সততার সাথে একজন লেখক তার পরিবার এবং সামাজিক অভিজ্ঞতার নানা দ্বন্দ্বময় স্মৃতি শব্দ-বাক্যে যখন তুলে ধরেন, তাতে পারিবারিক ও সম্পৃক্ত সমাজের অবয়ব স্পষ্ট ফুটে ওঠে। কেননা যে বাতারবণ বা-সময়ে বসে তিনি লিখেন, সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটে। লেখালিখির সে ধারা আত্মজৈবনিক বা স্মৃতিকথন হওয়া সত্ত্বেও লেখক হয়ে ওঠেন সময়ের প্রতিনিধি। একই সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন তার পারিবারিক ইতিবৃত্ত বয়ানকারী এবং রাজনৈতিক -সামাজিক ঘটনার ধারাভাষ্যকার। ‘Mother Mary Comes to Me’ বইটির হাত ধরে ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়ও যেন পছন্দের দুই লেখক নোবেল প্রাপ্ত অ্যানি থেরিস ব্ল্যাশঁ এরনো (Annie Therese Blanche Eranux), এবং আইকোনিক ইসাবেল আয়েন্দের পথ ধরে হাঁটলেন। উল্লেখিত দুজনের মধ্যে অ্যানি এরনো পুরোমাত্রায় আত্মজৈবিক বা স্মৃতিকথন ঘরোনার এবং ইসাবেল আয়েন্দের অনেকগুলো লেখা সাহিত্যের এই শাখার মধ্যে পড়ে।
অরুন্ধতীর আগের দুটি উপন্যাসের প্রথমটি ‘The God of Small Things’ পুরোপুরি আত্মজৈবিক উপন্যাস নয়। ১৯৯৭ সালে রচিত তাঁর এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাহিত্য জগতে দারুণ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। এটি দক্ষিণ ভারতের কেরালার একটি ছোটো শহরে বসবাসকারী একটি পরিবারের গল্প। যেখানে মূল চরিত্র যমজ ভাইবোন রাহেল এবং এস্থার জীবন এবং তাদের পরিবারের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে ঘিরে আবর্তিত। তাদের মা, আত্মবিশ্বাসী এবং প্রতিভাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও একটি রক্ষণশীল সমাজে একজন নারী হওয়ার চ্যালেঞ্জগুলো তাকে অনুভব করতে হয়। তার নিষিদ্ধ প্রেম এবং পরবর্তী সংগ্রামগুলো গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মোটকথা, ‘গড অফ স্মল থিংস’ উপন্যাস প্রেম সামাজিক বৈষম্য, পরিবার এবং সামাজিক রীতিনীতি ও তার পরিণতির বিষয়বস্তুতে গভীরভাবে আলোকপাত করে। প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে বলা গল্প এবং জটিল চরিত্র বিন্যাসের মাধ্যমে অরুন্ধতী তার প্রথম উপন্যাসের আখ্যানটি তৈরি করেন যা মানব সম্পর্কের জটিলতা এবং সূক্ষ্মতাগুলোকে ধারণ করে। বইটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি বুকার পুরস্কার জয় করে। ফলে অরুন্ধতী পান বিপুল অর্থ, খ্যাতি এবং নিজেকে প্রকাশের এক অমূল্য স্বাধীনতা। কিন্তু সেই খ্যাতি ছিল এক “সোনালী খাঁচা”, যা থেকে বেরিয়ে আসাই ছিল তাঁর পরবর্তী চ্যালেঞ্জ।
তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘The Ministry of Utmost Happiness’। যা প্রথমটি প্রকাশের বিশ বছর পর ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটি একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক ও মানবিক কাহিনি, যেখানে ভারতের নানা প্রান্তের চরিত্র ও বাস্তবতা উঠে এসেছে। অরুন্ধতীর উল্লেখিত দুটি বই-ই পরিপূর্ণ উপন্যাস। তার তৃতীয় বই ‘Mother Mary Comes to Me’ উপন্যাস নয়- এটি পুরোদস্তুর স্মৃতিকথনমূলক লেখা। The Hindu-এর একটি সাক্ষাৎকারে বইটি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
Her memoir Mother Mary Comes to Me is a window into her mother’s world, as well as her own.
এক সাক্ষাৎকারে বইটি সম্পর্কে অরুন্ধতী রায় বলেন, “আমার জীবনের ঘটনা নিয়ে বইটি লিখেছি। আমার মায়ের হয়তো মেয়ে হিসেবে আমার মতো একজন লেখক দরকার ছিল। তেমনি আমার মতো একজন লেখকের হয়তো তাঁর মতো একজন মা দরকার ছিল।”
‘Mother Mary Comes to Me’ অরুন্ধতীর প্রথম স্মৃতিকথা, যা একাধারে অন্তরঙ্গ এবং অনুপ্রেরণার উৎস। এতে লেখক তুলে ধরেছেন সময় উজিয়ে কীভাবে তিনি আজকের অরুন্ধতী রায় হয়ে উঠেছেন। হয়ে ওঠার সেই পর্ব ছিল ঘটনাবহুল পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি তাঁর, অনন্য সাধারণ মায়ের সঙ্গে জটিল সম্পর্কের দ্বারা পরিচালিত। মাকে তিনি বর্ণনা করেছেন “আমার আশ্রয় এবং আমার ঝড়” হিসেবে। মা সম্পর্কে তাঁর ভাবনার ছোট্ট একটি নজির :
She was woven through it all, taller in my mind than any billboard, more perilous than any river in spate, more relentless than the rain, more present than the sea itself.
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মা মেরি রায়ের মৃত্যুতে তাঁর “হৃদয়বিদীর্ণ” হয়ে যায়। নিজের ওরকম প্রতিক্রিয়ার তীব্রতায় তিনি “বিস্মিত ও খানিকটা বিব্রত” অনুভবে আক্রান্ত হন। সেই সময়টাতে তিনি মাদার মেরি কামস টু মি লিখতে শুরু করেন। মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ভেতর যে অনুভূতির জন্ম হয় সেগুলোর মানে খোঁজার তীব্র আগ্রহ ছিল এই লেখার পেছনে। কেননা তিনি যেই মায়ের কাছ থেকে ১৮ বছর বয়সে দূরে সরে গিয়েছিলেন, “ভালোবাসি না বলে নয়, বরং ভালোবাসা বজায় রাখার জন্য।” সেই মায়ের মৃত্যু তাঁর ভেতর যে অভিঘাত তৈরি করেছিল- সেটি কেন? জটিল সেই অনুভূতির অন্বেষণ থেকেই যাত্রা শুরু হয় বিস্ময়কর, মাঝে মাঝে অস্বস্তিকর, আবার আশ্চর্যজনকভাবে হাস্যরসপূর্ণ এই স্মৃতিকথার। যা তাঁর ভারতের কেরালায় কাটানো শৈশব থেকে শুরু করে, তাঁর মায়ের সংগ্রাম- দ্বৈত সত্তার বিচিত্র আচরণ এবং তাঁর লেখালিখির যাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত।
এটিকে নিতান্তই নিস্তরঙ্গ স্মৃতিকথন ধরে নিলে ভুল হবে। ঘটনাবহুল এবং জটিল পথপরিক্রমার আর্বতন পেরিয়ে এগিয়েছে এই স্মৃতিকথা। যে আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন মেরি রায়, অরুন্ধতীর মা। মেরি ছিলেন এক প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী, যিনি কেরালার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজের জন্য এক দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছিলেন। তাঁর আইনি লড়াই, বিশেষ করে খ্রিষ্টান নারীদের সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে, যা কেবল ব্যক্তিগত বিজয় নয়, বরং এক প্রজন্মের নারীর জন্য দৃষ্টান্ত। একইসঙ্গে, তিনি ছিলেন অরুন্ধতীর শৈশবের অস্থিরতম উৎস। তাঁর কঠোরতা, হঠাৎ উথলে ওঠা নিষ্ঠুরতা, আবার পরক্ষণেই ঢেলে দেওয়া ভালোবাসা; সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক জটিল মানবিক প্রতিচ্ছবি। অরুন্ধতী তাঁকে একদিকে “গ্যাংস্টার”, অন্যদিকে “আশ্রয়” বলে চিহ্নিত করেছেন। এই দ্বৈততা শুধু মেরির নয়, অরুন্ধতীর নিজের ভেতরেও বাসা বেঁধেছে।
তাঁর শৈশবের স্মৃতিতে রয়ে গেছে নির্মম বাক্য, হেনস্থা, এবং এক অদ্ভুত শৃঙ্খলার পরিবেশ। মা কর্তৃক নয় বছর বয়সের অরুন্ধতীকে ‘বিচ’ বলে ডাকা, ভাইকে ‘পুরুষ আধিপত্যবাদী শূকর’ বলে গালি দেওয়া, কিংবা স্কুলে নিজের নাম ধরে ডাকতে না দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা তাঁর নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে “চিরকালের জন্য জটিল” করে তোলে। সেই জটিলতার গিঁট খুঁলে মায়ের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক- তার আয়নায় নিজের জীবনকেই তিনি দেখেছেন। সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর এবং ভাই ললিত কুমার ক্রিস্টোফার রায়ের বিপন্ন শৈশব। মদ্যপ, অপদার্থ বাঙালি স্বামী রাজীব রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে মা মেরি দুই সন্তান নিয়ে ফিরে আসেন তামিলনাড়ুর উটিতে। সেখানে তারা তিনজন আশ্রয় নেন মেরির পৈতৃক এককামরার বাড়িতে। সেটি আবার অরুন্ধতীর মৃত নানু, যিনি ছিলেন ইংরেজ আমলের পতঙ্গ বিশারদ, তাঁর ব্যবহৃত জিনিসে বোঝাই। বাড়ির অন্যঅংশে মেরির মায়ের ভাড়াটেরা থাকে। সেখানে তিন বছরের অরুন্ধতী ক্রমেই মায়ের নিষ্ঠুর আচরণ সইতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, অ্যাজমার রোগী মাকে তাঁর শ্বাসকষ্ট বুঝি সন্তানদের প্রতি আরও নির্মম করে তোলে। যার অভিঘাতে অরুন্ধতী এবং তাঁর ভাইয়ের শৈশব প্রায়শই হয়ে ওঠে নরকসম। নানুর বাড়ি থেকেও একসময় তাদের উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লাগেন মেরির মা এবং ভাই। সিরিয়ান ক্রিশ্চান পরিবারে মেয়েদের পৈতৃকসম্পত্তির অধিকার নেই। সেটা কেরালার জন্য প্রযোজ্য হলেও তামিলনাড়ুর আইনে খাটে না। মেরি উকিলের পরামর্শের জোরে সে যাত্রা উচ্ছেদ থেকে রক্ষা পান। পরবর্তীতে স্বাস্থ্যগত কারণে এবং অভাব ঠেকাতে মেরি কেরালায় ফিরতে বাধ্য হন। ফেরার পর কোট্টায়াম রোটারি ক্লাবের ঘর নিয়ে মেরি স্কুল চালু করেন। অরুন্ধতী এবং ভাই মায়ের হাতে নিরন্তর নিগৃহিত হতে হতে মিতবাক এবং পলায়নপর হয়ে ওঠেন। বাবা নামের মানুষটির অস্তিত্ব তাঁদের মনে প্রায় ছিলই না। ভাইয়ের মনে যদিও আসামের চা বাগান এবং বাবা রাজীব রয়ের কিছু ছেঁড়া স্মৃতি রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিন বছরের অরুন্ধতীর কোনো স্মৃতিই ছিল না। মা মেরিই ছিলেন তাঁর পৃথিবী। মাকে তিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে অসহায়ভাবে ভালোবাসতেন। হাঁপানির টান উঠলে মেয়ে মায়ের ফুসফুস হয়ে যেন নিশ্বাস নিতেন। হয়ে উঠতেন মায়ের শ্বাসযন্ত্র। এসব সত্ত্বেও শৈশবের অস্থিরতা ভেতরে ভেতরে অরুন্ধতীকে করে তোলে বেপরোয়া একই সঙ্গে বুঝি ঘর ছাড়ার ফুসমন্তর দিয়ে গেছে অনবরত। এক সময় সেই সুযোগও এসে যায়, পড়াশোনার ছুতোয় ঘর ছাড়েন অরুন্ধতী। ১৮ বছর বয়সে দিল্লিতে স্কুল অফ আর্কিটেকচারে ঢোকার পর সাত বছর মায়ের সঙ্গে দেখা করেননি। মেয়ের খবর মাও রাখেননি। ভাইও চেষ্টা করে ততদিন পর্যন্ত অরুন্ধতীর খোঁজ পাননি, যতদিন না ‘ইন্ডিয়া টুডে’তে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশ হতে দেখেন এবং পরে তাঁর ফোন নম্বর জোগাড় করে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। আমাদের দেশে পরিবারের ভেতর বাবা-মায়ের হাতে সন্তানের নিগ্রহ বিরল কোনো ঘটনা নয়। পরিবার যখন আশ্রয়ের আড়ালে অত্যাচারের কারাগার হয়ে ওঠে, পালানো ছাড়া সন্তানের উপায় থাকে না, কিন্তু সহায় সম্বল অর্থ ছাড়া ক’জন সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে?
জীবনের সেই পর্যায়ে তাঁর আশ্রয় হয়ে ওঠেন কিছু মানুষ—কার্লো, যিনি তাঁর জীবনে স্থিতি এনে দেন, সঞ্জয়, যিনি ছিলেন নিখাদ বন্ধু, এবং প্রদীপ, যাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠে সৃষ্টিশীল বন্ধন। প্রদীপের সঙ্গে তাঁর চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু হয় ‘In Which Annie Gives It Those Ones’ মধ্য দিয়ে। যে চলচ্চিত্রের হাত ধরে শুরু হয় আজকের ‘বলিউড বাদশা’ শাহরুখ খানের অভিনয় জীবনের যাত্রা। তাতে আরো ছিলেন মনোজ বাজপায়ি, রোশন শেঠ, এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রে অরুন্ধতী নিজে অভিনয় করেন। সব মিলিয়ে সেটি ছিল এক সাহসী আত্মপ্রকাশ। গল্পের কাহিনি আবর্তিত হয় ১৯৭০-এর দশকে, নয়াদিল্লির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেকচার বিভাগের আনন্দ গ্রোভারকে ঘিরে। ক্যাম্পাসে যিনি অ্যানি নামে পরিচিত, যিনি একজন বিপজ্জনক স্বপ্নদ্রষ্টা, অধ্যক্ষ ওয়াই.ডি. বিলিমোরিয়াকে উপহাস করার জন্য যাকে ঝামেলায় পড়তে হয়। ‘In Which Annie Gives It Those Ones’, সেরা স্ক্রিনপ্লের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়। তবে অরুন্ধতী পরে চলচ্চিত্র থেকে সরে আসেন। ‘Electric Moon’ এর চিত্রনাট্যও অরুন্ধতীর লেখা এবং পরিচালনায় ছিলেন স্বামী প্রদীপ কৃষেন। এটি ছিল একটি ব্যঙ্গাত্মক কাহিনি, যেখানে পশ্চিমা পর্যটকদের ভারত সম্পর্কে রোমান্টিক ও বিকৃত ধারণার সমালোচনা করা হয়। কিন্তু সেটা অরুন্ধতীর মনমতো না হওয়ায় চলচ্চিত্র থেকে তাঁর আগ্রহ হারায়, এবং লেখালেখির দিকে একান্তভাবে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করে। এরপর চার বছরের একাকিত্ব, আর্থিক সংকট, এবং সৃষ্টিশীল চাপের ভেতর থেকে জন্ম নেয় The God of Small Things। যে বইটি লেখার পর অরুন্ধতীর সৃষ্টিশীলতার ধারা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। যা এখনও সচল রয়েছে।
বইটিতে তাঁর বিগত যাপিত জীবনের সেসব বর্ণনার পাশাপাশি আরো উঠে এসেছে তাঁর নর্মদা বাঁধ-বিরোধী আন্দোলন, গুজরাট গণহত্যা, আফজল গুরুর বিচার, কাশ্মীরের দমননীতি— যার সবগুলোতেই অরুন্ধতী রায় ছিলেন সরব। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে রাষ্ট্রের দমননীতি, বিচারব্যবস্থার পক্ষপাত, এবং সংবাদমাধ্যমের বিকৃতি। The Greater Common Good, The End of Imagination, এবং The Ministry of Utmost Happiness, এইসব লেখায় তিনি প্রান্তিক মানুষের গল্পকে কেন্দ্রে এনেছেন, এবং নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানকে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন।
কাশ্মীর অধ্যায়ে উঠে এসেছে আফসান নামের এক গর্ভবতী নারীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ, আফজল গুরুর মৃত্যুদণ্ড, এবং বিচারব্যবস্থার প্রহসন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে “সমাজের সম্মিলিত বিবেক”কে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে সত্যকে আড়াল করা হয়। একইসঙ্গে, জি.এন. সাইবাবার কারাবাস এবং মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলে ধরে রাষ্ট্রের দমননীতির নির্মমতা প্রকাশ করেছেন।
বাবার স্মৃতিহীন অরুন্ধতীর সঙ্গে বাবা রাজীব রায়ের সাক্ষাতের বয়ানও উঠে এসেছে। বহু বছর পর দেখা হয় বাবার সঙ্গে—এক “না-মানুষ” যাকে তিনি মনে করেন “ক্ষতিকারক দুর্বৃত্ত”। যার অনুপস্থিতি তাঁকে শেখায় পরাজয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার শিল্প। যে সাক্ষাতের ব্যাকড্রপে জি. আইজ্যাকের জীবনদর্শন তাঁকে বোঝায়, আত্মসমর্পণও হতে পারে জ্ঞানের পথ।
‘মাদার মেরি কামস টু মি’ কেবল একটি স্মৃতিকথা নয়—এটি এক নারীর আত্মপরিচয় খোঁজার, পরাজয়কে আলিঙ্গন করার, এবং সাহসের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। এর ভাষা দারুণ কাব্যিক, কখনো তীক্ষ্ণ, কখনো হাস্যরসপূর্ণ। যা পাঠককে এক দারুণ পাঠের অভিজ্ঞতা দেয়। এই বইটিতে অরুন্ধতী রায় দেখিয়েছেন, ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং সামাজিক অন্যায়ের ভেতর দিয়েও শিল্প জন্ম নেয়। তাঁর “যাযাবর” সত্তা, বেপরোয়া মন, এবং অদম্য নৈতিকতা এই বইকে করে তুলেছে এক অনন্য দলিল; যেখানে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী একত্রে মিশে গড়ে উঠেছে এক অকপট, হৃদয়স্পর্শী এবং শক্তিশালী ভাষ্য।
**********
মাদার মেরি কামস টু মি
অরুন্ধতী রায়
প্রকাশক: স্ক্রিবনার, কানাডা
প্রকাশকাল: ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আইএসবিএন: ৯৭৮-১৬৬৮০৯৫০৫৮
পৃষ্ঠা: ৩৫২
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম