যথা কবি নিরঞ্জন - মিজান খন্দকার

যথা কবি নিরঞ্জন - মিজান খন্দকার

চিত্রিত স্বরূপের অনুভববোধ এবং অনুষঙ্গে সবিশেষ মিজান খন্দকার
সুশান্ত বর্মন


যথা কবি নিরঞ্জন - মিজান খন্দকার

প্রকাশক: বুক ক্লাব, ঢাকা
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশকাল: ২০০৪
পৃষ্ঠা: ৬৪
মূল্য: ৫০
ISBN: 984-821-002-4


কবির মানসসঞ্জাত আবেগের শিল্পিত রূপ কবিতা। একজন ব্যক্তি নিজের অনুভূতির অন্তরালে যে অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি সঞ্চিত করেন তা যদি তাঁর রচনায় শিল্পরূপ ধারণ করে তাহলে তিনি উপভোগ করেন কবিত্বের আনন্দ। ধরলা নদীর বিস্তীর্ণ কোলে বসে মিজান খন্দকার অনুভব করেন তাঁর মর্মলোককে। চরাচরে ব্যপ্ত চিত্রপট তিনি চেনেন এবং বোঝেন, তাঁর দর্শনবোধের বিশেষ মাত্রা রূপ পায় বাস্তবতায়, তাই তিনি নিঃসঙ্গ পায়চারী করেন নিবিড় নৈসর্গে। তাঁর ‘যথাকবি নিরঞ্জন’ কাব্যটি আমাদের চেতনায় এই বার্তাই পৌঁছে দেয় যে ধরলাপ্রেমী কবি সমকাল ও আধুনিকতাকে ধারণ করতে পেরেছেন। পাদপ্রদীপের কাঙাল নন তিনি। তাই অনুষঙ্গের মৌলিকত্ব তাঁর প্রধান সহায়।

আপাতদৃষ্টিতে মানুষের জীবনযাত্রা এলোমেলো পথপ্রবণ হলেও তা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী। কালে কালে সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মানুষ সহজে হার মানতে নারাজ। বিপ্লব, বিদ্রোহ, সংগ্রামে মানুষ জয় করতে চেয়েছে জীবনসীমানাকে।

মিজান খন্দকার তাঁর আনন্দ, বেদনা, ইতিহাসবোধ, বিজ্ঞানচেতনা, রাষ্ট্রিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সমুন্নত রাখতে পেরেছেন। তিনি পুরাণকে অস্বীকার করতে চাননি। তিনি ইতিহাস ঘেঁটে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ শেষে সত্য চিনে ফেলেছেন। তাই রূপক উপমার অনবদ্য ব্যবহার মিজান খন্দকারের প্রধান সহায়। চিত্রকল্পের আধুনিক ও শিল্পীত নির্মাণ তাঁর কবিতাগুলোকে ভিন্ন রূপ দান করেছে। অনুষঙ্গের বৈচিত্র্য তাঁকে স্বকীয় করেছে। পৌরাণিক ও বিশেষায়িত চিত্রকল্পের বিপুল বৈভবে মিজান খন্দকারের প্রতিভা অনস্বীকার্য। তাঁর উপমা তথা চিত্রকল্পগুলো আমাদের সামনে কবিতার এক নতুন শরীরকে পরিচিত করে তোলে। নতুন স্বাদ ও সৌগন্ধে তাঁর কবিতাগুলোর অবস্থান বাংলাসাহিত্যে সুনির্দিষ্ট।

তিনি স্বদেশের অন্তর্জ্বালা বুঝতে পারেন। চারপাশের অসঙ্গতি তাঁকে ব্যথিত করে। তিনি ইতিহাসের ভুলগুলোকে শোধরাতে চান। প্রত্নতাত্ত্বিক বাস্তবতার আলোকে নির্মাণ করেন একবিংশ শতাব্দীর আনন্দলোক। ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ প্রভৃতি সামাজিক ও জৈবিক শ্রেণীবিভাগের বারান্দা পেরিয়ে তিনি অবগাহন করেন সাম্য ও মৈত্রীর সুশীতল সরোবরে। তিনি জানেন জীবন বিকাশের জন্য প্রয়োজন জীবনের স্পর্শ। কোন মতবাদ বা আদর্শের মায়াজাল, সোনালী হাতছানি তাঁকে আর মোহমুগ্ধ করেনা। হেলাল হাফিজের ‘ভুল নেতাদের জনসভা' মিজান খন্দকার চেনেন। নেতৃত্বের ব্যর্থতা তাকে কোন সান্তনা দেয়না। তাই কোন আদর্শেই আর তার আস্থা নেই। তিনি বরং মানুষের অন্তর্লোক উন্মোচিত করার কথা বলেন। নিজের মন ও সংস্কৃতির গভীরে অন্বেষণ করতে চান। কোন অজুহাতেই তিনি নিজের মর্মবোধকে বিক্রি করেননা। কারণ তিনি জানেন আজ হোক কাল হোক একদিন সত্য উদঘাটিত হবেই। শত মিথ্যার প্রলোভন ও হিংস্র বাঁধা পেরিয়ে মানুষের জয় হবেই। নতুন দিনের নতুন সূর্য সেই উদয়ের প্রত্যাশায় আছে এ প্রত্যয় তাঁর রয়েছে। আর সেই সাহসেই তিনি ‘ফেরৎ পাঠাচ্ছে নদী মানুষের পরিজন, শোকপরিবাহী জল' কবিতায় অকপটে উচ্চারণ করেন-


বহুদূরে নিরপেক্ষ আলো, উজানের দিকে ছুটতে ছুটতে
প্রতিফলিত হচ্ছে বধ্যভূমির আশে পাশে।
মূলত উত্তরে যে ধরলা নদী-
তার সমসাময়িক জল
অবিরত ছুটে যাচ্ছে আজ এক জন্মদৃশ্যের অনুসন্ধানে।


তিনি সচেতনভাবেই বধ্যভূমির কথা উচ্চারণ করেন। কারণ ১৯৭১ সালেই আমরা পেয়েছি আমাদের স্বতন্ত্র্য পরিচয়। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আবিষ্কার করতে পেরেছি নিজেদের অন্তর্গত শক্তিকে। বাংলাদেশী রাজাকারদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানীরা এ দেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মেরেছিল। পাশবিক জান্তব উল্লাসে মেতে উঠে খুন করেছিল শিক্ষক, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সহ মেধাবী বাঙালিকে। তাদের লাশগুলো কোনরকম ধর্মীয় সম্মান ছাড়াই এক জায়গায় গাদা করে পুতে ফেলা হয়েছিল। এভাবেই সমগ্র বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল হাজার হাজার বধ্যভূমি। আজ আমরা যখন ’৭১ এর কাহিনী ভুলতে বসেছি তখন মিজান খন্দকার আমাদেরকে সচেতন করতে চেয়েছেন। সতর্ক করেছেন আমাদের অজ্ঞানতা ও বিস্মৃতি প্রবণতাকে।

মিজান খন্দকার জানেন ১৯৭১ আমাদের জীবনে অনেককিছু হলেও সব নয়। সম্পূর্ণ বাঙালিকে চিনতে হলে পুরাণের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পুরাণের ছায়াতেই খুঁজে পাওয়া যাবে আত্মজ স্বকীয়তাকে। নৃতত্ত্বের নিগুঢ় বিশ্লেষণে ফিরে পাওয়া যাবে হারিয়ে ফেলা আমার আমিকে।


তারপর তাম্রভস্ম ওড়ালেই হবে দৃশ্য
লুপ্ত হাড় আদি ও জটিল
সে প্রাণের শিলাধর্ম খুঁড়ে যদি পাও মর্ম
নিজ দেহে পাবে অন্ত্যমিল। (সূত্র)


স্বাধীনতার ফল যা হবার কথা ছিল তা হয়নি। সাতচল্লিশ এর গহ্বরে যে অপশক্তি লুকিয়ে ছিল। এখন তারা প্রকাশ্যে বের হয়ে এসেছে। হিংস্র মুখ ব্যাদান করে স্বাধীনতাকে গ্রাস করতে চাইছে। কবি সময়ের দিকে সচেতন দৃষ্টি রাখেন। এখন প্রয়োজন বোধ করছেন পরিবর্তনের। তাই লোককথার বীরপুরুষকে আহ্বান জানাচ্ছেন, তাকে সাদরে গ্রহণ করার বার্তা দিচ্ছেন; সেই বীরপুরুষের হাতে বিধ্বস্ত দেশের পুনরুদ্ধার প্রত্যাশা করছেন। কবি লোকজ ভাসান গানের আঙ্গিকে লোকজ কাহিনীর আলোতে ইতিহাস বিধৃত করছেন। রূপকথার শেষ দৃশ্যের মতো স্বৈরশাসকের পরাজয় ও গণমানুষের পুনরুত্থান প্রত্যাশা করছেন।। (ভাসান)

শ্রেণী সচেতনতা মিজান খন্দকারের বিশ্বাসে আমূল গ্রন্থিত। মানুষের মধ্যে অন্য সব কিছুর চেয়ে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কটি যে অন্যতম সে বোধ তাঁর প্রকট। তিনি এর বিলোপ চেয়েছেন। তিনি চান শাসকের সৌধ ধ্বংস হোক। আর এ কাজটিতে পাশে ডাকেন শোষিত শ্রেণীটিকেই। মার্কসীয় দর্শনে আস্থা রেখে তিনি আদর্শ সমাজের সৌন্দর্য চিনে ফেলেছেন। তাই কবিতার শরীর তুলে আনেন স্বদেশের তৃণমূল মানুষঘেঁষা লোকজ পুরাণ থেকে। ঐ তৃণমূল মানুষদের মনে আশার সঞ্চার করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন। রূপকথার সমাপ্তি সুখকর হলেও বাস্তবের সমকালীন লোককথা খুব নির্মম। এখানে বৈষম্য ও ব্যর্থতাই সত্য। শাসকের আস্ফালনের সামনে আমরা অসহায়, পরাজিত। তাই আধুনিক লোকগল্পটির সূচনা চিরায়ত হলেও শেষাংশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। 


সোনার পালঙ্কে কন্যা জাগিয়া উঠিল
শিয়রে অচিন এক যুবক দেখিল।
..............................................
মন্ত্রগুণে রাক্ষসেও শুনিল সে কথা
উড়িয়া পৌঁছাইল সে মায়া নদী যেথা।
নীলবর্ণ মৎস্যখানি কাটিল তক্ষণে
জন্মিল রাক্ষস আরো মহাবিস্ফোরণে।

সেই পুঁথিগত গল্পের মায়া নদীর কূল থেকে
বিস্ফোরণজনিত তীব্র তরঙ্গ
ধেয়ে এসে আঘাত হানছে
আজ এই বঙ্গরাষ্ট্রে, আকাশের সুবোধ বাতাসে। (ফেরৎ পাঠাচ্ছে নদী মানুষের পরিজন, শোকপরিবাহী জল)


আধুনিক যুগে এখন আর কেউ কবি হয়ে জন্মায়না। প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, প্রেরণা, বেদনা, উৎসাহ, প্রতিবাদ, পর্যবেক্ষণ, শ্রম, অভিজ্ঞান মিলেমিশে একজন মানুষ ধীরে ধীরে কবি হয়ে ওঠেন। তাকে নিত্যদিন নিরন্তর আত্মবিশ্লেষণ করতে হয়। আবিষ্কার করতে হয় আত্মজ অনাবিস্কৃত দিগন্ত, যন্ত্রণার দায় ও মানবিক সৌকর্যকে। মিজান খন্দকার নিজের মর্মকে বিশ্লেষণ করতে দ্বিধান্বিত নন। তিনি নিজেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অবলীলায় বলেন-


অসম প্রণয়ে হয়েছি অসঙ্গত
ক্রমশঃ চৈত্রকে করেছি মর্মগত।
..................................
যে দেহ প্রতিভা দেখালে অগোচরে
সে দৃশ্য প্রেরণা ছড়াল এ অন্তরে। ( কবি)


তবে তিনি কবির স্বরূপ বোঝেন। কবির দায়িত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে তিনি সচেতন। পার্থিব জীবনের শত ব্যর্থতা ও আশাভঙ্গের বেদনা মিজান খন্দকারকেও আর্ত করে তোলে। তিনি দেখেন-


পশ্চিমপ্রবণ বায়ু হতে কতো ধর্মযুদ্ধ,
বাণিজ্য সন্ত্রাস এবং নিবিড় মেদের গদ্য
ছড়িয়ে পড়ছে
ফসলের নব-উদ্ভাবিত প্রকরণে। (যথা কবি নিরঞ্জন)

ফলে দেশের সমাজের আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে যায়। মানুষের পতন ঘটে অন্তসারশূন্য মহাকালীক গহ্বরে। ক্ষয়ে যায় প্রাত্যাহিক প্রতিবেশ ও সার্বিক মূল্যবোধ। মানুষের অস্তিত্ব ধরে নাড়া দেয়। সর্বব্যাপী আক্রমণাত্মক ‘পশ্চিমপ্রবণ বায়ু’ তারপরও সফল হতে পারেনা।


কেননা বিধানবর্জিত এমন দিনে
ভূ-গভীর থেকে উঠে আসছে আজও কাব্যপ্রণোদনা। (যথা কবি নিরঞ্জন)

 

বাঙালির মনে জাগরুক থাকে তার অতীত দিনে ধ্রুপদী রাষ্ট্রের চিত্র। শত বৎসরব্যাপী নির্মম অত্যাচার ও অপপ্রচারে বাঙালি বিভ্রান্ত হয়না। সানন্দ দিনের স্মৃতি তাদের সবাক করে, তারা ফিরে পেতে চায় প্রাচীন মূল্যবোধ, সমাজ কাঠামো, রাষ্ট্রব্যবস্থা। প্রাত্যাহিক প্রহসন থেকে তারা মুক্তি চায়। তারা জানে রাজনীতিকেরা ব্যর্থ। লোভ ও রিরংসায় তারা আপাদমস্তক আবৃত। তারা শুধু চেনে নিজেকে। দেশ ও সমাজের অবমূল্যায়ন করেই তারা সমৃদ্ধ করে তোলে নিজেদের ভবিষ্যতকে। তাই সাধারণ মানুষ আশ্রয় চায় কবির কাছেই। কবিকে গ্রহণ করতে হয় ত্রাতার ভূমিকা-


কবি হে, পুনশ্চ প্রাণ দাও এই দেহে, দাও ত্রাণ, তুমি নিরঞ্জন। (যথা কবি নিরঞ্জন)


সমাজ কাঠামো ও বিনির্মানের ইতিহাসে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। শ্রম ও মেধার বিনিয়োগে সমাজ সংসার রাষ্ট্রে সেও সমান অংশীদার। নৃতত্ত্বে মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসে নারী অনেকক্ষেত্রেই চালিকাশক্তির আসনে আসীন। শিকারজীবির যুগে নিজ ভূমিকা অক্ষুন্ন রেখে নারী কৃষিজীবি যুগের জন্ম দেয়। মানুষ মহাকালীক সোপানে একটি ধাপ অতিক্রম করে উপস্থিত হয় অগ্রগতির যুগে। নিজ কর্মগুণেই নারী ফসল উৎপাদন ও সন্তান লালনে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি ও সুখের স্বপ্ন নারীর প্রধান সহায়। ফসল ও সন্তানকে আশ্রয় করে নারীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণতা পায়, তাই-


একদিন শস্যরাজ্যে খুব অন্ধকার দেখে
বিয়োগ ব্যথায় ভরা আদিগন্ত ক্ষেতে
পৃথিবীর চিত্র এঁকে কতো না অশ্রু ঝরিয়েছিলে! (নারী)

বাঙালির জীবনে বর্ষাকাল এক অপরূপ অনুধ্যান। বর্ষাকাল এদেশে আসে ভিন্নপ্রাণের বার্তা নিয়ে। গ্রীষ্মের খরতাপে সবকিছু যখন শুকিয়ে চৌচির তখন বর্ষার আগমন হয় স্নিগ্ধ শীতলতা নিয়ে। প্রকৃতি উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে বর্ষাকালের। বৃষ্টির প্রথম স্পর্শ পাবার সাথে সাথেই মাটি শিউরে ওঠে। সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে বৃষ্টিকে স্বাগত জানায়। তপ্ত ত্রাহি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে নবজীবনের সঙ্গীত গেয়ে ওঠে। প্রকৃতির ওষ্ঠাগত প্রাণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বর্ষা বিষয়টি বিভিন্ন মাত্রায় ও আঙ্গিকে মিজান খন্দকারের কাছে উপস্থিত হয়েছে। একাধিক কবিতায় মেঘ, বৃষ্টি, শ্রাবণ, বন্যা, বর্ষাকাল তাঁকে ব্যাকুল করেছে। তিনি প্রকৃতির বিরুদ্ধবাদী নন। বর্ষাকাল তার কাছেও স্বস্তির মূর্ত প্রতীক। বর্ষার নিজস্ব রূপ কবির সামনে উপস্থিত হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। তবে বর্ষার রূপ সবসময়ই যে স্বস্তিবাচক তা নয়। অঝোর বর্ষা শ্রমজীবী ও কৃষকের কাছে ক্ষুধার প্রতিচ্ছবি। কাজের অভাব তাকে ঘরের ভেতর বন্দী করে রাখে। স্বচ্ছল সুখী নিরাপদ গৃহকোণে যাদের বাস তারা বর্ষার অঝোর রিমঝিম শব্দে কাব্যতাড়িত হতে পারে কিন্তু গ্রামের মানুষের মনে বন্যার দুঃস্বপ্ন জেগে ওঠে।

এনজিওদের আলোকিত প্রকল্পসমূহ আজ আর মিথ্যা নয়। মানুষের ক্ষমতা সামর্থ এত সীমিত ও ক্ষীণ হয়ে পড়েছে যে এনজিওদের মুখাপেক্ষী না থেকে পারা যায়না। তাদের সর্বব্যাপী হস্তক্ষেপ থেকে আমরা কেউই আজ আর মুক্ত নই। (পর্যটন)

আসলে মিজান খন্দকার অন্বেষণ করেন আনন্দের। জীবনের শত ব্যর্থতা, হাহাকার, লাঞ্চনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আনন্দকে উন্মোচিত করতে চান তিনি। নিগুঢ় প্রজ্ঞার আলোকে আবিষ্কার করতে চান মানুষের বেঁচে থাকার সহায়টুকুকে। অজ্ঞানতার কাছে আত্মসমর্পণ নয় বরং ভালোবাসা দিয়ে অন্ধকারকে জয় করবার শক্তি রাখেন তিনি। আধুনিক মনন দৃষ্টিভঙ্গী ও মানবতাবাদী দায়বোধ তাকে এই প্রেরণাই দিয়েছে। তিনি নিরন্তর খুঁজে ফেরেন জীবনের সাথে জীবনের যোগসূত্রকে। যে মর্মবোধ আমাদেরকে আমৃত্যু মানবিক করে রাখে তা মিজান খন্দকারের চেতনায় চির উজ্জ্বল।

তিনি তাঁর দেশ-কালের লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি চান। পুরাণ পুঁথিতেই খোঁজেন সমাধান। ইতিহাস ঘনিষ্ঠ পুঁথি থেকে জানতে পারেন কর্তব্যবোধ। বিদেশী মোহমুগ্ধতা নয় স্বদেশী সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, পুরাণ, পুঁথি, লোককথা ঘেঁটে করণীয় বুঝে নিতে হবে।

মিজান খন্দকারের মানসে দেশপ্রেম ও নতুন সমাজ গড়ার প্রত্যয় অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ। স্বদেশের শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর কাছে অনস্বীকার্য। বিদেশী ইতিহাস বা সংস্কৃতির প্রতি তার কোন বিদ্বেষ নেই। তিনি শুধু নিজেকে খুঁজে পেতে চান নিজের ঐতিহ্যগাঁথায়। এই প্রবণতাই তাঁর কবিতায় স্বদেশী মিথ উপমা-রূপকের আড়ালে বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়েছে। স্বদেশের দীনতা তাকে আর্ত করে তোলে। তিনি প্রতিবাদ করেন, বিদ্রোহ করেন। বিপ্লবের আহ্বান জানান। ঝড়ের শক্তি বুকে নিয়ে এক পৌরাণিক বীরের আবির্ভাব অথবা গণমানুষের সম্মিলিত সংহতি তিনি কামনা করেন। সার্বিক বিপর্যস্থ গহ্বর থেকে উত্তরণের এছাড়া আর কোন উপায় নেই। তিনি বিশ্বাস করেন একদিন এক বীর রাজকুমার আসবে। বন্দিনী দেশকে ঘুম থেকে জাগাবে। রাক্ষসগুলোকে মেরে ফেলে উদ্ধার করবে রাজকন্যা, দেশ এবং দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিরন্ন জনগণকে।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ