উত্তরাধুনিকতা - সম্পাদক: রতনতনু ঘোষ

উত্তরাধুনিকতা - সম্পাদক: রতনতনু ঘোষ

উত্তরাধুনিকতা
সম্পাদক: রতনতনু ঘোষ

প্রকাশক: কথাপ্রকাশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৫
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
পৃষ্ঠা: ৩৯২
মূল্য: ৪০০ টাকা
ISBN: 984 70120 0114 1

আধুনিকতার পরে আসে উত্তরাধুনিকতা। কিন্তু উত্তরাধুনিকতা কী? এর ধারণা, প্রবণতা কীরকম, বিকাশ কীভাবে হল এই প্রশ্নগুলো অনেককেই আলোড়িত করে। সাহিত্য, সমাজ, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি প্রভৃতিকে উত্তরাধুনিকতা কীভাবে প্রভাবিত করেছে, কতটুকু পরিবর্তন আনতে পেরেছে; মানবজীবনের বিভিন্ন দিকগুলোতে উত্তরাধুনিকতা কত ভঙ্গিতে মিশে আছে এরকম নানাবিধ প্রশ্ন সামনে দাঁড় করানো যায়। ফলে অনিবার্যভাবে উত্তরাধুনিকতাকে অনুধাবন করার প্রসঙ্গটি এসে যায়।

বলা হয় আমরা বাস করছি উত্তরাধুনিক কালের পরিসরে। আধুনিকতার আদিপর্ব, মধ্যমপর্ব, বিকাশপর্ব আর অতি আধুনিক পর্ব পেরিয়ে উত্তরাধুনিক কালপর্বের নতুনত্বকে ধারণ করেই আমরা অনিবার্য ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসরমান। আর সেজন্য উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞাকে আত্মস্থ না করে সচেতন জীবন যাপন প্রায় অসম্ভব। অচেতনভাবে যাপিত জীবনে উত্তরাধুনিকতার প্রভাব আমরা যতটা মেনে নিয়ে চলি, তাতে আমাদের ভূমিকা থাকে শুধুমাত্র গড্ডালিকায় গা ভাসানোর, স্রোতের সাথে তাল মিলানোর। সময় এবং পরিপার্শ্বকে নিয়ন্ত্রণে আমাদের তেমন কোন কিছুই করার থাকে না। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে - উত্তরাধুনিকতা কী, এর লক্ষণ আর বৈশিষ্ট্য কীরূপ?

‘উত্তরাধুনিকতার পূর্বাভাস' নামক ভূমিকায় সম্পাদক বলেন-
উত্তরাধুনিক সমাজবাস্তবতা হলো হাইপার রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও ম্যাজিক রিয়েলিটি। আধুনিকোত্তর সমাজে বহুমাত্রিক মানুষেরা নির্মাণ ও বিনির্মাণের যুদ্ধে সক্রিয়। অহিংস ও রক্তপাতহীন এ যুদ্ধে সবাই সবার টার্গেট। এ যুদ্ধে একবাচনে যিনি নির্মাতা অন্য বাচনে তিনিই বিনির্মাতা। এক স্থানে যিনি আক্রমণকারী অন্য স্থানে তিনিই আক্রান্ত। সকল মতবাদের পতন-পথ নির্দেশ করে উত্তরাধুনিকতা নিজেই মতবাদবিমুখ ও মতবাদঘাতী হয়ে পড়েছে। বর্তমানের সংকটময় বিকাশকালকে নানামাত্রিক প্রবণতায়, বহুস্বরে ও বহুকণ্ঠে, অনেকান্তুিক ব্যাখ্যায় এবং বহু দৃষ্টিকৌণিকতা পুনর্গঠন, সংস্কার ও নবায়নের প্রচেষ্টা চলছে।… এক মহাসত্য অপেক্ষা বহু সত্যে আস্থাবান উত্তরাধুনিকতা। সত্যের বস্তুভিত্তি নেই, তা বিষয়ীভূত। সত্য টেকস্ট নির্ভর; টেকস্ট নির্মিত হয় ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন টেকস্ট নির্মাণ করেন বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে। বহু বাচনে বহু সত্য সৃষ্টি করা হয়। এ জন্য উত্তরাধুনিকতায় মহাসত্য নেই, কোন গ্র্যান্ডন্যারেটিভ নেই। সমগ্রকে খণ্ড-বিখণ্ড করে বিশ্লেষণের প্রয়াস সৃষ্টি হয়েছে। একচেটিয়াকরণে নয় বরং বহুমুখী প্রতিযোগিতার দিকেই তার দৃষ্টি।
উত্তরাধুনিকতা সম্পূর্ণ নতুন নয়। মানবচেতনার জাগরণ, বিপ্লবের ধারায় সামাজিক নবজাগরণ, আর্থ-সামাজিক পুনর্জাগরণ ও সাংস্কৃতিক মহাজাগরণ সম্ভব হয়েছে। এ জাগরণ আজ বহুরৈখিক জটিলতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপট উন্মোচনে উন্মুখ হয়েছে উত্তরাধুনিক চিন্তন-প্রক্রিয়ায়। আধুনকতার সূচনাকারী ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব এবং রেনেসাঁস আর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব পেরিয়ে আজ উত্তরাধুনিক মানুষ ডিজিটাল বিপ্লব, জৈব-প্রযুক্তির বিপ্লব এবং চেতনার বহুমাত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছে।

রতনতনু ঘোষ সম্পাদিত উত্তরাধুনিকতা বইতে দশটি প্রধান বিষয় অনুসারে ঊনত্রিশটি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধগুলির বিবরণে যাওয়ার আগে সূচিপত্রটি একবার দেখে নেয়া দরকার।
  • ধারণা, প্রবণতা ও বিকাশ
  • সময় ও উত্তর আধুনিকতা - হাসান আজিজুল হক
  • পোস্টমডার্ণ – রুদ্র কিংশুক
  • উত্তরাধুনিকতা : প্রবণতা ও গন্তব্য – রতনতনু ঘোষ
  • উত্তর-আধুনিকতা - আনন্দ ঘোষ হাজরা
  • উত্তরাধুনিক সাহিত্য
  • আধুনিক ও অধুনান্তিক কবিতা - সমীর রায়চৌধুরী
  • অধুনান্তিক উপন্যাস – অরবিন্দ প্রধান
  • উত্তরাধুনিকতা : অথর, রিডার, টেক্সট – হুমায়ুন কবির
  • সমাজ, ইতিহাস ও গবেষণা
  • আইডেন্টিটি : একটি উত্তর আধুনিক পাঠ – বিপ্লব মাজী
  • সাবল্টার্ন ইতিহাসচর্চার সম(আ)লোচনা - দেবর্ষি তালুকদার
  • উত্তরাধুনিকতা ও ইতিহাস – সালাহউদ্দীন আইয়ুব
  • গবেষণায় উত্তর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি - জহির আহমেদ
  • বিনির্মাণ, বিনিশ্চয় ও গ্র্যান্ডন্যারেটিভ
  • বিনির্মাণ ও বিনিশ্চয়ের মিল-অমিল - মুরারি সিংহ
  • উত্তরাধুনিকতা : গ্র্যান্ডন্যারেটিভের সন্ধানে - মুহম্মদ আবদুল বাতেন
  • ভাষা, দর্শন ও বিজ্ঞান
  • ভাষা নিয়ে : মিশেল ফুকো - কল্যাণ সেনগুপ্ত
  • জাক দেরিদার ভাষাদর্শন – মঈন চৌধুরী
  • বাখতিনের তত্ত্ববিশ্ব ও দ্বিবাচনিকতা - তপোধীর ভট্টাচার্য
  • দর্শন, বিজ্ঞান ও উত্তর-আধুনিকতা - গালিব আহসান খান
  • উত্তর কাঠামোবাদ
  • পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম : কেন্দ্রচ্যুত গ্রহে জীবন – রাশিদ আসকারী
  • উত্তর সাংগঠনিক চিন্তা - আফজালুল বাসার
  • উত্তর উপনিবেশবাদ
  • উত্তর-উপনিবেশী মন ও উত্তর-উপনিবেশবাদ – ফয়েজ আলম
  • পোস্টকলোনিয়াল ক্রিটিক : হোমিভাবা - বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
  • মার্কসবাদ ও আন্তর্জাতিকতা
  • মার্কসবাদ ও উত্তর আধুনিকতাবাদ – রতন খাসনবিশ
  • আলথুজারের 'অতি-নির্ণয়' : মার্কসবাদ ও উত্তর আধুনিক ভাবনা - প্রদীপ বসু
  • উত্তর আধুনিকতা ও আন্তর্জাতিকতা - জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • নারীবাদ ও ইকোফেমিনিজম
  • উত্তর আধুনিক নারীবাদ – প্রদীপ বসু
  • অধুনান্তিক নারীবাদ ও ইকোফেমিনিজম – মলয় রায়চৌধুরী
  • সমালোচনা, বিভ্রান্তি ও পক্ষ-বিপক্ষ
  • উত্তরাধুনিকতাবাদ আধুনিকতাবাদ ও রেনেসাঁস : সমালোচকের দৃষ্টিতে - আবুল কাসেম ফজলুল হক
  • উত্তর আধুনিকতার বিপক্ষে - মামুন অর রশীদ
  • মৌলবাদ, পোস্টমডার্নিজম ও উত্তর আধুনিকতা : বিভ্রান্তির প্রতি-উত্তর – এজাজ ইউসুফী
‘ধারণা, প্রবণতা ও বিকাশ' বিষয়ে চারটি প্রবন্ধ রয়েছে। হাসান আজিজুল হক তাঁর 'সময় ও উত্তর আধুনিকতা' প্রবন্ধে সময়ের দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সাথে বিভিন্ন কালপর্বের বিশেষত্ব এবং উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে তাঁর নিজের উপলব্ধি বিস্তারিত বলেছেন। তার মন্তব্যের বেশ কিছু অংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আধুনিকতাকে শুধু একটি কালখণ্ড দিয়ে চিহ্নিত করা হয়নি। চিহ্নিত করা হয়েছে কিছু লক্ষণ দিয়ে, কিছু অর্জন দিয়ে। যেমন ইহজাগতিকতা, যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা, যেমন বিজ্ঞানমনস্কতা, যেমন যুক্তিবাদিতা। … আধুনিকতাকে অস্বীকার করতে গেলে এসব অর্জনকেও অস্বীকার করতে হয়। হয় অস্বীকার করতে হয়, অথবা বলতে হয় যে, এগুলোর চেয়ে উন্নততর বোধ বা উত্তর আধুনিকতা মানব জাতিকে উপহার দিয়েছে বা দিতে যাচ্ছে।
রুদ্র কিংশুক তাঁর 'পোস্টমডার্ণ' প্রবন্ধে এই ধারণাটির উৎস, বিকাশ, বৈশিষ্ট্য ও বর্তমান সমাজ ও চিন্তাকাঠামোয়  প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করেছেন।

রতনতনু ঘোষ 'উত্তরাধুনিকতা: প্রবণতা ও গন্তব্য' রচনাটিতে উত্তরাধুনিকতার ধারণা, প্রেক্ষাপট, বিকাশ, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে আধুনিকতা থেকে উদ্ভুত পুঁজিবাদ শোষণ, গ্লানি, বৈষম্য, হিংসা সৃষ্টি করে মানুষের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করেছে। বিপরীতে সমাজতন্ত্র উপহার দিয়েছে একনায়কতন্ত্র, দমন-পীড়নের প্রবণতা। তিনি বলেন-
  • উত্তরাধুনিক প্রত্যয়টি বহু অর্থজ্ঞাপক, জটিল ও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।
  • উত্তরাধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ অনির্ণেয়তা ও পরিব্যাপ্তি। এটি একটি স্ববিরোধী মতাদর্শ। মানুষের সমমর্যাদা ও অভেদের সন্ধানে তৎপর এ মতাদর্শ বিরোধিতা করে কর্তৃত্ববাদ, আধিপত্য, প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রমুখিতার প্রতি।
  • উত্তরাধুনিকতা বিশ্বাস করে ক্ষমতার বহুকেন্দ্রে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পথে উত্তরাধুনিকতা অগ্রসরমান।
  • উত্তরাধুনিকতার ভাষ্যমতে: চূড়ান্ত বলে কিছু নেই, শেষ বলেও কিছুই নেই, একমাত্র সত্য বলে কিছু নেই, শাশ্বত বলে কিছু নেই, ব্যাখ্যাহীন ও প্রশ্নহীন বলে কিছু নেই, সন্দেহের উর্ধ্বে কিছু নেই। এসব বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেই এগোতে চায় উত্তরাধুনিকতা। চরম কর্তৃত্বে তার আস্থা নেই। বিকল্পহীনতায় তার বিশ্বাস নেই। প্রচলিত প্রথা আর মতবাদের পীড়নে নয় বরং মুক্তমতে, প্রথাহীনতায় গতিশীল থাকে উত্তরাধুনিকতা। অধীনতায় নয় স্বাধীনতায় এবং মুক্তপরিসরে ক্রমাগত বিনির্মাণ ও নতুন কিছু সৃষ্টির চাঞ্চল্যে উন্মুখ উত্তরাধুনিকতা। উত্তরাধুনিকতা সবকিছু ভাঙতে চায়, সংস্কার করতে চায়। নানামুখী বর্ণনা, বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনে উত্তরাধুনিকতা পুনর্গঠন করতে চায় যাবতীয় ডিসকোর্স, ন্যারেটিভ ও টেক্সটগুলোকে। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করতে চায়, আগাগোড়া বাজিয়ে দেখতে চায়, সমগ্রকে ভেঙে খন্ডিতভাবে বিশ্লেষণ করতে চায় উত্তরাধুনিকতা। বাচনের পাল্টা বাচন গঠন করা, অবয়ববাদ পেরিয়ে অধুনান্তিক নারীবাদে পৌঁছানো, আন্তর্জাতিকতা পেরিয়ে বিশ্বায়নের পথ ধরা, মাস্টার টেক্সটকে ভেঙে ইন্টার টেক্সটে রূপায়ন, প্রচলিত সংস্কৃতিকে সংকর-সংস্কৃতির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, বহুজাতিক সংস্থাকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করা এবং বৈশ্বিক ইস্যু, এজেন্ডা ও এগ্রিমেন্টের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যর্থতাগুলো অতিক্রমের প্রয়াস চালায় উত্তরাধুনিকতা।
  • উত্তরাধুনিকতাপন্থীরা প্রয়োজনমতো অতীতের অনেক জ্ঞানের সারগ্রাহী। তবে কোনো মতবাদই তাদের নিকট চূড়ান্ত ও অকাট্য নয়। তাঁরা সাম্যের ধারণা চাপিয়ে দেয়ার বদলে সাম্যবাদী হয়ে উঠার তাগিদ দেন। তারা মার্কসবাদী কর্তৃত্ববাদ আর একরৈখিকতার বিরোধী। তারা বিশ্বাস করেন বহুরৈখিকতায়। তাদের মূল সুর বহুত্ববাদীতায়। উত্তরাধুনিকতা কোন মতবাদ নয়, বরং মতাদর্শ।
  • যুক্তিহীন, বিশ্বাসহীন, সিদ্ধান্তহীন, নির্ধারণহীন, নিশ্চয়তাহীন প্রবণতা নিয়ে উত্তরাধুনিকতাবাদীরা বিশৃঙ্খলা ও জটিলতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। অনৈক্য ও বিভ্রান্তির পথে সবাইকে সবার বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়ে মূলত নৈরাজ্যবাদের অভিমুখেই এগিয়ে চলেছেন তারা।
  • উত্তরাধুনিকতা আসলে উদারতাবাদের সর্বসাম্প্রতিক উগ্ররূপ বলে চিহ্নিত হয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র ও সংগঠনের কাঠামোতে উত্তরাধুনিকদের আছে অনাস্থা। কারণ তাদের মতে কাঠামো মানেই আধিপত্য, মহাআখ্যান মানে স্বৈরাচার, তত্ত্ব মানে আধিপত্য। এজন্য তারা আপ্তবাক্য, মহাবাচন, তত্ত্ব ও সাংগঠনিকতার বিরুদ্ধে। উত্তরাধুনিক মতাদর্শের প্রভাবে শিল্প-সাহিত্য ও দর্শনে জ্ঞানের নতুন উৎস ও প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

আনন্দ ঘোষ হাজরা তাঁর 'উত্তর-আধুনিকতা' প্রবন্ধে উত্তরাধুনিকতার ক্রমবিকাশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন দার্শনিক, চিন্তাবিদদের জীবনাচার, মনোভঙ্গি, পর্যবেক্ষণ ও তার সাথে বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে নিজের মতামত উপস্থাপন করেছেন। তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধটিতে রাষ্ট্র, সমাজ, বাণিজ্য, সামাজিক, ব্যক্তির নিজস্ব ও পারস্পরিক আচরণ ও মূল্যবোধের সাথে সমকালীন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর প্রভাব, মিল ও অমিল এবং এসবের কারণে ঘটা পরিবর্তনগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে।

‘উত্তরাধুনিক সাহিত্য' বিষয়ে আলোচনা রয়েছে তিনটি। প্রতিটি প্রবন্ধে লেখকগণ আধুনিক সাহিত্যের সাথে উত্তরাধুনিক সাহিত্যের উপাদান, মিল ও পার্থক্য স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। সমীর রায়চৌধুরী তাঁর 'আধুনিক ও অধুনান্তিক কবিতা' শিরোনামের প্রবন্ধে স্পষ্ট করেছেন যে, আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে বদ্ধআঙ্গিক, সিরিয়াস, একরৈখিকতা, কেন্দ্রমুখিতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিশ্বজনীনতা, ব্যাকরণের প্রতি আনুগত্য, পাণ্ডিত্য, মার্জিত এবং 'আমি' কিভাবে গুরুত্ব পায়। পাশাপাশি অধুনান্তিক কবিতায় তিনি দেখেছেন খোলামেলা, বহুরৈখিকতা, প্রান্তিকমুখিতা, সমমর্যাদা, অসংলগ্ন, বহুরঙা, আঞ্চলিকতা, কর্তৃত্ববাদ থেকে মুক্তি, বিনির্মাণ, সীমালঙ্ঘন এবং 'অপরে'র প্রতি গুরুত্ব।

অরবিন্দ প্রধান 'অধুনান্তিক উপন্যাস' শীর্ষক আলোচনায় আধুনিক ও অধুনান্তিক উপন্যাসের উপাদান ও এদের পার্থক্য, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি বিশ্লেষণ করেছেন। পাশ্চাত্য উত্তরাধুনিকতা ও ভারতীয় উত্তরাধুনিকতার মধ্যে যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে তাও তাঁর আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

'উত্তরাধুনিকতা : অথর, রিডার, টেক্সট' রচনাটিতে হুমায়ুন কবির লেখক, পাঠক ও রচিত উপাদানগুলির পারস্পরিক বৈশিষ্ট্য, সম্পর্ক ও পার্থক্যগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। আধুনিক যুগে লেখক ও পাঠকের মধ্যে যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল তা সমকালে ভেঙে গেছে। লিখিত উপাদান থেকে পাঠক কী গ্রহণ করবে তা উত্তরাধুনিককালে আর লেখকের উপর নির্ভর করে না। পাঠক নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। পাঠক হিসেবে সে এখন সার্বভৌমত্বের অধিকারী। আধুনিক যুগে লেখক ছিলেন শিক্ষকের ভূমিকায়। পাঠকের মধ্যে জ্ঞান ও নৈতিকতার বোধ জাগ্রত করা। আর এজন্য তিনি হয়ে ওঠেন আইন প্রণয়নকারী, বিশেষজ্ঞ, ব্যবস্থাপক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক। তারা যা নির্বাচন করেন, তাই সঠিক এবং মান্য। উত্তরাধুনিকতাবাদী পাঠকরা 'লেখকের মৃত্যু' ঘোষণা করেছেন। টেক্সটে লেখকের ব্যক্তিজীবনের যে প্রভাব আধুনিক যুগে গ্রহণ করা হতো, উত্তরাধুনিক যুগে তা অপ্রয়োজনীয় ফলে অবাঞ্চিত বলে মনে করা হয়। টেক্সটের ব্যাখ্যা তাই উত্তরাধুনিক সময়ে একেক পাঠকের কাছে একেকরকম হয়ে মূর্ত হয়ে উঠতে পারে।

'সমাজ, ইতিহাস ও গবেষণা' বিষয়ে চারজন লেখক সমাজে মানুষের অবস্থান নির্ণয়ে তাদের অনুসন্ধান বর্ণনা করেছেন।  'আইডেন্টিটি : একটি উত্তর আধুনিক পাঠ' প্রবন্ধে বিপ্লব মাজী বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে উত্তরাধুনিক সমাজে ব্যক্তির আত্মপরিচয় অন্বেষণ করেছেন। তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ঔপনিবেশিক, ধর্মীয়, ভাষা সম্পর্কিত, স্থানীয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দিক থেকে ব্যক্তির পরিচয় উন্মোচন করতে চেয়েছেন। দেবর্ষি তালুকদার তাঁর 'সাবল্টার্ন ইতিহাসচর্চার সম(আ)লোচনা' প্রবন্ধটিতে উত্তরাধুনিক ভাবনায় দলিত, উপেক্ষিত অর্থাৎ সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষদের অবস্থান চিহ্নিত করেছেন। প্রচলিত ইতিহাস শুধু রাজা ও সাম্রাজ্যবাদীদের কথা বলে। সেখানে সমাজের প্রান্তিক মানুষরা থেকে যায় উপেক্ষিত। তাঁর আলোচনা দেখিয়েছে যে, উত্তরাধুনিক চিন্তায় সমাজের নিম্নবর্গের মানুষরাও সমান গুরুত্ব পায়। কীভাবে তারা সাবল্টার্ন স্টাডিজে যায়গা পেল সে প্রসঙ্গে তথ্যপূর্ণ আলোচনা রয়েছে এই প্রবন্ধে। 'উত্তরাধুনিকতা ও ইতিহাস' প্রবন্ধে সালাহউদ্দীন আইয়ুব উত্তরাধুনিকতাবাদীদের ইতিহাস সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির বিশদ বিবরণ দিয়েছেন।

আলোচ্য গ্রন্থের প্রত্যেকটি প্রবন্ধে মূলত উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞা ও বৈচিত্র্য অনুসন্ধানে লেখকদের ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। আলোচকগণ তাঁদের রচনায় উত্তরাধুনিকতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন, সমকালীন পরিপার্শ্বের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত প্রদান করেছেন, উত্তরাধুনিকতার বিভিন্ন দিককে বিভিন্ন বিষয়ের প্রেক্ষিতে নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। যারা উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে জানতে চান, বিষয়টির বিস্তারিত বিবরণ জেনে বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে চান তাদের জন্য এই বই পাঠ অতি আবশ্যক। বিভিন্ন পত্রিকা ও লিটলম্যাগ থেকে উত্তরাধুনিকতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলো সংগ্রহ করে তা একটি গ্রন্থে রূপ দিয়ে রতনতনু ঘোষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে লেখাগুলো সংকলিত করেছেন তা সার্থক। 'উত্তরাধুনিকতা' শীর্ষক বইটির পাঠ একজন নতুন পাঠককে প্রসঙ্গটির পক্ষ ও বিপক্ষের নানারকম যুক্তির মুখোমুখি করবে। বাংলাদেশ, এশিয়া ও আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে বর্ণিত বিভিন্ন তথ্য-উদাহরণ তাকে নিজের পরিপার্শ্বকে বুঝতে সহায়তা করবে। উত্তরাধুনিক যুগে জীবনযাপন করার দর্শন ও প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে সচেতন করবে। সে বুঝতে পারবে পাল্টে যাওয়া পৃথিবীতে তার নিজের অবস্থান ও ভবিতব্য।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ