কলকাতা ছুঁয়ে ভারত ঘোরার দিনলিপি - ইকবাল করিম হাসনু

কলকাতা ছুঁয়ে ভারত ঘোরার দিনলিপি বইয়ের প্রচ্ছদ - ইকবাল করিম হাসনু

 

ঐতিহাসিক জনপদ কোলকাতা ভ্রমণের গল্প। বইয়ের ভূমিকায় নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে আবুল মোমেন বলেন:-



কোলকাতাকে কেন জানি আপন মনে হয়। এত জঞ্জাল, নোংরা আর বিদীর্ণ অবস্থার মাঝেও কোলকাতাবাসীদের জীবনযাত্রা গতিবান। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতাই বোধ হয় আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত করে তুলেছে সংশয়ে এবং দুশ্চিন্তায় ভরা! আমার মাদ্রাজ থেকে হাওড়াগামী ট্রেন ধরতে পারার পর থেকেই আমি নিজের ওপর আস্থা ফিরে পাচ্ছিলাম। এটা কি কোনো ঘরকুনো বাঙালির নস্টালজিয়া?

আমার মনে হয় আস্থা ফিরে পাওয়ার পেছনে কাজ করেছে আর্থিক অবস্থার আনুকূল্যের সম্ভাবনা।



স্মৃতি ও প্রীতি


আমার মায়েরা অনেক ভাইবোন-চৌদ্দজন। তার ওপর জ্যাঠা মহাশয় রেঙ্গুনের দাঙ্গায় খুন হওয়ায় সেই চার ভাইবোনও তাদের পরিবারভুক্ত হয়েই বড়ো হয়েছেন। এই আঠারোজনের সঙ্গে অনায়াসে ছোটো কাকার আটজনকেও ধরা যায়। সব মিলে মামা-খালারা ছিল ছাব্বিশজন। এর মধ্যে কেউ কেউ, প্রায় সাতজন ছিল বয়সে আমারও ছোটো, দু-একজন ছিল সমসাময়িক খেলার সাথী। মা ছিল এই গোষ্ঠীর জ্যেষ্ঠজন-অনেকের, বলা যায় সকলের মাতৃ তুল্য। বাবা ছিলেন অধিকাংশের পিতৃতুল্য ভগ্নিপতি। মায়ের এই জ্যেষ্ঠতার কারণে আমাদের অসংখ্য খালাতো-মামাতো ভাইবোনের মধ্যে সকলেই আমাদের সব ভাইবোনের ছোটো। উল্লেখ্য আমি ভাইবোনদের মধ্যে পঞ্চম জন তথা দ্বিতীয় শেষ মানে সেকেন্ড লাস্ট। বুঝতে অসুবিধা হবে না যে খালাতো- মামাতো ভাইবোনদের গুটিকয় বাদে বাকি সকলেই আমাদের অনেক অনেক ছোটো। কিশোরকাল হলো বড়ো হওয়ার বা বড়োগিরির তথা দাদা-দিদিগিরির পৌষমাস, ফলে নিচের দিকে যে ভাইবোনের ভিড় তৈরি হয়েছিল তাদের তেমন আলাদা করে চেনার গরজ হয়নি। তারই কোনো ভিড়ে ইকবাল করিম হাসনুও যে রয়েছে সেটা তখন বোঝা যায়নি।

তবে হাসনুদের আলাদা করে চেনার সুযোগ ছিল। বৃহৎ আলম পরিবারে তখনও একমাত্র মণিখালাই (হাসনুর মা) চাটগেঁয়েদের ভাষায় বিদেশে থাকেন। সেকালে ছেলেমেয়েরা পারিবারিকবৃত্তে এতই গোষ্ঠীবদ্ধ থাকত যা আবার আলমদের মধ্যে একটু বেশিই ছিল, তাদের কাছে কাপ্তাইও ছিল বিদেশ-৩০ মাইল দূরের সুদূর এক কৃত্রিম বসতি। কাপ্তাইয়ে তখন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘিরে মাত্রই ছোটো ঝকঝকে উপশহর গড়ে উঠেছে। এরকম শহরে অফিসার-গিন্নিদের সময় কাটে লেডিস ক্লাবে নিজ নিজ সামর্থ্য প্রদর্শনে, বন্ধুতায়-বৈরিতায় এবং সন্তানদের কৃতিত্ব জাহিরে। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের কৃতিত্ব প্রদর্শনের অনিবার্য বিষয় তো ব্যক্তিগত রূপলাবণ্য ও সাজসজ্জা; তাতে কিঞ্চিৎ ঘাটতি থাকলেও মণিখালা অপর দুটি ক্ষেত্রে ছিলেন জুড়িহীন। সে দুটি ক্ষেত্র হলো রান্না ও সেলাই। যেমন দুটিই নিজে ভালো পারতেন তেমনি নতুন কিছু শিখতেন আরও দ্রুততায়, তদুপরি কাপ্তাই তখন পাহাড়ের কোলে লেকের পাড়ে অসাধারণ এক প্রকৃতির দুহিতা-নগরী। মামাদের গোষ্ঠীপ্রীতির জোর প্রবল হলেও তাঁরা ছিলেন স্বভাবত অভিযানপ্রিয়। ফলে গোড়ার দিকে অর্থাৎ ষাটের দশকের প্রথম পর্যায়ে যখন সত্যিই কাপ্তাই-ভ্রমণ প্রায় অভিযানের পর্যায়ে পড়ত বলে জায়গাটি তাদের প্রায় সাপ্তাহিক গন্তব্য হয়ে উঠেছিল। সেরকম ভ্রমণে অবশ্য আমাদের পারিবারিক কোটায় অভিযাত্রী সমাজের অসম অনুসারী ছোড়দা (আবুল মঞ্জুর) নয়ত পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন এবং মামাদের আদরের জ্যেষ্ঠ ভাগ্নিই (মমতাজ লতিফ) স্থান পেত। আমি বা পিঠোপিঠি মনসুরের (আবুল মনসুর) স্থান হতো না।

মনে পড়ছে আমি কাপ্তাই গিয়েছি এসএসসি পরীক্ষার পরে সহপাঠী কাজী শাহজাহান ও মাহমুদুল মান্নানকে (উভয়ে গত হয়েছেন) সঙ্গে নিয়ে। সেবার আমরা বেশ কদিন থেকে খালা-খালুর আদর-আপ্যায়নে চমৎকার সময় কাটিয়েছি। সেই সাথে চিনেছি ছোটো ভাইবোনদের-মনে হয় সবার তখনও ধরার বুকে আগমন শেষ হয়নি। কাপ্তাইতে সেকালে সম্ভবত ভালো স্কুল থাকলেও কলেজ ছিল না। ফলে খালার জ্যৈষ্ঠ সন্তান ফরিয়াদ (ফরিয়াদ উল ইসলাম, পরে বুয়েট থেকে স্থপতি হয়ে এখন কানাডাপ্রবাসী) প্রথমে এসে নানার (সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম) বাসায় থেকে কলেজে পড়তে শুরু করে। তাকে অনুসরণ করে এসেছে পরের ভাই হাসনু। এবার ওদের আলাদা করে চিনতে শুরু করি। হাসনু আসতে আসতে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ওকে দেখেছি ফুটবল খেলতে আমাদের সামনে আউটার স্টেডিয়ামে। সার্কিট হাউজ ও আউটার স্টেডিয়াম জুড়ে খেলার মাঠ ছিল ছটি। এসব মাঠে শৈশব-কৈশোরে আমরাও খেলেছি – কাজির দেউড়ি-হেমসেন লেন অঞ্চলের সব্বাই। আমাদের শৈশবে ক্রিকেটার তামিম ইকবালদের বাবা অকাল প্রয়াত ইকবাল খান (এক সময়ের জাতীয় ফুটবলার ও চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবলার-ক্রিকেটার তৈরিরও অসাধারণ কারিগর) ছিল খেলার সঙ্গী, হাসনুরা বোধ হয় ওর ছোটো ভাইদের অর্থাৎ তামিমের চাচাদের পেয়ে থাকবে। সম্ভবত ফুটবল খেলায় হাত ভেঙে হাসনু একবার বা হয়ত প্রথম আত্মীয়দের সবার নজর কেড়েছিল। একসময় হাসনুকে দেখলাম ফিল্ম সোসাইটিতে আগ্রহী হতে, এতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে। এটি আমরা শুরু করেছিলাম ১৯৭৩ সনে ঢাকা থেকে ফিরে। সাহিত্যেও হাত পাকাতে শুরু করলেও হাসনু ধীরে ধীরে ফিল্ম মানে আর্ট ফিল্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এ নিয়ে পড়াশোনা, আলাপ-আলোচনা এবং বিভিন্ন দেশের নামী পরিচালকদের ছবি দেখায় মেতে উঠেছিল। সম্ভবত চলচ্চিত্র তার জীবনবোধ ও বিশ্ববোধকে জাগিয়ে তুলেছিল। একবার কেউ এই জাগরণের স্বাদ পেলে তার পিছু ফেরার কিংবা সংসারের গণ্ডিতে আটকে পড়ার সুযোগ থাকে না। অতএব হাসনুও এগিয়ে চলল। এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে হাসনু গেল ঢাকায়। তার দেখার, চেনার, জানার পরিধি বাড়তে থাকল। তারপর তার জীবনে নারী এলো, আবার একসময় পাড়ি দিল পশ্চিমে, কানাডায় থিতু হলো। প্রকাশ করল 'বাংলা জর্নাল', তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ল দুই বাংলার নির্বাচিত বুধমণ্ডলীর মধ্যে। তবে চট্টগ্রামে থাকতেই হাসনুর বিকাশের সূচনা। তেমন একটা পর্যায়ে মূলত কলকাতার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি দেখতে সে গিয়েছিল কলকাতা এবং সেই সুবাদে ভারত ভ্রমণে। তারই বিবরণী এই বই-'কলকাতা ছুঁয়ে ভারত ঘোরার দিনলিপি'। দিনলিপি এটি, প্রতিদিনের বর্ণনায় নানা মানুষ, স্থান যেমন বর্ণিত হয়েছে তেমনি জানা যায় তার ভাবনা-ওপর-মনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া আর ভিতর-মনের চিন্তন। তাতে বোঝা যায় তার বয়স, তার সামর্থ্য, ভাবনার পরিসর; সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের রূপরেখারও কিছু আঁচ পাওয়া যায়। এমনিতে জীবন তো চলমান তাই দৃশ্যপট বারবার পাল্টেছে, তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণের প্রকাশ ঘটেছে, উপলব্ধির বয়ান মিলেছে সবক্ষেত্রে। বইটিতে আছে এক ভ্রামণিকের চলমানতার টুকরো ছবি ও খণ্ড বর্ণনা এ যেন চলমান জীবনের চলচ্চিত্র, বলা যায় চালচিত্র ও চলচ্চিত্র। মাঝে মাঝে অতি তরুণের বয়সোচিত রগরগে মন্তব্যও বেরিয়ে আসে কলমে। পরিশীলিত বয়স্ক পাঠকের মনে খটকা দিলেও কাঁচা মনের সততার বেপরোয়া শক্তিটাও বুঝতে হবে।
পাঠক এ বইয়ে ভ্রমণ সাহিত্যের স্বাদ পাবেন। আবার এ বই পড়তে পারেন এক সতেজ জিজ্ঞাসু তরুণ মনের বিশ্বদর্শন ও মানবপঠনের প্রথম পর্বের প্রাণবন্ত বয়ান হিসেবে। আমি বইটির সাফল্য কামনা করি। - আবুল মোমেন


বইয়ের 'টুকরো কথা' অংশে লেখকের পরিচয় দিতে গিয়ে আনোয়ার হোসেন পিন্টু বলেন: -


টুকরো কথা


শিল্প-সৌকর্যে টইটম্বুর কলকাতার 'ঠাকুর' ও 'রায়' পরিবারের মতো চট্টগ্রামের 'আলম পরিবার'ও অনেকটা সেই সৌকর্যে ভরপুর। সুকুমারবৃত্তির সকল শাখা- প্রশাখায় আলম পরিবারের প্রায় সব সদস্যের বিচরণ। ইকবাল করিম হাসনুও উক্ত পরিবার বা পথের পথিক।

তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় এবং সখ্যের বাঁধন বছর চল্লিশেরও বেশি। চট্টগ্রামে নির্মল চলচ্চিত্র আন্দোলন বা চর্চার সুবাদে আমাদের বেড়ে ওঠা। দু'জন সমবয়সি হলেও বোধ ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশি প্রাজ্ঞ ও বেগবান। ফরাসি ও বিশ্বচলচ্চিত্রের রূপ-বৈচিত্র্য যত না জানতে পেরেছি পঠন- পাঠনের মাধ্যমে, তার চেয়ে বেশি জেনেছি প্রিয়জন ইকবাল করিম হাসনু'র সান্নিধ্যে।

নানাভাবে তাঁকে দেখেছি, জেনেছি। সেই দেখা ও জানার মধ্যে যে ব্যাপারটা আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে তা হলো-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া। ভ্রমণবিলাসী মন তাঁর পুরো সত্তাজুড়ে। ভ্রমণ কিংবা পৃথিবী চষে বেড়ানোর প্রাপ্তি বা অর্জন কতটা ইতিবাচক, সেটা আমরা জানতে পারি সত্যজিতের শেষ চলচ্চিত্র 'আগন্তুক' এর প্রধান চরিত্র মনমোহনের কথা, চালচালন ও বিশ্বাসে।

হাসনু ভাইও বেরিয়ে পড়েছিলেন ১৯৮২ সালে অনুষ্ঠিত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের চিত্রদর্শনে। ভ্রমণ বা ঘুরে বেড়ানোর প্রধান অবলম্বন অর্থ বা টাকা। আমার জানা মতে খুব স্বল্প পুঁজি নিয়ে বন্ধুবর হাসনু কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়াও ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতের নানা শহর, উপশহর। শুধু তাই নয়, রাতে হোটেলে ফিরে প্রতিদিনের দিনলিপি লেখার ইচ্ছাকেও ক্লান্ত শরীর দাবিয়ে রাখতে পারেনি। অবাক লাগে ভাবতে, টাকার সাশ্রয় ঘটাতে গিয়ে সকাল-দুপুর-রাতের খাবার নামিয়ে এনেছিলেন অর্ধাহারে! ভাবখানা যেন এমন-'অনাহারে নাহি খেদ / বেশি খেলে বাড়ে মেদ'।

ইকবাল করিম হাসনু এখন প্রবাসী। প্রায় সাঁইত্রিশ বছর ধরে কানাডাবাসী বা সে দেশের নাগরিক। কিন্তু তাঁর বুকজুড়ে আঁকা হয়ে আছে বাংলাদেশ, তার আকাশ-বাতাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। সেটা যে শুধু কথার কথা নয়, তার প্রমাণ তাঁর সম্পাদিত অনিন্দ্য সুন্দর পত্রিকা-'বাংলা জর্নাল'।

- আনোয়ার হোসেন পিন্টু




বইয়ের 'কৈফিয়ত' অংশে লেখক ইকবাল করিম হাসনু এই বই সম্পর্কে নিজের ভাবনাগুলো জানান। তিনি বলেন: - 


কৈফিয়ত


প্রবাসে জীবিকার সর্বগ্রাসী সময়খেকো ব্যস্ততার মাঝে জুটে যাওয়া দুর্লভ এক অলস দুপুরে পুরোনো চিঠির বাক্সের তলায় পেয়ে গিয়েছিলাম লাল রেক্সিনে মোড়ানো চার ইঞ্চি প্রস্থ আর ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের রুলটানা কাগজের ক্ষীণতনু ডায়ারিটা। মনেই ছিল না এটার অস্তিত্বের কথা। তিন যুগ আগে দেশ ছেড়ে বিভুঁইয়ে পাড়ি দেওয়ার সময় সহায়সম্বল মাত্র দুটো স্যুটকেসের ভেতরে কী করে যেন ওটা ঠাঁই পেয়ে গিয়েছিল। কৌতূহলে বাক্সের তলা থেকে হাতে উঠিয়ে নিয়ে পাতা ওল্টাতে গিয়ে নিজের যুবাবয়সকে আবিষ্কার করি। ডায়ারি বা দিনলিপি লেখার অভ্যাস কখনো ছিল না, কালেভদ্রে অনুরোধের ঢেঁকি গিলে কিংবা নিজের তাগিদ থেকে একটু আধটু লেখালেখি করেছি। দিনলিপি লেখার অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও যৌবনের প্রথম প্রহরে দেশ ছেড়ে প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে পা রাখার রোমাঞ্চকর অনুভূতিকে লিপিবদ্ধ করেছিলাম বলেই আমার ষাট পেরোনো সত্তা নতুন করে নিজেকে যাচাই করার সুযোগ পেল।

পেছনে ফিরে তাকানোর মধ্য দিয়ে মানুষ তার স্মৃতি ও সত্তাকে পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ পায়। ১৯৮২ সালে যখন আমি বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশ বা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে যাচ্ছিলাম সেই সময়টায় কিন্তু দৃক্ মাধ্যম ছিল আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র এবং দূরদর্শননির্ভর। আজকাল আন্তর্জাল, মুঠোফোন/চলভাষ, ইনস্টাগ্রাম/ভিডিওগ্রামের মাধ্যমে দূরদূরান্তের মানব-জমিন, ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে ঘটমান বাস্তবতায় আমাদের প্রতিমুহূর্তের অভিজ্ঞতা হয়ে উঠছে সে-সময়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সমাজে তা ছিল কল্পনাতীত। শিল্পশাখার মধ্যে চলচ্চিত্রের প্রতিই আমার দুর্বলতা। মেধায় ও মননে দুর্বলতার কারণে শিল্পের অন্যান্য মার্গের মাহাত্ম্য আমি অনুধাবনে ব্যর্থ হলেও চলচ্চিত্রের প্রতি যে প্রবলভাবে আকর্ষিত হয়েছি তার কারণ মাধ্যমটি ভিন্ন দেশ, মানুষ ও সংস্কৃতির জগৎকে চাক্ষুষ করে তোলে।

বাসাতে থাকা বাতাবি লেবুর মাপের ছোট্ট একটি গ্লোব এবং অ্যাটলাস (মানচিত্রের বই) আমাকে উসকে দিয়েছিল ভূগোল পড়তে এবং প্রাকৃতিক ও জনজীবনের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পিয়াসি হতে। কৈশোরে জেগে ওঠা সেই ভ্রমণপিয়াসা বাস্তবায়িত করার বাস্তবসাপেক্ষ আবশ্যিক বয়সের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে দুটো ব্যাপার মনের মধ্যে গভীর ছাপ ফেলেছিল। প্রথমটি ১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের পাকিস্তান-হিন্দুস্তান যুদ্ধ। সেইসময় রাতে ব্ল্যাকআউট চলাকালে সাইরেন বাজানো হলে আমরা হয় খাটের তলায় না হয় বাসার সামনের আঙিনায় পেয়ারা গাছের তলায় খোঁড়া পরিখাতে গিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য আশ্রয় নিতাম। বর্তমানের বাংলাদেশ তখনও পূর্ব পাকিস্তান। আমার বয়স কেবল সাত। আমরা তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সদ্য গড়ে ওঠা ছিমছাম পরিপাটি উপশহর কাপ্তাইতে থাকি। স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বৃহত্তর বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা আর রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে 'ভারত'কে ইন্ডিয়া অথবা হিন্দুস্তানই বলা হতো। পরে যখন আরও ওপরের শ্রেণিতে উঠি তখন সেই ছোট্ট মফস্সল শহরে চালু হয়ে যাওয়া ওই ১৭ দিনের যুদ্ধের রেশ ধরে কিছু গুজব আমার মতো কিশোরদের কানেও এসেছিল। সেসব গুজবের একটি ছিল আমাদের স্কুলের নিরীহ গোবেচারা টাইপের বাঙলার শিক্ষক আচার্য স্যারকে নিয়ে। যেহেতু তিনি ছিলেন হিন্দু তাই তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখাই যেন কর্তব্য! গুজবটা ছিল তিনি নাকি ব্ল‍্যাকআউট চলাকালে টর্চ লাইট মেরেছিলেন আকাশের দিকে, যাতে শত্রুপক্ষ হিন্দুস্তানের বোমারু বিমানের সুবিধে হয়। প্রায়শ আমাদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুল থেকে বাসায় স্যারের নিত্যদিনের যাওয়া-আসা দেখতাম। মাঝেমধ্যে দেখতাম সাইকেলের হ্যান্ডেলবারে কন্যাসন্তানকে বসিয়ে চলেছেন কোথাও। কখনও শ্রেণিকক্ষে কিংবা বাইরে কারুর ওপর তাঁকে রাগ করতে দেখিনি। এহেন নিরীহ আচার্য স্যারের ওপর কেন যে এরকম একটা অপবাদ ছড়ানো হয়েছিল তা নিয়ে মনটা খচখচ করত। দ্বিতীয় ঘটনাটা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং অব্যবহিত পরবর্তী সময়। স্কুলের সপ্তম শ্রেণি শেষ করে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছি কিন্তু স্কুল তো নেই। পালিয়ে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে আছি। বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন রামগড় বর্ডার অভিমুখে হাজারে হাজারে লাখে লাখে মানুষ যাচ্ছে ভারতে আশ্রয়ের জন্যে। আমাদের বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে গল্প শুনতে লাগলাম। এই সুযোগে তাঁদের কেউ কেউ যৌবনের ফেলে আসা দিনের অখণ্ড ভারতের স্মৃতিসুখের তাড়নায় কীভাবে শরণার্থীদের কাফেলায় মিশে সীমান্ত অতিক্রম করে ওপারটা দেখে ফিরে আসছেন। এখন বৃহত্তর সম্প্রদায়ের মুখে হিন্দুদের রাষ্ট্র আর 'হিন্দুস্তান' নয়, তাদের মুখে এখন তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইন্ডিয়া অথবা ভারত।

দেখলাম আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই ভিসা-পাসপোর্টের কড়াকড়ি না থাকায় কলকাতাসহ ভারতের নানা ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে এসে বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শোনাচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতির পর যখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের চৌকাঠে পা রাখতে যাচ্ছি সে-সময় দেশে স্বল্প সময়ের জন্যে বাঙালি সংস্কৃতির বৃহত্তর সম্ভারের রসসিঞ্চনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যে বাঙালিয়ানার চেহারাটি স্পষ্ট হচ্ছিল তাতে ছন্দপতন ঘটে ১৯৭৫-এ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সাল থেকে দেশে আবার শুরু হলো ভারতকে নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কূটচাল। আর এর কুপ্রভাব পড়ল সংস্কৃতিচর্চার নানা আঙিনায়। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনও নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে থাকল। ইতোমধ্যে আমি অলিয়স ফ্রঁসেজ এর সদস্য এবং চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার কারণে কোনো একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে উদগ্রীব। পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণের উদগ্র আকাঙ্ক্ষাও সদ্যলব্ধ কিছু দিনেমার বন্ধু-বান্ধবীর সুবাদে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে আমার মনে। এই সময়ে ১৯৮২ সালে কলকাতায় যখন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসব আয়োজনের খবর বেরুল তখন সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। পেছন থেকে উৎসাহ জোগালেন সুহৃদ আনোয়ার হোসেন পিন্টু। কলকাতায় গিয়ে শক্তি বসুসহ অন্যান্য আরও কেউ কেউ যাঁরা চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবেন এবং লেখেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নাম-ঠিকানা দিয়ে আমার ভ্রমণটা নিশ্চিত করে তুললেন পিন্টু। নিশ্চিত করার কথা বলছি এজন্য যে, চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেওয়াসহ ভারতের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখার জন্য যতটা সময় দরকার ততদিনের ছুটি চাকুরি থেকে পাওয়া কঠিন ছিল। সে-সময় একদিকে আমি 'দৈনিক স্বাধীনতা' নামক একটি সংবাদপত্রে পূর্ণকালীন সাংবাদিক আবার অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। তাই অর্থ ও সময় দুটোই ছিল অপ্রতুল। সম্প্রতি সুহৃদ পিন্টুর সঙ্গে নৈমিত্তিক উদ্দেশ্যবিহীন ফোনালাপের কোনো একটা সময়ে ঘটনাচক্রে তিন যুগেরও বেশি আগে লেখা দিনলিপিটির আবিষ্কার ও কলকাতার সেই চলচ্চিত্রোৎসবের স্মৃতিচিহ্নের প্রসঙ্গ এলে তিনি সেটি প্রকাশের আগ্রহ দেখিয়ে আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করলেন। সকল কুণ্ঠা ঝেড়ে তাঁর সিদ্ধান্তকেই মেনে নিলাম।

দিনলিপির পাণ্ডুলিপি পরিমার্জনা এবং সংশোধনের ব্যাপারে কিছু কথা বলে নিতে চাই। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম পাণ্ডুলিপিটি একেবারে অপরিবর্তিত অবস্থায় অবিকল ছাপানো হোক, অশুদ্ধ তথ্য, ফসকে যাওয়া শব্দ বা বাক্যাংশ এবং ভুল বানানসহ। কিন্তু পরে এই ভাবনা দ্বারাই প্ররোচিত হলাম যে, সুযোগ যখন আছে তখন কেন ভুল বানানের প্রসার ঘটাতে যাওয়া? বানান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাল্টাতে হয়েছে '-িকার,ী-কারের' ব্যবহার নিয়ে। উল্লেখ করা দরকার বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বানান সংক্রান্ত অভিধানগুলোর বেশিরভাগই বেরিয়েছে অনেক পরে। পাঠকের কাছে একটা ব্যাপারে আমার দায়মোচনের সুযোগ নেই। সেটা হচ্ছে দিনলিপিতে যে অসম্পূর্ণ বাক্যাংশ বা যেটা বোঝাতে চেয়েছি তার সঠিক ভাষ্য না থাকায় তা অবিকল রেখে ওই শব্দ বা বাক্যাংশের পাশে বন্ধনীর মধ্যে হেলানো হরফে সঠিক অংশটি যোগ করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে মনে হলো এটা করতে গেলে পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হবে, তাই পরিকল্পনাটি বাদ দিয়েছি। তাছাড়া যেহেতু এত বছর পর দিনলিপিটা প্রকাশ করছি তাই যতটুকু সম্ভব অবিকৃত রেখে পরিমার্জনা করাই সমীচীন।

আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। বইয়ের শিরোনামে লেখা হয়েছে 'কলকাতা' কিন্তু দিনলিপি জুড়ে লেখা রয়েছে 'কোলকাতা'। সেই-সময়ে উচ্চারণের দোহাই পেড়ে কোলকাতা লেখার একটা চল আমাকে আকৃষ্ট করেছিল, সঠিক-বেঠিক যাচাই না করে হাল-আমলের স্রোতে ভাসার প্রবণতা থেকে যে মুক্ত ছিলাম না সেই ঘাটতি যেমন পাঠককে জানাতে চাই তেমনি এও জানাতে চাই যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন মানুষ, তাদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবন- যাত্রা নিয়ে যেসব মন্তব্য বা সম্বোধন (যেমন এক জায়গায় লিখেছি নিগ্রো যা বর্তমানকালের সংবেদনশীলতার মাপকাঠিতে অসম্মানসূচক এবং অগ্রহণযোগ্য) করেছি সেগুলো ছিল আমার সেই-সময়ের অপরিণত মানসের বহিঃপ্রকাশ।

আরেকটি কথা। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে উড়োজাহাজে চড়ে আকাশবিহার এবং অভ্যন্তরের ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলেও ভারত ভ্রমণের সুবাদেই আমার প্রথম উড়োজাহাজে চড়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়। দেশের অভ্যন্তরে উড়োজাহাজে চড়ার মতো রেস্ত আমার কখনও ছিল না। তাছাড়া ইন্ডরেইল পাশ দিয়ে পুরো ভারতের এ মাথা থেকে ও মাথা ট্রেনে ভ্রমণের যে স্বাদ ১৯৮২ সালে পেয়েছিলাম তার সঙ্গে তুলনীয় কেবল ১৯৯৭ সালে ইউরেইল পাশ দিয়ে ইউরোপের ১৩টি দেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা। তবুও ভারতের মতো স্থানে স্থানে প্রকৃতিগত ভিন্নতা এবং এর বহুজাতিক জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন, ভাষা, বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস, বসতবাটির বিচিত্রতা অন্য কোথাও পাইনি। বৈচিত্র্যের ভেতরেও সুরের ঐকতানের যে 'ভারততীর্থ' রবির আরাধ্য, সেই তীর্থে থেকেও যেমন তাঁর মন অন্য কোথাও পড়ে থাকতে চায়-সংসারজীবনের চৌহদ্দির ভেতরে থাকতে থাকতে আমার ভ্রমণপিয়াসি মনও তেমনি কণিকার মোহর গড়ানো সুরের কম্পনে দূরে কোথায় দূরে দূরে ... - ইকবাল করিম হাসনু



==========

ইকবাল করিম হাসনু এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি


জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৫৮ সালে। বেড়ে ওঠা পাহাড় নদী আর সবুজ বনাঞ্চলে ঘেরা উপশহর কাপ্তাইতে।
পড়াশোনা বাংলাদেশ এবং কানাডায় ইংরেজি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়।
দ্বিভাষিক বাংলা জর্নাল-এর সম্পাদক ও প্রকাশক। বাংলাদেশ ও কানাডায় সাংবাদিকতায় জড়িত থাকা ছাড়াও টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ ক্যুবা ভ্রমণ নিয়ে মুখ ঢাকেনি বিজ্ঞাপনে (২০১৫); চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন নিবন্ধ চলচ্চিত্র (২০১৮)।

::::::::::

কলকাতা ছুঁয়ে ভারত ঘোরার দিনলিপি
ইকবাল করিম হাসনু

প্রকাশক : চট্টগ্রাম সত্যজিৎ চর্চা কেন্দ্র
প্রথম সংস্করণ: পৌষ, ১৪৩০, জানুয়ারি, ২০২৪
প্রচ্ছদ : সত্যজিৎ রায়ের রেখাচিত্র অবলম্বনে আনোয়ার হোসেন পিন্টু
অলংকরণ : সুমিত দাস
মূল্য: ২৫০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ