হিং টিং ছট্‌ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হিং টিং ছট্‌ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কে আছেন যিনি বাঙালি চরিত্রকে যথাযথভাবে বর্ণনা করতে পেরেছেন? তাঁর মতো অন্তর্দৃষ্টি আর কার আছে যিনি বাঙালির মানসিকতাকে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন? আজকের বাঙালি নিজেকে যতই বিদেশী রঙে পোষাক ও দর্শনের আড়ালে লুকিয়ে রাখুক, অন্তরে যে সে বাঙালি রয়ে গেছে তা বোঝার জন্য গল্পগুচ্ছ ছাড়া আর কীই আছে বাংলা সাহিত্যে? বাঙালি নারী-পুরুষ কীভাবে চিন্তা করে, কীভাবে প্রেম করে, কীভাবে সুখ-দুঃখের দোলায় তরঙ্গায়িত হয় তা বোঝার জন্য বাংলা সাহিত্যে গল্পগুচ্ছের বিকল্প আর আছে কি?

একইভাবে তাঁর 'হিং টিং ছট' কবিতাটি বাঙালিকে বুঝতে দারুণ সাহায্য করে। বাঙালির মন, মানসিকতা, চিন্তা পদ্ধতি, আত্মপ্রচারসর্বস্বতা, অহংকার, অন্যকে মূল্যায়নে অপারগত সবকিছুর দলিল এই কবিতাটি। বাঙালি সমাজের নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, তরুণ, শিশু, রাজা, সেপাই, মন্ত্রী, পণ্ডিত সকলের চরিত্রের অনবদ্য প্রতিফলন এই কবিতাটিতে রয়েছে। ত্রিকালদর্শী প্রজ্ঞা নিয়ে কবি বিবৃত করেছেন বাঙালির মানসপটের নানাবিধ বিবরণ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'হিং টিং ছট' কবিতায় বাঙালি চরিত্রকে যেভাবে তীর্যকভঙ্গিতে, অল্পকথায় প্রকাশ করেছেন তা আজো যথাযথ ও স্পষ্ট। তাই নিজের অন্তর্ছায়াকে চিনতে, তথা আত্মসমালোচনা দ্বার উন্মোচনের জন্য 'হিং টিং ছট' পাঠের বিকল্প নেই। সেজন্য নিজের অন্তর্জগতের ছায়াছবি নিজের সামনে দৃশ্যমান করার জন্য হিং টিং ছট কবিতাটি বারবার পাঠ প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্যে কবিতাটি 'পুনঃপাঠ' বিভাগে রেখে দিলাম। কবিতাটির চৌম্বক অংশগুলির পুনর্পাঠ আপন বাঙালি মর্মের অবগুণ্ঠন অনাবৃত করতে সহায়তা যে করবে সেবিষয়ে নিশ্চিত করাটি মোটেও অতিশয়োক্তি নয় বলে মনে করি।


হিং টিং ছট্‌
স্বপ্নমঙ্গল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


       স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ,
       অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ ।
       শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাঁদরে
       উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে ।
       একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড়,
       চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড় ।
        সহসা মিলাল তারা, এল এক বেদে,
      ‘পাখি উড়ে গেছে ' ব ' লে মরে কেঁদে কেঁদে;
       সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে,
       ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচ্চ এক দাঁড়ে ।
       নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়্‌থুড়ি
       হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়্‌সুড়ি ।
       রাজা বলে, ‘কী আপদ!' কেহ নাহি ছাড়ে ,
       পা দুটা তুলিতে চাহে, তুলিতে না পারে ।
       পাখির মতন রাজা করে ঝট্‌পট্‌ ,
       বেদে কানে কানে বলে — ‘হিং টিং ছট্‌ । '
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।

       হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয়-সাত
       চোখে কারো নিদ্রা নাই, পেটে নাই ভাত ।
       শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির
       রাজ্যসুদ্ধ বালবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির ।
       ছেলেরা ভুলেছে খেলা, পণ্ডিতেরা পাঠ,
       মেয়েরা করেছে চুপ — এতই বিভ্রাট ।
       সারি সারি বসে গেছে কথা নাহি মুখে,
       চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে ।
       ভুঁইফোঁড়া তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে,
       সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে ।
       মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট
       হঠাৎ ফুকারি উঠে — ‘হিং টিং ছট্‌ ।'
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।

       চারি দিক হতে এল পণ্ডিতের দল —
       অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল ।
       উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস
       কালিদাস-কবীন্দ্রের ভাগিনেয়বংশ ।
       মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা,
       ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা ।
        বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যখেত
       বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ-সমেত ।
       কেহ শ্রুতি, কেহ স্মৃতি, কেহবা পুরাণ,
       কেহ ব্যাকরণ দেখে , কেহ অভিধান ।
       কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ,
       বেড়ে ওঠে অনুস্বর-বিসর্গের স্তূপ ।
       চুপ করে বসে থাকে বিষম সংকট,
       থেকে থেকে হেঁকে ওঠে — 'হিং টিং ছট্‌ ।'
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।

       কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ ,
       ‘ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পণ্ডিত-সমাজ ,
       তাহাদের ডেকে আনো যে যেখানে আছে —
       অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে।'
       কটাচুল নীলচক্ষু কপিশকপোল,
       যবন পণ্ডিত আসে, বাজে ঢাক ঢোল ।
       গায়ে কালো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্তি ,
       গ্রীষ্মতাপে উষ্মা বাড়ে, ভারি উগ্রমূর্তি ।
       ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয় —
      ‘সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময় ,
       কথা যদি থাকে কিছু বলো চট্‌পট্‌ । '
       সভাসুদ্ধ বলি উঠে — ‘হিং টিং ছট্‌ । '
       ‘স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।

        স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে ,
        আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে ।
        হানিয়া দক্ষিণ মুষ্টি বাম করতলে
       ‘ডেকে এনে পরিহাস' রেগেমেগে বলে ।
        ফরাসি পণ্ডিত ছিল, হাস্যোজ্জ্বলমুখে
        কহিল নোয়ায়ে মাথা, হস্ত রাখি বুকে ,
       ‘স্বপ্ন যাহা শুনিলাম রাজযোগ্য বটে ;
        হেন স্বপ্ন সকলের অদৃষ্টে না ঘটে ।
       কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান
       যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান ।
        অর্থ চাই, রাজকোষে আছে ভূরি ভূরি
       রাজস্বপ্নে অর্থ নাই, যত মাথা খুঁড়ি ।
       নাই অর্থ কিন্তু তবু কহি অকপট ,
       শুনিতে কী মিষ্ট আহা, হিং টিং ছট্।'
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
        গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।

       শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্‌ ধিক্‌ —
       কোথাকার গণ্ডমূর্খ পাষণ্ড নাস্তিক!
       স্বপ্ন শুধু স্বপ্নমাত্র মস্তিষ্ক-বিকার ,
       এ কথা কেমন করে করিব স্বীকার ।
       জগৎ-বিখ্যাত মোরা ‘ধর্মপ্রাণ' জাতি
       স্বপ্ন উড়াইয়া দিবে! — দুপুরে ডাকাতি!
       হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখ —
       ‘গবুচন্দ্র, এদের উচিত শিক্ষা হোক ।
       হেঁটোয় কণ্টক দাও, উপরে কণ্টক,
       ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বণ্টক।'
       সতেরো মিনিট কাল না হইতে শেষ ,
       ম্লেচ্ছ পণ্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ ।
       সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে ,
       ধর্মরাজ্যে পুনর্বার শান্তি এল ফিরে ।
       পণ্ডিতেরা মুখ চক্ষু করিয়া বিকট
       পুনর্বার উচ্চারিল — ‘হিং টিং ছট্‌ ।
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।

        অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা
       যবন পণ্ডিতদের গুরুমারা চেলা ।
       নগ্নশির, সজ্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে —
       কাছা-কোঁচা শতবার খসে খসে পড়ে ।
       অস্তিত্ব আছে না আছে, ক্ষীণ খর্বদেহ ,
       বাক্য যবে বাহিরায় না থাকে সন্দেহ ।
       এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়
       দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময় ।
       না জানে অভিবাদন, না পুছে কুশল,
       পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যত মুষল ।
       সগর্বে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী লয়ে বিচার,
       শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই-চার,
       ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট-পালট।'
       সমস্বরে কহে সবে — ‘হিং টিং ছট্‌ ।'
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।

       স্বপ্নকথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া
       কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া,
       ‘নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিষ্কার,
       বহু পুরাতন ভাব, নব আবিষ্কার ।
        ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
       শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ ।
       বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
       জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী ।
       আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
       আণব চৌম্বকবলে আকৃতি বিকৃতি ।
       কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
       ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত ।
       ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট —
       সংক্ষেপে বলিতে গেলে, হিং টিং ছট্‌ ।
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।

       ‘সাধু সাধু' রবে কাঁপে চারিধার,
        সবে বলে — পরিষ্কার অতি পরিষ্কার ।
       দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল,
       শূন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল ।
       হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ,
       আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ
       পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে,
       ভারে তার মাথাটুকু পড়ে বুঝি ছিঁড়ে ।
       বহুদিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে,
       হাবুডুবু হবু-রাজ্য নড়িচড়ি উঠে ।
       ছেলেরা ধরিল খেলা, বৃদ্ধেরা তামুক,
       এক দণ্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ ।
       দেশজোড়া মাথাধরা ছেড়ে গেল চট্,
       সবাই বুঝিয়া গেল — হিং টিং ছট্‌ ।
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান । 
       যে শুনিবে এই স্বপ্নমঙ্গলের কথা,
       সর্বভ্রম ঘুচে যাবে নহিবে অন্যথা ।
       বিশ্বে কভু বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে,
       সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে ।
       যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে,
       এ কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে ।
       সবাই সরলভাবে দেখিবে যা কিছু,
       সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু ।
       এসো ভাই, তোলো হাই, শুয়ে পড়ো চিত,
       অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত —
       জগতে সকলি মিথ্যা সব মায়াময়,
       স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয় ।
       স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
       গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।


কবিতা সূত্র: রবীন্দ্র রচনাবলী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ