বই প্রকাশের অনুভূতি এবং সমসাময়িক সাহিত্য প্রসঙ্গে বিবিধ ভাবনা নিয়ে শিমন রায়হান কথা বলেছেন বই আলোচনার ওয়েবসাইট গ্রন্থগত ডট কম (www.granthagata.com) এর সঙ্গে।
====================
❑ সম্প্রতি আপনার বই প্রকাশিত হলো৷ আপনার অনুভূতি জানতে চাই৷
: এ বইয়ের প্রায় সব লেখাই ছাপা হরফে বিভিন্ন সাহিত্যের কাগজে এবং নানা ওয়েবম্যাগে গত এক দশকে প্রকাশিত। প্রথম লেখা ছাপা হবার উত্তেজনার কথা মনে পড়ে। কিন্তু বই বেরোনোর পর দেখছি পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ আর বই প্রকাশের উত্তেজনা ঠিক এক নয়। এ অনুভূতি অন্যমাত্রার।
❑ বই প্রকাশের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কীভাবে?
: আমি এক দশক ধরে লিখলেও আমার লেখার সংখ্যা খুব বেশি নয়। অর্থাৎ উচ্চফলনশীল লেখক আমি নই। তবু একটি বই দু-তিন বছর আগে হতেই পারতো। যাইহোক, এবার ভেতর থেকে চূড়ান্ত অর্থে আহ্বান পেলাম এবং সাড়া দিলাম।
❑ বইটি প্রকাশ করতে প্রকাশক নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছিলো কি?
: এমন কোন জটিলতায় আমাকে পড়তে হয়নি। আমার অভিজ্ঞতা সরল এবং চমৎকার।
❑ নিজের লেখার প্রতি আত্মবিশ্বাস কতটুকু?
আত্মমূল্যায়নের এই ক্ষমতা একজন ভাল লেখকের সব চেয়ে বড় গুণ
: হোর্হে লুই বোর্হেসের মতে, সব মৌলিক রচনাই অবিরাম সংশোধনযোগ্য। তিনি নাকি নতুন বইয়ের ওপরেও সংশোধন করতেন। এক অর্থে লেখা নিয়ে আত্মবিশ্বাস থাকে বলেই তো একজন কবি ও লেখক তা প্রকাশের জন্য ছাড়েন। আত্মমূল্যায়নের এই ক্ষমতা একজন ভাল লেখকের সব চেয়ে বড় গুণ। ভাল সম্পাদকের পক্ষে এজন্য লেখক হয়ে ওঠা কঠিন। তিনি নিজের লেখা নিয়ে সন্তুষ্ট'ই হতে পারেন না। বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে, নিজের চার-পাঁচ বছর আগের অনেক লেখাই প্রলাপ মনে হতে পারে। হয়ত যখন লেখা হয়েছিল তখন ভেবেছিলাম অসাধারণ কিছু একটা হলো। এই মুগ্ধতা ধরে রাখার মতো লেখা শেষোব্দি খুব কমই হয়। ❑ কবিতাই কেন লিখলেন? ভাব প্রকাশের জন্য শিল্পের আরও তো মাধ্যম আছে।
: ছবি আঁকার দিকে খুব ঝোক ছিল ছেলেবেলায়, কিন্তু সহায়ক পরিবেশ না থাকায় হয়ত কাগজ-কলমের এ মাধ্যমটিকেই বেছে নেওয়া। অল্প কথায় বড় কাজ সারার রাজকীয় মাধ্যম হচ্ছে কবিতা। আমার কোনও কবিতাই খুব বড় নয়। এমনকি এক লাইনের কবিতাও আছে এ বইটিতেই।
❑ অনেকে বলেন লেখার ক্ষেত্রে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আপনারা প্রস্তুতির কথা জানতে চাই।
: অবশ্যই প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে অনেক প্রস্তুতি নিয়েও তা কাজে নাও আসতে পারে, যদি না কবিতাযাপন থাকে (কবিতা লেখার ক্ষেত্রে)। এ মাধ্যমটির প্রতি প্রকৃত অনুরাগই আসলে গভীর প্রস্তুতির দিকে অবচেতনেই টেনে নিয়ে যেতে থাকে। যেকোন ভাল সাহিত্যপাঠ, সিনেমা দেখা, গান শোনাসহ প্রকৃতি ও বিচিত্র মানুষের সান্নিধ্যে থাকার মধ্য দিয়ে বিবিধ পন্থায় প্রস্তুতি চলতে থাকে।
❑ পাণ্ডুলিপি গোছানোর ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন?
: পাণ্ডুলিপি গোছানোর ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু মাথায় রাখিনি। সব কবিতাগুলো এক করেছি। তারপর একজন পাঠক হয়ে পড়েছি। কিছু লেখা বাদ দিয়েছি।
❑ শিল্প না কি পাঠক, আপনার দায়বদ্ধতা কার কাছে?
: ক্রিকেট না কি গ্যালারির দর্শক, একজন ক্রিকেটারের দায়বদ্ধতা কার কাছে? দিনশেষে সমস্ত ক্রিকেট দর্শকদের আনন্দের জন্যেই। কিন্তু তাই বলে আমি তাদের হর্ষধ্বনিতে বিগলিত হয়ে একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে বলে বলে ছক্কা হাকাতে চাইব না। এই সংযমই ক্রিকেটের সৌন্দর্য। শিল্পের সৌন্দর্যও এভাবে দাঁড়ায়। এবং তা পাঠকের উৎকর্ষসাধনেই কাজে লাগে।
এখানে মূলত শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারেই জানতে চাইছেন। এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই। শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার ধারণাটি খুব সরল নয়। শিল্প-সাহিত্যের কাছে তাৎক্ষণিক ফল প্রত্যাশার ভিত্তিভূমি থেকেই আসলে এই ধারণা এবং বিতর্কের সূত্রপাত। অনেক সময় একটি কুকুরের মরে যাওয়াও বহু মানুষের ক্ষুধার্ত থাকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠতে পারে একজন শিল্পীর কাছে। শিল্পীর অন্তর্গত এই সংবেদন আর অস্তিত্ব চেতনার ভার অন্যদের পক্ষে বুঝে ওঠা ও বহন করা কঠিন। যেকোন মানবিক সঙ্কটের তাৎক্ষণিক প্রতিকার শিল্পীর ঝুলিতে থাকার কথা নয়। তিনি তার সময়ের চেয়ে অগ্রগামী থাকেন এবং গোটা জনপদকে সেই অগ্রগামী চিন্তার দিকেই অদৃশ্য সুতোয় টেনে নিয়ে যেতে থাকেন। এটাই প্রগতির পক্ষে কাজ করা। বাদবাকী দায়-দায়িত্ব নাগরিকের। শিল্পী যদি নাগরিক হন তো উনি মানববন্ধন করবেন, রাজপথে নামবেন। কিন্তু তার শিল্পকর্মকেই দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের কথা সাধারণের যোগাযোগসক্ষম ভাষায় বলে যেতে হবে- এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন অযোগ্য এবং স্থূল।
❑ একজন পাঠক হিসেবে যখন বইটি দেখছেন/পড়ছেন, তখন বইটিকে কেমন মনে হচ্ছে?
: পাণ্ডুলিপি যখন পড়েছি তখন পাঠক হিসেবেই পড়েছি। বই বেরোনোর পর এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি।
❑ অধিকাংশ লেখক বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করে, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
: আসলে প্রকাশকগণ বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করেন, লেখক নন। লেখক সারাবছরই লিখতে থাকেন। বইমেলা ক্রমশ বড় হচ্ছে। বইমেলা ঘিরে অধিকাংশ বই হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে অন্যান্য সময়ে বই প্রকাশ না পাবার বাস্তব কারণ রয়েছে। আমাদের পাঠকদের একটি বড় অংশ কেবল বইমেলার সময়েই বার্ষিক ভিত্তিতে বইপত্র কিনে থাকেন। এজন্য প্রকাশক ও লেখক মেলার সময়েই বই হওয়াটাকে নিরাপদ মনে করেন।
================
কহে কৈফা
শিমন রায়হান
প্রচ্ছদ- ধ্রুব এষ
প্রকাশক- ঐতিহ্য
দাম ১২০টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম