অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ এক বিকেলে “ভিন্নচোখ” এর স্টল থেকে সংগ্রহ করেছিলাম আলী আফজাল খান সম্পাদিত বিখ্যাত ‘‘ভিন্নচোখ” লিটল ম্যাগাজিনের নতুন কবিতাসংখ্যা যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। সম্পাদক সুলেখক আলী আফজাল খান সেদিন স্টলেই ছিলেন। তখনই তার হাত থেকেই পত্রিকাটি সংগ্রহ করেছিলাম। ভিন্নচোখ এর সম্পাদক আলী আফজাল খান; তবে সহ-সম্পাদক আছেন পাঁচজন , নির্বাহী সম্পাদক পাঁচজন, উপদেষ্টা দুজন, বিপণন সম্পাদক দুজন, শিল্প উপদেষ্টা একজন। তাদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশের কয়েকজন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের। সম্পাদনা পরিষদ এত বড়ো হওয়ার কারণ হচ্ছে পত্রিকাটি অন্তর্ভুক্তিমূলক চারিত্র্যের (Inclusive in nature) এবং আকৃতিতে বিশাল-- ৭২০ পৃষ্ঠার। এই যদি ছোটো কাগজ হয়, তাহলে বড়ো কাগজের সংজ্ঞা কী? বাঙালি কবি-প্রাবন্ধিক -অনুবাদক যেখানেই বসবাস করুন, তাদের মানসম্মত লেখা অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা আছে ভিন্নচোখ সম্পাদক এবং তার টীমের, এটা পত্রিকার সূচি দেখেই সেটা আঁচ করা যায়।
পত্রিকার প্রচ্ছদ শিরোনাম বলছে এটি কবিতাসংখ্যা। এই সংখ্যায় বহু সংখ্যক কবির প্রচুর সংখ্যক কবিতা আছে। দীর্ঘ কবিতা আছে দুজনের: ভাস্কর চৌধুরী এবং দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর। গুচ্ছ কবিতা আছে ৫০ জনের। একক কবিতা আছে ৪৫ জনের। হাইকু আছে ২ জনের। অন্যভাষার ৫জন কবির কবিতার বাংলা অনুবাদ আছে। সাক্ষাৎকার আছে ৩ জনের। এই সংখ্যায় আমারও একগুচ্ছ কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দেখে স্বভাবতই একটু বাড়তি ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করেছে আমার নিজের মাঝে। সমানভাবে সমৃদ্ধ অংশটা হচ্ছে প্রবন্ধ ও গদ্যের। প্রবন্ধ আছে ৪০জনের, অন্তরঙ্গ গদ্য/ মুক্ত গদ্য আছে ১১ জনের।
কবিতা নিয়ে যত রকমের ভাবনা, মতবাদ ও মতবিরোধ আছে, সেসবের অধিকাংশই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্নজনের প্রবন্ধে ও মুক্তগদ্যে। এটা ঠিক যে, কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ পড়ে কবি হওয়া যায় না, কাব্যশক্তি মূলত জন্মগত অর্জন, তথাপি যাদের জন্মগত কবিপ্রতিভা আছে, তাদের জন্য প্রবন্ধ/গদ্যগুলো সহায়ক হতে পারে। কেননা কবিতা বিষয়ক আলোচনা কবিতাভাবনা ও কাব্যশৈলী উভয় ক্ষেত্রেই নিবিড় আলো ফেলে। এসব পাঠে কবিপ্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিগণ তাদের জন্মগত কাব্যশক্তিকে সঠিকপথে বিকশিত করার ও কাজে লাগানোর দিশা পেয়ে যেতে পারেন। সেই বিবেচনায় ভিন্নচোখ এর এই সংখ্যাটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং কবিতা চর্চাকারীদের সংগ্রহে রাখার মতো।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, ভিন্নচোখ এর এই সংখ্যার কবিতার সমৃদ্ধ ডালা। বিভিন্ন বয়সের বহু সংখ্যক বাঙালি কবি এবং কিছু বিদেশি কবির কবিতা রাখা হয়েছে সেই ডালায়। কবিতার পাঠকগণ নানা স্বাদের কবিতা পাবেন একই মলাটের ভেতর। তবে যারা নতুন প্রজন্মের কবিতা লেখক তাদের জন্য সংখ্যাটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে: Example is better than precept. উৎকৃষ্ট কবিতা কি তা কবিতা বিষয়ক দশটা প্রবন্ধ/গদ্য পড়ে যতটা শেখা যায়, তারচেয়ে বেশি শেখা যায় কয়েকটি উৎকৃষ্ট মানের কবিতা পাঠ করে।
ভিন্নচোখ এর এই সংখ্যার সকল কবিতাই উৎকৃষ্ট মানের বলে দাবি করা যৌক্তিক হবে না, তবে সত্যের কারণেই একথা বলতে হয় যে, এই সংখ্যায় উৎকৃষ্ট মানের কবিতা আছে অনেকগুলো। উদাহরণ স্বরূপ, ভাস্কর চৌধুরী দীর্ঘ আকৃতির “আমার মা কবি ছিলেন’’ শীর্ষক কবিতাটি একটি উৎকৃষ্ট মানের সৃষ্টি। এটি পড়তে গিয়ে প্রথমে মনে আসে আবুজাফর ওবায়দুল্লাহর বিখ্যাত “আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’’ কবিতাটির কথা। তবে শেষপর্যন্ত পড়ার পর জানা যাবে এটি একটি মহাকাব্যিক কবিতা কিংবা একক কবিতারূপী মহাকাব্য। একজন বাঙালি মায়ের যাপিত জীবন, কর্ম ও জীবনদর্শন উঠে এসেছে সন্তানের জবানিতে। কবিতায় জননী আর জন্মভূমি একাকার ব্যঞ্জনায় মহাকাব্যিক মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এই জননীকে জানলে জানা হয়ে যায় জন্মভূমির ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, সংগ্রাম ও স্বাধীনতা, ধর্ম ও সাহিত্য, বিবর্তন ও পরিবর্তন--- এসবকিছুর বাহির ও ভেতরের রূপ। অন্তরঙ্গ ভাষায় রচিত কবিতাটি একইসঙ্গে ধারণ করেছে হৃদয়ের আকুলতা ও নিবিড় শৈল্পিকতা। কিছুটা পাঠ করা যায়:
আমার মা রাতে শ্লোকে শ্লোকে আরব্য রজনীর কথা বলতেন
তিনি কুরআনের আয়াত পড়তেন
তিনি শরৎবাবুর বই পড়েন।
আমার মা মেঘ দেখলেই বৃষ্টি ভেবে
ঘুটো ডাকতেন, চেনাকাঠে মন ছিল তাঁর।
তিনি সংসারে একক ছিলেন।
আমার মায়ের রূপোর রেকাবি আর পানের বাটা ছিল
আমার মায়ের সোনালী পুত্র কন্যা ছিল।
আমার মা তার আত্মজার কথা বলতেন।
আমার মা, কবিতা পড়তেন, পড়ে শোনাতেন
তিনি নতি ও জিতের কথা বলতেন
তিনি ভালোবাসার কথা বলতেন।
তিনি বাবার প্রেমিকার কথা বলতেন
বাবার সাথে সিনেমা দেখার গল্পটা বলতেন।
আমার মা পথের পাঁচালি [পথের পাঁচালী] দেখে কাঁদতেন।
তিনি সর্বজয়ার সাথে আপন মিলের কথা বলতেন
দুর্গার কিশোরী কালের সাথে মিলের কথা বলতেন।
তিনি আকালের কথা জানতেন
ক্ষুধায় অন্ন পাত থেকে দিয়ে চুপ থাকতেন।
আপটমা তার নদীটির কথা বলতেন
গাঙে বানের শব্দ এলে নৌকার কথা বলতেন।
বেশ দীর্ঘাকৃতির এই কবিতাটি ভিন্নচোখে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পাদক আলী আফজাল খান একটি উত্তম কাজ করেছেন। নতুন প্রজন্ম এই কবিতা পড়লে কিছুটা আঁচ করতে পারবে -- তাদের পূর্বপূরুষদের সময়কাল কেমন ছিল, কতটা মায়া আর পারস্পারিক শুভকামনাবোধ ছড়ানো ছিল সেদিনের পারিবারিক বাতাসে - --- প্রতিবেশী উঠোনে, উত্তর প্রজন্মকে নিয়ে কেমন ছিল তাদের স্বপ্নের রং, কতটা ছিল তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ, কতটা সমৃদ্ধ ছিল তাদের সেদিনের সাদাকালো সংস্কৃতি। নিঃসন্দেহে ভাস্কর চৌধুরীর “আমার মা কবি ছিলেন’’ একটি শিল্পোত্তীর্ণ মহৎ কবিতা।
অনুরূপভাবে দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর একটি অসাধারণ সুন্দর ও সমৃদ্ধ দীর্ঘ কবিতা "একগুচ্ছ মলয় রায়চৌধুরী"। মোট ১৮টি ভাগে ভাগ করে সাজানো এই কোলাজ কিন্তু বাস্তবে একটি অভিন্ন কবিতা। এই কবিতায় হাংরি জেনারেশনের অন্যতম প্রধান কবি মলয় রায়চৌধুরীকে ভাবনার কেন্দ্রে রেখে বলা যায় মিথ হিসাবে ব্যবহার করে বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যুগের কথিত "অগ্রসর আধুনিক সভ্যতার" কদর্য দিকসমূহ যথা পুঁজিবাদী শোষণ নিপীড়ন, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক গণহত্যা, ইথনিক ক্লিনজিং, নারী ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের বিনাশ সাধনের তৎপরতা, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি, সেক্সচুয়াল পারভার্সন এবং আরও বহুকিছুকে স্যাটায়ার-পরিহাস-বিদ্রুপের শানিত ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে এবং একইসঙ্গে কবিতার নান্দনিক সৌকর্য অক্ষুণ্ণ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। কবিতার নামকরণের সঙ্গে সাজুয্য রেখে কিছু শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যা হাংরি জেনারেশনের মলয় রায়চৌধুরীরা ব্যবহার করে গেছেন। দীর্ঘ কোলাজ কবিতাটির উপসংহার নিবিড় ও গভীর ব্যঞ্জনায় অনিঃশেষ। পাঠ করা যেতে পারে:
গ্লোসারি দোকান দিয়ে ব্যর্থ হলুম
তারপর কবিতার বই বের করলুম, ব্যর্থ হলুম
বুড়াদের সঙ্গে ছোকরা-ছুকরি কবিরাও গালমন্দ করলো
একসময় গার্ডেনার হই
পদ্ম ফুলের চাষাবাদ করি...
কিছুদিন পর চলে যাই গ্রেভ-ডিগিংয়ের কাজে
ওখান থেকে কসাইয়ের দোকানে
তারপরও হাংরি থেকে যাই
পেটের মধ্যে পেরেক ঠুকে অন্যগ্রহের আলপিন
ক্ষুধা
ক্ষুধা
ক্ষুধা
সব মূলধন, সম্ভাবনা হারিয়ে গেলে বীর্য-ব্যবসায় মনোযোগী হই
আর কদিনের মধ্যেই আবিস্কার করি, মানুষের বীর্যের চেয়ে
রাজস্থানী গরু-বীর্যের চাহিদা, এবং বাজার মূল্য বহুগুণ বেশি।
পরিহাসে শানিত ও শৈল্পিকতায় সমৃদ্ধ ‘‘গালি বা খিস্তি বিষয়ক মর্মকথা” হচ্ছে কবি খসরু পারভজের একটি মাস্টারপিস। খুব ভালো লেগেছে জুয়েল মাজহারের “তন্দুরের পাশে বসে ” ও “মেগাস্থিনিসের হাসি”, মনোতোষ আচার্যের ‘‘চুমু উদযাপন”, অতনু বন্দোপাধ্যায়ের “চোখের বাইরে’’ ও “প্রান্ত বিনিময়”, সমরেন্দ্র বিশ্বাসের “জেব্রার থিওরোম”, মাসুদার রহমানের “ম্যাজিক টাইম” ও “সোনা পাড়া এগ্রোফার্ম”, ত্রিশাখ জলদাসের “দুরান”, সৌমনা দাশগুপ্তের “কম্পাস”, সৈকত হাবিবের “আমার সন্তানের প্রতি”, কচি রেজার “শীতকাল”, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের “অক্ষর লিপি’’, তৈমুর খানের “সর্বনাশ”, গৌতম গুহ রায়ের “ব্লেড” , কৌশিক চক্রবর্তীর “হে মোর দেবতা”, নাহিদা আশরাফীর “এ কবিতা অপাঠ্য বলে গণ্য করা হোক’’ ,হাসান মসফিকের “নয়নতারার শোক”, সৌরভ বর্ধনের “বাথরুম”, রাজাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের “মতামত ব্যক্তিগত”, ওয়াহিদার হোসেনের “কবির আয়াত’’, সোনালী চক্রবর্তীর “ব্রিগেড, শহীদ ইত্যাদি সার্কাস” প্রভৃতি। সত্যজিৎ চৌধুরীর অনুবাদে অসমিয়া ভাষার কবি মিণ্টুল হাজারিকার “পানীস্তম্ভ”, “একটি কক্ষের জনশ্রুতি”, “শ্রীমুখে রবীন্দ্রনাথ” বেশ ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে দেবযানী বসুর “হাতেলেখা চন্দ্রপৃষ্ঠ” । আসলে কবিতার বিচারের দুটি প্রধান দিক। প্রথমত, ভালো লাগার অনুভূতি; দ্বিতীয়ত, তার মধ্যে থাকা বিষয়ভাবনার গভীরতা অথবা শৈল্পিক সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য অথবা উভয়ের সোনায় সোহাগা সংশ্লেষ। কবিতার প্রথম ও প্রধান কাজটি হচ্ছে ভালো লাগার বা আনন্দ দানের অনুভূতি সৃষ্টি করা। কোনো কবিতা পড়ে ভালো লাগলে তার অর্থব্যঞ্জনা না খুঁজলেও চলে, খুঁজলেও লোকসান হওয়ার কারণ নেই। আর পাঠক তো একটু “নতুনত্ব” চাইবেই। মোবাইল ফোন-ফেসবুকের সদাই ব্যস্ত ও চিত্তচঞ্চল সময়ে চর্বিত চর্বনে তার মন ভরবে না, বসবেও না। সেই নতুনত্ব আসে মূলত কাব্যভাষা থেকে যা তৈরি হয় নতুন শব্দ অথবা পুরোনো শব্দের নতুন ব্যবহার, উপমা-চিত্রকল্পের অভিনবত্ব, কল্পনার দুরন্তপনা, পরিহাস-স্যাটায়ারের ভিন্নধর্মী প্রয়োগ ইত্যাদি থেকে। অভিধান ঘেঁটে ঘেঁটে শব্দের কোষ্ঠকাঠিন্যময় উপরচালাকি নির্মাণ নয়, ভাষার একধরনের সাবলীল আড়াল চায় অভিজ্ঞ পাঠক।
লিফট ভাঙতে ভাঙতে এই চন্দ্রগ্রহে। মধুঝোয়ার প্রস্রাবের।
অধরা মাধুরী ছড়িয়ে আইসিইউ নেচে যায়। মনে রয়ে যায়
মনের বেদনার পরিবর্তে কমলাসুন্দরী ও রমলাসুন্দরীর
নিজেদের জ্যাকেটের বিভঙ্গে ওয়াই জেড বাংলো।
ফারের মাদুর বিছানো মুখ। ঝলকে ঝলকে বালি বমি করে
সমুদ্র মরে গেছে। ফারের মাদুরের তোলা ঝড়ে মুখের
কান্না বলে কিছু নেই আর। আর একটি ছদ্মবেশী মৌচাকে
মৌমাছিরা কী করে তার ভিডিও লাখ টাকার ভাইরাল।
উলঙ্গতমা প্রকৃতি ফুলের জন্য হাহাকার করে ।
তাকে বেস্ট গ্রামি দিতেই হবে।-
[হাতেলেখা চন্দ্রপৃষ্ঠ’, দেবযানী বসু ]
এই সংখ্যায় বেশকিছু দুর্বল কবিতাও আছে, আছে আধা-কবিতাও। কিন্তু সেটা আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন যা অনেকের অভিমতের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। আসলে কবিতা তো নানারকমেরই হয়। পাঠকের রুচিভেদে তার আবেদন বা আকর্ষণও ভিন্নতা নিয়ে উপস্থিত হয়। সেজন্য কবিতার ব্যাপারে চূড়ান্তসত্য বলে কোনোকিছু স্থির করা প্রায় অসম্ভব।
ভিন্নচোখে ঠাঁই পাওয়া প্রবন্ধ-গদ্যগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই সুলিখিত ও সমৃদ্ধ। এসব প্রবন্ধ পাঠে কবিতার নানা দিক ও দিগন্ত সম্পর্কে নিজেদের জানাশোনাকে নতুনভাবে ঝালিয়ে নেয়ার প্রচুর সুযোগ আছে। শুরুতেই আফজাল আলী খানের বিশাল আয়তনের “নতুন কবিতার রন্ধনশালা : ইশারা দিগন্ত” পাঠ করতে করতে পাঠক হারিয়ে যেতে পারবেন কবিতার মহাবিশ্বে। এতে করে অন্যান্য প্রবন্ধ পড়ার ইচ্ছা জাগবে বেশি করে। তৈমুর খানের “কবিতার বাঁক ও নতুন কবিতার অন্বেষা” একটি সমৃদ্ধ নিবন্ধ। তিনি তাঁর বক্তব্যের পক্ষে বিভিন্নজনের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যা পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। “পুনরাধুনিক কবিতা নিয়ে কিছু কথা” শীর্ষক প্রবন্ধে কবি অুনপম মুখোপাধ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন যেখানে কবি এবং কবিতা-চিন্তক উভয়শ্রেণির মানুষের জন্য প্রাসঙ্গিক চিন্তার অবকাশ রয়েছে। তার কবিতাভাবনায় প্রবল প্রাতিস্বিকতার ছাপ বিরাজমান। প্রণব পাল লিখেছেন “ভাষা বদলের কবিতা” নামীয় গদ্য। তার নিজস্ব বক্তব্য ছাড়াও বিশাল আকৃতির গদ্যটির মধ্যে আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারভিত্তিক অভিমত সন্নিবেশিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ফরিদ কবিরের “কবিতা বনাম নতুন কবিতা’’ একটি ছোটো আয়তনের প্রবন্ধ তবে সুচিন্তিত ও সলিখিত। সুবীর সরকার তার "অণু কবিতা দীর্ঘ কবিতা : কবিতার এক অনন্য পরিসর " শিরোনামযুক্ত গদ্যে কবিতার আয়তন, শৈল্পিকতা, এসময়ের পাঠকের চাহিদা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। নিবন্ধে উদ্ধৃত নানা আয়তনের কবিতা পাঠকের জন্য বাড়তি পাওয়া হিসাবে গণ্য হতে পারে। মতিন বৈরাগীর "আদিই প্রথম রূপান্তরে নতুন" শানিত মেধা ও নিবিড় অভিজ্ঞানে থেকেউঠে আসা একটি চমৎকার প্রবন্ধ। তার প্রবন্ধে বামপন্থার প্রতি অনুরাগ লক্ষণীয়। প্রবন্ধটির উপসংহারের অভিমত সত্যনিষ্ঠতায় সুন্দর:
"বস্তু থেকে বস্তুরই উপস্থিতি বস্তুর নানা স্তরিক বিকাশ। নতুন কিছু নয়, বস্তুই শেষতক। কবিতাও নতুন কিছু নয়। যা কিছু নতুন তা হচ্ছে কবিতার নতুন রূপান্তর আঙ্গিকের বদল, আর এই রূপান্তর ক্রিয়াটিই নতুন। "
আমরা জেনে এসেছি যে কবিতা এবং সংগীত পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে অচ্ছেদ্যতায় সংশ্লিষ্ট ও সম্পর্কিত। এটা অনেকটা বহু যুগ আগে থেকেই মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু কবিতা বা সংগীতের সাথে গণিতের কোনো ইতিবাচক নিবিড় সম্পর্কের কথা অন্তত আমার জানা ছিল না। সেটা আমার ব্যক্তিগত অজ্ঞতা। আমি বরং কবিতা আর গণিতকে বিপরীত ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করে এসেছি। প্রসঙ্গত আমার একটা কবিতা থেকে ৪টি লাইন উদ্ধৃত করছি,
হয়তো তুমিও জিতে গেলে কোনোখানে
বেঁচে গেল খুব হিসাবের হালখাতা
বাজেটের ঘরে ক্যালকুলেটর মন
গণিতের গাছে হিসাবে হলুদ পাতা।-
(কবিতার নাম : ‘এই তো জীবন’)
কিন্তু ঋজু রেজওয়ান লিখিত "কবিতায় সঙ্গীত এবং গণিতের সৌন্দর্য" পাঠ করতে করতে গণিত বিষয়ে আমার এতদিনের ধারণা বা বিশ্বাস উল্টে গেল! আইনস্টাইন , এপিজে আবুল কালাম প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সংগীত প্রীতি সম্পর্কে আমি আগে থেকেই ওয়াকিবহাল ছিলাম। কিন্তু অংকের মধ্যে ছন্দ ও সুর আছে এবং বিশেষত তা কবিতায় ব্যবহৃত হচ্ছে বা হতে পার, এভাবে জানতাম না। অবশ্যই ছন্দ ও মাত্রাকে অংক বা সংখ্যা দিয়েই মাপা হয়। তবে ঋজু রেজওয়ানের লেখাটিতে গণিতের নিজেরই কবিতা হয়ে ওঠার বিষয়টি অনেকগুলো উদাহরণ সহযোগে আলোচিত হয়েছে। অন্তত নতুন প্রজন্মের কবিগণ প্রবন্ধটি পাঠ করে কবিতার নতুন দিগন্ত অথবা নিদেনপক্ষে কবিতার নতুন একটা রূপ পেয়ে খুশি হতে পারেন। বহু পঠনপাঠন ও চিন্তাভাবনার ফসল তার এই প্রবন্ধ "কবিতায় সঙ্গীত এবং গণিতের সৌন্দর্য"।
এভাবে ধরে ধরে অন্যান্য প্রবন্ধ/ মুক্ত গদ্য নিয়ে বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হবে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আগ্রহী পাঠক “ভিন্নচোখ : নতুন কবিতাসংখ্যা” সংগ্রহ করে পড়তে পারেন। সব মিলিয়ে ‘ভিন্নচোখ নতুন কবিতা’ সংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এমন সুসম্পাদিত ও সমৃদ্ধ একটি প্রকাশনার জন্য সম্পাদক-গবেষক আলী আফজাল খানকে সাধুবাদ জানানোই যায়।
::::::::::
ভিন্নচোখ
সম্পাদক: আলী আফজাল খান
প্রকাশকাল: ২০২৪
পৃুষ্ঠাসংখ্যা: ৭২০
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম