‘শেমিজের ফুলগুলি’ ও অন্যান্য প্রসঙ্গে মোস্তফা হামেদীর সাক্ষাৎকার


‘সেমিজের ফুলগুলি’ ও অন্যান্য প্রসঙ্গে মোস্তফা হামেদীর সাক্ষাৎকার
প্রকাশিত হল মোস্তফা হামেদী রচিত কাব্য "শেমিজের ফুলগুলি"। নতুন বইটির প্রকাশক প্রিন্ট পোয়েট্রি; প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০/- টাকা। বইটি পরিবেশন করছে জনান্তিক;  বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে-৬০৫, ৬০৬ নম্বর স্টলে।

মোস্তফা হামেদী তার নতুন বই নিয়ে মনের নানাবিধ ভাবনা প্রকাশ করেছেন গ্রন্থগত.কম এর কাছে।

===============

❑ সম্প্রতি আপনার কবিতার বই প্রকাশিত হলো৷ আপনার অনুভূতি জানতে চাই৷

মোস্তফা হামেদী: বই প্রকাশের আনন্দ আছে। একটা পাণ্ডুলিপি বইয়ে সমাহিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন কিছু লেখার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

❑ বই প্রকাশের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কীভাবে?

 মোস্তফা হামেদী:  এটা আমার চতুর্থ কবিতার বই। ফলে বই প্রকাশের ধারাবাহিকতার মধ্যে আছি। একটা বই থেকে আরেকটা বই আলাদা করার চেষ্টা থাকে আমার। এই লেখাগুলা গত দুই বছর ধরে লেখা। একটা নির্দিষ্ট ফর্ম, নির্দিষ্ট জগৎ। যখন মনে হইলো এই ফর্মে আপাতত আর দেওয়ার কিছু নাই, তখন পাণ্ডুলিপি গোছানো শুরু করলাম।

❑ বইটি প্রকাশ করতে প্রকাশক নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছিলো কি?

মোস্তফা হামেদী:  প্রিন্ট পোয়েট্রি শুরু থেকে চমৎকার আচরণ করছে। বইও মেলার শুরুতেই নিয়ে আসছিল। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক আছে সবকিছু।

❑ নিজের লেখার প্রতি আত্মবিশ্বাস কতটুকু?

মোস্তফা হামেদী: আমার নিজস্ব একটা নন্দন চিন্তা আছে। একটা ঘরানার মধ্যে কাজ করি। জনসংস্কৃতির নানা বিষয়-আশয় আমার আগ্রহের জায়গা। বাঙালির জীবনধারা ও বাংলার প্রকৃতির সাথে মিলমিশে গড়ে ওঠা জগতে নিত্য যে কাব্য-সুর মর্মরিত হয়, তাকে কবিতা করতে চেষ্টা করি। লেখাগুলি মানুষ পছন্দ করছে৷ ফলে নিজের সৃষ্টি নিয়ে আমার কোনো দ্বিধা নেই।

❑ কবিতাই কেন লিখলেন? ভাব প্রকাশের জন্য শিল্পের আরও তো মাধ্যম আছে।

 মোস্তফা হামেদী: ছোটবেলা থেকেই আমি আসলে ভিন্ন কিছু করতে চাইছিলাম। বাংলাদেশে বইসা তো আর বিজ্ঞানী হওয়া সোজা নয়, তাই কবি হতে চাইছি। তখন মনে হইছিল কবি হওয়া সহজ। খাতা, কলম হইলেই চলে। আস্তে আস্তে কবিতার ভিত্রে ঢুইকা দেখলাম, বিরাট কাণ্ড-কারখানা। নির্দিষ্ট কোনো ফর্মুলা এখানে খাটে না। নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করতে হয়।

❑ অনেকে বলেন লেখার ক্ষেত্রে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আপনারা প্রস্তুতির কথা জানতে চাই।

 মোস্তফা হামেদী: হ্যাঁ। এলাম-দেখলাম-জয় করলামের সুযোগ নাই এখানে। দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কবিতা যাকে তাড়িয়ে না বেড়াবে, তার পক্ষে কবি হওয়া সম্ভব নয়। কবিতার মায়াজালে পড়লেই হয়তো এক জীবনে কিছু কবিতা লেখার সুযোগ হয়। কবিতা নেয় অনেক কিছু, দেয় সামান্য। সেই সামান্যের ঝলকানি সহ্য করার মতো মানসিকতা না থাকলে কবি জীবন কোনো কাজের না।

❑ পাণ্ডুলিপি গোছানোর ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন?

মোস্তফা হামেদী: 'তামার তোরঙ্গ'র পান্ডুলিপি গোছানোর পর থেকেই নতুন পথের খোঁজ নিতে থাকি। তখন আমার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখার কাল। ঢাকা থেকে পাত্রী দেখে বাড়িতে আসছিলাম। রাত্রি বারোটার দিকে বইসা ছিলাম পুকুরের ঘাটলায়। কিছু একটা লিখতে চাইছিলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের বুক চিরে একটা রাজকুঁড়াল ডেকে উঠলো। সেই তীক্ষ্ণ চিৎকারে বুকের মধ্যে রক্ত খেলে গেল। অভীভূতের মতো লিখে ফেললাম 'অভিব্যক্তি' কবিতাটা৷ তারপর আরও কয়েকটা। পরে ভাবলাম এই ফর্মে একটা বই করা যায়। এই পরিকল্পনার মধ্যে কাজ করা আর কী! তবে আমার জগতটা আছে পুরা ব্যাপারটার মধ্যে। সেটা আবার 'তামার তোরঙ্গ' বা 'জড়োয়া'র মতো না। এখানে পরিসরটা অন্য রকম। অনেক বেশি মায়া। একটু মন্থর। গ্রামীণ আবহের মধ্যে যেরকম থাকে আর কী! বইটা পড়তে হবে একটু ধীরে-নিরিবিলি পরিবেশের মধ্যে

❑ শিল্প না কি পাঠক, আপনার দায়বদ্ধতা কার কাছে?


আমি একটা জগত তৈরি করতে চাইছি আমার লেখার মধ্যে যেটা খুব নৈর্ব্যক্তিক।
মোস্তফা হামেদী: প্রশ্নটা আমার কাছে পরিষ্কার না ঐভাবে। অবজেক্টিভ টাইপ প্রশ্ন হওয়াতে মনে হয় গোলমাল লাগছে। যাই হোক, তবে আমি যে ব্যাপারটা আন্দাজ করতেছি সেটা খোলাসা করি। আমি যখন শিল্প করতে আসছি তখন শিল্পটা ঠিকঠাক থাকা লাগবে প্রথমত। এটা খুব মৌলিক ব্যাপার। যে কোনো কলারই। পরে আসতে পারি এইটা কীভাবে কাজ করবে সমাজের মধ্যে। তখন আসলে পাঠকের ব্যাপারটা আসে। যদিও পাঠক কোনো শাদামাটা ব্যাপার না। নানা কারণে লোকে বই কিনে-পড়ে। তাদের পড়ার ধরন এনালাইসিস করে লিখি না আমি। আমি একটা জগত তৈরি করতে চাইছি আমার লেখার মধ্যে যেটা খুব নৈর্ব্যক্তিক। বহু মানুষ সেখানে ভীড় করে। আমার জনগোষ্ঠী ও জনসংস্কৃতির বিষয়-আশয় নানাভাবে সেখানে আসে। আমার সমাজের একটা বড় পরিসর ধরতে চাই আসলে। এটা মফস্বল শহর, গ্রাম। যেটা এখানকার বেশিরভাগ অংশকে কাভার করে। আমাদের কবিতার বা শিল্প চর্চার ইতিহাসের মধ্যেই এই ব্যাপারগুলি ছিল। মাঝখানে নাই হয়ে গেছিল। এখন ঐ জায়গাটায় কাজ করে যাচ্ছি। দায় যদি বলেন, চিন্তার কাছে। জনগোষ্ঠীর সাথে সংযোগের আকাঙ্ক্ষা থেকে করি এটা। পাঠক বললে ব্যাপারটা সীমিত হয়ে পড়ে। পাঠক অর্থে বই না পড়েও মানুষ যেন আমার সাথে যুক্ত হতে পারে সেই কাজ করতে চাই। এটা হয় সমাজে ব্যক্তি সম্পর্কে এক ধরনের রিডিং বা পাঠ তৈরি হলে। আমি এমন সিগনেচার ক্রিয়েট করতে চাইছি, লোকে যেন বুঝতে পারে আমি তাদের লোক। কিংবা আমি কেউ না। আমার টেক্সট তাদের টেক্সট। এভাবে টেক্সটের মধ্যে তথা সমষ্টির মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমি করি।

❑ একজন পাঠক হিসেবে যখন বইটি দেখছেন/পড়ছেন, তখন বইটিকে কেমন মনে হচ্ছে?

মোস্তফা হামেদী: বইটা প্রকাশের পর আসলে পড়তে চাই নাই ঐভাবে। ভুলটুল থাকলে মন খারাপ হইতে পারে এই চিন্তা করে পড়ি নাই। পরে পাঠকের বেশ কিছু রিভিউ পাওয়ার পর মনে হইলো পড়ে দেখি আরেকবার। তখন ভালো লাগতেছিল যে, হ্যাঁ জিনিসটা কাজ করতেছে। কারণ আমি তো একটা সচেতন জায়গা থেকে লিখছি। আমি জানি কোথায় কী আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লোকজন নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতেছে। এইটা সবচেয়ে আনন্দের। বইয়ের নামটা নিয়াই নানা রকমের জিজ্ঞাসা ও জবাব লোকজন তৈরি করতেছে। আমি নিজে এখন এইটাতে নাই আর। পরের কিছু কাজ করতেছি সেগুলোর মধ্যে ঢুইকা পড়ছি। শুধু কেউ কিছু বললে পিছন ফিরে দেখি আর কীভাবে কাজটা হইছিল।

❑ অধিকাংশ লেখক বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করে, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মোস্তফা হামেদী: আমাদের এখানে এইটা একটা কালচার হয়ে গেছে। সবাই মেলাকেন্দ্রিক পরিকল্পনা করে। এটাকে মানা ছাড়া আপাতত উপায় নাই। এইটার পজিটিভ দিক আছে। একটা উৎসবের মধ্য দিয়া বই প্রকাশ, বিপণন, আড্ডা, পরিচয় ইত্যাদি হয়। আমরা যারা মফস্বলে আছি তাদের জন্য এইটা বিরাট সুযোগ। সারা বছর বই বেচাবেচি চলতে পারে যেন, সেই উদ্যোগ দরকার। এইটা প্রকাশনাগুলা করবে। পাঠকের কাছাকাছি বই পৌঁছানোর সহজ উপায় বাইর করতে হবে। বই প্রকাশ নিয়ে অত বিপ্লবীপনা আমার মধ্যে কাজ করে না। যে মেলা ছাড়া বই করতেই হবে। মেলার মধ্যে বই করলে বেশিরভাগ পাঠক বইটার ব্যাপারে জানতে পারে। মানুষের নজরও থাকে মেলার দিকে। ফলে আমার বই মেলায়ই করতে চাই আমি। কবিতার বইয়ের ক্ষেত্রে তো মনে হয়, এই এক মাস যা বই বেচা যায়, বাকি এগারো মাসেও তার সমান যায় না। ফলে বাজারের ধরন অনুযায়ীও আমি মেলাকে গুরুত্ব দিতে চাই। আর এখন অনলাইনে বই কেনা যায়। আগ্রহী পাঠকরা পরে বই কিনতে পারবেন। সুতরাং মেলার ডামাডোলে কোনো বই কেনা না হলেও পরে সেটা হয়। আমাদের মতো উৎসবপ্রবণ দেশে এই ডামাডোল দরকার আছে। নাইলে মানুষের কানে বইয়ের খবর পৌছাবে না।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ