আফ্রিকাতে দেড়শ বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অবসান— যে খুব তাড়াতাড়ি হয়েছে তা নয়! —এর জন্য আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের বহুকাল প্রস্তুতি নিতে হয়েছে; ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের যে চিত্র আমরা দেখেছি ১৯ শতকের নীলকর বিদ্রোহ, সাঁওতাল, মুন্ডা আদিবাসী কিংবা কৃষক বিদ্রোহ ইত্যাদির ইতিহাস— তা আফ্রিকার ইতিহাসের সমতুল্য বলা চলে। এর প্রতিটি মূলে ছিল শোষণ, শাসন, নির্যাতন ও তীব্র বঞ্চনার অন্ধকার অধ্যায়। আফ্রিকার বিদ্রোহ হয়েছিল শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সালে এই দুই বছরে অরণ্যবাসী গুপ্ত সশস্ত্র সংগঠন মাউ মাউ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
WEEP NOT, CHILD বইটি কেনিয়া স্বাধীনতা লাভের এক বছর পরেই প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ স্বাধীনতাকামী আফ্রিকানদের লড়াইয়ের মধ্যকালীন সময়ে বইটির সূচনা হয়েছিল। এর আগে কোন আফ্রিকান বই আমার পড়া হয়নি! হ্যাঁ, এই প্রথম আফ্রিকার কোন লেখকের বই পড়তে বসলাম। বই পড়া মানেই আমার কাছে অন্যরকম কিছু। আফ্রিকার বিদ্রোহী লেখক ন্গুগি ওয়া থিয়াংও ( Ngũgĩ wa Thiong'o ) কিছুদিন আগে মারা গেছেন। আফ্রিকান উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন তিনি প্রথম উপন্যাস লিখেছেন, WEEP NOT, CHILD বা `কেঁদো না, বাছা' অনুবাদ করেছেন, শামীম মণ্ডল। বৃষ্টিস্নাত দিনে ঘরে বসে মন্ত্রমুগ্ধকর বইটি পড়ে শেষ করলাম। মনে হচ্ছিল, আফ্রিকানদের সাথে কিছুটা সময় কাটালাম। বইটি মূলতঃ আফ্রিকান উপনিবেশিকতা, সামাজিকতা, বর্ণবৈষম্য, জনজীবন ইত্যাদির সমন্বয়ে রচিত হয়েছে।
মূল প্রেক্ষাপট: ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার প্রতিবাদে আফ্রিকানরা গড়ে তুলেন এক মুক্তিকামী সংগঠন, যার নাম মাউ মাউ। এসব সংগঠনের মানুষেরা সাধারণত বনে জঙ্গলে থাকতেন। দেদান কিমাথি ছিলেন, আফ্রিকান মুক্তিবাহিনীর কিংবদন্তি নেতা। তার প্রেরণায় আফ্রিকানরা ব্রিটিশ উপনিবেশিক বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং কেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে কেনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
ন্গুগি ওয়া থিয়াংও এই উপন্যাসটি এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যেখানে প্রত্যেকটি চরিত্র একেকজন নায়ক। ভিলেন ছিলেন মাত্র একজন, হাউল্যান্ডস সাহেব আর দেশদ্রোহী জ্যাকোবো। আফ্রিকানদের নিজের জায়গা জমি পর্যাপ্ত ছিল কিন্তু সেগুলো ছিল শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের দখলে। নিজেদের জমিতে কৃষ্ণাঙ্গদের দাস হিসেবে ক্ষেতে কাজ করতে হতো। গোথো, পাঁচ সন্তানের জনক। তার দুজন স্ত্রী, জেরি ও নাইওকাবি। বলা চলে, গেথো’র পুরো পরিবার ছিল বিদ্রোহী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্য থেকে গেথো’র পরিবারও যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেই ব্রিটিশরাই আফ্রিকানদের দাসত্বে পরিণত করেছিলেন। এইসব হতাশা ও ক্ষোভ নিয়ে গোথো’র সন্তানেরা বরো, কামাউ, কোরি প্রমুখ মাউ মাউ বিদ্রোহী দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।
গেথো’র ন্যায্য জমি দখল করে, হাউল্যান্ডস খামার তৈরি করেছিলেন। জ্যাকোবো, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ধনী ছিলেন, তার মেয়ে উইহাকি। জর্জি’র প্রেমিকা। গোথো’র ছেলেদের মধ্যে জর্জি ছিলেন, খানিকটা কাপুরুষ, তবে শিক্ষানুরাগী। আফ্রিকানদের ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষায় লাভ করার কথা ভেবেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে স্বপ্ন তার কখনোই পূরণ হয়নি! তার পরিবার মাউ মাউ দলের সদস্য হওয়ার কারণে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং স্কুল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। গরিব আফ্রিকানদের জমি দখলে সাহায্য করেছিলেন, জ্যাকোবো। গ্রামবাসীদের রোষানলে পড়েছিলেন। বিদ্রোহী মাউ মাউ দলের সদস্য বরো’র বাবা গোথোকে হত্যা করেছিলেন, পাড়ার মহিলাদের ধর্ষণ ও নির্যাতন তাই বরো জ্যাকোবোকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। অথচ একদিন শ্বেতাঙ্গদের কাছেই গরিব আফ্রিকানরা যাদের জমি দখল করেছিল ব্রিটিশরা তাদের থেকে গুলি চালানো শিখছেন, বরো।
জোমো ছিলেন এ পর্বের নায়ক! যার তীব্র বজ্রবাণী আফ্রিকানদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। প্রথম যে বার আফ্রিকার মানুষেরা ধর্মঘট করেছিলেন, সেটি ব্যর্থ হয়েছিল, বর্ণবৈষম্যের কারণে। রাজনৈতিক বক্তৃতার কারণে জোমোকে বন্দি হতে হয়। মামলা হয়। বিচার হয়। সবই ব্রিটিশদের আইনে। কিন্তু আফ্রিকার জনগণ বুঝে ফেলে জোমোকে আমরা ফিরে পাব না, কারণ আইন শুধু ব্রিটিশদের পক্ষেই থাকবে। ওরাই আইন প্রেণেতা।
বরো বলেন,
শ্বেতাঙ্গরা ঐক্যবদ্ধ। তাই তারা শক্তিশালী। কিন্তু আমরা এই কৃষ্ণাঙ্গরা ভিন্ন ভিন্ন। আর একে অপরের বিরুদ্ধে লেগে আছি। এখন জোমো কারাগারে। আমরা শ্বেতাঙ্গদের দাসে পরিণত হব। তারা আমাদেরকে দিয়ে তাদের স্বার্থে যুদ্ধ করিয়ে নিয়েছে। তারা আমাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
হ্যাঁ সত্যিই তাই! নগুগি ওয়া থিয়াংও উপন্যাসটিতে এমন কিছু বিষয় উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন, তরুণ বয়সী বরো, অবশ্য লেখকেরও তখন তরুণ বয়স, —এ বয়সে বিদ্রোহের একটা আবহ তৈরি করা উপন্যাসটিকে আরো বেশি প্রাঞ্জল করেছে।
একজন দেশপ্রেমিকের দেশদ্রোহীর মেয়ের সাথে প্রেম। উপন্যাসটিকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। লেখকের এই বিষয়টি হতে পারে, উইহাকির প্রতি দেশাত্মবোধ জাগ্রত করা। কিন্তু জর্জির ক্ষেত্রে তা সম্ভবপর হয়নি! শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব যখন তীব্র হচ্ছে, মাউ মাউ বিদ্রোহীরা আরও তুখোড় হচ্ছে, প্রথম ধর্মঘটের দিন, নাইবোরি থেকে আগত এক যুবকের বক্তব্য নিন্মে দেওয়া হলো—
অতীতের কথা বললেন অনেক। সোনালি অতীতের কথা, যখন কৃষ্ণাঙ্গরাই জমির মালিক ছিলেন। আফ্রিকা ছিল তাদেরই। নিজেদের আফ্রিকা। কারণ স্বয়ং স্রষ্টা তাদেরকে জমি দান করেছিলেন। পরে শ্বেতাঙ্গরা আসে। কেড়ে নেয় সেই জমি। তিনি আরো বললেন, আমাদের বাবারা, দাদারা ব্রিটিশদের বিশ্বাস করে ভুল করেছেন। তারা শ্বেতাঙ্গদের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখলেন এক প্রতারণা। তাদের সব জমি শ্বেতাঙ্গরা নিয়ে নিয়েছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, এটা কি ঠিক?
সবাই সমস্বরে বলল, না, না, না।
কালোরা তাদের নিজেদের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতে বাধ্য হলো। কর দিতে হলো তাদেরকে। আমরা স্বাধীনতা হারালাম। কোথায় গেল স্বাধীনতা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলো। আমাদেরকে আবার যুদ্ধে যেতে হলো। আমরা কৃষ্ণাঙ্গরা জীবন দিলাম। আমাদের জীবনের বিনিময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষা পেল। কিন্তু আমরা কিছুই পেলাম না। এটাই কি ন্যায়বিচার?
সমস্বরে চিৎকার করে উঠল জনতা-না, না।
তিনি আরো বললেন, আমরা স্রষ্টাকে ডাকলাম। তিনি আমাদের প্রার্থনা শুনলেন। তিনি আমাদের কাছে জোমোকে পাঠিয়েছেন। তিনিই আমাদের মসিহ, তিনিই আমাদের ত্রাণকর্তা। তিনিই আমাদের উদ্ধারকারী। তিনি শ্বেতাঙ্গদের বলেছেন, আমার মানুষকে চলতে দাও। বক্তার কণ্ঠের জোর বেড়ে গেছে। উচ্চস্বরে চিৎকার করে বক্তৃতা করে যাচ্ছেন।
আর সেজন্যেই আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। সব কৃষ্ণাঙ্গ ভাই ভাই। আজ আমাদের একসঙ্গে আওয়াজ তুলতে হবে। এখন সময় হয়েছে। আমাদের মানুষকে স্বাধীন হতে দাও। এখন আমাদের জমি আমাদেরকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
গোথো মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। খারাপ লাগছে তার। বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। চারদিকে সবাই অবশ্য চিৎকার করছে। কিন্তু তিনি চিৎকার করতে পারছেন না। হঠাৎ করেই তার চোখ পানিতে ভরে গেল। কিছুই আর ভালোমতো দেখতে পাচ্ছেন না। তারপর এপাশ-ওপাশ তাকালেন। একটু পরেই বুঝলেন, পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
বক্তা বললেন, মনে রাখতে হবে, এটা একটা শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট। আমাদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। কোনো সহিংসতা নয়, কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়। যদি কেউ আমাদেরকে আঘাত করে, তবু আমরা আঘাত করব না।
আফ্রিকানদের বিশ্বাস ধৈর্য এবং সঙ্ঘবদ্ধতা লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করেছিল। কৃষ্ণাঙ্গরা ন্যায্য পাওনা জমি ফিরে পেয়েছিলেন একদিন। উপনিবেশিক ব্রিটিশরা চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার মধ্য থেকে এতগুলো মানুষের জীবন দান। কেনিয়াকে আরও সতেজ করে তুলেছিল। কিন্তু কেনিয়ার পুরো অঞ্চল দখল করা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই এশিয়া, ইউরোপ প্রভৃতি থেকে দলে দলে মানুষজন সেখানকার পরিবেশকে উত্তপ্ত করেছেন। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আফ্রিকানদের অর্থাৎ কেনিয়াবাসীদের এক নির্মম নিয়তির সম্মুখে দাঁড় করিয়েছেন।
ইংরেজি ভাষা এখন তাদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা। অথচ ন্গুগি ওয়া থিয়াংও ইংরেজি ভাষাকে ত্যাগ করেছিলেন, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য, ইংরেজি ভাষা ছেড়ে নিজের কেনীয় ভাষাতে সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপরেখা তৈরি করতে থাকেন। পূর্বে যখন তিনি ইংরেজি ভাষায় লিখেছিলেন, তখন দেখেছিলেন, আফ্রিকার মানুষেরা যারা ইংরেজি জানেন না, তাদেরকেও ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সম্পর্কে অবগত করা প্রয়োজন— তাই লেখক খুব শক্ত হাতে ইংরেজি ভাষা ত্যাগ করে কেনীয় ভাষায় সাহিত্য লেখা শুরু করেছিলেন। মূলত, এটি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি অংশ। হাসান আজিজুল হক মন্তব্য করেন,
“তৃতীয় বিশ্বের সমস্ত সৎ লেখকের যে অবস্থান হতে পারে ও হওয়া উচিত, ন্গুগি অবস্থানও ঠিক তাই।”
—এই কথার সাথে আমি একমত। একজন সৎ লেখক যিনি সারাটা জীবনবাজি রেখে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ভেবেছেন, তাদের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। যা আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের দৈনন্দিন জীবনের বৈপ্লবিক চেতনার ভেতর মনুষ্যত্বের খোরাক জোগায়।
লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই প্রখর ছিল, তিনি আফ্রিকানদের শুধু দুর্দশার কথাই বলতেন না বরং সে সময়ের সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সাক্ষরতার কথা বলে, যে নিখুঁত বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন তা মাউ মাউ বিদ্রোহের পর আফ্রিকানদের উন্নত জীবন যাপনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। মূলত, মাউ মাউ বিদ্রোহ ছিল, আফ্রিকানদের স্বাধীনতা লাভের একমাত্র পন্থা।
**********
কেঁদো না, বাছা
নগুগি ওয়া থিয়াংগো
অনুবাদ: শামীম মণ্ডল
প্রকাশক: প্রকৃতি, ঢাকা
প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে বইমেলা ২০২৪
মূল্য : ১৬০ টাকা
পৃষ্ঠা : ৮৮
আই এস বি এন: ৯৮৪-৩০০-০০০৬৭০-৫

0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম