“রক্ত বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম” তার কাহিনী বলেছেন ‘আইজ্যাক আসিমভ’

 “রক্ত বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম” তার কাহিনী বলেছেন  ‘আইজ্যাক আসিমভ’

রক্ত বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম
আইজ্যাক আসিমভ

রূপান্তরঃ আবুল বাসার
প্রচ্ছদঃ শতাব্দী জাহিদ

প্রকাশনায়ঃ প্রকৃতি-পরিচয়, ঢাকা
প্রথম প্রকাশঃ ২০১৪
দ্বিতীয় মুদ্রণঃ ২০১৭
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৭০
মূল্যঃ ১১০/=
ISBN: 978-984-88-8294-8

প্রাণীদেহের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হল রক্ত। লাল রঙের তরল এই পদার্থটি ঠিক কী কাজ করে বা কীভাবে এই বস্তুটি তৈরি তা জানতে মানুষের অনেকদিন লেগেছে। তবে রক্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন কুসংস্কার মানুষের মনে আদিম কাল থেকে প্রচলিত ছিল। রক্ত বিষয়ে মানুষের আদিম জিজ্ঞাসা, বিভিন্ন কুসংস্কার এবং আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত জ্ঞানলাভ- এইসব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের আজকের আলোচ্য বই “রক্ত বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম”; মূল লেখক বিখ্যাত বিজ্ঞানোপন্যাস বা বিজ্ঞান কল্প-কাহিনী লেখক আইজ্যাক আসিমভ। তথ্যসমৃদ্ধ এই বই ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আবুল বাশার। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বা বিজ্ঞানোপন্যাস এর জগতে আইজ্যাক আসিমভ এক অবিস্মরণীয় নাম। তার রোবটের যে কাহিনীগুলো লিখিত হয়েছে তা থেকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন বিষয়ে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। রোবটের সাথে মানুষের সম্পর্ক কেমন হবে তার নীতিমালা এসেছে আইজ্যাক আসিমভের ধারণা থেকে (আরও জানতে পড়ুন ‘নবারুণ’ পত্রিকার জুলাই ২০১৭ সংখ্যা)। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর লেখক হলেও তিনি বেশ কিছু বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের বই লিখেছেন। এরকম একটি বই হল “রক্ত বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম”।

বইটি ‘প্রকৃতি-পরিচয়’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত “বিজ্ঞানের ইতিহাস গ্রন্থমালা”র দ্বিতীয় বই। এই গ্রন্থমালাতে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞান বিষয়ে জনপ্রিয় ধারার বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকৃতি পরিচয় প্রকাশনীর এই প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়।

“রক্ত বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম” বইয়ের সূচীপত্র একবার দেখে নেইঃ-

  • হৃৎপিন্ড
  • রক্ত সঞ্চালন
  • লোহিত রক্ত কণিকা
  • শ্বেত কণিকা ও অনুচক্রিকা
  • রক্তরস

রক্ত সম্পর্কিত মোটামুটি সব বিষয় এই পাঁচটি অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ছবির বহুল ব্যবহার আলোচ্য বিষয়গুলোকে আরো বেশি অর্থবহ ও প্রামাণ্য করেছে। ছবিগুলো যদিও সাদাকালো কিন্তু ছাপানোর স্পষ্টতা রঙের অভাবকে বুঝতে দেয় নি।

মূল আলোচনা শুরুর আগে রয়েছে আইজ্যাক আসিমভ (Isaac Asimov, January 2, 1920– April 6, 1992) সম্পর্কে দুই পৃষ্ঠার জীবন কাহিনী। তাঁর জন্ম, শৈশব, পরিবার, লেখাপড়া, লেখালেখি ইত্যাদি বিষয়ে স্বল্প কথায় অনেক কিছু বলা হয়েছে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯২০ সালে। মাত্র ১১ বৎসর বয়সে নিজে নিজেই গল্প লেখা শুরু করেন। প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন ১৭ বৎসর বয়সে। সেসময়ের বিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী পত্রিকা ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ (Astounding) তার লেখা গল্প ৩১ বার প্রত্যাখ্যান করেছিল। ৩২ তমগল্প ‘নাইটফল’ ছাপানো হয় ওই পত্রিকায়। এই গল্পটি সর্বকালের সেরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর স্বীকৃতি পায়।ফাউন্ডেশন সিরিজ, রোবট সিরিজ ইত্যাদি সিরিজগুলো তাঁকে দিয়েছে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখকের মর্যাদা। ছোটদের জন্য ‘পল ফ্রেঞ্চ’ ছদ্মনামে লিখেছেন ‘লাকি স্টার’ সিরিজ। কল্পকাহিনীর পাশাপাশি বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিষয়ক বই লেখা শুরু করেন হঠাৎ করে। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক বই ‘ওয়ার্ল্ড অব সায়েন্স অ্যান্ড হিস্টোরি বিহাইন্ড দেম’। একে একে জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণরসায়ন, জীববিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা প্রসঙ্গে বই লিখতে থাকেন। আড়াইশ'র বেশি বিজ্ঞাননির্ভর বই তিনি লিখেছেন। পাঁচশতেরও বেশি বইয়ের লেখক আইজ্যাক আসিমভ পেয়েছেন মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা ও সম্মান। অসংখ্য পুরস্কারের পাশাপাশি তার নামে একটি গ্রহাণু ও মঙ্গলগ্রহের একটি খাদের নাম রাখা হয়েছে। এই মহান বিজ্ঞান লেখক মারা যান ১৯৯২ সালে। আইজ্যাক আসিমভ সম্পর্কে এই নাতিদীর্ঘ রচনা নবীন পাঠককে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর জগত সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে।

মূল বইয়ের প্রথমে আলোচনা করা হয়েছে ‘হৃৎপিণ্ড’ নিয়ে। সারা শরীরে রক্ত ছড়িয়ে দেয়া হৃৎপিণ্ডের প্রধান কাজ। কিন্তু মানুষ তা জানত না। তারা মনে করত রক্তই জীবন। তাই তারা মৃত প্রাণীর রক্ত খেতে নিষেধ করত। বিভিন্ন উত্তেজনা বা পরিশ্রমে অস্বাভাবিক আন্দোলনের কারণে কেউ কেউ ভাবত হৃৎপিণ্ড মানুষের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যারিস্টটল ভাবতেন হৃৎপিণ্ড চিন্তাভাবনার কাজ করে। সেইসময়ে কেউ কেউ মনে করতেন ধমনী দিয়ে রক্ত নয় বাতাস প্রবাহিত হয়। ৩০০ থেকে ২৫০ খ্রিষ্টপূর্বে আলেকজান্দ্রিয়ায় শব ব্যবচ্ছেদ করে গবেষণা করা হত। সেই সময়ে হৃৎপিণ্ডের গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের বেশ কয়েকটি দিক তারা আবিষ্কার করেছিলেন। ধমনী, শিরা ইত্যাদির সাথে হৃৎপিণ্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু অপরিণত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কারণে তারা অনেক কিছুই বুঝতে পারেন নি। ১৩০ – ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেন (Aelius Galenus or Claudius Galenus 129 AD – 200/ 216) প্রমাণ করেন ধমনী দিয়ে বাতাস নয় রক্ত প্রবাহিত হয়। তিনি ভেবেছিলেন হৃৎপিণ্ডে একটিমাত্র পাম্প রয়েছে। অথচ আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞানীরা দুইটি পাম্প দেখতে পেয়েছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ার পতনের পর গ্যালেনের মতবাদটি পরবর্তী ১৪শত বৎসর টিকে যায়।

এরপর মানুষের অঙ্গসংস্থানের ধারণা বিষয়ে আমুল পরিবর্তন আনেন বেলজিয়ামের শরীরতত্ত্ববিদ ডা. অ্যান্ড্রিয়া ভেসালিয়াস (Andreas Vesalius, 1514-1564) (তাঁর আবিষ্কারের কাহিনী নিয়ে একটি বইয়ের আলোচনা গ্রন্থগত ওয়েবসাইটে রয়েছে। উৎসাহবোধ করলে পড়ুন “চিকিৎসাবিজ্ঞানে আবিষ্কারের কাহিনী”)। কিন্তু তিনিও হৃৎপিণ্ডের গঠন ও কাজ নিয়ে খুব একটা নতুন তথ্য উপস্থাপন করতে পারেন নি।

দ্বিতীয় অধ্যায় “রক্ত সঞ্চালন”। হৃৎপিণ্ড থেকে সারা শরীরে কীভাবে রক্ত পৌঁছায় তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ ছিল। গ্যালেনের ধারণা থেকে মুক্ত হতে ইউরোপের ১৪ শত বৎসর লেগেছিল। ইউরোপে বহুদিন মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ ছিল। ফলে এ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন সহজ ছিল না। গ্যালেনের সময় থেকেই জানা ছিল হৃৎপিণ্ড থেকে মোটা মোটা নালী ফুসফুসে গেছে আবার ফিরে এসেছে। আবার শরীরের বিভিন্ন অংশে হৃৎপিণ্ড থেকে বের হওয়া মোটা মোটা রক্তবাহী নালী ছড়িয়ে পড়েছে। শব ব্যবচ্ছেদ করার অনুমতি না থাকায় এই নালীগুলোর সঠিক কাজ কেউ বুঝতে পারে নি। ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার চিকিৎসক ইবনে আল নাফিস (Ala-al-din abu Al-Hassan Ali ibn Abi-Hazm al-Qarshi al-Dimashqi) একটি অস্ত্রোপচার বিষয়ক বই লেখেন। তার রাষ্ট্রে মৃতদেহ কাঁটাছেড়ায় কোন বিধিনিষেধ ছিল না। তাই তিনি গ্যালেনের এক পাম্পের ধারণা ভুল বলে দেখতে পেরেছিলেন। তিনি তার বইতে হৃৎপিণ্ডে দুটি পাম্পের কথা উল্লেখ করেছেন। এই দুটি পাম্প থেকে কয়েকটি মোটা নালী বের হয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করার বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি সঠিকভাবে ধারণা করেছিলেন যে ফুসফুস থেকে বাতাস রক্তে মেশে এবং সেই রক্ত আবার হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পরে। কিন্তু অনুবীক্ষণ যন্ত্রের অভাব ও অক্সিজেন নামক গ্যাসের কথা না জানায় তিনি খুব বেশি পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদ্ভাবন করতে পারেন নি। আবার তার এই জ্ঞান সিরিয়া অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে ইউরোপের গবেষণায় তা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে নি। ইউরোপকে কারো সহায়তা ছাড়াই নিজেদের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে।

রক্ত নালীর অন্যতম উপাদান ভালভ বা কপাটিকা। রক্তকে যে কোন একদিকে প্রবহমান রাখতে এরাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। পায়ের শিরা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ভাল্ভ আবিষ্কার করেন ইতালিয় চিকিৎসক গিরোলামো ফ্যাবরিচি (Hieronymus Fabricius অথবা Girolamo Fabrizio, 20 May 1537 – 21 May 1619)। একমুখী এই ভালভের কাজ তিনি বুঝতে পারেন নি। তার ছাত্র উইলিয়াম হার্ভে পায়ের শিরার ভেতরের একমুখী কপাটিকা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। দীর্ঘ গবেষণা থেকে তিনি রক্ত সংবহনের সূত্রগুলো আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। তিনিই প্রথম জানান যে হৃৎপিণ্ড থেকে ধমনী শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত বয়ে নিয়ে যায় এবং শিরার মধ্য দিয়ে রক্ত হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। তার এই প্রস্তাব অতীতের অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটায়। এজন্য তাঁকে শরীরবিদ্যার জনক বলা হয়।

আলোচ্য বইয়ের ‘লোহিত রক্ত কণিকা’ অধ্যায়ে রক্তকে লাল রঙে রাঙিয়ে তোলা এই উপাদানটির পরিচয় রয়েছে। ১৬৫০ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা আতশি কাঁচের ব্যবহার শিখে ফেলেন। এই বিবর্ধক কাঁচের ব্যবহার রক্তের বিভিন্ন উপাদানকে বিজ্ঞানীদের সামনে দৃশ্যমান করে তোলে। রক্তে লোহিত কণিকার উপস্থিতি প্রথম শনাক্তের কৃতিত্ব দুইজনের। ইতালির বিজ্ঞানী মারসেলো মালপিজি ও ডাচ বিজ্ঞানী জেন সোয়ামমারড্যাম (Jan Swammerdam,February 12, 1637– February 17, 1680) রক্তের ভেতরের লাল রঙের ছোট বস্তুর বর্ণনা প্রায় একই সময়ে দিয়েছেন। কিন্তু বস্তুটি স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণের কৃতিত্ব এন্থনি ভন লিউয়েন হুকের (Antonie Philips van Leeuwenhoek,  24 October 1632 – 26 August 1723)। তিনি নিজেই কাঁচ ঘষে লেন্স তৈরি করতে পারতেন। নিজের তৈরি পরিষ্কার ও শক্তিশালী লেন্সের মাধ্যমে লোহিত রক্ত কণিকার স্পষ্টতর ছবি তিনিই প্রথম দেখেন। তিনি সঠিকভাবে লোহিত কণিকার বর্ণনা দেন ও ছবি আঁকেন।

এই লোহিক কণিকায় কোন নিউক্লিয়াস থাকে না আবার এর মধ্যে বিশেষ একটি রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যার কারণে রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হয়। এই প্রসঙ্গটিও ‘লোহিত রক্ত কণিকা’ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায় থেকেই আমরা জানতে পারিঃ-

আমাদের দেহে প্রতি সেকেণ্ডে ২০ লাখের বেশি লাল রক্ত কণিকা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠা: ৪৮

‘শ্বেত কণিকা এবং অণুচক্রিকা’ নামক অধ্যায়ে রক্তের এই অন্যতম উপাদান দুটির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। রক্তের মধ্যে শ্বেত কণিকার পরিমাণ খুব বেশি থাকে না। কিন্তু এরাই শরীরকে বিভিন্ন বাহ্যিক ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে প্রধান সৈনিকের কাজ করে। এদের শরীরে কোন হিমোগ্লোবিন থাকে না, ফলে এরা সাদা রঙের হয়। রক্তে শ্বেতকণিকার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তা আবার সমস্যা তৈরি করে। বেশি শ্বেতকণিকা রক্তের ভেতরের জায়গা দখল করে, ফলে রক্তের অন্যান্য কাজে বিঘ্ন ঘটে। এই সমস্যার নাম 'লিউকিমিয়া'। শ্বেতকণিকা নিয়ে মূল্যবান গবেষণার জন্য জার্মানীর পল এহরলিখ (Paul Ehrlich, 14 March 1854 – 20 August 1915) এবং রাশিয়ার ইলিয়া মেচনিকভ (Ilya Ilyich Mechnikov, 15 May1845– 15 July 1916) ১৯০৮ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার পান।

শরীরের কোথাও কেটে গেলে হৃৎপিণ্ডের চাপে রক্ত বেরিয়ে যেতে থাকে। তখন যে উপাদানটির কারণে রক্ত জমাট বাঁধে তার নাম অণুচক্রিকা। এদের আকার ও পরিমাণ লোহিত কণিকার চেয়ে কম। তবে লোহিত কণিকার মতই অণুচক্রিকাতেও নিউক্লিয়াস থাকে না। এদের আয়ু মাত্র নয় দিন। কোথাও রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজন হলে অণুচক্রিকা নিজেকে ভেঙে ফেলে কয়েক ধাপের রাসায়নিক পরিবর্তন করে। ফলে রক্ত জমাট বাঁধে আর শরীর নিরাপদ থাকে রক্তশূন্য হওয়া থেকে।

‘রক্তরস’ অধ্যায়ে রক্তের প্রধান উপাদান রক্তরস নিয়ে আলোচনা রয়েছে। রক্তের ৪৫ শতাংশ গঠিত হয় রক্ত কণিকা দিয়ে; আর বাকী ৫৫ শতাংশ তৈরি জলীয় পদার্থ দিয়ে। এই অংশটির নাম রক্তরস বা প্লাজমা (Plasma)।  এই রক্তরসের কারণেই রক্ত তরল থাকে। রক্তরসের মাধ্যমে বাহিত হয়ে রক্তকণিকাগুলো শরীরের বিভিন্ন অংশে বাহিত হয়। শরীরের যেখানে যখন যে কণিকার প্রয়োজন, সেখানে সে রক্তরসের উপর ভর করে দ্রুত চলে যেতে পারে। রক্তকণিকা বহন ছাড়াও রক্তরস শরীরের ভেতরে উৎপন্ন অতিরিক্ত তাপ ত্বকের মাধ্যমে বের করে দেয়। ফলে শরীরের তাপমাত্রা সহনশীল অবস্থায় থাকে। খাবার থেকে গ্লুকোজ, ফ্যাটিএসিড, পরিশ্রমের ফলে রক্তে মিশে যাওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড, ইউরিয়া ইত্যাদিও রক্তরস বহন করে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকারের হরমোন শরীরের প্রয়োজনীয় অংশে পৌঁছে দেয়ার কাজটিও রক্তরস করে থাকে। রক্তরসে থাকা বিভিন্ন রকমের  প্রোটিনগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য ১৯৪৮ সালে সুইডেনের রসায়নবিদ আর্নি উইলহেম টিসেলিয়াসকে (Arne Wilhelm Kaurin Tiselius,10 August 1902– 29 October 1971) নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।

আসলে রক্ত আমাদের শরীরের প্রাণপ্রবাহকে সজীব রেখে দেয়। রক্ত বিভিন্নভাবে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করে। রক্তের এমন উপকারী বিভিন্ন প্রসঙ্গ সহজভাষায় বর্ণিত হয়েছে আমাদের আজকের আলোচ্য বই “রক্ত বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম” বইতে। বিভিন্ন পাতায় প্রয়োজনীয় ছবির সংযোজন বইয়ের আলোচনাগুলোকে করে তুলেছে আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য। এই ধরণের বিজ্ঞান বিষয়ক বই বাংলায় রূপান্তর করা সহজসাধ্য নয়। আবুল বাসার এই কঠিন কাজটিকে বেশ বুদ্ধিদীপ্তভাবে সম্পন্ন করেছেন। ফলে বইটি পড়তে গিয়ে কোথাও অনুবাদ পড়ার অনুভূতি হয় না। তবে বিজ্ঞানীদের নাম বাংলায় লেখার পাশাপাশি ইংরেজিতে দিলে বুঝতে আরও সুবিধা হত। বিজ্ঞানের বইয়ের অনুবাদ সহজ কাজ নয়। আবুল বাশার যে ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করেছেন তাতে সাবলীল বাক্যে সহজ শব্দের সুষম ব্যবহার পাঠকের অনুভূতিকে জটিলতার জালে বন্দী করবে না। অনুবাদকের এ কৃতিত্ব শুধু ধন্যবাদ দিয়ে পূরণের নয়।

পেপারব্যাক মলাটের বইটি ৭.২×৪.৭ ইঞ্চি আকারের কারণেই দীর্ঘক্ষণ হাতে নিয়ে রাখা যায়। ছাপার মান ভালো, বর্ণগুলো স্পষ্টতর, গাঢ় রঙের; ফলে চোখে কোন ক্লান্তি তৈরি করে না। বইয়ের প্রচ্ছদের যথাযথ পরিকল্পনার জন্য শিল্পী শতাব্দী জাহিদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেই হয়। রক্ত বিষয়ে বইয়ের প্রচ্ছদের রক্তের রঙ ও ফোঁটার ব্যবহার সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বলে মনে হয়। আসলে প্রচ্ছদটি যেভাবে অঙ্কিত হয়েছে তা পাঠকের চোখে বইটি হাতে নিয়ে প্রথম দর্শনে রক্তের একটি চিত্রকল্প তৈরিতে সক্ষম হবে। সার্বিকভাবে বলা যায়, গ্রন্থ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে প্রকৃতি-পরিচয় কর্তৃপক্ষ সফল। বইয়ের প্রসঙ্গটি সব বয়সের পাঠকের উপযোগী। ফলে অল্প বয়সী পাঠকের পাশাপাশি কৌতুহলী বয়স্ক পাঠকও রক্ত সম্পর্কে বিভিন্ন অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ হবেন। এই ধরণের বই আরও প্রকাশিত হোক, বইটি ব্যাপক প্রচার পাক এই প্রত্যাশা করি।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ