শামসুল হক রচিত 'হরফ পেলাম কেমন করে' বইটি পড়ে হরফ পাওয়ার ইতিহাস সম্পর্কে যা যা জানতে পারলাম - রিজিয়া জাহান ঐশী

শামসুল হক রচিত 'হরফ পেলাম কেমন করে' বইয়ের প্রচ্ছদ



‘হরফ পেলাম কেমন করে' বইটি শামসুল হক রচিত একটি কিশোর ক্লাসিক বই। যা 'মুক্তধারা' প্রকাশনী থেকে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি পড়লে বোঝা যাবে হরফ সৃষ্টির দীর্ঘ ইতিহাস সম্পর্কে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে, মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য অথবা হিসাব-নিকাশের সুবিধার জন্য প্রথম দিকে চিত্রলিপির মাধ্যমে এবং ধাপে ধাপে হরফ সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যায়।

প্রাচীনকালে মানুষ তাদের মনের ভাবকে প্রকাশ করার জন্য লিখিত রূপ হিসেবে ছবি এঁকে ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করতো। কিন্তু ক্রমেই দেখা দিল সমস্যা। কোনো সুক্ষ্ম ভাবনাকে প্রকাশ করার জন্য শুধু চিত্র আঁকাআঁকি যথেষ্ট নয়। কারণ চিত্র বোঝার ক্ষমতা এক এক জনের একেক রকম। তারপর ক্রমেই যখন মানুষ সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করতে শুরু করলো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে শুরু করলো এবার হিসাব-নিকাশের জন্য তাদের গণনার সুবিধার জন্য হরফ সৃষ্টির প্রয়োজন পড়লো। সেই থেকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী অনেক প্রচেষ্টার মাধ্যমে হরফ বা অক্ষর সৃষ্টির এক একটি ধাপ উন্মোচন করা শুরু করল। প্রথমদিকে অক্ষরগুলো জটিল হলেও পরবর্তীতে অক্ষরগুলো কে সহজ ও সংক্ষিপ্ত রূপ দান করতে সক্ষম হয়েছে। আর এভাবেই ধাপে ধাপে বর্ণমালার উদ্ভব ঘটলো এবং বিভিন্ন লিপি মালার ব্যবহার শুরু হলো। যেমন- কিউনিফর্ম লিপি, হায়ারোগ্লিফিক লিপি, হায়ারেটিক লিপি, ডেমোটিক লিপি, সিনাই লিপি, সেমিটিক লিপি, ফিনিশীয় লিপি,ল্যাটিন লিপি, গ্রীক লিপি ইত্যাদি।

সেই আদিমকালে কেউ একজন গুহার দেয়ালে একটি ছবি এঁকেছিল। ধরা হয়, ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে পঁচিশ হাজার বছর আগে। এই ঘটনা দেখে তো সবাই অবাক হয়ে গেল। আসলেই তো চারপাশে অনেক কিছু মানুষ দেখে, কিন্তু তাকে যে চিত্রের মাধ্যমেও প্রকাশ করা যায় এটি তারা প্রথম অনুভব করলো। এ থেকেই শুরু হলো ছবি আঁকা। সুন্দর করে ছবি সম্পূর্ণরূপে আঁকতে অনেক সময় লাগতো বলে পরে পুরো ছবি না এঁকে সংক্ষিপ্ত ছবি আঁকা শুরু করলো মানুষ। ছবি দিয়ে লেখার নাম চিত্র লিপি।

প্রাচীনকালে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো হঠাৎ একদিন এক নদীর সন্ধান পেয়ে আনন্দিত হল । নদীর তীরে তারা বসতি স্থাপন করল। সবাই মিলে গ্রাম তৈরী করলো। জমি চাষ করতে শিখলো। পশু পালন করতে শিখলো। বাঁধ দিয়ে নদীর পানি নিজেদের কাজে লাগাতে শিখলো। পরে ঐ লোকদের নাম জানা যায়, সুমেরীয় হিসেবে। তারা অন্যের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করলো। তাই লেনদেনের হিসাব রাখতে তারা ছবি এঁকে গণনা শুরু করলো। ক্রমেই ছবি আঁকাকে তারা সহজভাবে ও সংক্ষিপ্ত রূপে করতে লাগলো। এঙ্গেলবার্ট ক্যাম্ফার (১৬৫১-১৭১৬ খ্রিঃ) নামে এক পন্ডিত এ লিপির নাম রাখলেন কিউনিফর্ম।

তারপর আরেক জাতি হলো ইলামাইট। বর্তমান কালের ইরান। সেই আদ্যিকালে ইরানের দক্ষিণ - পশ্চিমদিকে একটি দেশ  ছিল সুসীয়ানা। সুমা ছিল এর রাজধানী। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে জায়গাটির নাম ইলাম। ইলামে মাটি খোঁড়ার কাজ চলছে ১৮৯৭ সাল থেকে। মাটি খুঁড়ে পুরনো দিনের নানা মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। আর প্যারিসের বিখ্যাত জাদুঘর হচ্ছে ল্যুভর জাদুঘর। ইলামের পুরনো আর মূল্যবান জিনিস রাখা হয়েছে ঐ জাদুঘরে। ইলামের সভ্যতা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৫০ সালের দিকে সুসার খ্যাতি ম্লান হয়ে যায়। ইলামাইট গোষ্ঠীর অপর একটি শাখা কাসসাইট। তারা বাস করত বেবিলনের পূর্ব দিকে এক পাহাড়ি এলাকায়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৮০ সালে সুসিয়ানা এই স্থান দখল করে নেয় এবং দীর্ঘ ছয় শ' বছর রাজত্ব করে তারা। কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা কাসাইটদের একটি অভিধান পাওয়া গিয়েছে। 

মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ঘোড়া বশ করে কাসাইটরা। প্রাচীন ইলামাইটদের মধ্যে এক ধরনের লেখা চালু ছিল সেগুলোকে বলা হয় প্রোটো-ইলামাইট লেখা। পাঁচ হাজার বছর আগের এই লেখা বাংলা ভাষার মতো বাঁ দিক থেকে ডানদিকে লেখা হত। মাত্র একচল্লিশটি চিহ্ন দিয়ে পুরো ইলামাইট ভাষাই লেখা যেত ।

কিউনিফর্ম লিপি লেখা হত তিনটি ভাষায়। যথা- প্রাচীন ফার্সী,বেবিলনীয় আর ইলামাইট ভাষায়। কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা শিলা-লিপিগুলোর মধ্যে বেহিস্তুন শিলালিপির খুবই নামডাক। আকিমিনীয় রাজা প্রথম দারাউস খোদাই করেছিলেন এটি। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। বেহিস্তুন শিলালিপিতে রয়েছে চৌদ্দজন মানুষের ছবি। ছবিগুলোর মধ্যে একজন রাজা ও দুইজন তার দেহরক্ষী। আর রাজা দম্ভভরে পা রেখেছেন বন্দীদের গায়ের ওপর। বাকি নয় জন মিলে এক সারি বন্দীর ছবি। বন্দীদের ঠিক ওপরে ও নিচে রয়েছে ছোট ছোট বত্রিশটি কবিতা। তাদের মধ্যে ফার্সী ভাষায় রচিত এগারোটি, বারোটি ইলামাইট ভাষায় এবং নয়টি আক্কাদীয় ভাষায় রচিত। ১৮২৪ সালে গ্রোটেফেন্ড (১৭৭৫-১৮৫৩ খ্রি.) নামে জার্মানির এক শিক্ষক বললেন, বেহিস্তুন শিলালিপির তিনটি ভাষা একেবারে আলাদা আলাদা ভাষা। তিনি দীর্ঘ অধ্যবসায় এবং অনেক বইপত্র ঘাটাঘাটি করে বারোটি কিউনিফর্ম লিপির উচ্চারণ পেয়ে গেলেন৷ কিন্তু বেঁচে থাকতে তাঁর কাজের স্বীকৃতি মিললো না। মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর তার গবেষণার স্বীকৃতি পেয়েছিল।
  
কিউনিফর্ম লিপির প্রচলন ছিল সুমেরু, বেবিলন, আসিরিয়া, ইলাম, পারস্য প্রভৃতি প্রাচীন দেশের অধিবাসীদের মধ্যে। বেহিস্তুন পাহাড় থেকে রলিনসন স্যার হেনরি ক্রেসউইক রলিনসন (১৮১০ খ্রিঃ) আবিষ্কার করেন এক শিলালিপি। শিলালিপিখানি ছিল- পঁচিশ ফুট উঁচু আর পঞ্চাশ ফুট চওড়া। এটি খোদাই করা হয়েছিল তিন শ‍' ফুট উঁচুতে। আহার নিদ্রা ভুলে তিনি পাঠোদ্ধারের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন ফলে একদিন অসাধ্য সাধন করলেন। একদিন মূক ভাষা মুখর হয়ে ধরা দিল রলিনসনের কাছে। কিউনিফর্মের জনক হিসেবে তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকলেন ।

মিসর নীল নদের দান। পিরামিড ও মমির দেশ মিসর। প্রাচীনকালে মিসর দেশের নয়াক্রেটিস শহরে বাস করতেন থথ নামে এক দেবতা। যার মাথা ছিল আইবিস নামে এক পাখির ঠোঁটের মত আর শরীরটা ছিল মানুষের মতো। মিসরবাসীর বিশ্বাস দেবতা থাই আবিষ্কার করেছেন মিসরের জ্ঞান-বিজ্ঞান, অঙ্ক - জ্যামিতি আর জ্যোতির্বিদ্যা। মিসরের লেখাও শুরু হয়েছিল চিত্রলিপির মাধ্যমে এবং এর নাম হায়ারোগ্লিফিক লিপি বা পবিত্র লিপি। আজ থেকে প্রায় ছ'হাজার বছর আগে হায়ারোগ্লিফিক লিপির মধ্যে চিত্রলিপি ও ভাবলিপি উভয়ই ছিল। হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে ব্যঞ্জনধ্বনির চব্বিশটি বর্ণের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। হায়ারোগ্লিফিক লিপি মানে পবিত্র লিপি। পবিত্রতা রক্ষার জন্য ঐ লিপি ব্যবহার হত শুধু প্রসিদ্ধ ঘটনা বর্ণনার জন্য অথবা জাঁদরেল রাজ-রাজরাজড়াদের কাজের বিবরণ দেওয়ার জন্য।

মিসর থেকে সবচাইতে পুরনো যে হায়ারোগ্লিফিক লিপি পাওয়া গেছে তা আবিষ্কৃত হয়েছে এক রাজার কবর থেকে এবং তা ছিল খ্রিষ্টপূর্ব চার হাজার সাত শ' সাতাত্তর সালের। হায়ারোগ্লিফিক লিপির বেশিরভাগ তৈরী হত নানান পশুপাখির ছবি দিয়ে। যেমন- সিংহী, প্যাঁচা, ঈগল, সাপ ইত্যাদি। এর পরবর্তী সহজ সরল রূপকে বলা হয় হায়ারেটিক লিপি। মনে করা হয় হায়ারেটিক লিপিও প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। হাসারেটিক লিপির অর্থ হলো- পুরোহিতদের লিপি। আরও দিন চলে যেতে লাগলো। এক সময় হায়ারেটিক লিপির চেয়েও সহজ, সরল ও সংক্ষেপ লিপি চালু হল। এর নাম ডেমোটিক লিপি। এই লিপি সব কাজে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, শিক্ষায়-দীক্ষায় এবং সরকারি নথিপত্রে ব্যবহৃত হতে লাগল।

ফরাসি দেশ। আজ থেকে প্রায় দু'শ বছর আগের কথা। তখন সে দেশের সম্রাট ছিলেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। একবার তার খেয়াল চাপলো তিনি বিশ্বজয় করবেন। নানা দেশ জয়ও করলেন কিন্তু এবার ভাবলেন মিশর জয় করতে না পারলে তাঁর বিশ্বজয়ের সাধই যে‌ অপূর্ণ থেকে যাবে। যেমন ভাবে হোক মিসর জয় করতেই হবে। ১৭৯৮ সালে তিনি মিসরে পাঠিয়ে দিলেন এক সৈন্যবাহিনী। সেই সেনাবাহিনীর তরুণ ইঞ্জিনিয়ার বৌসার্দ রশীদ গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কালো রঙের এক বেসল্টের পাহাড়ের উপর নজর পড়ে। বৌসার্দ জানান তার ওপরওয়ালা জেনারেল মেনুকে। মেনু ঝানু লোক। পাথরখানি দেখেই এর মূল্য বুঝতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়ে একেবারে পাঠিয়ে দিলেন ফ্রান্সে তার নিজের বাড়িতে।

নেপোলিয়নের কানে গেল এই কথা, তিনি হুকুম দিলেন ফিরিয়ে আনার জন্য কায়রোয়। সম্রাটের হুকুম মানতে বাধ্য। অগত্যা পাথরখানি নিয়ে আসতে হলো। কিন্তু ফ্রান্স ইংরেজের হাতে পরাজিত হলে ফ্রান্সকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্যাসল্টের ঐ কালো পাথর দাবি করলো। পরে না দিতে চাওয়ায় ইংরেজরা গোলন্দাজ বাহিনী পাঠিয়ে পাথরখানি নিয়ে নেয়। এবার পাথরখানা রাখা হল ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। ইউরোপীয়রা রশীদকে বলে রসেটা। তাই পাথরখানি রসেটা পাথর নামে বিখ্যাত। পাথরটিতে ছিল তিন প্রকারের লেখা ওপরে হায়ারোগ্লিফিক, মাঝে ডেমোটিক এবং নীচে গ্রীক। এই লেখা খোদাই করা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৬ সালে। জাঁ ফ্রাসোয়াঁ শাপোলিয়ঁ (১৭৯০ খ্রি.) ফরাসী দেশের লোক। তিনিই এই রসেটা পাথরের পাঠোদ্ধার করেন।

নীলনদের তীরে জন্ম নিয়েছে মিসরীয় সভ্যতা। তাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের কিনারায় গড়ে উঠেছে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা, সিন্ধুনদ ও ইরাবতীর কূলে বিকাশ লাভ করেছে সিন্ধু সভ্যতা। আর হোয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং এর ধারে সৃষ্টি হয়েছে সৃষ্টি হয়েছে চীনা সভ্যতা। বিরাট ভূমধ্যসাগর। এখানকার একটি দ্বীপের নাম ক্রীট। মিসরের উত্তর-পশ্চিমে আর গ্ৰিসের দক্ষিণে এই দ্বীপটি। সেই আদ্যিকাল ক্রীটে রাজত্ব করতেন মাইনস নামে এক রাজা। তার নামানুসারে ক্রীটের এই সভ্যতার নাম হয়েছে মিনোয়ান সভ্যতা। মিনোয়ান এর লিখন পদ্ধতি দুটি- একটি মিনোয়ান ভাষা এবং অন্যটি মাইসেনিয়ান ভাষা। মিনোয়ান ভাষায় ব্যবহার করা লিপিকে বলা হয় 'লিনিয়ার এ' লিপি এবং এ মাইসেনিয়ান ভাষায় ব্যবহার করা লিপির নাম 'লিনিয়ার বি' লিপি। লিনিয়ার এ ও বি বর্ণমালা একই রকমের, তবে তাদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। 'লিনিয়ার এ' লেখার সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থাৎ একশ' পঞ্চাশটি চাকতি পাওয়া গেছে। আর এগুলো পাওয়া গেছে হাগিয়া দ্রিমাদায়। ক্রীটের নেসাস শহরের রাজবাড়ী থেকে উদ্ধার করা মাটির চাকতিগুলো হলে 'লিনিয়ার বি’ লিপি। মাইকেল ভেনট্রিস নামক এক ইংরেজ স্থপতি 'লিনিয়ার বি' এর পাঠোদ্ধার করেন ।

সে এক প্রাচীন দেশ। নাম আনাতোলিয়া। এর অনেক শহরের মধ্যে একটির নাম ছিল হামা। হামায় ষাট বছর আগে এক ভদ্রলোক নাম বুকহার্ট এসে ব্যাসল্টের একখানা কালো পাথরের ওপর বিচিত্র লিপি লেখা দেখেছিলেন। সেই পাথর খুঁজতে সুদূর আমেরিকা থেকে এসেছেন জনসন একজন কুটনীতিক এবং জেসাপ খ্রিষ্টান পাদরি। তারা অনেক খোঁজাখুজির পর জানতে পারলো সেখানে তিনটি কালো পাথর আছে এবং পাথরগুলো খুবই উপকারী, যেকোনো অসুখ সারাতে সক্ষম। জনসন ও জোসাপ ক্যামেরা বের করে ছবি তোলার জন্য তখন স্থানীয়রা বাধা প্রদান করলো আর তাদেরকে পাথরের কাছে ঘেষতে দিতো না। পরবর্তীতে সিরিয়া দেশ থেকে ১৮৭২ সালে উইলিয়াম রাইট নামে এক পন্ডিত আসেন। সিরিয়ার গভর্নর সুবহি পাশার সাহায্যে উইলিয়াম রাইট পাথর তিনটিকে পরিষ্কার করে এর লিপিগুলোর ছাপ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই পাথরগুলো থেকে হিট্টাইট জাতির সম্পর্কে আমরা জানতে পারি । হিট্টাইটদের নাক ছিল টিকালো এবং তারা বাস করত এশিয়ার মাইনরের পাহাড়ী অঞ্চলে। হিট্টাইটদের ভাষা লেখা হত দুটি লিপির সাহায্যে কিউনিফর্ম ও হায়ারোগ্লিফিক। কিউনিফর্ম লিপির চল ছিল, আসিরিয়া, সুমের ও বেবিলনে। আর হায়ারোগ্লিফিক লিপির চল ছিল মিসর দেশে ।

অনেকদিন আগের কথা মিসর দেশে ছিলেন মস্ত বাদশাহ্। ফেরাউন বলে ডাকত সবাই। তাঁর বাবা-মা নাম রেখেছিলেন সিসোসট্রিস। দেশটার মাঝ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বয়ে গেছে নীল নদী। আবিসিনিয়ার পাহাড়ে এর জন্ম, আর  পড়েছে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে। নীল নদীর পুবে পাওয়া গেলে পাওয়া যায় লোহিত সাগর বা রেড সী। সিনাই নামে একটি উপদ্বীপ আছে, কিন্তু এটি মরুভূমি। মরুভূমির ওপরটা কৃপণ হলেও ভিতরে লুকিয়ে আছে তামা, সোনা, নীলকান্তমণি আরও কত দামি দামি হীরা জহরত, মণি-মুক্তা। সিসোসট্রিস হুকুম দিল সিনাইয়ের খনিতে কাজ করতে হবে। তখন থেকে কাজ শুরু হয়, খনিতে কাজ করতে করতেই এক সময় সৃষ্টি হয়েছিল সিনাই লিপির। সেমিটিক জাতি যে ভাষা ব্যবহার করত তাই সেমিটিক ভাষা। B'aalat ছিলেন ঐ সেমিটিক জাতির দেবী। সিনাই লিপি পরীক্ষা করে গার্ডিনার নামক এক ইংরেজ পন্ডিত দেখালেন হায়ারোগ্লিফিক ও সেমিটিক লিপির মধ্যবর্তী লিপি সিনাই লিপি। সিনাই লিপির জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব উনিশ শতকের শেষ ভাগে এবং অনেক ঘষামাজার পর আকৃতি পেয়েছিল চব্বিশটি ব্যঞ্জনবর্ণের।

 ভূমধ্যসাগরের তীরে সিরিয়া দেশ। এই সিরিয়া দেশেরই একটি জায়গার নাম লাতাকিয়া। এই লাতাকিয়ার মাইল কয়েক উত্তরে আর সাইপ্রাসের ঠিক উল্টো দিকে মিনেত - আলবিদা বলে একটি বন্দর আছে। এই বন্দরের কাছাকাছি একদিন এক কৃষক চাষ করতে গিয়ে লাঙলের ফলায় আটকে গেল বড় পাথর। সময় তখন ১৯২৮ সালের ২৫শে এপ্রিল তারিখে। পরে কৃষক পাথরটি তুলতেই এক সুরঙ্গ দেখতে পেয়ে মাটির নিচে নেমে দেখল সেটি কবরখানা। পরে গভর্নর জানতে পেরে একটি নকশা করে পরে মিলিয়ে দেখা গেল, মাইসেনির কবরখানার সঙ্গে মিল আছে। এসব শুনে ফ্রান্স থেকে পন্ডিত এসে খুঁড়তে খুঁড়তে বুঝতে পারলো সেটি ইউগারিট শহর । ইউগারিট ভাষা বাঁ দিক থেকে ডানদিকে লেখা হত। ১৯৫৫ সালে আবার খোঁড়াখুঁড়ির পর পাওয়া গেল, মাটির চাকতি যেখানে ইউগারিট লিপির ত্রিশটি হরফই  খোদাই করা ছিল।

সেই আদ্যিকালে ভূমধ্যসাগরের তীরে ফিনিশিয়া নামে একটি দেশ ছিল এখন যেখানে সিরিয়া দেশে প্রাচীনকালে তার উত্তর দিকটার নাম ছিল ফিনিশিয়া। ঐ দেশের লোকেরা সভ্যতায় বেশ উন্নত ছিল। ফিনিশীয়রা ছিল একেবারে জাত বণিক। তাই হিসেব রাখতে হত তাদের প্রতিটি মালপত্রের। হায়ারোগ্লিফিক আর কিউনিফর্ম লিপি ছিল বড় জবর-জং গোছের। তাই তারা তাদের চারপাশের জানা লিখন-পদ্ধতিগুলো থেকে নিজেদের সুবিধামত বাইশটি হয়ফ তৈরী করে নিয়েছিল। ফিনিশীয় লিপির বেশিরভাগ লিপি এসেছে মিসরীয় লিপি থেকে। ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লেখা হত এবং কোন বিরতি চিহ্ন ছিল না। মিশরীয় লিপির মত ফিনিশীয় লিপিতেও স্বরবর্ণ ছিল না, শুধু ছিল ব্যঞ্জনবর্ণ। ফিনিশীয়দের ঐ বর্ণমালা হিরু ও গ্রীকরাও ব্যবহার করত। ফিনিশীয় লিপির সব চাইতে পুরনো নমুনা পাওয়া গেছে ১৯২৩ সালে বিবলস শহরের রাজা আহিরামের সমাধি থেকে। 

১৮৬৮ সালে ফিনিশীয় লেখার একটি প্রাচীন নমুনা আবিষ্কৃত হয়। এটি একটি শিলালিপি। এটি খোদাই করা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতকের প্রথম দিকে। পাথরখানি পাওয়া গেছে মরু সাগরের তীরে। ইংরেজিতে মরু সাগরকে বলে ডেড সী। মোয়াবের রাজা ছিলেন মেশা এবং ইসরাইলের রাজা ছিলেন জোহরাম। তাদের মধ্যে একবার ভীষণ লড়াই বেঁধেছিল, সেই লড়াইয়ের কাহিনী লেখা হয়েছিল ঐ শিলাখন্ডটিতে। মোয়াবাইট পাথরখানি বেশ যত্নের সঙ্গে রেখে দেওয়া হয়েছে প্যারিসের ল্যুভর যাদুঘরে।

অনেক অনেকদিন আগের কথা। ফিনিশিয়া দেশে ছিলেন এক রাজা নাম ইজিনর। তার ছিল তিন পুত্র, তবু রাজা-রানির দুঃখ তাঁদের ঘরে মেয়ে নেই। অনেক তয়-তদবিরের পর এক সোনার টুকরো মেয়ে হলো, নাম রাখলেন ইউরোপা। ইউরোপার রূপে চাঁদ লজ্জায় মুখ ঢাকে। গ্রীকদের অনেক দেবতার মধ্যে সেরা ছিল জিউস তিনি ইজিনরের প্রাসাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন ইউরোপা বাগান আলো করে খেলে বেড়াচ্ছে। তখন জিউস ষাড়ের রূপ ধরে ইউরোপার কাছে গেলে ইউরোপা ষাড়ের পিঠে চড়ে বসে। অমনি ষাড় দিল ভোঁ দৌড়। গ্রামের পর গ্রাম রাজ্যের পর রাজ্য পার হয়ে গিয়ে থামল একেবারে ক্রীট দেশে।

এদিকে মেয়ের শোকে রাজা-রানী আকুল হলেন। শেষে তিন ছেলেকে হুকুম দিলেন যেখান থেকে পার মেয়েকে খুঁজে আনতে হবে নয়তো রাজবাড়ির দরজা তোমাদের জন্য বন্ধ। বাবার হুকুম। ক্যাডমাস তাই ভাইদের ও মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বোনের খোঁজে। ঘুরতে ঘুরতে থেরা নামক দ্বীপে পৌছালেন। পরিশ্রমে পরিশ্রমে তখন ওরা ভারি ক্লান্ত। বুড়ো মা পরিশ্রম সইতে না পেরে মারা গেলেন। ক্যাডমাস বোনকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন গ্রীসে। বিয়োশিয়া নামের একটি জায়গায় স্থায়ীয় আবাস গড়ে তুললেন। গ্রীকদের শেখাতে লাগলেন হরফের ব্যবহার। এ ঘটনা ঘটেছিল খুব সম্ভব যিশুখ্রীষ্টের জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে। থেরা দ্বীপের একটা শিলালিপিতে পাওয়া গেছে গ্রীকদের প্রাচীন লেখার নমুনা। গ্রীকদের ভাষায় আছে মোট চব্বিশটি হরফ। এই চব্বিশটি হরফের মধ্যে তারা উনিশটি হরফই ধার করেছিল ফিনিশীয়দের কাছ থেকে।

ফিনিশীয়দের গুটি কয় বাড়তি হরফ ছিল। ফালতু বলে সেগুলো তারা পরে একেবারে বাদ দিয়েছিল। গ্রীকরা ঐ বাদ দেওয়া হরফগুলোকে স্বরবর্ণ করে নিল। তৈরী করল পাঁচটি স্বরবর্ণ। গ্রীক বর্ণমালা দেখতে সুন্দর বটে, তবে সব হরফই কিন্তু বড় হাতের। ফিনিশীয়দের মত এদের লেখারও কোনো দাড়ি, কমা, সেমিক্লোনের ব্যবহার ছিল না। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৩ সাল থেকে গ্রীক লিপি বাঁ দিক থেকে ডানদিকে লেখার রেওয়াজ শুরু হল। ফিনিশীয়দের প্রথম হরফ আলেফ আর দ্বিতীয় হরফটিকে বলা হয় বেথ। গ্রীকরা ফিনিশীয়দের মত তাদের প্রথম হরফটির নাম দিল আলফা এবং দ্বিতীয় হরফটিকে বলল বিটা। রোমানরা গ্রিকদের কাছ থেকে বর্ণমালা গ্রহণ করেছিল কিন্তু U, W এবং J এই তিনটি হরফ ছিল না। রোমানরা গ্রেট ব্রিটেন জয় করার পর তাদের বর্ণমালায় নতুন করে যোগ করেছিল U, Wএবং J. ফলে ইংরেজি বর্ণমালা দাঁড়াল ছাব্বিশে। রোমানদের ঐ বর্ণমালা প্রায় সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রীকদের আলফা এবং বিটা এ দুটি হরফ মিলে সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজি অ্যালফাবেট কথাটির।

আমরা প্রাচীন লিপিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব মানুষ সহজ, সরল ও সংক্ষেপ কাজ পছন্দ করে। যাতে সময় কম লাগবে এবং কাজও বেশি পরিমাণ করা যাবে। তাই প্রথম দিকে চিত্রলিপি দিয়ে লেখার প্রক্রিয়া শুরু হলেও ক্রমেই তা ধাপে ধাপে সহজ ও সরল লিপিতে পরিণত হয়ে আজকে আমরা এই বর্ণমালা পেয়েছি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ আমরা মনের ভাব সুন্দর ও সুচারুভাবে প্রকাশ করতে পারছি লেখার মাধ্যমে। কালের বিবর্তনে ধাপে ধাপে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বর্ণমালার সৃষ্টিকে সম্ভব করেছি। শামসুল হকের 'হরফ পেলাম কেমন করে' ব‌ইটি পড়লে আমরা হরফ বা বর্ণমালা সৃষ্টির ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারব, সেই সঙ্গে জানতে পারব বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সভ্যতার ইতিহাস।


**********


হরফ পেলাম কেমন করে
শামসুল হক


প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ

প্রকাশনী: সময় প্রকাশন, ঢাকা।
প্রকাশকাল: প্রথম সময় সংস্করণ- একুশে বইমেলা ১৯৯৪
মূল্য: ৪০/-
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৭২
ISBN: 984-458-070-6



**********


আরও পড়ুন

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ