হই। শেষ পর্যন্ত অধ্যক্ষ আব্দুল ওদুদ, চট্টগ্রাম ইসলামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক মুফতী সাহেব ও নোয়াখালী কেরামতিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক মাওলানা রফিক উল্লাহ্ সাহেবের অকৃপণ সাহায্য ও সহানুভূতি অনুবাদের কাজে আমার পরম সহায়ক হয়েছিল। এজন্য তাঁদের কাছে আমি সকৃতজ্ঞ হৃদয়ে ঋণস্বীকার করছি।
মূল গ্রন্থের মলাট ও প্রথম দিকের দু'একটি পাতা খণ্ডিত বলে গ্রন্থটি কোন সংস্করণ বা কোথা হতে মুদ্রিত তা উল্লেখ করা সম্ভব হয় নি। অবশ্য এতে অনুবাদের বেলায় তেমন কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় নি। কিন্তু মূল গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা খণ্ডিত থাকায় আমাদেরকে তৎকালীন ইতিহাস বিশেষ করে সম্রাট আলমগীরের রাজত্বকালীন ঘটনাবলী সম্পর্কে কিছুটা ভিন্নপথ ধরতে হয়েছে। সম্রাট আলমগীরের ঘটনাবহুল জীবনীর যে যে অংশ 'তারিখে হামিদে' বর্ণিত হয়েছে, খণ্ডিত অংশের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষার্থে তা হতে হয়তো আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা দূরে সরে পড়েছি। এ অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত।
এ গ্রন্থের অনুবাদ সম্পর্কে আমাকে মরহুম খান বাহাদুরের উত্তরপুরুষ এ, এস, এম আমানত দ্দৌলা খান ও তাঁর কনিষ্ঠভ্রাতা এ, এস, এম আজিম দ্দৌলা খান যে সাহায্য ও সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন তজ্জন্য অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
-- খালেদ মাসুকে রসুল, তারিখ: ডিসেম্বর-১৯৯৫, চট্টগ্রাম
ভূমিকা
চট্টগ্রাম শহর সম্পর্কে লিখা ইতিহাসের বই নেই বল্লেই চলে; যদিও চট্টগ্রাম সম্ভবত বঙ্গ দেশের একমাত্র নগর যে নগরের বয়স; কোন কোন ঐতিহাসিক সূত্রমতে দু'হাজার বছরেরও প্রাচীণ। মাত্র চার'শ বছরের পুরনো শহর কোলকাতা নিয়ে শতাধিক প্রামাণ্য গ্রন্থ লেখা হয়েছে। ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ নিয়েও ইতিহাসবিদদের উৎসাহ অপরিসীম। চট্টল সন্তান ও খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিমও ঢাকা নিয়ে ইতিহাস লিখেছেন। চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাস লিখার ইচ্ছে তাঁর ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। কিন্তু তিনি তাঁর ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি।
বঙ্গ দেশের প্রাচীননগর তাম্রলিপ্তি, গাঙ্গে, পুণ্ড্রবর্ধণ, গৌড় ইত্যাদির প্রায় সমকালীনতো বটেই, কোন কোন ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম এসব নগরের চাইতেও প্রাচীন। খাঁন বাহাদুর হামিদুল্লাহ খাঁনের মূল ফার্সি গ্রন্থ 'আহাদিসুল খাওয়ানিনের' সম্পাদক অধ্যাপক তানবীর মুহাম্মদ তাঁর সম্পাদকীয়তে যথার্থই বলেছেন- পাহাড় বেষ্টিত সমুদ্র বিধৌত প্রকৃতির লীলাভূমি এই চট্টগ্রাম শহরটির নান্দনিক ঐশ্বর্য্য ও প্রাচুর্যের কথা সেই ৬৪ খ্রি. রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি থেকে শুরু করে চীনা পরিব্রাজক মা হুয়ান, মুর পর্যটক ইবনে বতুতা, পর্তুগীজ ডি বারোস, ফ্রেডেরিক মানরিক প্রমুখ বহুজনের লেখায় পাওয়া যায়। কিন্তু বিস্ময় ও পরিতাপের বিষয় উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে মৌলভী হামিদুল্লাহ খাঁনের এই ফার্সি বইটি ছাড়া কেবল শহরটিকে নিয়ে ঐতিহাসিক চর্চার কোন হদিস আমরা এখনো পাই না। এর সম্ভাব্য কারণ হয়তো এই, এটি ছিল ভাতরবর্ষ এবং বিশেষত বঙ্গ দেশের সবচেয়ে পূর্ব-প্রান্তিক নগর। যার পরেই শুরু হয়েছে মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল। পার্বত্য চট্টগ্রামও এ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাস বিচিত্র ও ব্যতিক্রমী তার প্রান্তিক ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই।
মৌলভী হামিদুল্লাহ খাঁন বাহাদুর সুলতানী আমলের সময় থেকে চট্টগ্রাম শহর ও তার আশপাশের অঞ্চলের যে ইতিহাস বর্ণনা করেছেন, আমরা আজ জানি তার অধিকাংশই সত্য। আলাউদ্দিন হোসেন শাহর ছেলে নসরত শাহ কিভাবে চট্টগ্রাম শহর দখল করেন এবং সেখান থেকে আট মাইল দূরে ফতেয়াবাদ নগরটির পত্তন করেন তা বর্ণনা করার আগে, অর্থাৎ জানা ইতিহাস শুরুর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের (বিশেষত এই প্রান্তিক শহরটির আশেপাশের জনপদের) জনগোষ্ঠীর যে নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, সেখানে বেশ কিছুটা লোক কাহিনী ও উপকথার আবরণ থাকলেও সত্য যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকার জনগোষ্ঠী, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার যে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন তাতে অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় রয়েছে। এখানকার আদিবাসী উপজাতি গুলোর হিন্দুতে রূপান্তরিত হওয়ার যে প্রক্রিয়া ও ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তার সঙ্গে ড. শ্রী নিবাসের দেয়া উপজাতিগুলোর সংস্কৃতায়নের ব্যাখ্যার গভীর মিল রয়েছে। ড. শ্রী নিবাসও তাঁরই মতো বলেছেন, এই উপজাতিগুলো ধীরে ধীরে তাদের খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে জীবনাচরণের প্রায় সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত তথাকথিত আর্য জীবনাচারকে গ্রহণ করে হিন্দুতে রূপান্তরিত হয়। ভাষার ক্ষেত্রে ফারসি, সংস্কৃত, বাংলা এবং ইংরেজির মধ্যে যে ভাষাগত ঐক্য তিনি দেখেছেন সেখানেও তাঁর সুগভীর অন্ত বীক্ষার পরিচয় রয়েছে।
তিনি চট্টগ্রাম শহরের প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তিসমূহের বিবরণ গভীর অনুরাগ দিয়ে বর্ণনা করেছেন, ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোর বিবরণও তুলে ধরেছেন। তিনি উনবিংশ শতাব্দীতে যখন ইংরেজ শাসন অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত, তখন এই বইটি লিখেছিলেন বলে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর কোন বিদ্বেষ পরিস্ফুট নয়।
ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় তিনি জীববিজ্ঞানী বা উদ্ভিদবিজ্ঞানী ছিলেন না, পরিবেশ বিজ্ঞানও তাঁর সময়ে আজকের মতো বিকশিত হয়নি। কিন্তু এই তিন ক্ষেত্রে তাঁর প্রজ্ঞা ও ভালোবাসা তাঁকে চট্টগ্রামের ভূপ্রকৃতি, নদী-সমুদ্র ও পশু-পাখি সম্পর্কে যে অনুপুঙ্খ বর্ণনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল তা তুলনাহীন। তিনি ফেনী নদী, কর্ণফুলী, মাতামুহুরী, শঙ্খ, ধুরং নদী চট্টগ্রাম-জনপদ-জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল তা ব্যাখ্যা করেছেন, বর্ণনা করেছেন এসব নদীর অপার সৌন্দর্য। তিনি নিসর্গকে সম্পূর্ণ অর্থে গ্রহণ করেছিলেন। তাই এ অঞ্চলের পশুপাখির বৈশিষ্ট্য তাঁকে বিমুগ্ধ করেছিল।
চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার দেশ হিসেবে পরিচিত। দিল্লীতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগে থেকেই চট্টগ্রামে সমুদ্রপথে এসেছিলেন পীর-আউলিয়ারা তাঁদের প্রেমের বাণী ছড়িয়ে দিতে। তাই আমরা দেখি চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পূর্ব বাঙলা বহু সুফী সাধকের শান্তির বাণীকে ধারণ করে পীর-দরবেশের লীলাভূমি হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। তিনি এই সব মহান পীর-দরবেশের জীবনবৃত্তান্ত ও তাঁদের কর্মপরিধি গভীর শ্রদ্ধা ও মমতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন।
মৌলভী হামিদুল্লাহ খাঁনের এই গ্রন্থটি যাঁরা চট্টগ্রাম নিয়ে গবেষণা করবেন তাঁদের জন্য একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় নানা মণি- মুক্তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলো নিয়ে এই প্রজন্মের কেউ যদি গবেষণা করেন, আমি মনে করি, তিনি একটি মূল্যবান কাজ করবেন। এই গ্রন্থের পরম স্নেহাস্পদ সম্পাদক তানবীর মুহাম্মদ এই গ্রন্থটি যে অধ্যবসায় ও অসীম মমতা দিয়ে ও সযত্নে সম্পাদনা করেছেন তা তাঁর গভীর গবেষণা প্রীতিরই পরিচায়ক। এর আগেও বিভিন্ন ক্ষেত্রেও জ্ঞানের প্রতি তার যে ভালবাসা দেখেছি তা এ যুগে প্রায় দুর্লভ বল্লেই চলে। তার জন্য তাঁকে আমার অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অনুবাদক ও প্রকাশকের প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা। তারা সকলে মিলে সত্যিই মহৎ কাজ করেছেন। খাঁন বাহাদুর হামিদুল্লাহ খাঁনের হারিয়ে যাওয়া বাংলা ও ফারসি বইগুলো যত্ন সহকারে অনুসন্ধান করলে হয়ত পাওয়া যেতে পারে। সেগুলো অনুসন্ধানের জন্য অনুবাদক ও গবেষককে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
- ড. অনুপম সেন, উপাচার্য, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। ১ মার্চ, ২০১৩
সম্পাদনা প্রসঙ্গে
চট্টগ্রাম একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ। এশিয়ার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে, নানান ঘটনা প্রবাহে ঐতিহাসিক কাল থেকে চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আধুনিক কালের মত অতীতকালেও চট্টগ্রাম সমগ্র প্রাচ্যে গৌরবোজ্জ্বল অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত ছিল। রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি ৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর 'Periplus of the Erythraeansea' গ্রন্থে চট্টগ্রামের কথা বর্ণনা করেছেন। ইতিহাসবিখ্যাত মুর পর্যটক ইবনে বতুতা, চৈনিক মা হুয়ান ও কুও-ছং-লি, আরবের সুলাইমান, পর্তুগিজ ক্যাম্পোস, ডি বারোস, পাদ্রি ফাদার ম্যানরিক, ইয়োরোপের ফ্যন লিন্সকোটেন, সিজার ফেডারিক, বিখ্যাত ইংরেজ মনীষী স্যার উইলিয়াম জোনস্, ইংরেজ সিভিলিয়ান এ.এল.ক্লে সহ অনেক বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক তাঁদের ভ্রমণ বিবরণে গুরুত্বের সাথে চট্টগ্রামের সৌন্দর্য ও প্রাচুর্যের কথা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পরিতাপে বিষয় হলো প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেক ঐতিহাসিক গ্রন্থ, ভ্রমণ কাহিনী, চিঠিপত্রে চট্টগ্রামের ইতিহাস আংশিক বা খণ্ডিত ভাবে বর্ণিত হলেও চট্টগ্রামের উপর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একক কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাসগ্রন্থ রচিত হয়নি। সর্বপ্রথম খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থাকারে রচনা শুরু করেন। গ্রন্থটি পাঠে বুঝা যায় এই গ্রন্থ রচনায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছিল এবং ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হয়। ১৮৭১ সালে সেটি কলিকাতা হতে 'আহাদিসুল খাওয়ানিন” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। মূল গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় লিখিত। এই গ্রন্থটি চট্টগ্রামের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে ইংরেজ রাজদরবার ও অভিজাত মহলে সপ্রশংস গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। অনেকের কাছে গ্রন্থটি 'তারিখে হামিদ' নামেও পরিচিত। বিগত শতকে বাংলা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ইতিহাস চর্চায় 'তারিখে হামিদ' বহু গবেষণায় অগুনিতবার রেফারেন্স গ্রন্থ হিসাবে স্থান পেয়েছে। যেহেতু মূল গ্রন্থটির কোনো অনুবাদ ছিল না তাই সম্মানিত লেখক- গবেষকগণ এক্ষেত্রে কেবল প্রয়োজোনীয় অংশটুকুই অনুবাদ করেছেন, কখনোবা ভাবানুবাদ করেছেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ডক্টর আবদুল করিম অনেকবার চেষ্টা করেও এই গ্রন্থটির অনুবাদ কাজে হাত দিতে পারেন নি। মহান আল্লাহর অশেষ দয়ায় আমরা অনুবাদের কাজটি শেষ করতে পেরেছি। গ্রন্থটির মূল ফারসি কপি সংগ্রহ করে অনুবাদ, টীকাভাষ্য ও সম্পাদনার কাজে প্রায় দশ বছর সময় লেগেছে। মূল গ্রন্থে বর্ণিত অনেক স্থান এখন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে বা নাম পরিবর্তিত হয়ে গেছে, একশত পঞ্চাশ বছর পূর্বের অনেক ফারসি শব্দের এখন ব্যবহার নেই। এছাড়াও 'আহাদিসুল খাওয়ানিন' ক্লাসিক্যাল ফারসি ভাষায় লেখা, তাই এর মূল ভাষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক অনুবাদ করাও অত্যন্ত দুরূহ কাজ। বিশেষ করে গ্রন্থের ফারসি কবিতাগুলোর অন্ত্যমিল, ছন্দ ও অনুপ্রাসের ধারাবহিকতা বজায় রেখে মূল ভাব ঠিক রাখা অত্যধিক কঠিন। এ ক্ষেত্রে মূল গ্রন্থের সফল অনুবাদক শ্রদ্ধেয় ড. খালেদ মাসুকে রাসুলকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তিনি নিষ্ঠা ও ধৈর্য সহকারে এই সুবিশাল গ্রন্থের পরিপূর্ণ অনুবাদ করেছেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে গ্রন্থটির মূল্যায়ন হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। চট্টগ্রাম-বিশেষঙ্গ আবদুল হক চৌধুরী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উক্ত গ্রন্থের আলোচনা করেছেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. আবদুল করিম, সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, ড. আবদুর রহিম, ড. মোহর আলী, ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো, ড. আহমদ শরীফ, ড. সুখময় মুখোপাধ্যায়, ড. মুনতাসীর মামুন, প্রমুখ শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত গ্রন্থটির গুরুত্ব ও অনুবাদের আবশ্যকতার কথা বারংবার আলোচনা করেছেন।
'আহাদিসুল খাওয়ানিন'-এর আংশিক অনুবাদ ইংরেজিতে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭০ সালে। ইংরেজ ঐতিহাসিক ব্লকম্যান Asiatic Society of Bengal Journal- এ বিশেষ বিশেষ অংশের অনুবাদ প্রকাশ করেন। মূলতঃ সেই সময়ে প্রথম ব্যাপক আলোচনায় আসে গ্রন্থটি। এ গ্রন্থটির মাধ্যমেই সমগ্র ভারতবর্ষ ও ইউরোপের পাঠক মহলে চট্টগ্রামের পরিচিতি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। সাহিত্যিক মাহুব্-উল্ আলম তাঁর 'চট্টগ্রামের ইতিহাস' এর নবাবী আমল ও কোম্পানী আমল দুই খণ্ডে 'আহাদিসুল খাওয়ানিন'-এর অংশবিশেষের ভাবানুবাদ প্রকাশ করেন।
গ্রন্থটির বিশেষ দিক হলো এ গ্রন্থে চট্টগ্রামের অধিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভৌগোলিক, জলবায়ু, কৃষি ও কৃষিপণ্য, ভেষজ ও বনজ লতা-গুল্ম, ফলমূল, পশুপাখি, মাছ, এমনকি শুটকির আলোচনাও উঠে এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে পারিবারিক সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রতিটি বিষয়ের খুটিনাটি বিবরণ রয়েছে এই গ্রন্থে। এতে লেখকের গভীর অনুসন্ধিৎসা ও পর্যবেক্ষণের শক্তি ফুটে উঠে। চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্যের অবনতির কারণ নিয়ে পর্যালোচনা লেখক সম্পর্কে সত্যিই শ্রদ্ধা জাগায়।
খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান প্রথমত একজন কবি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দিন, আবুল কাশিম ফিরিশতা, বাদায়ূনী, আবুল ফজল, শিহাব উদ্দিন তালিশ, গোলাম হোসেন খান তাবাতাবায়ীর ন্যায় উঁচুস্তরের ঐতিহাসিক ছিলেন না। তাঁর সমগ্র রচনায় কাব্যময়তার ছাপ স্পষ্ট, স্থানে স্থানে তিনি তাঁর অনুভূতি কবিতায় প্রকাশ করার অভ্যাস সংবরণ করতে পারেননি। কোনো কোনো কবিতা আকৃতির দিক থেকে দীর্ঘ ও ভাষা অতি আবেগপূর্ণ। একজন সত্যিকারের ঐতিহাসিক হওয়ার পথে এটি একটি বড় সমস্যা। তাঁর দ্বিতীয় সমস্যা ছিল তিনি উগ্র জাত্যভিমান বশত আভিজাত্যের অহংকারে দুষ্ট ছিলেন। মানুষের জাত-বংশ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তৃতীয় সমস্যা ছিল তিনি কট্টর সুন্নী মতাদর্শ দিয়ে ইতিহাস বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। রাফেজী ও শিয়াদের তিনি বিপথগামী অমুসলিম বলে কটূক্তি করেছেন। তিনি নিজেকে দারাইল্যা বলে হরাইল্যাদের অবজ্ঞার চোখে দেখেছেন। বিশেষ করে আমিরাবাদ, ভুলুয়া, দাঁদারা ও নিজামপুরকে তিনি নিজের অঞ্চল বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া স্থানীয় হিন্দু জনগণ ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঐতিহাসিক নির্লিপ্ততা রক্ষা করতে পারেন নি। এ সমস্ত বিষয় পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ্ খান পণ্ডিতসুলভ উদারতা ও ঐতিহাসিকসুলভ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে পারেন নি।
সর্বজনশ্রদ্ধেয় পণ্ডিত আবুল ফজল আল্লামি ও গোলাম হোসেন তাবাতাবায়িকে হামিদুল্লাহ্ খান ধর্মদ্রোহী বলে চিহ্নিত করেছেন। পদ্মাবতী কাব্যে মহাকবি আলাওল হিন্দু আচার অনুষ্ঠানের যে রসসিক্ত অনুপম বর্ণনা দিয়েছেন তার সমালোচনা করেছেন। তিনি লর্ড এলেনবারোর রাজস্ব সংস্কার ও দাস প্রথা বিলুপ্তি আইনের বিপক্ষে ছিলেন। হামিদুল্লাহ খান উনবিংশ শতকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, সিপাহী বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময় বিশেষত ১৮৫০-১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। সম্ভবত তিনি ইংরেজ রাজশক্তির অনুগত (faithful native) হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লবের সময় হামিদুল্লাহ্ খান ও তাঁর আত্মীয়-পরিচিত মহল ইংরেজদের সর্বাত্মক সহায়তাদান করেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে ইংরেজ রাজশক্তি তাঁকে 'খান বাহাদুর' উপাধি প্রদান করে এবং তিনি তা গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলেন। আমৃত্যু তিনি ইংরেজ অনুগত ছিলেন। এই ঘটনার একটি ইতিবাচক দিকও ছিল। ইংরেজদের সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারণেই তিনি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি ইংরেজদের কবল থেকে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন এবং তা মুসলমানদের ইবাদতের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
এই গ্রন্থের সন-তারিখ মগী সনের মোতাবেক করা হয়েছে, আমরা মগী সনকে ইংরেজি সনে রূপান্তর করেছি। এক্ষেত্রে দু'এক বছর কম-বেশি হতে পারে, আশা করি পাঠকগণ তা নিজের মত করে বুঝে নিবেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে 'আহাদিসুল খাওয়ানিন' খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খানের একটি মৌলিক রচনা। উনবিংশ শতকের চট্টগ্রামের যে কোনো ইতিহাসচর্চা ও অনুসন্ধানের জন্য এই গ্রন্থটির সাহায্য আবশ্যক। আশা করছি বাংলায় অনূদিত 'আহাদিসুল খাওয়ানিন' বা 'তারিখে হামিদ' গ্রন্থটি ইতিহাস- সচেতন পাঠকগণকে আনন্দ দেবে এবং দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশ ও চট্টগ্রামের ইতিহাস চর্চায় ও গবেষণা কর্মে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে অবদান রাখবে। এই গ্রন্থটির মান উন্নয়নে যে কোনো পরামর্শ, তথ্য-উপাত্ত আমরা উদারভাবে গ্রহণ করবো।
মরহুম খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খানের উত্তরপুরুষ মরহুম এ, এস, এম আমানতদ্দৌলা খান ও মরহুম এ, এস, এম আজিমদ্দৌলা খানের সুযোগ্য সন্তানগণ বিশেষ করে জনাব সাইয়েদ খান, জনাব কে.এম আশরাফ সিদ্দিকী (আক্কু ভাই), মোঃ রাশেদ দ্দৌলা খান আমাকে এই গ্রন্থখানি প্রকাশের নিঃশর্ত অধিকার ও স্বত্ব প্রদান করে এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যে উপকার করেছেন তার শুকরিয়া আদায় করছি। আমার ছোট মামা জাতীয় বিনিয়োগ বোর্ডের সম্মানিত সদস্য আহমদ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ এই গ্রন্থটি প্রকাশের ব্যপারে যে প্রেরণা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁকে ছোট করতে চাই না।
পরম শ্রদ্ধেয় লেখক সুব্রত বড়ুয়া গ্রন্থটি আদ্যোপান্ত নিরীক্ষণ করে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। সবশেষে অনুপম প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মিলন নাথকে জানাই সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা।
-- তানবীর মুহাম্মদ, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজ, ১ জানুয়ারি ২০১৩
সূচিপত্র
- প্রথম অধ্যায়
- প্রথম পরিচ্ছেদ
- ইসলামাবাদে প্রথম বসতি ও প্রধান বিজয়াদি সম্পর্কিত বর্ণনা
- আধুনিক ও প্রাচীন হিন্দুজাতির উৎপত্তি
- ইসলামাবাদের প্রাথমিক নির্মাণ ও বসতিস্থাপন
- ভেলুয়া সুন্দরীর কাহিনী
- ভেলুয়ার পরে
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- প্রাসঙ্গিক ফারসি কবিতার অনুবাদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- দ্বিতীয় অধ্যায়
- তারিখে হামিদ
- প্রথম পরিচ্ছেদ
- কবিতা
- পাহাড়িরা যে ত্রিপুরার মহারাজার অধীনতাপাশ ছিন্ন করেছিল তার কারণ
- ইসলামবাদের জনসাধারণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- ইসলামাবাদের জনসংখ্যা ও জমিন নিয়ে আলোচনা।
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- আগা বাকের
- দেওয়ান সভাসিং
- নবাব সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খান
- নবাব রশীদ খান
- পুনর্বার নবাব বুজুর্গ উমিদ খান
- মীর জাফর খান
- বাহাদুর খানের পুত্র মোজাফ্ফর খান
- নবাব ফেদায়ী খান
- নবাব নুরুল্লাহ্ খান
- নবাব ইয়াকুব খান
- নবাব রহমত উল্লাহ্ খান
- নবাব আকিদত খান
- নবাব রহমত উল্লাহ্ খান
- নবাব বেশারত খান
- নবাব শের বুলন্দ খান
- নবাব মুর্শিদ কুলি খান
- নবাব মীর এওজি
- ফিদবী হোসাইন খান
- দ্বিতীয় প্রতিনিধি
- হোসাইন মোহাম্মদ খান
- মনিরাম
- চতুর্থ প্রতিনিধি
- মোহাম্মদ রেজা খান
- সিরাজ উদ্দীন মোহাম্মদ খান
- দ্বিতীয় প্রতিনিধি মীর আফজল
- দ্বিতীয় নায়েব হাসান কুলি খান
- মহাসিং
- নায়েব আকা মোহাম্মদ নেজাম
- নায়েব মীর মোহাম্মদ রেজা খান
- প্রাক-শাহী আমল ও শাহী আমলের সর্দার, জমিদার ও সম্মানিত ব্যক্তিগণ,
- জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ধরন ও সময়
- মরহুম ইয়াহ্ইয়ার খান্দান
- মরহুম শেহাব উদ্দীন দারোগা
- চৌধুরী কাদের ইয়ার খানের খান্দান
- ফজল আলী খানের খান্দান ও সমকালীন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ
- চৌধুরী ও হামজা খানের খান্দান
- উপদেশ
- মুনশীদের আলোচনা
- খোন্দকারগণ
- ইসলামাবাদের কতিপয় ওলি ও মাজমুব: তাঁদের কেরামত
- শাহ আমানত
- মজ্যুব
- মন্তব্য
- শরীয়তের মতামত
- হুলা পরগনা
- আসাদ চৌধুরীর খান্দান
- চৌধুরী মোহাম্মদ আকবরের খান্দান
- মোল্লা ছাইনের বংশ
- নয়াপাড়ার মদন চৌধুরী
- রমজান আলী চৌধুরী
- মুজাফফরাবাদের মুন্নী খান্দান
- মুঘল-অনুগামীদের কথা
- মির্জা মাহমুদের খান্দান
- জ্ঞানীদের জন্য উপদেশ
- কোরআনের ঘোষণা
- হিন্দু জমিদার
- ইসলামাবাদের কিছু ব্যবসায়ী ও কারিগরদের সম্বন্ধে আলোচনা
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ
- তরিতরকারি
- বনজ সম্পদ
- ইংরেজ আমলের পূর্বেকার খাজনা ও করের আলোচনা
- বুজুর্গ উমিদ খান
- ওলিবেগ খান
- ইসলামাবাদের জমির পরিমাণ, জনসংখ্যা, খাজনা ও করের বিবরণ
- আবহাওয়া দূষিত হওয়ার কারণ
- ইসলামাবাদের কিছু অশুভ লক্ষণের আলোচনা
- তৃতীয় অধ্যায়
- ইসলামাবাদ জমে মসজিদের ইতিবৃত্ত
- প্রথম পরিচ্ছেদ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- চতুর্থ অধ্যায়
- প্রথম পরিচ্ছেদ
- সাম্রাজ্যবিস্তার
- চারিত্রিক পবিত্রতা
- গোলাম হোসেন
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- 'দীন-ই-ইলাহীর আদর্শ ও রীতিনীতি
- জেহাদ
- পঞ্চম অধ্যায়
- প্রথম পরিচ্ছেদ
- নবাব শায়েস্তা খান
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- শায়েস্তা খানের চরিত্র
- লেখক পরিচিতি
হামিদুল্লাহ খাঁর রচিত বাংলা গ্রন্থ
ঊনবিংশ শতকের একজন খ্যাতিমান মনীষী ছিলেন খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ্ খান। তিনি ফারসি ভাষায় কবিতা রচনা করে যেমন সুখ্যাতি অর্জন করেন, তেমনি সমকালীন ইসলামাবাদের (চট্টগ্রাম) একটি প্রামাণ্য ইতিহাস রচনা করেও সুধী সমাজের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নিজের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি তাঁর বই 'আহাদিসুল খাওয়ানিন'-এর ভূমিকায় লিখেছিলেন, 'খাকসারের নাম হামিদুল্লাহ্ ইসলামাবাদী, পিতার নাম মরহুম খান বাহাদুর ওবায়দুল্লাহ্। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মর্যাদা ও উচ্চপদের অধিকারী হিসেবে এ অঞ্চলে প্রখ্যাত।' তাঁর মনে বাসনা জাগে যে, তিনি এ সময়কার অবস্থা সম্বলিত একটি তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করবেন। আর বইটিতে থাকবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমির প্রকার, মাঠঘাট, ভূমির উৎপন্ন দ্রব্যাদি, অধিবাসী, কর্তৃপক্ষ, ভদ্রসমাজ, প্রবীন ও প্রধান বিজ্ঞলোক প্রভৃতির বিবরণ। হামিদুল্লাহ্ খানের জন্ম বনেদি অভিজাত পরিবারে। তাঁর পিতা-পিতামহ ছিলেন চট্টগ্রামের সম্ভ্রান্ত জমিদারদের সমগোত্রীয়। বাদশাহি ও ব্রিটিশ আমলে তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন উচ্চ রাজ কর্মচারী।
::::::::::
আহাদিসুল খাওয়ানিন চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস
মূল : মৌলভী হামিদুল্লাহ্ খান বাহাদুর
অনুবাদ : ড. খালেদ মাসুকে রসুল
সম্পাদনা ও টীকাভাষ্য : তানবীর মুহাম্মদ
প্রকাশক: অনুপম প্রকাশনী
প্রকাশকাল: জুন ২০১৩
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ৪০০ টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম