শামসুদ্দীন আবুল কালাম রচিত 'কাশবনের কন্যা' উপন্যাসটি যেন বইয়ের মলাটে আবদ্ধ নদীবেষ্টিত ভাটি অঞ্চলের প্রান্তিক ও মেহনতি মানুষের সমাজবাস্তবতার এক জীবনগাঁথা।
বঁধুর রূপ দেখিয়া হইয়াছি পাগল
ঔষধে আর মানে না
চল সজনি যাই লো যমুনায় ।
এই বঁধুর কাঁটা বিষম কাঁটা
ঠেকলে কাঁটা খসান দায়
চল সজনি যাই লো যমুনায়।
(পৃ: নং-১৭)
উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ:
১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ২৫ টি পরিচ্ছেদে রচিত 'কাশবনের কন্যা' উপন্যাসটিতে দুটি ঘটনাপ্রবাহে রচিত হয়েছে তৎকালীন দক্ষিণবঙ্গের দেশীয়-লোকজ, অপ্রচলিত গ্ৰাম্য শব্দ, প্রবাদ-প্রবচন, লোককথা। আখ্যানমূলক উপন্যাসটিতে মূলত 'সখিনা-হোসেন-মেহেরজান' বিষয়ক কাহিনির সমান্তরাল ধারায় অগ্ৰসর হয়েছে 'কানু শিকদার-জোবেদা' বিষয়ক প্রণয়মূলক কাহিনি।
উপন্যাসটির প্রথম দিকের কাহিনিতে আমরা দেখেছি হোসেন কেরায়া বায়। তার বাল্যসাথী কিশোরী সখিনার প্রতি সে আকর্ষণ অনুভব করে ও তাকে বিয়ে করতে চায় এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি সুখী জীবনের প্রত্যাশা করে বন্ধু আমজাদের পরিবারের মতো। তার মতে,
ঘরে একটা মাইয়া ছেইলা না থাকলে কোন শ্রী ছাঁদই যেন আসে না। (পৃ: নং-৩০)
কিন্তু তাদের গ্ৰাম্য প্রেমের সম্পর্কটি ততটা স্পষ্ট নয়। হোসেনের হয়ে শিকদার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে শুনতে পায় সখিনার বাবা গঞ্জে আলীকে যিনি আশ্রয় দিয়েছেন তারই ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সখিনার। অনেকটাই নিয়তিবাদের কবলে পড়ে সখিনার বিয়ে হয় এবং বিচ্ছেদও ঘটে। কিন্তু বিচ্ছেদ হওয়া সখিনার মতামত অনুযায়ী হোসেনের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কথাবার্তা চললেও হোসেনের কান পর্যন্ত এই কথা যায় না। কারণ ততদিনে হোসেন ছবদার মাঝি নামে পূর্ব পরিচিত এক বয়স্ক ও অসুস্থ মাঝিকে নিয়ে যাত্রা করে বৈশাখী গ্ৰামের উদ্দেশ্যে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে।
শিকদার হোসেনের অপেক্ষা করতে থাকে ও বিভিন্ন ঘাটের মাঝির কাছে তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে। অন্যদিকে হোসেন ছবদার মাঝিকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার দুই দিন পর মাঝি মারা যায়। মাঝির এক স্ত্রী, এক যুবতী ও স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে মেহেরজান আর এক কিশোর ছেলে জাফর। একে তো উপার্জনক্ষম কেউ নেই তাতে আশেপাশের লম্পট ও দুশ্চরিত্র মানুষের মেহেরজানের প্রতি কুদৃষ্টির প্রভাব দেখে হোসেন সেখানে থাকতে বাধ্য হয়। এরপর আমারা দেখি মেহেরজান ও হোসেনের মধ্যে প্রণয়নের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু একটা পর্যায়ে হোসেন তার বন্ধু শিকদারের সাথে পরামর্শ করে শিকদারকে নিয়ে আবার মেহেরজানের কাছে ফিরে আসবে বলে কথা দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে কেরায়া নিয়ে যাত্রা করে। এখানেই হোসেনের জীবন কাহিনীর আকস্মিক ইতি টেনেছেন লেখক।
প্রথমদিকে লেখক হোসেন চরিত্রটিকে প্রকটভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অন্যদিকে শিকদার চরিত্রকে তুলে ধরেছেন প্রচ্ছন্নভাবে। শিকদার চরিত্রে দেখা যায় কবিয়াল, প্রেমিক পুরুষ, ভীরু, গম্ভীর, বাস্তব বিমুখ সংসার উদাসীন হিসেবে। যদি আমরা শিকদারের পরিবারের দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে পারব যে তার দাদা করমালীও তারই মত কবিয়াল ও সংসার বিমুখ ছিলেন যার প্রভাব তার বাবা জয়জামালী ও তার নিজের উপর পড়েছে।
শিকদারের গীতগুলোর জন্য সবাই পাগল ও তাকে বয়াতি ভাই বলেও ডাকে। কিন্তু তিনি এইভাবে গান গেয়ে অর্থ, সম্পদ, প্রতিপত্তি অর্জন করতে চায় না। তার কাছে মনে হয় এভাবে টাকা উপার্জন হলো ফাঁকি দিয়ে উপার্জন। তাই তিনি সংসার উদাসীন হিসেবে গানকে ভালবেসে এক কাব্যিক চিন্তা ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকেন।
শিকদারের এই সংসার উদাসীনতার জন্য তার প্রেমিকা জোবেদা নলসিঁড়ির এক বয়স্ক ব্যবসায়ী আজগর উল্লাহকে বিয়ে করে। জোবেদা চরিত্রটিকে লেখক এ উপন্যাসে জীবন্ত চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন। জোবেদা চরিত্রের মধ্যে সে একজন সক্রিয় মননের অধিকারী, প্রতিবাদী, সক্রিয় নায়িকা, ছলনাময়ী, বন্ধ্যা, প্রথাবিরোধী, কাশবনের কন্যা। গম্ভীর, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি স্বামী আজগর উল্লাহ তার মায়ের কথা শুনে জোবেদার উপর নির্যাতন করে ।
অত্যাচারী শ্বাশুড়ির নানারকম বিদ্রুপ ও মন্তব্যের অশ্লীলতায় সে যেন পুকুরে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়াও শান্তি পাইত না। মাঝে মধ্যে মনে হইত মেয়েমানুষ হইয়া জন্মগ্ৰহণের মতো অভিশাপ বুঝি আর নাই। (পৃ: নং -৮০)
ব্যবসায়ী কাজে ও আরেক স্ত্রী থাকায় আজগর উল্লাহ বাড়িতে বেশি আসতো না বলে শ্বাশুড়ির সব আক্রোশ যেন জোবেদার উপর। শ্বাশুড়ির মতে,
বউকে ফলবতী হইতে হইবে, পুত্রবতী হইতে হইবে।.... সন্তান চাই, বংশ জিয়াইয়া রাখতে হইবে। আমি অন্য কিছু বুঝি না। এবারটা দেইখা লই, এবারও কিছু না হইলে মনের মতো বউ আনিয়া ঘরে উঠামু... পোলাটারেও আর ঘরমুখি রাখতে পারস নাই। চুপ চুপ। সবই তোর মানিয়া চলতে হইবে। (পৃ: নং -১১৭)
একদিকে জোবেদা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অন্যদিকে তাকে না পেয়ে কানু শিকদার বয়াতি হয়ে এলোমেলোভাবে জীবন যাপন করছে। তবে জোবেদা শ্বাশুড়ির অত্যাচার কখনো মুখ বুজে মেনে নেয় নি, প্রত্যেকবার সে প্রতিবাদ করেছে। তাকে হেদায়েতের জন্য পীরের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ হয় এবং তাকে নিয়ে তার শ্বাশুড়ি ও স্বামী পীরের বাড়ির দিকে যাত্রা করে। নলসিঁড়ির ঘাটে গিয়ে শিকদারের সাথে তার দেখা হয় কিছুক্ষণের জন্য। এই ক্ষণস্থায়ী সময়ের মধ্যে জোবেদা ও শিকদারের মনে আবেগ, অনুভূতি কাজ করে এবং অনেক কথা বলতে চেয়েও যেন বলা হয়ে ওঠে না। শিকদার নলসিঁড়ির ঘাটে যায় হোসেনের খোঁজে। সেখানে তার পরিচয় ঘটে ঘাট মাস্টারের সাথে এবং তারা একে অপরের অনুভূতি বুঝতে পারে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। ঘাট মাস্টার তার গান শুনে মুগ্ধ হয় ও তাকে একটি দোতারা উপহার দেয়। যদিও শিকদার তার দাদা করমালীর দোতারাটি সে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় নলসিঁড়ির ঘাট থেকে ফিরে এসে নিজের বাড়িতে জোবেদাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। জোবেদা সামাজিক প্রথাকে পদদলিত করে প্রাক্তন প্রেমিক কানু শিকদারের কাছে চলে আসে নিজের ভাইয়ের বাড়িতে না গিয়ে। শিকদারের বাড়িতে সে কিছুদিন থাকে,পরে শিকদার তাকে সামাজিকতার কথা বলে ও অনেক বুঝিয়ে তার ভাইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এদিকে শিকদারের এক বন্ধু মনসব সর্দারের (বড়বাড়ির পেয়াদা) সাথে পরামর্শ করে সে জোবেদাকে নিয়ে নতুন যে ভাটি অঞ্চলের সন্ধান মিলেছে সেখানে গিয়ে ঘর বাঁধার পরিকল্পনা করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যাওয়ার আগের দিন জোবেদার স্বামী কিছু লোক নিয়ে এসে জোর করে জোবদাকে তার ভাইয়ের বাড়ি থেকে নিয়ে চলে যায়।
উপন্যাসটির পরিসমাপ্তিতে দেখি কানু শিকদার তার অর্জিত অর্থ, নিজের বাড়ি ও হোসেনের বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব মনসব সর্দারকে দিয়ে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষের সাথে ভাটি অঞ্চলের দিকে পা বাড়ায়।
বিষয়বস্তু:
'কাশবনের কন্যা' উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য দেশের মাটি আর মানুষের প্রতি গভীর আগ্ৰহ। এ উপন্যাসে লেখক নদীমাতৃক বাংলাদেশের স্বপ্নহীন ও সংগ্ৰামী মাঝি জীবনের আলেখ্যই উপস্থাপন করেছেন। কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালামের নাগরিক সভ্যতা থেকে বহুদূরবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রকৃতিনির্ভর প্রান্তিক লোকমানুষের চালচিত্র রূপায়ণে লেখকের শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি, চরাঞ্চল বেষ্টিত মেহনতি মানুষের দুর্বার জীবনাভিপ্সা ও লোকজ সংস্কৃতির যৌথতায় গ্ৰন্থিত অসামান্য উপন্যাস 'কাশবনের কন্যা'। তীরহারা মাঝিদের জীবনের আর্থিক অনটন, অভাব, শূন্যতা, হাহাকার, শান্তির নীড় রচনার ব্যর্থ প্রচেষ্টা, প্রেমিকের অভিমান আর অনুশোচনা সামাজিক উৎপীড়নে জীর্ণ নায়িকার সাহসিক গৃহত্যাগ, সামাজিক বিধিনিষেধের গভীরে নিমজ্জিত হয়ে অনুশোচনার পরিণতিতে অসহায় আত্মসমর্পণ এ উপন্যাসের অধ্যায়ে অধ্যায়ে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তাছাড়া এ উপন্যাসে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর নিকটবর্তী চরাঞ্চলের মানুষের জীবন সমুদ্রের জোয়ার ভাটার মতোই সংগ্রামী ।
মাঝিদের বজরা, পানসী, মুঠিয়া, কেরায়া নামের নৌকাগুলোতে ভরে যায় নদীর বুক। জলসিঁড়ি, নলসিঁড়ি প্রভৃতি ঘাটে জনসমাগম লেগেই থাকে। সুভিতপুর, ধবলার চরও বিভিন্ন উপলক্ষ - অনুষ্ঠানাদিতে জমজমাট হয়ে ওঠে। নদীর বাঁকে বাঁকে গড়ে উঠেছে গঞ্জ বা ব্যবসাকেন্দ্র। গঞ্জের পূর্ব দিকের একটা পল্লিতে বাউল-বৈষ্ণবদর আখড়া ছিল বলেও লেখক জানিয়েছেন। এই বাউল বা বেবুশ্যারা ছিল সমাজ নিগৃহীত। তাদের বাসভূমি বহমান নদীর স্রোতের আঘাতে আঘাতে ভেঙে ভেসে গেছে। তাছাড়া এ উপন্যাস সমাজ-বাস্তবতা, অধ্যাত্মবাদ ও নিসর্গের সমন্বিত বন্ধনে এক উদ্ভাসিত ক্যানভাস উপহার দেয়। ঔপন্যাসিক লোক-ঐতিহ্যকে কীভাবে ধারন করেছেন তার মননে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায় বিন্যাসে সংযুক্ত লোকগীতির সংযোজনে।
নিজস্ব ভাবনা:
'কাশবনের কন্যা' (১৯৫৪) উপন্যাসটির প্রথম কয়েকটি পরিচ্ছেদ পড়ার পর মনে হয়েছিল উপন্যাসটির নায়ক হোসেন। কিন্তু যতই উপন্যাসের ভিতরে প্রবেশ করছিলাম ততই মনে হচ্ছিল উপন্যাসের নায়ক আসলে কে? হোসেন নাকি কানু শিকদার? লেখক প্রথম ৮টি পরিচ্ছেদে হোসেনের জীবনের কাহিনীকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে পাঠক তাকেই নায়ক হিসেবে মনে করার ভ্রমে পড়ে যাবেন। আমিও সেই দলেরই একজন। দক্ষিণ বাংলার কর্মজীবী মানুষের অন্যতম 'নায়ের মাঝি'র জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, কাঠিন্য-কোমলতা কিংবা দৃঢ়তা, প্রেম-বিরহ এ উপন্যাসে উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ চরিত্রে আমরা দেখবো প্রতিকূল পরিবেশকে উপেক্ষা করেও নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার সংগ্ৰাম চলছে। এ যেন এক অস্তিত্ববাদী উপন্যাসকে সমর্থন করে।
হোসেনকে দেখা যায় প্রথম দিকে সখিনার প্রেমে পড়তে কিন্তু একইসাথে আবার মেহেরজানের প্রমেও পড়তে ও ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতেও দেখি। আসলে হোসেনের কঠোর জীবন সংগ্রামের পেছনে আছে নিজের পরিবার গঠনের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস। অন্যদিকে সখিনা ও মেহেরজান স্বামীর বাড়িতে সুখী না হওয়ায় নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। কানু শিকদারকে প্রথম দিকে সংসার বিমুখ হিসেবে দেখানো হলেও পরবর্তীতে জোবেদা ফিরে আসায় সেও এক সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে যদিও তা পূর্ণতা পায় না তারপরও শিকদার থেমে থাকেনি জীবন সংগ্রামী মেহনতি মানুষের সাথে আরেক চরাঞ্চলের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় যা মার্কসীয় ভাবধারার প্রতিফলন ঘটেছে। উপন্যাসটিতে একইসাথে সামাজিক, আঞ্চলিক, রোমান্টিক, ফটোগ্রাফিক, গীতধর্মী ও মার্কসবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
ভাষাশৈলী:
লেখক উপন্যাসটি রচনা করেছেন কাব্যময় সাধু ভাষায়। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপটে সাধু ভাষা রচনাটিকে আরো বাস্তব ও জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। পাশাপাশি অপ্রচলিত কিছু আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ, প্রবাদ-প্রবচন, লোককথা, সংস্কার, লোকগীতি ইত্যাদি তুলে ধরেছেন লেখক। তার প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক নিসর্গের বর্ণনা যেন চোখের সামনে ছবি ভেসে ওঠে। এ উপন্যাসে চরিত্র ও ঘটনাগুলি পূর্ব বাংলার জনজীবনের চরিত্র ও স্বভাবকে এমনই সহজ ও বাস্তব করে এঁকেছেন যে, ঐ নরনারী ও নিসর্গের সঙ্গে পাঠকের যুক্ত হতে মুহূর্ত দেরি হয় না। যদিও উপন্যাসটি শেষ করে পাঠক অতৃপ্তবোধ করেন। কারণ কোন সম্পকই শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পায় নি। তবুও যেন তার লেখা এত বাস্তব জীবনকথা আমাদের উপন্যাসটি পড়তে বাধ্য করে এবং তা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। উপন্যাসটি লেখককের প্রথম উপন্যাস হয়েও ভাষা, ভঙ্গিমায় ও প্রকরণে এক জনপ্রিয় উপন্যাসে পরিণত হয়েছে।
নামকরণের স্বার্থকতা:
'কাশবনের কন্যা' বলতে উপন্যাসের নায়িকা জোবেদাকে বোঝানো হয়েছে। উপন্যাসটিতে বেশ কয়েকবার নদীর ধারে কাশবনের মধ্যে কানু শিকদার জোবেদার প্রতিচ্ছবি দেখতে পান সাথে সাথে পাঠকগোষ্ঠীর সামনেও যেন এক নারীর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। মূলত কাশবনকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আখের একটি জাত হলো এই কাশ, যা খেতে সামান্য মিষ্টি ও তেতো স্বাদের হয় এবং এতে তুলোর মত নরম আর মেঘের মতো সাদা কাশফুল ফোঁটে। তেমনি জোবেদা আধুনিক মননের অধিকারী, সক্রিয় নায়িকা, ছলনাময়ী, বন্ধ্যা, প্রথাবিরোধী, নিয়তিবাদের শিকার ইত্যাদি বিভিন্ন চরিত্রের সমন্বয় ঘটেছে তার মাঝে। জোবেদা যেন বিভিন্ন জীবন্ত চরিত্রের সমন্বয়ে এক 'কাশবনের কন্যা'। তাই প্রতীকধর্মী নামকরণটি যথার্থ হয়েছে।
উপসংহার:
'কাশবনের কন্যা' শামসুদ্দীন আবুল কালামের প্রথম, সবচেয়ে বিখ্যাত ও মিথিক্যাল উপন্যাস, প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে (১৩৬১ খ্রী.)। লেখকের জন্ম বরিশাল জেলায়। ফলে তিনি ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন। লেখক দক্ষিণ বাংলার শ্রমজীবী মানুষের আর্থ-সামাজিক সংগ্ৰাম, শ্রেণি - সংঘাত ও জীবনযাত্রার কঠিন বাস্তবতাকে সুন্দরভাব ফুটিয়ে তুলেছেন এই উপন্যাসে। এ উপন্যাসটির একটি তথ্যসমৃদ্ধ ভূমিকা লিখছেন পবিত্র সরকার। এই ভূমিকা থেকে আমরা উপন্যাসটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাই। উপন্যাসটি পাঠকমহলে বেশ জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। এ উপন্যাসের প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। 'কাশবনের কন্যা' উপন্যাসের দ্বিতীয় মুদ্রণ করতে হয় প্রথম প্রকাশের মাত্র দুই বছর পরে এবং তৃতীয় মুদ্রণ হয় ১৯৬৮ সালে। প্রথম প্রকাশক হলেন ওসমানিয়া বুক ডিপো, ঢাকা। পরবর্তীতে মুক্তধারা উপন্যাসটি প্রকাশ করে। কাশবনের কন্যা" উপন্যাসটির প্রকাশনী হল 'বিভাস' ।
**********
কাশবনের কন্যা (উপন্যাস)
শামসুদ্দীন আবুল কালাম
প্রকাশকাল: ১৯৫৪ সাল
প্রচ্ছদশিল্পী: শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
প্রথম প্রকাশক: ওসমানিয়া বুক ডিপো, ঢাকা
পৃষ্ঠা: ১৬০
মূল্য: ২৫০/-
ISBN: 984-70343-0233-2

0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম