তেজেন্দ্রলাল দত্ত রচিত 'উদ্‌বাস্তু আন্দোলনের স্মৃতিচিত্র' বই প্রসঙ্গে রাজা সরকার

তেজেন্দ্রলাল দত্ত রচিত 'উদ্‌বাস্তু আন্দোলনের স্মৃতিচিত্র' বই প্রসঙ্গে রাজা সরকার


‘উদ্বাস্তু’ শব্দটি বাঙালির অভিধান থেকে হারিয়ে যাওয়ার মুখে। কারণ প্রজন্মান্তরের গোলক ধাঁধায় ‘উদ্বাস্তু’ শব্দটি অচেনা হতে হতে আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। হওয়ারই কথা। এখন  উদ্বাস্তু একটি অপর শব্দ। উদ্বাস্তুর উত্তরাধিকারীরাও উদ্বাস্তু শব্দটা অপর মনে করে। তার উপর এখন আর উদ্বাস্তু আসেনা, এলেও লড়াই করে উদ্বাস্তু কলোনিও তৈরি করে না। এলেও নীরবে মুখ নিচু করে অপরাধীর মত গা ঢাকা দিয়ে থাকে। এ-ও এক ইতিহাসের কথা। সেই কথা এখন থাক। 

কিন্তু কলকাতা শহরটি যে বিগত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে উদ্বাস্তু বেষ্টিত হয়ে তার অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। একই ভাবে উদ্বাস্তুরাও কলকাতার বিগত ছয়/সাত দশক জুড়ে কলকাতার উত্থান পতনের সঙ্গে নিজেদের অঙ্গাঙ্গী করে তুলেছে। ফলস্বরূপ এই সব দশকগুলো জুড়ে কলকাতার সামাজিক রাজনৈতিক উত্থান পতনের অক্লান্ত অংশীজনও এই উদ্বাস্তুরা।

কেউ কেউ বলেন স্বাধীনতার পর কলকাতা কিনে নেয়ার জন্য অনেক ক্রেতা গড়ের মাঠে রাত কাটাতো। কিন্তু দেশ হারানো ভিটে হারানো স্বজন হারানো মানুষগুলোর জন্যই নাকি ডিলটা সেসময় হয়নি। এরা সংখ্যায় কত ছিল সেদিন গোনা যায়নি। এরা অজস্র অসংখ্য অনিঃশেষ!  এদের  ক্রুদ্ধ বিপন্ন চোখ মুখ দেখে নাকি তারা সেদিন ভয় পেয়েছিল। কিন্তু দান ছেড়ে দেয়নি তারা। গরম লোহা শীতল হয়েছে। তারাও গুটি গুটি পায়ে এগিয়েছে আর সফল হয়েছে। এই কথাও আপাতত থাক।

‘উদ্বাস্তু আন্দোলনের স্মৃতিচিত্র’ বইটি লিখেছেন শ্রী তেজেন্দ্রলাল দত্ত। কলকাতাকে ঘিরে যে উদ্বাস্তু বলয় তৈরি হয়েছিল ১৯৪৭ সনের পর থেকে তার একটি সাক্ষাৎ বিবরণ এই বইটি। তেজেন্দ্রলালকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাতে হয় এই জন্য যে, তিনি এটি লিখেছেন। না লিখলে জানাই যেত না এই বিদ্যাসাগর উপনিবেশ, রামগড়, লক্ষ্মীনারায়ণ কলোনী, চিত্তরঞ্জন কলোনী বাঘাযতীন সহ আরো অনেক নামের কলোনিগুলোর শুধু  বেঁচে থাকার জন্য কী বিপুল পরিমাণ ক্লেশ সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু কেন? এই উত্তরটি সেখানে নেই । কারণ স্বাধীনতার নামে একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কারণে এক  বিশাল জনগোষ্ঠীর নিজ দেশ থেকে উৎখাত হওয়ার পর এই দেশে এসে সহায় সম্বলহীন নেহাত বেঁচে থাকার সংগ্রাম এতটাই কঠোর ও নির্দয় ছিল যে পেছনে তাকানোর অবকাশ ছিল না। সেটা এক পৃথক ইতিহাস।

এই বইটি বর্তমান প্রজন্মের জন্য খুব জরুরি একটি কাজ। আজকের ঝাঁ চকচকে কলকাতা দক্ষিণের উপনিবেশ বা কলোনিগুলো দেখলে কেউ ভাবতেই পারবেন না যে ১৯৪৭ এর পর পূর্ববঙ্গ থেকে প্রাণ ও মান রক্ষার্থে পালিয়ে আসা মানুষগুলো কী অপরিসীম উদ্যম ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে জলা জঙ্গল সাপ খোপ মশা মাছি অধ্যুষিত এই সব জায়গায় মাথা গোঁজার একটুখানি আশ্রয় তৈরি করে নিয়েছিলেন বাঁশ আর হোগলাপাতার ছাউনি দিয়ে। ভাবা যায় না। তার উপর জমি মালিকের গুণ্ডাবাহিনী এবং সরকারের পুলিশ বাহিনী এসবেরই মোকাবেলা করতে হয়েছিল। 

এটাইতো শিকড় এই প্রজন্মের। শিকড় জানতে হয়, শিকড় নিয়ে ভাবতেও হয়।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ