চট্টগ্রামের ইতিহাস, জনজীবন-সংস্কৃতির তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ বিবরণে সমৃদ্ধ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বই 'ইসলামাবাদ'। তথ্য আহরণে লেখকের পরিশ্রম-নিষ্ঠা এবং সেগুলোর বিশ্লেষণে তাঁর নৈর্ব্যক্তিকতা ও দক্ষতার কারণে এই বইটি চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসুদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমিদ খাঁ মগ ও পর্তুগিজদের কবল থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত ক'রে এর নাম দিয়েছিলেন ইসলামাবাদ। ইংরেজ শাসনামলেও এই নামের প্রচলন ছিল। পরে চট্টগ্রাম নামটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পুরাতত্ত্ববিদ উইলফোর্ডের তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম ছিল পুষ্পপুর। এই পুষ্পপুর বা ইসলামাবাদ বা চট্টগ্রামেরই ইতিহাস, সমাজ ও জনজীবনের পরিচয় দিয়েছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। ইসলামাবাদ নামে পরিচিত হলেও চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছে পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মাবলম্বীদের মিলনক্ষেত্র। কীভাবে নানা ধর্মসাধনার তীর্থভূমি এবং বহু সংস্কৃতিচর্চার উর্বরভূমি হয়ে উঠেছে এই জনপদ-তারই তথ্যনির্ভর ও মনোমুগ্ধকর বিবরণ আছে এই বইতে। আবদুল করিমের অনুসন্ধিৎসু গবেষণায় উদ্ঘাটিত হয়েছে প্রাক মুসলমান যুগে চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে ত্রিপুরার হিন্দু-নরপতিদের সঙ্গে আরাকানের বৌদ্ধ-শাসকদের বিরোধ-দ্বন্দ্ব, পর্তুগিজদের দখল-প্রয়াস, মুঘল সাম্রাজ্যভুক্তি, ইংরেজদের অধিকার-ইতিহাসের এই দ্বন্দ্বমুখর ঘটনাবলি।
পালি, মঘী, রাঢ়ীয় আরবি, ফার্সি ও পর্তুগিজ ভাষার মিশ্রণ ও প্রভাবে চট্টগ্রামের ভাষা কীরকম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে তার পরিচয় দিয়েছেন লেখক, অনেকটা ভাষাতাত্ত্বিকের মতো বিশ্লেষণ ক'রে। এই কারণে চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অসাধারণ দলিলে পরিণত হয়েছে ইসলামাবাদ।
ইসলামাবাদ প্রকৃতির চির লীলা-নিকেতন! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ইহার সহিত তুলনীয় হইতে পারে, ভারতে এমন স্থান অতি অল্পই আছে। প্রকৃতি সুন্দরী তাহার সকল সুন্দর বস্তু হইতে তিল তিল সৌন্দর্য আহরণ করিয়াই যেন আমাদের জন্মভূমির গায়ে মাখাইয়া দিয়াছেন। ইহাকে সৌন্দর্য-লীলামভূতা সৌন্দর্যের রাণী বলিলেও তাহার কিছুই বর্ণনা করা হয় না। সৌন্দর্যের উপাসকগণ ইহার মুনিমন-লোভন চিত্র দেখিয়া ভাবে আত্মহারা হইবেন। ঘোর সংসারী হইতে সংসার-বিরাগী যোগিজন পর্যন্ত সকল শ্রেণির লোকের পক্ষেই ইহা পরম মনোরম স্থান। প্রকৃতি সুন্দরী এমন অকাতরে আপনার বিভূতি ভারতের আর কোথাও বিলাইয়াছেন কি না সন্দেহ। আমাদের এই তালতমালতরুরাজিনীলা শস্য-শ্যামলা জন্মভূমির চতুর্দিকে অনন্ত বিস্তৃত বারিধি এবং পর্বতশ্রেণি প্রিয় সহচরীর ন্যায় সৌন্দর্য সম্ভার হস্তে সতত দণ্ডায়মান! একটু অনুধ্যান করিয়া দেখিলেই ইহার সমস্ত সৌন্দর্য ছায়াচিত্রের ন্যায় দর্শকের নয়ন-সমক্ষে প্রতিভাত হইবে। পশ্চিমের পর্বত শিখরে আরোহণ করিয়া চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলে ইহার নৈসর্গিক সৌন্দর্য-মাখা মনোহারিণী মূর্তিখানি আপনাদের দৃষ্টিপথবর্তিনী হইবে। সেই দৃশ্যে ভাবুকগণ ভাবের বিহ্বলতায় একেবারে আত্মবিস্মৃত হইয়া যাইবেন, পুত্র-শোকাতুর পিতার হৃদয় হইতে অন্ততঃ ক্ষণকালের জন্যও পুত্র-বিরহ-বেদনা অন্তর্হিত হইয়া যাইবে, আর সাধারণ মানবের মনে অতুল আনন্দের উৎস উথলিয়া উঠিবে। পাঠক একবার কল্পনানেত্রে পশ্চিমের সেই অনন্ত-বিস্ফারিত বারিরাশির প্রতি চাহিয়া দেখুন। দেখিবেন, উহার ফেনিল বারিরাশি ঊর্ধ্বস্থিত সুনীল গগনের প্রতিমা বুকে লইয়া মনের আনন্দে কেমন তরঙ্গে তরঙ্গে নাচিয়া নাচিয়া ছুটিয়াছে। সান্ধ্য অংশুমালীর অংশুজালে স্বর্ণকান্তি-বিশিষ্ট হইয়া সান্ধ্য সমীরণ-হিল্লোলক্ষুব্ধ বীচিমালা কেমন সুন্দর মধুর হাসি হাসিতেছে। আবার নৈশগগনে পূর্ণচন্দ্র যখন রজততারা বিস্তার করিয়া এই বিশাল বারিধি বক্ষে তরঙ্গে ভঙ্গে হাসিতে হাসিতে নাচিতে থাকে, সেই দৃশ্যের বর্ণনা আমার এই ক্ষুদ্র লেখনীর পক্ষে অসম্ভব। ঐ স্থান হইতে একবার পূর্বদিকে দৃষ্টি ফিরাইলে আপনারা দেখিবেন, বহুদূরব্যাপী সমতলভূমি ছাড়াইয়া পর্বতমালা সুনীল নভোমণ্ডলের সহিত একাত্মভাবে মিশিয়া গিয়া কী সুন্দর দৃশ্যেরই সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে। কেবল নীলিমার পর নীলিমার তরঙ্গ দেখিয়া দেখিয়া চক্ষুর তৃপ্তি হইয়াও হয় না। ভাবুক হৃদয় তখন ভাবোচ্ছ্বাসে বিদ্যাপতির ভাষায় বলিবে:
জনম জনম হাম রূপ নেহারনু নয়ন না তিরপিত ভেল।
সেই ঘন নীলিমা-মণ্ডিত পর্বতমালা কখনও-বা নিবিড় জলদজাল বলিয়া আপনাদের চক্ষুর ভ্রমোৎপাদন করিবে। এই সকল পর্বতমালা অনন্ত যুগ-যুগান্তর ধরিয়া ধ্যাননিমগ্ন যোগীর ন্যায় এরূপে অনন্ত সৌন্দর্যের আধার বিশ্বপিতার চরণ-ধ্যানে নিযুক্ত রহিয়াছে। আমরা তাহা দেখি, আর দেখিয়া দেখিয়া হর্ষোৎফুল্ল-লোচনে বিস্ময়-স্তম্ভিত-হৃদয়ে কেবল সেই অনন্ত শক্তিমানের অনন্ত শক্তির কথা ভাবিতে থাকি। আমাদের জন্মভূমির এই অনুপম সৌন্দর্যই আবহমানকাল নানা দেশের যোগী ও দরবেশদিগকে আকর্ষণ করিয়া আনিয়া আপনার বুকে স্থান দিয়াছিল। পূর্বে পরীর রাজ্য ছিল বলিয়া চিরদিন ইহার একটা খ্যাতি আছে। একটু চিন্তা করিয়া দেখিলেই আপনারা বুঝিতে পারিবেন, তাহার এই খ্যাতি অনর্থক কল্পিত হয় নাই। সাধনার এমন উপযোগী স্থান সমগ্র বঙ্গদেশে আর দ্বিতীয় নাই। সৌন্দর্য পিপাসুর সৌন্দর্য-লিপ্সা মিটাইবার উপযুক্ত স্থান এই চট্টগ্রাম; ভাবুক জনের পক্ষেও ইহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ স্থান জগতে দুর্লভ। বস্তুত কল্পনারাজ্য ভিন্ন বাস্তব জগতে এমন সুন্দর দেশ জগতে বড় বেশি মিলিবে কি না সন্দেহ।
অন্তত সৌন্দর্যের আধারভূতা বলিয়াই আমাদের জন্মভূমি চিরদিন কবিপ্রসূতি। চিত্রকরের কল্পনা-প্রসূত চিত্রপটে মাত্র আপনারা এতদিন এরূপ দেশের চিত্র দেখিয়াছেন। এবার চর্মচক্ষে সে চিত্র দেখিয়া যাইবেন। উত্তরে ফেনী-নদী, দক্ষিণে আরাকান সীমার নাফ-নদী এবং বঙ্গোপসাগর, পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের গিরিরাজি এবং পশ্চিমে বঙ্গসমুদ্র-এই চতুঃসীমার মধ্যবর্তী ২৪৯৮ মাইল পরিমিত ভূভাগই আমাদের ইস্লামাবাদ। নামে ইস্লামাবাদ হইলেও ইহাতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এই চারি জাতিরই বসতি রহিয়াছে। ইহার অধিবাসীর মধ্যে প্রায় চারি লক্ষ হিন্দু, সত্তর হাজার বৌদ্ধ, দেড় হাজার খ্রিস্টান এবং প্রায় এগারো লক্ষ মুসলমান।
১। এই সংখ্যা ১৯১১ সালের গণনা অনুযায়ী। ঐ সময়ে চট্টগ্রাম জেলার লোকসংখ্যা ছিল ১৫,০৮,৪৩৩। ১৯৬১ সালের গণনা অনুযায়ী চট্টগ্রামের লোকসংখ্যা ২৯,৮২,৯৩১। মুসলমান ২৪,০৭,৩৬৮। বর্ণহিন্দু ৩,৯৮,০৫৪। তফসিলী হিন্দু ৯৬,০৭২। খ্রিস্টান ৩,০৩৬। অন্যান্য ৭৮,৪০১।
লেখক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন পুথিসংগ্রাহক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
তাঁর জন্ম ১৮৭১ সালের ১০ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে। পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ১৮৯৩ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। চট্টগ্রাম কলেজে কিছুকাল এফ.এ. শ্রেণিতে পড়েছিলেন। চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল বিদ্যালয় ও সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর চট্টগ্রামের প্রথম সাব-জজ আদালতে চাকুরিতে নিযুক্ত হন।
প্রাচীন পুথির প্রতি আকর্ষণ বাল্যকালেই। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচয় উদ্ঘাটনে পুথির ভূমিকা উপলব্ধি ক'রে পুথিসংগ্রহে নিয়োজিত হন। সারা জীবন ধ'রে পুথি ও পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সংগৃহীত পুথির সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। সম্পাদনা করেছেন নরোত্তম ঠাকুরের রাধিকার মানভঞ্জন, কবিবল্লভের সত্যনারায়ণের পুথি, দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ, দ্বিজমাধবের গঙ্গামঙ্গল, আলী রাজার জ্ঞানসাগর, শেখ ফয়জুল্লাহ্ গোরক্ষ-বিজয় ও আলাওলের পদ্মাবতী। সাহিত্যবিশারদ-আবিষ্কৃত পুথিগুলো বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাসকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন রচনা ও রচয়িতাদের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখে তিনি আমাদের ইতিহাসচর্চার ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
১৯৫২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মৃত্যুবরণ করেন।
::::::::::
ইসলামাবাদ
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
দ্বিতীয় মুদ্রণ: পৌষ ১৪২৬, ডিসেম্বর ২০১৯
প্রথম বাতিঘর সংস্করণ: মাঘ ১৪২৩, ফেব্রুয়ারি ২০১৭
প্রথম প্রকাশ: আশ্বিন ১৩৭১, অক্টোবর ১৯৬৪
প্রকাশক: বাতিঘর
মূল্য: ৩০০ টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম