‘রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী’ রচিত “শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ” বইয়ের পাঠ বাংলা রেনেসাঁ বুঝতে সাহায্য করবে

‘রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী’ রচিত “শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ”


বাংলা রেনেসাঁর মর্মবাণী যে সকল মণীষীর মাধ্যমে বাঙালির মানসপটে প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে প্রাবন্ধিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অন্যতম। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬৪ সালের ২০ আগস্ট। বাড়িতে তাঁর পিতা, পিতৃব্য, পিতামহ সকলেই বিদ্যানুরাগী ছিলেন। ফলে শৈশব থেকেই তিনি বঙ্গদর্শন, আর্য্যদর্শন, নবজীবন, ভারতী, সাধনা প্রভৃতি পত্রিকার দেখা পেয়েছেন। আর তাই লেখালেখির প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রবল ছিল। নবজীবন পত্রিকায় ‘মহাশক্তি’ নামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে তার লেখক জীবনের যাত্রা শুরু। এরপর দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, পরিভাষা এবং প্রধানত বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা ছিল তার প্রধান আগ্রহের বিষয়। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করার পর শিক্ষাবিভাগে একাধিক চাকরি শেষে রিপন কলেজে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে জীবনের শেষ দিন অতিবাহিত করেন।  তাঁর সম্পর্কে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেন -


যৌবনের প্রারম্ভেই তুমি যেরূপ বিদ্যাবত্তা ও গুণবত্তা প্রকাশ করিয়াছিলে, তুমি যে পথেই যাইতে, তাহাতেই প্রভূত ধন-সম্পদ ও যশঃ উপার্জন করিতে পারিতে, কিন্তু তুমি সে সকল পদই ত্যাগ করিয়া দারিদ্র্যমণ্ডিত অধ্যাপনা ও মাতৃভাষার সেবাই জীবনের ব্রত করিয়াছ এবং আত্মত্যাগ ও আদর্শ চরিত্রের পরমোজ্জ্বল ও মহিমময় দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছ। তুমি বিজ্ঞানকে স্বর্গ হইতে মর্ত্ত্যে নামাইয়া আনিয়াছ এবং যাঁহারা বিজ্ঞানজ্যোতিঃ বিকীর্ণ করিয়া দেশের অশেষ কল্যাণ সাধন করিয়াছেন, তাঁহাদের একজন অগ্রণী হইয়াছ।

 

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী চিন্তায় ছিলেন দার্শনিক, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ছিলেন বৈজ্ঞানিক আর এই দুইয়ের প্রকাশ ঘটাতেন সৌন্দর্যময় সাহিত্যশিল্পীর নিপুণ কারুকার্যে। তাঁর প্রতিটি রচনা প্রাঞ্জল ভাষায় কৌতুকরসে জারিত ও তাত্ত্বিক যুক্তিতে শাণিত। রচনার সৃজনশীলতা ও উপস্থাপনের মৌলিকত্বের কারণে তিনি সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত।

আজকের আলোচ্য গ্রন্থের সম্পাদক ড. প্রদীপ রায় বইয়ের ভূমিকাতে জানান- 


রামেন্দ্রসুন্দর আজীবন বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানসাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন। তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞানভাণ্ডার মন্থন করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নিজের শেকড় থেকে বিচ্যুত হলে সেই জাতির উন্নতি, অগ্রগতি ও বিকাশের পথ চিরদিনের জন্য রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই এ ক্ষেত্রে তিনি যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তেমনি প্রতীচ্যের হার্বাট স্পেনসার, চার্লস ডারউইন, হেনরি বার্গসঁ প্রমুখের দ্বারাও সমভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি তাঁর কর্ম ও করণীয় নির্বাচনে খাঁটি বাঙালিত্বের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। বাঙলা, বাঙালি ও বাংলাভাষা ছিল তাঁর হৃদয়তন্ত্রীতে বাঁধা। সেই বোধ ও বোধি থেকে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ গড়ে তুলেছেন, জাতীয় চিত্রশালা গঠনের চেষ্টা করেছেন, বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা তৈরি করে শ্রেণীকক্ষে বাংলাভাষায় পাঠদান করেছেন, ইংরেজির চেয়ে বাংলায় লেখালেখি করতে, ইংরেজির চেয়ে বাংলায় বক্তৃতা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।

 

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তার চেতনা নিজের জীবনেও চর্চা করেছেন। তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞানসমুদ্র মন্থন করে একজন পরিপূর্ণ মানুষ (Complete Man) হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টায় রত ছিলেন। তাই তিনি সচেতন আগ্রহ নিয়ে মানবসমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, শিক্ষা, লোকাচার, রীতি-নীতির পাশাপাশি একই উৎসাহ নিয়ে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। উদার, নিরপেক্ষ, কুসংস্কার ও গোঁড়ামিমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানের পাশাপাশি ইতিহাসকেও জানার প্রয়োজন আছে। আর এইসব বিবিধ বিষয় নিয়ে রচনা করে গেছেন একের পর এক প্রবন্ধ। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধাবলী একত্রিত করে প্রকাশ করেছেন গ্রন্থ। তাঁর সম্পূর্ণ রচনাগুলো বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসের সম্পাদনায় ছয় খণ্ডে এবং কলকাতার গ্রন্থমেলা ড. বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় চার খণ্ডে প্রকাশ করে। এই বিশালাকায় রচনাবলী থেকে নিরপেক্ষ ও নির্মোহ অবস্থান থেকে সকল শ্রেণীর পাঠকের কথা মনে রেখে মোট তেইশটি প্রবন্ধ ড. প্রদীপ রায় নির্বাচন করেছেন। পরিশিষ্টে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী'র একটি চিন্তাসমৃদ্ধ চিঠি ও তাঁর আত্মকথা সংযুক্ত করেছেন। ফলে এই বইটি আগ্রহী পাঠকের সামনে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর একটি সম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করবে।

বইয়ের সূচি একবার দেখে নিলে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী'র রচনাগুলোকে চিনে নেয়া আরও সহজ হবে।


  • প্রকৃতি
  • পৃথিবীর বয়স
  • জ্ঞানের সীমানা
  • প্রকৃতির মূর্তি
  • মৃত্যু
  • প্রলয়
  • জিজ্ঞাসা
  • সুখ না দুঃখ?
  • সৌন্দর্য-তত্ত্ব
  • নিয়মের রাজত্ব
  • মায়া-পুরী
  • বিজ্ঞানে পুতুলপূজা
  • বিচিত্র জগৎ
  • জড় জগৎ
  • প্রাণময় জগৎ
  • প্রজ্ঞার জয়
  • চঞ্চল জগৎ
  • কর্ম্ম-কথা
  • মুক্তির পথ
  • বৈরাগ্য
  • জীবন ও ধর্ম
  • ধর্ম প্রবৃত্তি
  • ধর্মের প্রমাণ
  • প্রকৃতি-পূজা
  • চরিত-কথা
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
  • অধ্যাপক মক্ষমূলর
  • নানা-কথা
  • মহাকাব্যের লক্ষণ
  • পরিশিষ্ট
  • আত্মকথা
  • পত্রাবলী

প্রতিটি প্রবন্ধই রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী'র অনন্য জ্ঞান ও দেশপ্রেমের আলোতে সমুজ্জ্বল। নিজস্ব ভাষারীতির বাক্যধারায় যুক্তি ও তত্ত্বের অসাধারণ বয়নকৌশলে প্রকাশ করেছেন মৌলিক চিন্তুাসূত্র। পাঠককে নিয়ে যান এক অভূতপূর্ব চিন্তার জগতে। পাঠক আপ্লুত হন, সমৃদ্ধ হন, বিজ্ঞানের প্রবন্ধ পাঠে লাভ করেন সাহিত্যের তৃপ্তি। ভূমিকাতেই ড. প্রদীপ রায় আরও বলেন - 


… রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও সাহিত্যিক - এই ত্রিধারা সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ‘ডিরোজিও যুগের প্রতিক্রিয়ার অবতার’। ভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত এই বাঙালির দেশাত্মবোধ, ভাষাপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, এবং সর্বোপরি মানবিকতাবোধ দ্বারা এক অপূর্ব সুন্দর জগতের সৃষ্টি করেছেন। এই জগতের নাম আমরা দিতে পারি ‘রামেন্দ্র জগৎ’। সাহিত্যিক সৌন্দর্যে, চিন্তার গভীরতা ও ব্যাপকতায়, শিল্পগুণ ও রীতিতে, ভাষার সমৃদ্ধতায়, রূপক ও কৌতুকরসে তাঁর এই জগৎ তাই আমাদের নিকট অম্লান, শাশ্বত ও চিরন্তন।

 

আলোচ্য সংকলনগ্রন্থে যে প্রসঙ্গগুলো আলোচনা করা হয়েছে তার প্রত্যেকটির সারাংশ “শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ” বইয়ের ভূমিকাতে উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠক সেগুলো পাঠ করে মূল বইয়ে প্রবেশের পূর্বেই রামেন্দ্র'র রচনা সম্পর্কে একটি পূর্বধারণা অনুধাবন করতে পারবে। আমরাও কয়েকটি প্রবন্ধের মূলভাব সংক্ষিপ্তাকারে পাঠকের পাতে উপস্থাপন করছি।

পৃথিবীর বয়সঃ
আলোচ্য বিষয় ভূ-তত্ত্ব, প্রাণিতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদির আলোকে পৃথিবীর বিবর্তনের ইতিহাস। বিষয়টি ব্যাপক, জটিল এবং বিতর্কিতও বটে। প্রত্যেক ধারার বিজ্ঞানীগণ নিজ নিজ গবেষণাগত তথ্য দিয়ে পৃথিবীর বয়স নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। ফলে সুনির্দিষ্ট ফলাফল নিয়ে তাত্ত্বিক ও গবেষকদের মধ্যে একটা বিতর্ক থেকেই গেছে। লেখক মনে করেন এসব গবেষণাজাত বিতর্ক পৃথিবীর বয়স সঠিকরূপে নিরূপণে সহায়ক হবে। তিনি প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য পাঠকের সামনে তুলে ধরে এই আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।

জ্ঞানের সীমানাঃ এই প্রবন্ধে লেখক জানিয়েছেন জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্রমাগত উন্নতির ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নানাবিধ অজানা বিষয় আবিষ্কারের প্রভাবে মানুষের জানাশোনার পরিধি বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। পদার্থবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, ধর্মতাত্ত্বিকগণ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞানসমুদ্রের আয়তন বাড়াতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। তবুও অনেক কিছু এখনও মানুষের অজানা থেকে গেছে এবং থাকবেও। জ্ঞানরাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি মানবসভ্যতার অগ্রগতির চিহ্ন। প্রত্যেকটি ধারা নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে জ্ঞানের অন্যান্য ধারাকে সমৃদ্ধ করে তোলে। জ্ঞান আহরণের কোনো সীমা নেই। মানবজাতির অগ্রগতির পরিচায়ক হচ্ছে জ্ঞানবিজ্ঞানের সীমানার ক্রমাগত বৃদ্ধি।

সুখ না দুঃখঃ
এটা একটি দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ। আমাদের জীবনে কার পরিমাণ বেশি বা কম? এই প্রাচীন প্রশ্নটিকে লেখক দুইপক্ষের অনুসারীদের যুক্তি তর্ক সহজবোধ্য ভাষা ও উদাহরণসহযোগে উপস্থাপন করেছেন। তিনি কোন পক্ষাবলম্বন না করেই আলোচনা চালিয়ে গেছেন। কোন একটির পক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেন নি।

সৌন্দর্য্য-তত্ত্বঃ সৌন্দর্যের দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, মানসিক ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সৌন্দর্য সম্পর্কে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি জানেন মানুষের মধ্যে সৌন্দর্য অনুভবের মাত্রাগত পার্থক্য থাকতে পারে। তবে যে সুন্দর ব্যক্তিবিশেষের চাইতে সামষ্টিক জীবনের জন্য বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাই যথার্থ। তিনি জানান সৌন্দর্য প্রধানত দুই রকমের। স্থূল সৌন্দর্য এবং সুক্ষ্ম সৌন্দর্য। তবে তাঁর যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল -


যাহাতে চৈতন্যের প্রবাহকে স্থিরবেগে মন্দগতিতে চালিত রাখে, তাহা সুন্দর; যাহাতে জীবনের ভরসা দেয়, প্রাকৃতিক প্রতিকূল শক্তির সম্মুখে আত্মাকে ম্রিয়মাণ হইতে নিষেধ করে, তাহা সুন্দর; আর যাহাতে অনেকের মনে সমান প্রীতি জন্মাইয়া মনে মনে জড়াইয়া দেয়, পরার্থপ্রবণ বৃত্তিগুলিকে জাগ্রত ও উত্তেজিত রাখিয়া সমাজ-জীবনকে অগ্রসর করে, তাহা আরও সুন্দর। এই হিসাবে জীবনরক্ষার সহিত সৌন্দর্যের সম্বন্ধ; শুধু আমার জীবনের রক্ষা নহে, তোমার জীবনের এবং সমগ্র সমাজ-জীবনের রক্ষার সহিত ইহার সম্বন্ধ। পৃষ্ঠা- ৬৭

 

প্রজ্ঞার জয়ঃ প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষের মধ্যেই প্রজ্ঞার দেখা পাওয়া যায়। উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণী তাদের সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা জীবনের ভার বয়ে চলে। কিন্তু মানুষ তার পরিপার্শ্ব থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। উত্তরপুরুষের মধ্যে এই অভিজ্ঞতার সারাৎসার বিলিয়ে দিয়ে সমৃদ্ধ করে মানবসভ্যতা। লেখক বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের সচেতনতা, অচেতনতা তুলনায় মানুষের আচরণ বিচার করে প্রজ্ঞার জয়গান ঘোষণা করেন। বলেন -

 

প্রজ্ঞার অস্ত্র বিজ্ঞানময় অস্ত্র। বৈজ্ঞানিক এই বিজ্ঞানশাস্ত্র প্রয়োগ করিয়া বাঙ্ময় জগৎ নির্মাণ করিয়াছেন, এই বাঙ্ময় জগতের অনুশাসনে প্রত্যক্ষ জগৎকেকও আপনার বশীভূত করিয়াছেন। বিজ্ঞান-বিদ্যার এইজন্য এত স্পর্ধা। মানুষের কারবার প্রত্যক্ষ জগতে। প্রজ্ঞাবলে সেই প্রত্যক্ষ জগৎ মানুষের বশীভূত। প্রজ্ঞাবান মনুষ্য প্রত্যক্ষ জগতের প্রভু; অতএব প্রজ্ঞারই জয়; পৃষ্ঠা- ১৮৪

 

চরিত কথা অংশে রামেন্দ্রসুন্দর দুজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের জীবনী আলোচনা করেছেন।
প্রথম জন হলেন অসামান্য মানবতাবাদী বাঙালি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং দ্বিতীয়জন হলেন জার্মানীর সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত অধ্যাপক মক্ষমুলর (ম্যাক্সমুলার)। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন - 


সেই দুর্দম প্রকৃতি, যাহা ভাঙ্গিতে পারিত, কখনও নোয়াইতে পারে নাই; সেই উগ্র পুরুষকার, যাহা সহস্র বিঘ্ন ঠেলিয়া ফেলিয়া আপনাকে অব্যাহত করিয়াছে; সেই উন্নত মস্তক, যাহা কখন ক্ষমতার নিকট ও ঐশ্বর্যের নিকট অবনত হয় নাই; সেই উৎকট বেগবতী ইচ্ছা, যাহা সর্ববিধ কপটাচার হইতে আপনাকে মুক্ত রাখিয়াছিল, তাহার বঙ্গদেশে আবির্ভাব একটা অদ্ভুত ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে গণ্য হইবে, সন্দেহ নাই। এই উগ্রতা, এই কঠোরতা, এই দুর্দমতা ও অনম্যতা, এই দুর্ধর্ষ বেগবত্তার উদাহরণ, যহারা কঠোর জীবনদ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকিয়া দুই ঘা দিতে জানে ও দুই ঘা খাইতে জানে, তাহাদের মধ্যেই পাওয়া যায়; পৃ-২৭০

 

জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার সম্পর্কে আবেগপ্রবণ হয়ে জানান - 


মক্ষমূলর আমাদের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন; আমরা সেই বন্ধু হারাইয়াছি। পণ্ডিতপ্রসূ পাশ্চাত্যভূমিতে আরও কত বড় বড় পণ্ডিত জন্মিবেন। কিন্তু আর এক জন মক্ষমূলর আমরা কবে পাইব, কে বলিতে পারে? পৃষ্ঠা- ২৮৩

 

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বর্তমানে বিস্মৃতপ্রায় একটি নাম। রবীন্দ্র সমসাময়িককালে যে সকল পণ্ডিত জ্ঞানে মানবিকতায় নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে তিনিই স্মরণীয়। বাংলা রেনেসাঁসের প্রাথমিক সময়ে জাতির মননগঠনে তাঁদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনবোধ ভাষাচর্চায় প্রাণরূপ পেয়েছিল। সমসাময়িক সময়ের কূপমণ্ডুক সমাজের প্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন সেই প্রাজ্ঞজনদের দিকে তাকাই, তখন নিজেদের অবস্থানকে বড়ই করুণ মনে হয়। এমতাবস্থায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর রচনার পুনঃপাঠ চিন্তাজগতে শক্তির সঞ্চার করে। ফিরে পাওয়া যায় বাঙালিত্বের প্রতি এক প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আলোকিত মানুষ তৈরির কার্যক্রমে ড. প্রদীপ রায়ের সহায়তায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কয়েকটি রচনার সংকলন প্রকাশ করেছে। তাদের এই কার্যক্রম সফল হোক। রামেন্দ্রসুন্দরের রচনা প্রকাশের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হোক এই প্রত্যাশা করি।

বইটি শক্ত মলাটে সাদা কাগজে ছাপানো। বাঁধাই এর মান ভাল। ৩০৪ পৃষ্ঠার হৃষ্টপুষ্ট বই হলেও মানসম্মত সেলাই এর কারণে সহজে নষ্ট হবে না। বহু ব্যবহারেও জীর্ণ হবে না। তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি পাঠাগার কর্তৃপক্ষের এই বইটি সংগ্রহ করা প্রয়োজন। যত বেশি সংখ্যক পাঠক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে চিনবেন; বাঙালিত্বের বিকাশ নিয়ে ততোবেশি নিঃসংশয় থাকা যাবে।

=======================
শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী


সম্পাদনাঃ ড. প্রদীপ রায়
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
প্রকাশনায়ঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা
প্রকাশকালঃ ২০১৩
পৃষ্ঠাঃ ৩০৪
মূল্যঃ ৩৫০/-
ISBN: 984-18-0387-9

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ