বইয়ের সূচনায় লেখক আনোয়ারা আলম বলেন-
গবেষণার জন্য প্রয়োজন অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ, প্রয়োজনীয় উপাদান তথা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য। ইচ্ছে ছিল শবনম খানম শেরওয়ানীর নানার বাড়ি বিক্রমপুর এবং প্রয়োজনে কলকাতা যাওয়ার। কিন্তু মহামারির কারণে কিছুই হয়নি। না দেশে, না কোনও জাদুঘরে, না কোনও বিশিষ্ট জনের সহযোগিতা- বা কোনো সহযোগী। তবে সামনে ছিল ড. শামসুল হোসাইন ও ড. মাহবুবুল হক রচিত জীবনীগ্রন্থ 'লোকমান খান শেরওয়ানী জীবনকথা' ও মমতাজ লতিফ রচিত 'খুঁজি তারে আপনায়' গ্রন্থ। একই সাথে লোকমান খান শেরওয়ানীকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিচারণ। এগুলোকে সাথে নিয়ে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি একজন মহীয়সী নারী শবনম খানম শেরওয়ানীকে আবিষ্কার করার। তবে আন্তরিকভাবে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ও মনোবল বা প্রেরণায় ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠপুত্র ড. বদরুল হুদা খান, ছোট মেয়ে নাসিমা জামান, আসাদ ভাই এবং আমার ছাত্রী ডোনা। তাঁরা সাক্ষাৎকার পর্বের ভিডিওতে স্মৃতিচারণে দিয়েছেন মা'কে ঘিরে বিভিন্ন স্মৃতি। এগুলো ছিল আমার শুধু পাথেয় নয়- আমার প্রেরণা- সাহস ও উৎসাহ। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কায় যখনই ঝিমিয়ে যায় মন, তখনই ড. বদরুল হুদা খানের আবেগ আক্রান্ত- মমতাভরা সহানুভূতিতে- 'পারতেই হবে'- এই শপথে উজ্জীবিত হয়ে কলম ধরেছি। জানি না- কতটুকু পেরেছি- বা সফল হয়েছি- যদিও অতৃপ্তি রয়ে গেছে। শেষে বলি যতটুকু পেরেছি, তা আপনাদের অবদান; যা পারেনি তা আমার ব্যর্থতা। - আনোয়ারা আলম
মুখবন্ধ
এক
ইতিহাস রচিত হয় ক্ষমতাবানদের হাতে। আর তাই, ক্ষমতা সম্পর্কের নিরিখেই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। নিজ নিজ সময় আর সম্পর্কসূত্রকে অতিক্রম করে সমাজে ন্যায় আর সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি যারা, তাদের মধ্যে রয়েছেন নারীরাও। যদিও পুরুষতান্ত্রিক বয়ানে তারা উপেক্ষিতই বলা চলে। সেসব নারীর মধ্যে কেউ বিপ্লব করেছেন অস্ত্র হাতে, কেউবা আবার সঙ্গী করেছিলেন লেখনী। শারীরিক মৃত্যুর পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক বলয়ে ইতিহাসের পাতায় তাদের নামও অক্ষয় থাকেনি।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পুরুষের সাথে নবজাগ্রত নারীদেরও একটা গৌরবময় অংশ ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্ত্রী দীক্ষা সম্পর্কে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও কুসংস্কার ধীরে ধীরে অপসৃত হওয়ার সাথে সাথে নারী প্রগতির যতই বিস্তার লাভ করে ততই নারীসমাজ সচেতন হয়ে ওঠে। তাঁদের মধ্য থেকে এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র উদিত হয় রাজনৈতিক গগনেও। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে নারীরা নিজেদের কীভাবে বিকশিত করে তুলেছিলেন তা গভীর তাৎপর্যময়। যদিও ইতিহাসে বর্ণিত আলোচিত ঘটনায় চিরকালই চাপা থেকেছে নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণের বিষয়টি। যেভাবে লেখা হয়েছে পুরুষের বীরত্বগাথা, আত্মত্যাগ ও কর্তৃত্বময় জীবনযাপনের চিত্র সে তুলনায় পুরুষতন্ত্রের দাপটে আড়াল থেকে গেছে নারীর কীর্তি। বাঙালি নারীর ইতিহাস আরো উপেক্ষিত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নারী সংগঠক মণি কুন্তলা সেনের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য-
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ বিশ্বের যে কোন মুক্তি সংগ্রামের চেয়ে ব্যাপক। কংগ্রেসী ঐতিহাসিকরা এই অংশগ্রহণকে তুলে ধরেননি।
যে কারণে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদেরই নাম পাওয়া যায় যারা ছিলেন কাছাকাছি বা দৃষ্টিসীমার মধ্যে; দৃষ্টি নেপথ্যে যাঁরা-
সমাজের জীবন প্রবাহে... তাঁরা অখ্যাত, অনামী।
দুই
শুধু কংগ্রেসী ঐতিহাসিকরা নয়- প্রচলিত ইতিহাসে নারীর অনুপস্থিতি দীর্ঘদিনের- পক্ষপাতিত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, তত্ত্ব ও পদ্ধতির ফসল। যে কারণে পুরুষপ্রধান ইতিহাসে নারীর স্থান হয়েছে একটি ক্ষুদ্র ছত্র বা অধ্যায়ে। পুরুষ থেকে গেছে ইতিহাসের মূল সংগঠক। নারী চিহ্নিত হয়েছে অভিন্ন অবিমিশ্র এক জনগোষ্ঠী হিসেবে যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে নারীর নির্দিষ্ট ভূমিকা তথা- কন্যা, জায়া ও জননী রূপে। অধ্যাপক জোন কোলের মতে,
'নারীর ইতিহাস'- এ প্রত্যয়টির দুটো লক্ষ্য- ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় নারীকে নিয়ে আসা এবং আমাদের ইতিহাস রচনাকে নারীর কাছে নিয়ে যাওয়া।
বাঙালি নারীর ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গেও এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ণয় এক অনিবার্য দায়িত্ব। কেননা বাঙালির প্রচলিত ইতিহাসে ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় নারীর উপস্থিতি অনুজ্জ্বল, খণ্ডিত, ক্ষেত্রবিশেষে শূন্য। শবনম খানম শেরওয়ানীর ব্যাপারে এ কথাটি আবারও প্রমাণিত।
তিন
১৯৬৯ এবং ৭০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে পাঠানটুলী চৌমুহনী নিবাসী সর্দার মির্জা আহমদ বেগ তথা আমার শ্বশুর বাড়িতে কলেজ থেকে ফিরে বিকেলে মাঝে মধ্যে দেখতাম একজন অভিজাত চেহারার লম্বা গড়নের স্নিগ্ধ এক মাঝবয়েসী নারীকে শাশুড়ি-মা পরিচয়ে বলতেন, 'লোকমান খান শেরওয়ানীর স্ত্রী'। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। বাবার পাশে বসে মৃদুস্বরে কথা বলতেন দীর্ঘক্ষণ। তখন কি জানতাম! তিনি শুধুমাত্র একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা লোকমান খান শেরওয়ানীর জীবনসঙ্গী নন- তিনি একাধারে একজন বিপ্লবী, রাজনৈতিক কর্মী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রেডিওর স্বনামধন্য কথক! তাঁর সব পরিচয় তখন বিস্তৃত। কিন্তু চাপা পড়েছে ইতিহাসের আড়ালে। শুধু একটি পরিচয়ে খ্যাত তিনি- 'লোকমান খান শেরওয়ানীর স্ত্রী।' ইতিহাসের পাতায়- “অজ্ঞাত, অনামী, অখ্যাত।” তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা, অবদান ও অবস্থান নিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাসেও লেখা হয়নি কিছু, সামান্যতম ইঙ্গিতও নেই। এ বিষয়ে খুঁজি তারে আপনায়- গ্রন্থের লেখক মমতাজ লতিফের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য
কীভাবে লোকমান খান শেরওয়ানী 'শিশিরকণা গুহ' এর সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন, শবনম নানীই বা কি অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে সুভাষ বসুর শিষ্য এই পাঠান বংশের সুদর্শন তরুণটির কাছে নিজের ধর্ম, পরিবার, বাবা-মা, ভাইদের ছেড়ে, শিক্ষা ও সঙ্গীতের জগৎ বন্ধু-বান্ধবী, পরিচিত সমাজ, এমনকি দেশকে চিরদিনের মতো ত্যাগ করে নতুন অজানা একেবারে ভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতির সমাজে স্বেচ্ছায় বন্দিনী হলেন- জানা হলোনা সেই যুগের এই হিন্দু-মুসলিম বিয়ের অসাধারণ এক প্রেমকাহিনি। আমাদের ছোট নানা লোকমান খানের একমাত্র বোনকে বিয়ে করে এনেছিলেন যিনি, তিনিই বা কেন তাঁর স্ত্রীর এমন কীর্তিমান বড় ভাইয়ের কোন বিষয়ই আমাদেরকে জানাননি? বাবাও তো ওনার এই ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা আমাদের বলেননি কখনো, তাঁরা কি নীরবে নিভৃতে জীবন কাটানো ঐ রাজনৈতিক সৈনিকটির জীবনের কথা তেমনভাবে জানতেন না?
চার
২০০২ খ্রিস্টাব্দে আমার গবেষণাগ্রন্থ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী প্রকাশিত হলো শৈলী প্রকাশন থেকে। এ গ্রন্থে দু'একজন মুসলিম নারীর সাথে যাঁর তথ্য পেলাম- তিনি শবনম খানম শেরওয়ানী। দৈনিক আজাদীতে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক সাখাওয়াত হোসেন মজনু অর্থাৎ একজন শবনম খানম শেরওয়ানীকে খুঁজে পাওয়ার প্রথম কৃতিত্ব তাঁর। এটি আমার গ্রন্থে সংযোজিত হওয়ার পরেই বদরুল হুদা খান তথা খোকনের সাথে যোগাযোগ। যিনি এ গ্রন্থটি সংগ্রহ করেছেন বেতার ব্যক্তিত্ব জনাব আসাদুজ্জামান এর কাছ থেকে। ওনার মেয়ে সাবরিনা চৌধুরী ডোনা সে আমার প্রাক্তন ছাত্রী এবং ওর মা নাসিমা জামানের সাথে পরিচয় ঐ সূত্রে। খোকনের গল্প করতেন প্রায় আমার শাশুড়ি মা। কীভাবে তাঁর মেধা ও মানসিক শক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমে এক লুপ্তপ্রায় পরিবার তথা একজন বহুধা মেধা ও প্রতিভার ব্যক্তিত্ব লোকমান খান শেরওয়ানীর ঐতিহ্য ও আভিজাত্যকে ফিরিয়ে এনেছেন; অত:পর চট্টগ্রাম একাডেমি থেকে তাঁর উদ্যোগে ও সহযোগিতায় লোকমান খান শেরওয়ানীর নামে প্রতিবছর সাংবাদিকতায় (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া) পুরস্কার ও মা শবনম খানম শেরওয়ানীর নামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নামে 'মেধাবৃত্তি কর্মসূচি' প্রবর্তিত হওয়া। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট গবেষক শামসুল হোসাইন ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষক ও প্রাবন্ধিক জনাব মাহবুবুল হকের যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত হয় লোকমান খান শেরওয়ানী জীবন কথা গ্রন্থ। ইতিহাসের পাতায় উদ্ভাসিত হল একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের বিস্তৃত জীবন ও কর্মকাহিনি।
২০১৭ খ্রিস্টাব্দে শবনম খানম শেরওয়ানীর জীবনীগ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন নাজমাতুল আলম। সুদীর্ঘ দুই বছর! ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝিতে মনে এলো 'চ্যালেঞ্জ'টা নিলে কেমন হয়? জানালাম খোকনকে। বিপরীতে তাঁর আবেগ ভারাক্রান্ত অনুভূতিতে আমার ইচ্ছাশক্তির সাথে যুক্ত হলো গভীর ভালোবাসা। অতঃপর! কাজে হাত দিয়ে দেখি- সামনে শুধুই অন্ধকার! কোথাও কিছু নেই। না তথ্য, না উপাদান, না তথ্যের উৎস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ- যা গবেষণার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুকে আবেদন জানালাম- কোন সাড়া নেই। ড. বদরুল হুদা খান তথা খোকন একের পর এক যোগাযোগের সূত্র দিচ্ছেন- নাম, মোবাইল নম্বর ইত্যাদি। সে সুবাদে গভীর প্রত্যয় ভেতরে-
খুঁটি গেড়ে যখন রেখেছি তখন ঐ খুঁটি পর্যন্ত পৌঁছুতে হবেই।
অবশেষে প্রথমে শবনম খানম শেরওয়ানীর প্রাক্তন সহকর্মী পাঠানটুলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক জোহরা খাতুনের মেয়ে নাহারের সাথে সাক্ষাৎ, অতঃপর নানাভাবে নানা জনের সাথে। সাপ্তাহিক 'কোহিনূর' পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন শবনম খানম শেরওয়ানী। এ কোহিনূরের সন্ধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুষ্প্রাপ্য শাখায় গমন। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর মাইনুল হাসান চৌধুরীর সাথে কথা হলো। তিনি আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলেন এবং সহযোগিতা করলেন। জানলাম, শবনম খানম মাসিক 'বান্ধবী' পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। বান্ধবী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্পাদক শহিদজায়া ও মুক্তিযোদ্ধা বেগম মুশতারী শফি। এক বিকেলে তাঁর বাসভবনে। ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকা চট্টগ্রামের নারীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক-সেনাদের সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর থেকেও তিনি তিল তিল করে বিন্দু বিন্দু ঘাম ও শ্রমে এই পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা 'স্বাধীন বাংলাদেশে'র এই চট্টগ্রাম শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে হকারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন, সে সংখ্যাগুলো পরমযত্নে বাঁধাই করে রেখেছেন। পুরো পাঁচঘন্টা তিনি আমার সাথে থেকে সহযোগিতা করেছেন- অশেষ কৃতজ্ঞতা তাঁর কাছে। অতএব, তাঁর সাহিত্যকর্মসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ইঙ্গিত বা সূত্রের সন্ধানও পাওয়া গেল।
বেশ উৎসাহে কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কে জানতো- পুরো বিশ্বে এবং দেশের আকাশ ঢেকে যাবে- 'করোনা' নামক এক ভয়ংকর ভাইরাসের ছোবলে। অত:পর লকডাউন। এর পরে মৃত্যুর মিছিল। নিত্যদিনে কেবলি হাহাকার- আর্তনাদ- নানা ধরনের বিভীষিকা- প্রথম ধাক্কা এলো নিজের ঘরেই। ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে। চিকিৎসক ছেলে ডা. তারেক শামসকে যেতে হলো আইসোলেশনে- একই ঘরে- জ্বরতপ্ত ছেলে বিচ্ছিন্ন একাকী- করোনা সন্দেহে। দিন সাতেক পরে- স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই ছোটভাই মনজুর। কী এক দুঃসহ যন্ত্রণার অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত সে চলে গেল জীবনের ওপারে। এ শোক নিতে পারছিলাম না- মনে হচ্ছিল নিজেই শেষ হয়ে যাচ্ছি। সামাল দেওয়ার আগেই আরেক ছোটভাই। ওর পরে বড় ছেলে বলা যায়- প্রচণ্ড এক ঝড়ের মাঝে দুলছে জীবন। থিতু হয়ে মনকে শান্ত করে আবারও বসতে গিয়ে এবারে ছোট বোনের পুরো পরিবার। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের প্রথম সপ্তাহে একই সাথে জীবনসঙ্গী। আবারও শোকের ছায়া- এবারে ছোট বোনের স্বামী চলে গেলেন। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুনভাবে শুরু করতে হল, যদিও প্রতিদিন একে একে মৃত্যুর মিছিলে কাছের বন্ধুরা ও প্রিয় চেনা অনেকে।
পাঁচ
গবেষণার জন্য প্রয়োজন অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ, প্রয়োজনীয় উপাদান তথা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য। ইচ্ছে ছিল শবনম খানমের নানার বাড়ি বিক্রমপুর- প্রয়োজনে কলকাতা যাওয়ার। কিন্তু মহামারীর কারণে কিছুই হয়নি। না দেশে না কোনও জাদুঘরে, না কোনও বিশিষ্ট জনের সহযোগিতা বা কোন সহযোগী। তবে সামনে ছিল জনাব শামসুল হোসাইন ও মাহবুবুল হক রচিত জীবনীগ্রন্থ লোকমান খান শেরওয়ানী, জীবন কথা গ্রন্থ ও মমতাজ লতিফ রচিত খুঁজি তারে আপনায় গ্রন্থ। একই সাথে লোকমান খানকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিচারণ। এগুলোকে সাথে নিয়ে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি একজন মহীয়সী নারী শবনম খানম শেরওয়ানীকে আবিষ্কার করার। তবে আন্তরিকভাবে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ও মনোবল বা প্রেরণায় ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠপুত্র ড. বদরুল হুদা খান, ছোট মেয়ে নাসিমা জামান, আসাদ ভাই এবং আমার ছাত্রী ডোনা। ওনারা সাক্ষাৎকার পর্বের ভিডিওতে স্মৃতিচারণে দিয়েছেন মা'কে ঘিরে বিভিন্ন স্মৃতি।
এগুলো ছিল আমার শুধু পাথেয় নয়- আমার প্রেরণা, সাহস ও উৎসাহ। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কায় যখনি ঝিমিয়ে যায় মন- তখনি খোকনের আবেগমথিত মমতাভরা সহানুভূতিতে- 'পারতেই হবে'- এই শপথে উজ্জীবিত হয়ে কলম ধরেছি। জানিনা, কতটুকু পেরেছি বা সফল হয়েছি- যদিও অতৃপ্তি রয়ে গেছে। শেষে বলি যতটুকু পেরেছি তা আপনাদের অবদান যা পারিনি তা আমার ব্যর্থতা। বলা বাহুল্য, গ্রন্থে পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও সংশোধনের অবকাশ থাকতেই পারে। তাই, সবার কাছে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কামনা করি।
'শৈলী' প্রকাশনের কর্ণধার বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক রাশেদ রউফের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা- যিনি আন্তরিকভাবে সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল কালাম বেলালকে।
লেখক সম্পর্কে রাশেদ রউফ জানান-
ড. আনোয়ারা আলম গবেষণা করেন, গল্প লেখেন, কবিতাও লিখেছেন একসময়। প্রবন্ধ লেখেন, সমসাময়িক প্রসঙ্গে কলাম লেখেন, লেখেন ছোটোদের জন্যও নানা স্বাদের রচনা। 'ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী' গ্রন্থের জন্য জন্য পেয়েছেন ব্যাপক খ্যাতি ও পরিচিতি। এছাড়া আরো কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। এর মধ্যে রয়েছে : 'বসন্তের বৃষ্টি', 'নারী ও সমাজ', 'অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারী', 'ভিন দেশে ঝরা পালক', 'আমার শিক্ষকতার জীবন' 'ছোটদের প্রীতিলতা', 'ছোট্ট এক রাজকুমারী', 'নারীর জীবন এবং ইত্যাদি' 'প্রসঙ্গ প্রিয় অপ্রিয়', 'গোধূলি বেলায় মেঘের ভেলায়, 'এক যে ছিল রাজকুমারী,' 'ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ও শিশু: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ', 'ঘুমন্ত রাজকুমারী', 'রূপাঞ্জল ও রাজকুমার',' গেরিলা যোদ্ধার গল্প শোনো', 'যাদুর শহর' প্রভৃতি। 'শিশির থেকে শবনম' তাঁর আরেক গবেষণা কর্ম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী শবনম খানম শেরওয়ানীর জীবন ও কর্মকে নিয়ে লেখা বইটি তাঁর শ্রমলব্ধ কাজ।
আনোয়ারা আলমের রচনায় আমরা পাই তাঁর জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশ। তাঁর মননশীল চিন্তার সুন্দর উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করি প্রায় সব কটি লেখায়। অত্যন্ত শাণিত ও যৌক্তিকভাবে তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন পাঠকের সামনে। নানা লেখায় তিনি ভেঙেছেন সংস্কারের প্রাচীর এবং অতিক্রম করেছেন গোঁড়ামির বেড়াজাল।
ব্যক্তিজীবনে সৎ, সাহসী, পরোপকারী এই মানুষটা বড় হৃদয়ের অধিকারী। তিনি অন্যকে বড় করে তোলেন, অন্যের কাজকে মূল্যায়ন করেন অকৃত্রিম আন্তরিকতায়। সমাজব্রতী জীবনসঙ্গী -জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ শামসুল আলমের একান্ত সহযোগিতায় তিনি অতিক্রম করে চলেছেন সমস্ত প্রতিকূলতা। - রাশেদ রউফ
সূচি
- প্রথম অধ্যায়
- জীবন কথা
- সংসারজীবন
- জীবনের আরেক সংগ্রাম
- দ্বিতীয় অধ্যায়
- ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী এবং শিশিরকণা গুহ রাজনৈতিক জীবনের আরেক পর্ব
- তৃতীয় অধ্যায়
- সাংবাদিকতার জীবন
- চতুর্থ অধ্যায়
- সাহিত্যিক জীবন বাঙালি নারীর সাহিত্য চর্চা ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সাহিত্য কর্মের মূল্যায়ন
- পঞ্চম অধ্যায়
- শিক্ষকতা জীবন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বেতার জীবন
- ষষ্ঠ অধ্যায়
- জীবনদর্শন জীবন ও কর্মের মূল্যায়ন
- সপ্তম অধ্যায়
- চারিত্রিক গুণাবলী স্বামীহারা নারীর অস্তিত্বের লড়াই শেষ জীবন
- অষ্টম অধ্যায়
- সন্তানদের স্মৃতিচারণে রত্মগর্ভা মা শবনম
- পরিশিষ্ট
- লন্ডন থেকে ছোট ভাইয়ের চিঠি
- স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন
- রঙিন এ্যালবাম
::::::::::
শিশির থেকে শবনম অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারী
আনোয়ারা আলম
প্রকাশকাল : আশ্বিন ১৪২৮, অক্টোবর ২০২১
প্রচ্ছদ : উত্তম সেন
প্রকাশক : শৈলী প্রকাশন
মূল্য: ৪০০ টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম