পঞ্চতন্ত্র - সৈয়দ মুজতবা আলী


পঞ্চতন্ত্র - সৈয়দ মুজতবা আলী
 
বই কেনার অভ্যাসটাই আমাদের মধ্যে এখনও তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। আবার সামর্থ্য থাকলেও বই কেনার আগ্রহ ও সদিচ্ছার অভাবটাও মাঝেমধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে। সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত 'বইকেনা' প্রবন্ধটি অনেকেরই পড়া আছে। এই প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যও কিন্তু বই পড়া ও বইকেনার অভ্যাসকে নিয়েই। এই বইকেনা প্রবন্ধটি তাঁর 'পঞ্চতন্ত্র' গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত। পঞ্চতন্ত্র বইয়ের বেশিরভাগ রচনা ত্রিশের দশকের সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে রচিত।

তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ছাত্র ও শিক্ষক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষাতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বে পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। একাধিক বিদেশী ভাষা যেমন সংস্কৃত, হিন্দি, আরবি, ফারসি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি, ইংরেজি, ফরাসি, ইতালিয়ান ও জার্মান ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন। তাকে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মতত্ত্ব ও তার তুলনামূলক বিচারে এই উপমহাদেশের স্বল্পসংখ্যক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম বলা হয়।

তাঁর পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থটি অনেকগুলো প্রবন্ধের একটি সংকলন। গ্রন্থের সূচনায় লেখকের বয়ানে জানা যায়:-


এই পুস্তিকার অধিকাংশ লেখা রবিবারের 'বসুমতী' ও সাপ্তাহিক 'দেশ' পত্রিকায় বেরোয়। অনুজপ্রতিম শ্রীমান কানাই সরকার ও সুসাহিত্যিক শ্রীযুক্ত মনোজ বসু কেন যে এগুলো পুস্তিকাকারে প্রকাশ করার জন্য আমাকে বাধ্য করলেন সে কথা সুহৃদয় পাঠকেরা বিবেচনা করে দেখবেন।

    সৈয়দ মুজতবা আলী, নয়াদিল্লী, আষাঢ়, ১৩৫৯

 
পঞ্চতন্ত্র বইটির সূচিপত্র বেশ সমৃদ্ধ। সবগুলো রচনাকে দুইপর্বে সাজানো হয়েছে। প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব।

প্রথম পর্বে প্রবন্ধ রয়েছে মোট ৩৫টি আর দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে ৩৪টি। সৈয়দ মুজতবা আলী তার পাণ্ডিত্যমিশ্রিত রসবোধের জন্য বিখ্যাত। তাঁর সে অসাধারণ সামর্থ্যের পরিচয় প্রতিটি প্রবন্ধেই রয়েছে। কয়েকটি প্রবন্ধ থেকে উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরছি।

বার্ট্রাণ্ড রাসেল বলেছেন- সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতরে ডুব দেওয়া। যে যত বেশী ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার বেশী হয়।- বই কেনা

 
কোনটা মহত্ত্বর? জ্ঞানার্জন নাকি ধনার্জন? এ বিষয়ক একটি সমস্যার সমাধান লেখক খুঁজে পেয়েছেন জনৈক আরব পণ্ডিতের লেখাতে।

পণ্ডিত লিখেছেন- 'ধনীরা বলে, পয়সা কামানো দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কর্ম কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন, না, জ্ঞানার্জন সবচেয়ে শক্ত কাজ। এখন প্রশ্ন, কার দাবিটা ঠিক, ধনীর না জ্ঞানীর? আমি নিজে জ্ঞানে সন্ধানে ফিরি, কাজেই আমার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া কঠিন। তবে একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, সেইটে আমি বিচক্ষণ জ্ঞানের চক্ষু-গোচর করতে চাই। ধনীর মেহন্নতের ফল হল টাকা। সে ফল যদি কেউ জ্ঞানীর হাতে তুলে দেয়, তবে তিনি সেটা পরমানন্দে কাজে লাগান, এবং শুধু তাই নয়, অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, জ্ঞানীরা পয়সা পেলে খরচ করতে পারেন ধনীদের চেয়ে অনেক ভালো পথে, ঢের উত্তম পদ্ধতিতে। পক্ষান্তরে, জ্ঞানচর্চার ফল সঞ্চিত থাকে পুস্তকরাজিতে এবং সে ফল ধনীদের হাতে গায়ে পড়ে তুলে ধরলেও তারা তার ব্যবহার করতে জানে না।- বই পড়তে পারে না।'- বই কেনা

আরবীয় পণ্ডিতের বক্তব্য শেষ হয়েছে এই বলে যে 'অতএব সপ্রমাণ হল জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়ে মহত্তর।'

মুজতবা আলী এই গল্পের উপসংহারে বলেছেন -"তাই প্রকৃত মানুষ জ্ঞানের বাহন পুস্তক যোগাড় করার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করে।'- বই কেনা

'আহারাদি' প্রবন্ধটিতে খাবারের আন্তর্জাতিক রূপ যে কত বৈচিত্র্যময় তার একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা পাওয়া যায়। এখান থেকে কয়েকটা খাবারের দেশিবিদেশী নাম জেনে নেই।

আমাদের দেশের মাংশের ঝোল এবং প্যারিসের রেস্তোরাগুলোতে পরিবেশিত 'হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ' এর মধ্যে মূলগত কোন পার্থক্য নেই।

  • 'ইতালিয়ান রিসেত্তো' মূলত ভারতীয় পোলাও মাংসের মতই।

আহারাদি প্রবন্ধ থেকে একটু বর্ণনা করি।

    কাইরোতে (কায়রো) খেলেন মিশরী রান্না। চাক্তি চাক্তি মাংস খেতে দিল, মধ্যিখানে ছ্যাঁদা। দাঁতের তলায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে বটে, কিন্তু সোওয়াদ খাসা। খাচ্ছেন আর ভাবছেন বস্তুটা কি, কিন্তু কোন হদিস পাচ্ছেন না। হঠাৎ মনে পড়ে যাবে, খেয়েছি বটে আমজাদিয়ায় এই রকম ধারা জিনিস- শিক কাবাব তার নাম। তবে মসলা দেবার বেলায় কঞ্জুসী করেছে বলে ঠিক শিক কাবাবের সুখটা পেলেন না।
 
একই রান্না বিভিন্ন দেশে গিয়ে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন নাম গ্রহণ করেছে। মানুষের রুচি, অভ্যাস ছাড়াও রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি প্রভাব এর অন্যতম কারণ। ইতিহাস পাঠ করতে গিয়ে এর সন্ধান মেলে। তুর্কি ও পাঠানরা যখন ভারত জয় করে, তখন ভারতের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের মানুষেরা নিরামিষভোজী ছিল। তুর্কিদের প্রভাবে তারা মাংস খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়। তুর্কিরাও পূর্বে মাংসের সাথে মসলা মেশাতে জানতো না। ভারতীয়দের প্রভাবে তারাও মশলা খাওয়া শুরু করে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী রান্নার সাথে ভারতীয় মসলার মিশ্রণে যে অসাধারণ রান্নার আবিষ্কার হল, তারই নাম মোগলাই রান্না। মোগলাই রান্নার ঘ্রাণ আস্তে আস্তে সারা ভারতকে ছেয়ে ফেলেছে। এই তুর্কিরা পরে যখন বল্কান অঞ্চল জয় করে হাঙ্গেরি পার হয়ে ভিয়েনাতে গিয়ে হাজির হয়, তখন মোগলাই মাংসের ঝোল পরিবর্তিত হয়ে 'হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ' নাম ধারণ করল। মিশর ও তুর্কিদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ভেনিসের মানুষ 'মিনসটমীটের' পোলাও বা 'রিসোত্তো' বানাতে শিখে ফেলল। গ্রিস তুরস্কের অধিকারভুক্ত ছিল বলে গ্রিসের রান্নাতেও মশলার যথেষ্ট ব্যবহার রয়েছে।

ভোজনবিলাসী মানুষ ছিলেন মুজতবা আলী। খাদ্যরসিকদের প্রতি তার যে ভালোবাসা, তা থেকে তিনি মন্তব্য করেছেন:-

পৃথিবীতে দ্বিতীয় উচ্চাঙ্গের রান্না হয় প্যারিসে কিন্তু মশলা অতি কম, যদিও রান্না ইংরেজী রান্নার চেয়ে ঢের ঢের বেশী। এককালে তামাম ইয়োরোপে ফ্রান্সের নকল করত, তাই বল্কান গ্রীসেও প্যারিসী রান্না পাবেন। গ্রীস উভয় রান্নার সঙ্গমস্থল। বাকি জীবনটা যদি উত্তম আহারাদি করে কাটাতে চান, তবে আস্তানা গাড়ুন গ্রীসে (দেশটাও বেজায় সস্তা)। লাঞ্চ, ডিনার, সাপার খাবেন ফরাসী মোগলাই এবং ঘরোয়া গ্রীক কায়দায়।
 
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে নিয়ে তার লেখা নেতাজী প্রবন্ধ থেকে দুটো অংশ উদ্ধৃত করি।

সেকালের অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলিম সমস্যাটা বেশ প্রকট ছিল। পরস্পরের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ এত বেশি ছিল যে শেষ পর্যন্ত ধর্মের নামে একটি অখণ্ড দেশ একাধিক ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বেশিরভাগ নেতাদের মধ্যেই কোন না কোন ধর্মের প্রতি সহানুভূতি ছিল বা তারা কোন একটি ধর্মাবলম্বী মানুষদের পক্ষে কথা বলতেন। সেই ধর্মের মানুষেরাই শুধু তাকে সমর্থন করত। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র।

একদিকে যেমন দেখতে পাই, সুভাষচন্দ্র 'আজাদ হিন্দ' নামটি অনায়াসে সর্বজনপ্রিয় করে তুললেন, অন্যদিকে দেখি, কৃতজ্ঞ মুসলমানেরা তাঁকে 'নেতাজী' নাম দিয়ে হৃদয়ে তুলে নিয়েছে- 'কাইদ-ই-আকবর' বা ঐ জাতীয় কোনো দুরূহ আরবী খেতাব তাঁকে দেবার প্রয়োজন তারা বোধ করে নি।

হিন্দি-উর্দু ভাষা নিয়ে সে সময়ের রাজনৈতিক নেতারা সবসময় বিচলিত ছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের সে জাতীয় কোন সমস্যা ছিল না। মুজতবা আলীর ভাষায়-

রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি যে মহাত্মার থাকে, দেশকে সত্যই যিনি প্রাণ-মন সর্বচৈতন্য সর্বানুভূতি দিয়ে ভালবাসেন, সাম্প্রদায়িক কলহের বহু উর্দ্ধে নির্দ্বন্দ্ব পুণ্যলোকে যিনি অহরহ বিরাজ করেন, যে মহাপুরুষ দেশের অখণ্ড সত্যরূপ ঋষির মত দর্শন করেছেন, বাক্যব্রহ্ম তাঁর ওষ্ঠাগ্রে বিরাজ করেন। তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেন, সে-ভাষা সত্যের ভাষা, ন্যায়ের ভাষা, প্রেমের ভাষা। সে-ভাষা শুদ্ধ হিন্দী অপেক্ষাও বিশুদ্ধ হিন্দী, শুদ্ধ উর্দু অপেক্ষাও বিশুদ্ধ উর্দু। সে ভাষা তাঁর নিজস্ব ভাষা।

সুভাষচন্দ্র দেশের সমস্যাটিকে এমনভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন যে, সাম্প্রদায়িক তুচ্ছতাকে মানুষ মোটেও আমলে নেয়নি।

আমার মনে হয়, সুভাষচন্দ্র এমন এক বৃহত্তর জাজ্বল্যমান আদর্শ জনগণের সম্মুখে উপস্থিত করতে পেরেছিলেন, এবং তাঁর চেয়েও বড় কথা, এমন এক সর্বজনগ্রহণীয় বীরজনকাম্য পন্থা দেখাতে পেরেছিলেন যে, কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি শিখ সকলেই সাম্প্রদায়িক স্বার্থের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদান করেছিলেন। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই, সুভাষচন্দ্র বলছেন, 'আগুন লেগেছে, চল আগুন নেভাই, এই আমার হাতে জল। তোমরাও জল নিয়ে এসো।' সুভাষচন্দ্র কিন্তু এ কথা বলছেন না, আগুন নেভাতে হলে হিন্দু-মুসলমানকে প্রথমে এক হতে হবে, তারপর আগুন নেভানো হবে।
 
সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র বইটি প্রকাশ করেছে স্টুডেন্ট ওয়েজ। এর প্রিন্টার্স লাইনে প্রকাশকাল সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই। অন্তত: প্রথম প্রকাশ কাল উল্লেখ করা উচিত ছিল। এখানে লেখা আছে 'এস.ওয়েজ দ্বিতীয় সংস্করণ বৈশাখ ১৪১৫ বঙ্গাব্দ'। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল এস. ওয়েজের প্রথম সংস্করণ কত সালে হয়েছিল তা বইয়ের কোথাও খুঁজে পেলাম না।

সৈয়দ মুজতবা আলী'র 'পঞ্চতন্ত্র' বইটি থেকে আরও কয়েকটি মজার ঘটনা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।

বর্ষা নামক নিবন্ধটি থেকে আমরা জানতে পারি, মিসরের কায়রোতে বৃষ্টি খুব কম হয়। লেখকের ভাষ্যে 'কাইরোতে বছরে ক'ইঞ্চি বৃষ্টি পড়ে এতদিন বাদে সে কথা আমার স্মরণ নেই। আধা হতে পারে সিকিও হতে পারে।' এটুকু পাঠ করেই বোঝা যাচ্ছে কায়রোতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কেমন। তো, কায়রোতে লেখকের চোখের সামনেই একদিন বৃষ্টি এল। এই বৃষ্টি নিয়েই সুদানের এক ছেলে একটি গল্প বলল। গল্পটি এরকম:-

সুদানের একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হ'ল। সে বললে, তার দেশে নাকি ষাট বছরের পর একদিন হঠাৎ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি নেবেছিল। মেয়েরা কাচ্চা-বাচ্চারা, এমন কি গোটা কয়েক জোয়ান মদ্দরা পর্যন্ত হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়েছিল, 'আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে আমাদের ঘাড়ে ভেঙ্গে পড়লো গো। আমরা যাব কোথায়? কিয়ামতের (মহাপ্রলয়ের) দিন এসে গেছে। সব পাপের তওবা (ক্ষমা-ভিক্ষা) মাঙবার সময় পেলুম না, সবাইকে যেতে হবে নরকে।' গাঁও-বুড়োরা নাকি তখনো সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, 'এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আকাশটুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে না। এ যা নাবছে সে জিনিস জল। এর নাম মৎর্‌ (অর্থাৎ বৃষ্টি)।' সুদানী ছেলেটি আমায় বুঝিয়ে বললে,'আরবী ভাষায় মৎর্‌ (বৃষ্টি) শব্দ আছে; কারণ আরব দেশে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়, কিন্তু সুদানে যে আরবী ভাষা প্রচলিত সে-ভাষায় মৎর্‌ শব্দ কখনো ব্যবহৃত হয়নি বলে সে শব্দটি সুদানী মেয়েছেলেদের সম্পূর্ণ অজানা।'
 
বেদে নামক নিবন্ধে লেখক প্রথমেই একটু ভূমিকা টেনেছেন। সেখানে 'রাসল পাশা'র একটি বইয়ের কথা বলেছেন। এই বইয়ে রাসল পাশা মন্তব্য করেছেন, পৃথিবীর সকল বেদের (জিপসী) ভাষা আদতে ভারতীয়। মুজতবা আলী এটা বিশ্বাস করতে চাননি। সন্দেহ পোষণ করেছেন এভাবে:

পণ্ডিত নই, তাই চট করে বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না। ইউরোপীয় বেদেরা ফর্সায় প্রায় ইংরেজের সামিল, সিংহলের বেদে ঘনশ্যাম। আচার-ব্যবহারেও বিস্তর পার্থক্য, বৃহৎ ফারাক। আরবিস্থানের বেদেরা কথায় কথায় ছোরা বের করে, জর্মনীর বেদেরা ঘুষি ওঁচায় বটে, কিন্তু শেষটায় বখেড়ার ফৈসালা হয় বিয়ারের বোতল টেনে। চীন দেশের বেদেরা নাকি রূপালি ঝরণাতলায় সোনালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চুকুস চুকুস করে সবুজ চা চাখে।

কিন্তু নিজের জীবনের একটি ঘটনার শেষে তিনি বিশ্বাস না করে পারলেন না। তখন তিনি জার্মানীর রাজধানীতে। বয়স ২৫/২৬। একদিন কলেজের পাশের কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিলেন। তখন এক বেদেনী তাকে 'যবনিকা' ভাষায় কি জানি বলতে লাগল। "সে ভাষা আমার চেনা-অচেনা কোন ভাষারই চৌহদ্দি মাড়ায় না, কিন্তু শোনালো - তারই মুখের মত-মিষ্টি।" পরে কাফে মালিক মুজতবা আলীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে যখন বললেন যে তিনি ভারতীয়, তখন মেয়েটা হুঙ্কার দিয়ে কাফেওয়ালাকে বলল, "সেই কথাইতো হচ্ছে। আমরা বেদে, ভারতবর্ষ আমাদের আদিম ভূমি। এও ভারতীয়। আমার জাতভাই। ভদ্রলোক সেজেছে, তাই আমার সঙ্গে কথা কইতে চায় না।" পরে মুজতবা আলীর সাথে আলাপচারিতায় জানা গেল। এরা বেদে, কিন্তু পড়াশোনা করে না। তারা ভাবতেও পারে না, কোন বেদে কখনও পড়াশোনার চৌহদ্দি মাড়িয়েছে।

বুঝতে পেরেছি বাপু, বুঝতে পেরেছি; বাপ তোমার দু'পয়সা রেখে গিয়েছে- হঠাৎ নবাব হয়েছ। এখন আর বেদে পরিচয় দিতে চাও না! হাতে আবার খাতাপত্র- কলেজ যাও বুঝি? ভদ্রলোক সাজার শখ চেপেছে, না?

আমি বললুম, 'ফ্রালাইন, তুমি ভুল বুঝেছ। আমার সাতপুরুষ লেখাপড়া করেছে। আমিও তাই করছি। ভদ্রলোক সাজা না সাজার কোনো কথাই উঠছে না।'

মেয়েটি এমনভাবে তাকালো যার সোজা অর্থ 'গাঁজা গুল'। জিজ্ঞেস করল, 'তুমি ভারতীয় নও?

'আমি বললুম, 'আলবৎ'!

আনন্দের হাসি হেসে বলল, 'ভারতীয়েরা সব বেদে।'

আমি বললুম, 'সুন্দরী, তোমরা ভারতবর্ষ ছেড়েছ, দু-হাজার বছর কিংবা তারও পূর্বে। বাদবাকী ভারতীয়রা এখন গেরস্থালী করে।'

মুজতবা আলীর বক্তব্য মেয়েটা কিছুতেই বিশ্বাস করে নি। পরে জানাল শহরের বাইরে রাখা তাদের সার্কাসের গাড়ি রাখা আছে। তার বাবা-মার সাথে তর্ক করার আমন্ত্রণ জানাল। বলল -"বাবা সব জানে। কাচের গোলার দিকে তাকিয়ে সব বাৎলে দেবে।"

ভাষাতত্ত্ব নিবন্ধের একটি রসিকতা।

ফরাসী ভাষাটা সব সময় ঠিক বুঝতে পারি কি না বলা একটু কঠিন। এই মনে করুন, কোনো সুন্দরী যখন প্রেমের আভাস দিয়ে কিছু বলেন, তখন ঠিক বুঝতে পারি আবার যখন ল্যান্ডলেডি ভাড়ার জন্য তাগাদা দেন তখন হঠাৎ আমার তাবৎ ফরাসী ভাষাজ্ঞান বিলকুল লোপ পায়।

দাম্পত্য জীবন নামক নিবন্ধে তিনটি সংস্কৃতির দাম্পত্য জীবন নিয়ে কাহিনী আছে। মুজতবা আলীর একজন চীনা বন্ধু ছিল। তারা দুজনে অফিস ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই ক্লাবে এসে আড্ডা দিতেন। ক্লাবের এক কোনে নিমগাছের তলায় বসে তারা গল্পগুজবে মজে যেতেন। সাথে একজন ইংরেজ ছিলেন। কথায় কথায় তাদের মধ্যে একটি বিবাহিত জীবন নিয়ে আলোচনা শুরু হল। প্রথমে ইংরেজের গল্প। তাঁর গল্পটি এরকম। লন্ডনে একবার স্বামীদের বিরাট প্রতিবাদ সভা হচ্ছিল। মিছিল মিটিং চলছে।

প্রসেশনের মাথায় ছিল এক পাঁচ ফুট টিঙটিঙে হাড্ডি-সার ছোকরা। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই ছ'ফুট লম্বা ইয়া লাশ এক ঔরৎ দুমদুম করে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললে, 'তুমি এখানে কেন, তুমি তো আমাকে ডরাও না। চলো বাড়ি।' সুড়সুড় করে ছোকরা চলে গেল সেই খাণ্ডার বউয়ের পিছনে পিছনে।'

এবার চীনা বন্ধুর গল্প। চীনা গুণী আচার্য সূ রচিত শাস্ত্রে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। একবার পেপিং শহরে অত্যাচার-জর্জরিত স্বামীরা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল। কিভাবে স্বামীদেরকে খান্ডার গৃহিনীদের হাত থেকে উদ্ধার করা যায় সেই বিষয়ের আলোচনা সভার প্রধান উদ্দেশ্য। সভাপতি ছিলেন ষাট বছর ধরে দজ্জাল গিন্নীর হাতে নিপীড়িত এক দাড়িওয়ালা অধ্যাপক। সভায় বক্তারা নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বলে গেলেন। -"স্ত্রীলোকের অত্যাচারে দেশ গেল, ঐতিহ্য গেল, ধর্ম গেল, সব গেল, চীন দেশ হটেনটটের মুল্লুকে পরিণত হতে চলল, এর একটা প্রতিকার করতেই হবে। ধন-প্রাণ, সর্ব দিয়ে এ অত্যাচার ঠেকাতে হবে' ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সময় দারোয়ান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানালো এ সভার খবর পেয়ে গিন্নীরা 'ঝাঁটা, ছেড়া জুতো, ভাঙা ছাতা' ইত্যাদি নিয়ে তেড়ে আসছে। এ কথা শুনে তো সবাই পড়িমড়ি করে পালিয়ে গেল। শুধুমাত্র সভাপতি তার আসনে শান্ত গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে আছেন। দারোয়ান কাছে গিয়ে বলল-

হুজুর যে সাহস দেখাচ্ছেন তাঁর সামনে চেঙ্গিস খান তসলীম ঠুকতেন, কিন্তু এ তো সাহস নয়, এ হচ্ছে আত্মহত্যার শামিল। গৃহিনীদের প্রসেশনে সক্কলের পয়লা রয়েছেন আপনারই স্ত্রী। এখনো সময় আছে। আমি আপনাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।। সভাপতি তবু চুপ। তখন দারোয়ান তাঁকে তুলে ধরতে গিয়ে দেখে তাঁর সর্বাঙ্গ ঠাণ্ডা। হার্টফেল করে মারা গিয়েছেন।

এবার মুজতবা আলীর পালা। গল্পটি অবশ্য পরিচিত।

রাজা নিজ বৌয়ের (রাণীর) অত্যাচারে মন খারাপ করে বসে আছেন। মন্ত্রী কারণ জানতে চাইলে বললেন- "ঐ রাণীটা- ওঃ কি দজ্জাল, কি খাণ্ডার। বাপরে বাপ! দেখলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।"

মন্ত্রী বললেন এ আর কি ব্যাপার, বউকে তো সবাই ডরায়। এজন্য মন খারাপ করে বসে থাকতে হবে নাকি? রাজা বিশ্বাস না করলে মন্ত্রী জনসমাবেশের ব্যবস্থা করলেন। সেখানে বলা হলো, যারা বউকে ভয় পায়না তারা একদিকে আর যারা ভয় পায় তারা পাহাড়ের দিকে যেন যায়। মুহূর্তের মধ্যে পাহাড়ের দিকটা ভর্তি হয়ে গেল। একজন শুধু ফাকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তখন মন্ত্রী তাকে ডেকে বললেন-"তুমি যে বড় ওদিকে দাঁড়িয়ে? বউকে ডরাও না বুঝি?"

লোকটা কাঁপতে কাঁপতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, 'অত শত বুঝি নে, হুজুর। এখানে আসবার সময় বউ আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, "যেদিকে ভিড় সেখানে যেয়ো না।" তাই আমি ওদিকে যাই নি।'

মুজতবা আলী একবার ভারতবর্ষে ফিরছিলেন। জাহাজে অনেক যাত্রীর মধ্যে একজন মহিলা যিনি বোম্বেতে (অধুনা মুম্বাই) আসছিলেন। লন্ডনে তার স্বামী ব্যবসা জমিয়ে বসেছে। ভারতে মেয়ের বাড়িতে আসছেন। ইংল্যান্ডে বাড়ি বানাবার পূর্বে তারা ইরানে থাকতেন। ইরানের মেসেদে তাদের ব্যবসা ছিল। লন্ডনে আটবছর বাস করেও মহিলা একবর্ণ ইংরেজি শেখেননি। যে সময়ের কাহিনী (৩০ এর দশক) সে সময়ে ইরানে ইহুদীরাও যে বাস করতো তার একটি চিত্র এই মেসেদিনী রচনাটি থেকে জানতে পারলাম।


মহিলা ইংরেজি না জানার কারণে কারও সাথে কথা বলতেন না। মুজতবা আলী ফার্সী ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলতেন। তাকে পেয়ে মহিলা হাঁফ ছেড়েছিলেন। জাহাজ ছেড়ে আসার পর থেকে কারও সাথে কথা বলতে না পেরে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। ইংরেজি শেখেননি কেন এ কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন:-

লণ্ডনে তো আমি ইচ্ছে করে যাই নি। আমার স্বামী মেশেদে সর্বস্বান্ত হয়ে লণ্ডন গেলেন তাঁর কাকার কাছে। আমরা ইহুদি, জানেন তো, আমরা ব্যবসা করি দুনিয়ার সর্বত্র। সেখানে ওঁর দু'পয়সা হয়েছে, কিন্তু আমাদ্বারা আর ইংরিজি শেখা হল না। ইরানী ইহুদিরা যে দু'চারজন লণ্ডনে আছেন, তাঁদের সঙ্গেই মেলামেশা করি, কথাবার্তা কই। তবে হাট করতে গিয়ে "গ্রীন পীজ, কলি-ফ্লাওয়ার, ট্যাপেল, ত্রাপেন্স-হে পেনি" বলতে পারি, ব্যস।

স্বামী লণ্ডনে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দিনে দিনে তার ব্যবসার প্রসার বাড়ছে। তার আর লণ্ডন ছাড়ার ইচ্ছে নেই। মহিলা কিন্তু লণ্ডন শহরটাকে মোটেও ভালবাসতে পারছেন না। মেসেদ শহরের স্মৃতি তাকে প্রায়ই কাতর করে তোলে। জন্মভূমির জন্য তার আকুলতা তার বক্তব্যের প্রত্যেক লাইনে স্পষ্ট।

লণ্ডন সাফসুৎরো জায়গা, বিজলি বাতি, জলের কল, খাওয়া-দাওয়া, থিয়েটার সিনেমা সবই ভালো- কোথায় লাগে তার কাছে বুড়ো গরীব মেশেদ? তবু যদি জানতুম একদিন সেই মেশেদে ফিরে যেতে পারবো, তাহলেও না হয় লণ্ডনটার সঙ্গে পরিচয় করার চেষ্টা করতুম, কিন্তু যখনই ভাবি ঐ শহরে আমাকে একদিন মরতে হবে, আমার হাড় ক'খানা বাপ-পিতামহর হাড়ের কাছে জায়গা পাবে না, তখন যেন সমস্ত শহরটা আমার দুশমন, আমার জল্লাদ বলে মনে হয়।

জাহাজে কয়েকদিন সঙ্গ পেয়ে (আসলে একমাত্র তার সাথেই মাতৃভাষায় কথা বলতে পেরেছেন বলে) মহিলা মুজতবা আলীর উপর খুব কৃতজ্ঞ বোধ করছিলেন। বোম্বে পৌছে লেখককে আর হোটেলে উঠতে দেননি। মেয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। জাহাজ ঘাটে পৌছলে, কাস্টমস এর আনুষ্ঠানিকতা শেষে মহিলা মুজতবা আলীকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেয়ে ও জামাই এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন:

এই আমার বন্ধু দিল-জানের দোস্ত, আমার সঙ্গে ফার্সী কথা কয়েছে, ফুর্তি-ফার্তি হৈ-হল্লা ছেড়ে দিয়ে। মেয়ে যতই জিজ্ঞেস করে, জাহাজে ছিলে কি রকম, খেলে কি, বাবা কি রকম আছেন, কে বা শোনে কার কথা, সত্য-সত্যই জাহাজে যেন 'সমুদ্রে রোদন।' তিনি বারবার বলেন, 'বুঝলি, নয়মি, এঁকে আচ্ছাসে খাইয়ে দিতে হবে। পোলাওর সব মালমশলা আছে তো বাড়িতে?'

লেখক তাদের সাথে তিন দিন ছিলেন। এই তিন দিন কেমন ছিলেন, তা লেখকের জবানীতে শোনা যাক:

সে তিন দিন কি রকম ছিলুম? মাছ যে রকম জলে থাকে। ভুল বলা হল: মাছকে যদি শুধান, 'কি রকম আছে?' তবে সে বলবে, 'সৈয়দের ব্যাটা যে রকম ইহুদী পরিবারে ছিল'।

মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম