হাসান রুহুল ও জিহাদ হোসেনের যৌথ কাব্যগ্রন্থ 'লাল রঙের সুখ': জীবনবোধের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণঃ সৌমেন দেবনাথ

হাসান রুহুল ও জিহাদ হোসেনের যৌথ কাব্যগ্রন্থ 'লাল রঙের সুখ'

কবি হাসান রুহুল সেই কবি যাঁর কবিতায় আছে প্রেম, সমাজ-সংস্কৃতি, দেশ চিন্তা, আছে বাহুশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার উচ্চারণ, যাকে আমি বলবো কালের যথাপোযুক্ত কলম সৈনিক। কবির কবিতায় আছে সমাজ বাস্তবতার চমৎকার চিত্র, একেবারে শিকড়কে ছোঁয়ার প্রয়াসও চমৎকার। প্রতিদিনের ব্যবহার্য শব্দমালাকে কবি সঠিকভাবে নান্দনিক প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করে কবিতা লেখেন। কবিতার পরতে পরতে যে শক্তি দৃশ্যমান তা উদঘাটন করতে পারলে পরম প্রাপ্তি ঘটে। মন, মনন, জীবন শুদ্ধতা, প্রেম, যাতনা, বিদ্রোহের বালুকণা আর ক্ষোভের যে রূপায়ণ কবিতাতে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

কবি হাসান রুহুল ও জিহাদ হোসেনের যৌথ কাব্যগ্রন্থ 'লাল রঙের সুখ', যেখানে প্রথম ১৯টি  কবিতা হাসান রুহুলের ও পরবর্তী ২০টি কবিতা জিহাদ হোসনের। প্রথমে হাসান রুহুলের ১৯টি কবিতা পাঠে আমার যে উপলব্ধি তা তুলে ধরলাম।

পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো আমরা মলাটের আড়ালে রেখে অতি মানবীয় প্রবৃত্তিগুলো প্রকাশ করি। মুখে মধু আর অন্তরে বিষ এই চরিত্রের আমরা। সাদা পোশাক পরে লোকচক্ষুর অন্তরালে  কালো কর্ম করে বেড়াই। মুখে মুখে সাধু সন্ন্যাসী আর তলে তলে ভাণ্ডারখানা গণ্ডার সেজে লুটে পুটে চেটে নিঃশেষ করে ফেলি। কবির তাই খেদোক্তি,

'হৃদয়ে আমার মুক্তির তৃষ্ণা।/বাহিরে আমি পতিতার মলাট'। (মলাট)

'একটি বিষণ্ন কবিতা' কবিতায় কবি দেশের দুর্দিনে কাতরতা প্রকাশ করেছেন। মানব সৃষ্ট দেশের দুর্যোগে কবি বড় বিষণ্ন এবং হতাশাগ্রস্ত। স্বস্তিশ্বাস নিতে তিনি পারছেন না। সকল কর্মের মাঝে অস্থির তিনি। হতাশার ধূম্রজালে ধূমায়িত জীবন তিনি চাননি৷ মুক্তিকামী মানুষ, সমাজ সচেতন মানুষ কিংবা নিরপরাধী মানুষ যদি সন্ত্রাসের বলি হন তবে কবি হৃদয়ে কেনো উচ্চারিত হবে না,

' জাতীয় পতাকার পতপত শব্দে/ একটি কথায় শুধু আলোচিত হচ্ছে /কী হলো কী হয়ে গেলো?' (একটি বিষণ্ন কবিতা)

 

বিদ্রোহী মনোবৃত্তি ফুঁটে উঠেছে 'মুক্তিকামী বীর সৈনিক' কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে। অন্যায়, অবিচার, ব্যভিচার কবি যখন দেখেন কবি হৃদয় ব্যাকুল হয়ে যায়। অগ্নিকুণ্ড হয়ে উঠে হৃদয়। প্রতিবাদী সত্তা জাগ্রত হয়। নির্যাতনকারী, নিগ্রহকারী, বিবেকহীনতা সমাজপতিদের দখলে। সদা জাগ্রত ও দেশকাল সচেতন কবি তাই লেখেন,

'লাল রক্ত শুকিয়ে যাবে/ কালো হয়ে যাবে দৃষ্টির অগোচরে/ তখনও সবুজ ঘাস চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাবে/ আমি জুলুম মানি না'। (মুক্তিকামী বীর সৈনিক)

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য স্থান পেয়েছে কবির কবিতায়। হাসান রুহুলের কলমের শক্তি অত্যন্ত প্রখর রূপ বৈচিত্র্য আর চিত্র বিন্যাসে। সৌন্দর্য সবাই দেখতে পান কিন্তু সাজিয়ে গুছিয়ে সবাই লিখতে জানেন না। বাংলার মোহময়ী রূপ লাবণ্য, সৌন্দর্য, সৌকুমার্য সাবলীল ছন্দে কবিতার ছত্রে ছত্রে ছান্দিক দোলাচলে লিখে গেছেন কবি। কবিতাটিতে বীর বাঙালির অকুতোভয়ের কথা স্বীকার করা হয়েছে। চেতনার বিদগ্ধ জলে স্নাত কবি কালের প্রবাহে গা না ভাসিয়ে স্রোতের বিপক্ষে বিদ্রোহ জাগাতে হস্ত আর মস্তকের সম্মিলনে লেখেন,

'বারান্দায় দুপুরের খাবার/বউ'র হাতপাখার বাতাস/ শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে দেওয়া/ আমার বাংলাদেশ '। (বাংলাদেশ)

 

রূপকথার আড়ালে, প্রচ্ছন্নতার আড়ালে অতি দার্শনিকতা আর প্রজ্ঞার পরিচয় দেন কবি। গ্রাম্য উপকরণ আর রূপকল্প কবিতায় দারুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। বিশ্বায়নের যুগে সাহায্য সহযোগিতার নামে পরাশক্তিধর দেশগুলি দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে দেশের সর্বনাশ করে চলে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো গরীব থেকে গরীবতর হচ্ছে। কবির কাব্যহৃদয় কাতর হয়ে উঠে ঠিক এভাবে,

'বিড়ালের চোখের মত জ্বলজ্বলে তারা নিভে দিওনা/ভোরের শিশির বিন্দু হিরের কণা নষ্ট করো না/ আমার দেশের সবুজ নিলাম ডেকো না'। (কবিতার পঙক্তিমালা)

 

'বসন্ত' কবিতাটি ছন্দময়। বনের বসন্ত   কবিতাটিতে ব্যাপক ব্যঞ্জনা দান করেছে। বনের বসন্ত চলে গেলেও মনের বসন্ত যায় না। প্রাকৃতিক অপরূপতা সাবলীল ছন্দে রচিত হয়েছে। বসন্ত এমনি ঋতু যে কোন হৃদয়কে নাড়া দিতে ভুল করে না আর কবি হৃদয় তো কাতর হবেই। হরেক রকম ফুল ফোঁটে, পাখির কূজনে নান্দনিক ব্যঞ্জনা, ব্যাকুল হৃদয় দ্বেরাজ কাতর হয়ে উঠে। প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে, হৃদয়ের খা খা ক্ষরণও দেখা দেয় বৈকি। হাসান রুহুলের ছন্দজ্ঞান প্রখর, তীক্ষ্ণ আর শাণিত ধারার, যেমন,

'বনে বনে ফুলেরা সব/ ছড়ায় ফুলের মৌ/ শাখায় শাখায় ডাকে পাখি/ বৌ কথা কও বৌ'। (বসন্ত)

 

মানুষ অত্যাচারিত হতে হতে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তবে প্রতিবাদের একটা সীমা থাকে। যতই ক্রোধাগ্নিতে নিবেদিত হয় না কেনো একা একা প্রতিবাদী হলে হিতে বিপরীত হয়। মা, বাবা, স্ত্রী, অনাগত শিশু ও বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যেয়ে কবি নিজেও রাইফেলের বাঁটের আঘাতে জ্ঞান হারিয়েছেন। বর্বরদের হাতে কবির স্ত্রী মৃত্যু বরণ করেছে বর্ণনা করতে যেয়ে কবি লেখেন,

'আঙিনায় পড়ে আছে অন্তঃসত্ত্বা মায়া/ ছাব্বিশ দিন পর জন্ম দিত বংশের প্রদীপ'। (প্রতিশোধ)

 

লেখাপড়া শেষ করে সবাই বের হয়ে পড়ে চাকরির খোঁজে। পেছনে পড়ে থাকে ক্যাম্পাস, শফি স্যারের ক্লাস। কেউ চাকরি পায়, সাজায় সংসার, কেউ হতাশার রংতুলিতে ডুবে যায়। কবি হতাশায় ডুবে যাওয়া একজন। আক্ষেপ করে লেখেন,

বন্ধুরা কেমন আছে নেই যোগাযোগ/র্যাগ ডেতে বলেছিলাম দেখা হবে বন্ধু কর্মখালির বিজ্ঞাপনে'। (দেখা হবে কর্মখালির বিজ্ঞাপনে)

 

প্রিয়ার ঠোঁটের চেয়ে, লাস্যময়ী তরুণীর বেলাল্লাপনার চেয়ে, নটির উদ্যাম নৃত্যের চেয়ে, উর্বশীর প্রেমের চেয়ে কবি কবিতাকেই বেশি ভালোবাসেন। কবি কবিতাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন,

'আমার অন্তিম চাওয়া/ মৃত্যুদূত যখন শিয়রে দাঁড়াবে/ তুমি তখন অন্তত শেষ আদরটুকু দিও'। (অন্তিম চাওয়া)

 

তৃষ্ণার্ত হৃদয় সব সময় বেশি চায়। আর তা না পেলে হৃদয় কোন এক সময় লাশে রূপান্তরিত হয়। অথচ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের মাঝেও আছে মহিমান্বিত করার ক্ষমতা। তাদেরকে অবজ্ঞা করার কিছু নেই। কবি লেখেন,

'গোলাপ জবা বকুলের ভীড়ে/ অনাদরে জন্ম নেয়া কাশফুল জঞ্জাল/ গোধূলি বেলায় হাসনাহেনার সুরভিত সুবাসে/ ধুতরা ফুল চোখের বিষ'। (তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের লাশ)

 

প্রিয় মানুষের স্বপ্ন দেখতে মন ভালোবাসে। প্রিয়ার তীক্ষ্ণ চাহনীতে চেয়ে চেয়ে, মজা করতে, গল্প করতে করতে সময় চলে যায়। আসে সামনে মৃত্যুদূত। কবির ভাষায়,

'যমদূত এসেছো তুমি আমার শিয়রে/ নিস্তার নেই আজি তোমার আহ্বানে/ ওগো মহাকাল কিছু সময় দাও একটু কৃপা করে/ শেষ পূজা দিয়ে নেই আমার প্রিয়ার তরে'। (শেষ পুজা)

 

মাঝির সাথে তার প্রেয়সীর ছন্দে ছন্দে মান অভিমান, ভালোবাসার কথা বন্দিত হয়েছে। যেমন,

'মাঝিঃ লক্ষ্মী পাখি কলিজা আমার/হাসো একটু খানি,/ প্রেয়সীঃ দুষ্টমী না করে/ ছাড় আঁচল খনি'। (রাগ করো না কিনে দেবো চুড়ি)

 

কাউকে ভালোবেসে ক্ষত বিক্ষত হলে পৃথিবীকে মরীচিকা মনে হয়। কবির বর্ণনায়,

'সুখ সেতো বসনবিহীন নর্তকীর শরীরের মাংসের তুফান/ আর পতিতার দেহে বিলাসের নেশায়।/ জীবন সেতো প্রতি রাতে এক পাতা সিডাক্সিন'। (মরীচিকা)

 

মানুষ বাস্তবতার যাতাকলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, খুঁজে পায় না জীবনের মোড়। অশান্ত মন অমানিশার অন্ধকারে ঘুরপাক খায়। কবির বর্ণনায়,

না, স্বপ্ন কেড়ে নেবে না/ তোমার মনের মরীচিকায়/ পিপাসিত বিভ্রান্ত পথিক আমি/ তোমার দেহের মায়াবী খোলসের / বিচ্ছুরিত অপয়া রশ্মিতে খুঁয়েছি/ হৃদয়ের দৃষ্টিশক্তি'। (বিভ্রান্ত পথিক)

 

সুখের শেষ নেই, সুখের অনেক রং। সুখ আপেক্ষিক। কে কিসে সুখী বলা মুশকিল। কেউ আধপেটাতে সুখী, কেউ সব পেয়েও অসুখী। সুখের আশায় দিন যায়, দিন আসে। ভাবি ক্ষত সেরে গেলে সুখ আসবে। সুখ থাকে অধরা। মৃত্যু নামক অতি সত্য সামনে এসে হাজির হয়। কবির কথায়,

'কখন যে চাঁদ হারিয়েছে আঁধারের গায়/ বুঝতে পারিনি/ এভাবে জীবনে তিমিরের আগমন হয়েছে / বুঝতে পারিনি'। (লাল রঙের সুখ)

 

বড় অসময় এখন। সবাই সব সয়ে নিচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করছে না। এই দুঃসময়ে কবি নজরুলের মতো একজন প্রতিবাদী কলম সৈনিক কামনা করেছেন। তাঁর লেখনিতে বিধাতাকে উদ্দেশ্য করে,

তোমার নিকট দাবী একটাই/ ফরিয়াদ করিয়া যাচাই/ এখন নজরুলের বড্ড প্রয়োজন/ তাই একটি নজরুল চাই'। (আর একটি নজরুল চাই)

প্রেয়সীকে ভালোবাসার অনন্য ভাব আছে 'ভালবাসি' কবিতায়। প্রিয়ার মলিনতাকেও কবি যত্ন করে ভালোবাসেন। কবি বলেন,

'তোমাকে প্রেম দিয়ে আমি ঋণী/ আগুনের মত তোমার প্রতি ভালবাসা/ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে'। (ভালবাসি)
অপশক্তির হানা আমাদের দোচালা ঘরে৷ প্রতীকী উপমায় কবি লেখেন,

 'বোঁদকা গন্ধে দোসর শুয়োর ঘোঁৎঘোঁৎ করে/ ব-দ্বীপের কচুক্ষেতে'। (দাঁতাল শুয়োর)
কবির ১৯ ও শেষতম কবিতা 'পরিবর্তন চাই'। অদ্ভূত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ৷ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে সজ্জন। কবি অদ্ভূত এবং উদ্ভট উঠের পরিবর্তন চান সবার মঙ্গলার্থে। কবি লেখেন,

'হাসনাহেনার দল গন্ধ ছড়ায় না আর/ ফুলেরা সব হরতাল করেছে/ ড্রাইভার পরিবর্তন চাই'। (পরিবর্তন চাই)
জিহাদ হোসেনের কবিতার ছত্রে ছত্রে দেশের কথা, দেশ নিয়ে উদ্বেগের কথা, মনের কথা, প্রেমিকার প্রতি নিবেদিত আত্মার সমর্পণ, বিশ্বাসের কথা, রাজনীতির ডামাডোলের কথা, খেটে খাওয়া মানুষের জীবনবোধের কথা, সমাজের নানা প্রকার অসংগতি বিসংগতির কথা দারুন ভাবে স্থান করে নিয়েছে। মানুষের মনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বাক-স্বাধীনতা সব যেন কবির কলম দিয়ে অবলীলায় বের হয়েছে। অন্যায়ের পাল্লা কেনো ভারি হচ্ছে, কেনো সুশীলের স্থান পশ্চাতে যাচ্ছে, কেনো সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে, কেনো গণ্ডমূর্খদের হস্তগত হচ্ছে সব কবির কবিতাগুলোতে সে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা দৃশ্যমান। অধুনান্তিক কবিদের মতই তাঁর কবিতায় রয়েছে শব্দ নির্বাচনে মননশীলতার পরিচয়। কবিতা নির্মাণে মগজ-মস্তিষ্কের নিবেদন প্রশংসার দাবি রাখে। সব মিলে জিহাদ হোসেন আপাদমস্তক মানুষ, সমাজ ও দেশের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ কবি। 'লাল রঙের সুখ' কাব্যগ্রন্থে তাঁর ২০টি কবিতা আছে। আমার উপলব্ধি তুলে ধরলাম।

নোংরা রাজনীতির কারণে কবির চোখে স্বাধীনতা খুন হয়ে যাচ্ছে। লজ্জায়

'পাটের গাছ মাথায় নিচু করে বাঁচতে চায়'

এমন বাক্য কবি লেখেন। আরো লেখেন
 
'আজ জাতির বিবেক ঝুলছে ফাঁসির দড়িতে'।
 
কবির কলমে  ঝাঁঝালো শক্তি আছে তা দৃশ্যত। লেখেন,

গণতন্ত্রের হাতে আজ স্বাধীনতা খুন'। (স্বাধীনতা খুন)

 

কবির 'কবিতা' কবিতাটি পড়তে যেয়ে দেখি কবিতা লিখতে যেয়ে কবি দেখেন চৌদিকে সহিংসতা। সহিংস সড়ক, বার্ন ইউনিটে মানুষ, আহত, থ্যাতলানো মানুষ। কবি লেখেন,

'সময়টা এত বীভৎস' যা কবির কলমে লেখা আনছে না।
আরো আক্ষেপ করে লেখেন,

 'হারিয়ে গেলো অধিকার'। পড়লে চিন্তার সদর দরজা খুলে যায়।

 

নষ্ট রাজনীতির কারণে কবি স্বাধীনতার মানে খুঁজে পান না। 'বাতাসে নেই অক্সিজেন' বলে কবি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কবি ক্ষোভের বশে গণতন্ত্র চান না, চান না রাজনীতি। কবি চান,

কেবল বাঁচার অধিকার চাই/রক্তে কেনা পতাকার কাছে'। (নষ্ট রাজনীতি)

 

বৈশাখী মেলার নামে কবি অশ্লীলতার স্রোত, উলঙ্গ সংস্কৃতির ঘৃণা করেছেন। যে উৎসবের সম্পর্ক মায়ের সাথে, মাটির সাথে, বিশ্বাসের সাথে কবি সেই উৎসবে কোনো অশ্লীল বিষবাষ্প চান না। এই অসময়ে কবি মেলায় যে আনন্দ তাও  পান না। কবি লেখেন,

সুবাসিত ফুল আজ বন্দি কাঁচের ঘরে/সুবাস ছড়ালেই দণ্ড'।(বৈশাখী মেলা)

 

ভালোবেসে কবি কোন একজনকে আপন করে নিয়েছিলেন। প্রেয়সীকে বর্ণনা করতে যেয়ে কবি লেখেন,

'চুলের ভাজে আবীর মাখিয়েছিলে/ শরীর অমাবস্যায় ঢাকা,/ আঁখি যুগল গহীন অরণ্যের পাখির নীড়'। (বন্ধুত্ব)
 
কিন্তু এক পশলা কথা কাটাকাটিতে কবির সে বন্ধু কবিকে ছেড়ে চলে গেছে। 

প্রকৃতির বর্ণনা করতে করতে পুকুরঘাটে এক অপূর্ব রূপসীকে দেখে কবি পাগলপ্রায় হন। যে রূপসীর কপালে ছিলো লালটিপ মুগ্ধ করার মতো। তাকে উদ্দেশ্য করে কবি লেখেন,

'প্রথম আজ হিংসা হল/ কপালে ঐ টিপ দেখে/ টিপে তোমায় বেশ মানিয়েছিলো/ টিপ সরাও নইলে থমকে থাকবে পথচলা'। (লাল টিপ)

 

কোন এক 'তুমি' র পেছনে কবি ছোটেন। কিন্তু সেই 'তুমি' র দেখা পান না। নানা উপমায় আর উপদেশে প্রেয়সীকে কবি সাজান।

'ব্যথা দিলে ব্যথা পাবে/ ভালোবাসায় জীবন পাবে'

 

বলে কবি আরো লেখেন,

'তোমায় নিয়ে কাব্য লিখবো শতশত/ অম্লান সবুজ এক অমর বৃক্ষের প্রতীক্ষায়'। (শূন্যতা)

 

খেলাচ্ছলে কাউকে আঘাত করা ঠিক না। নিজের খেলার জন্য অন্যের জীবন নিয়ে খেলা ঠিক না। কাউকে আশা দিয়ে নিরাশা করা ঠিক না। কবি লেখেন,

'হৃদয়টাকে মাটির হাড়ির মতো ভেঙে ফেলেছো/ জোড়া দেবে কীভাবে?/ বন্ধ কর তোমার নোংরা খেলা'। (খেলা)

 

যা ঘটছে তা হয়ত আমরা জানছি না। কুকুর বিড়ালের অত্যাচারে শান্তিপ্রিয় জোনাকীরা ঘুমাতে পারে না। চারিদিকে শকুনদের দাপাদাপি যারা অশান্তি সৃষ্টি করছে। কবি লেখেন,

'চারদিকে লাশের মিছিল/ একটাই দাবি/ কী দোষ ছিল আমাদের/ আজও কোন উত্তর মেলেনি'। (একটাই দাবি)

 

অনেক সংগ্রাম শেষে আমরা যে বাংলা পেয়েছি তা 'মণি মুক্তা স্বর্ণের খনি বিপুল সাম্রাজ্য' সমান। আজ ব্যর্থতা, পরাজয়ের কোন গ্লানি নেই। কবি লেখেন,

'আমি পা বাড়িয়েছিলাম/ আশাহীন অন্ধকারের পথে।/ আজ বুক ভরে শ্বাস নিই/ আমার বাংলায়'। (আমার বাংলা)

 

নারীর কথনে 'কথা' কবিতাটি। যেখানে প্রিয় মানুষের কাছে কথা অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি চাওয়া হচ্ছে, সে কথা পেলে প্রিয়া বেণী করে রাখবে, ওষুধ করে খাবে। আরো লেখেন,

'অনুভব করতে পারবে না/ সামান্য কথা কতটা শান্তি দেয়,/ অস্থির ভাবান্তর মনকে/ নিমেষেই করে দেয় ভাবনাহীন'। (কথা)

 

থমকে গেছেন কবি সমসাময়িক বিষয় বিবেচনা করে। দেশমা দগ্ধ, দেশ মায়ের গায়ে পঁচন লেগেছে বলে কবি মনে করেন। সংবাদ শিরোনাম জুড়ে শুধু মৃত্যু। কবি লেখেন,

'আজ আমার কাব্যবিলাস/ জুলুম, নির্যাতন, দুঃসময় ও দুর্ভাবনা/ বুলেট, বুলডোজার, দাবানল জ্বলছে/ জলকামান, টিয়ারশেল তাড়া করে ফিরছে'। (কাব্যবিলাস)

 

মন মানসী ছাড়া জীবন পূর্ণতা পায় না, তাকে ছাড়া কবিতা লেখা যায় না, কাব্যরস হারিয়ে যায়। রাত্রি হয়ে উঠে নিস্তব্ধ, সঙ্গী হয় দীর্ঘশ্বাস। কবি আক্ষেপ করে লেখেন,

'ভুলে গেছি আজ তোমায়/ সত্যি বলছি শুধুই আছো ধূলোপড়া স্মৃতিতে'। (তুমি আছো)

 

স্বাধীনতার এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাধীনতার স্বাদ কেউ পাচ্ছে না বলে কবি মনে করেন।

'আজও বন্দুকের নলের সামনে স্বাধীনতা গুমড়ে কাঁদছে/ নরপশুগুলো আজও ইজ্জত লুটছে লক্ষ মা বোনের'। (স্বাধীনতা)

 

বিষাদে কবির মন ছেঁয়ে গেছে। না পাওয়ার হাহাকার, অন্যের অবিবেচনামূলক কাজে কবি বিমর্ষ।

'আমি মৃত্যু বিরোধী নই/ তাই মৃত্যু সমুদ্র আমার বন্ধু'।

 কবি এছাড়াও লেখেন,

'পথ চলতে পারছি না/ যেন ঘূর্ণিস্রোতে পা দুটো থেমে গেছে'। (বিষাদ রঙ)

 

বসন্তের বর্ণনায় কবি সিদ্ধহস্ত। দখিনা দুযার, ফাগুন বাতাস, প্রজাপতির পাখা, পূর্ণিমার চাঁদ কবির লেখার উপমা। কবি লেখেন,

'শিল্পীর হৃদয় ভাঙতে পার/ গড়তে নাহি জানো,/ কোকিল হয়ে কেন তুমি / বসন্তে নাহি ডাকো'। (বসন্ত)

 

কোনো এক গাঁয়ের মেয়ের প্রেমে কবির মাঝি মন নোঙর ফেলে। তাকে কবি নানা উপমায় সাজান। কবি লেখেন,

'দেহখানি কলমিলতা/ কাজল কালো ডাগর আঁখি/ মন যে আমার চাইছে তারে/ সারাটিক্ষণ বেঁধে রাখি'।(নোঙর)

 

সরকারি আমলাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কবি। কবি লেখেন,

'আমরা ধাবিত হচ্ছি/ ভয়ংকর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে/ যার নেই আয়তন, ভর'।

 

কবির দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কবি আরো লেখেন,

'অত্যাচারীর গায়ে আগুন হয়ে জ্বলতে পারি/ জালেমকে মারতে পারি'। (যেতে পারি অবশেষে)

 

এ সমাজের অলিতে গলিতে বিড়াল, কুকুর আর দৈত্যদের বাস। তারা অত্যাচারী, সমাজের কীট বলে কবি মনে করেন। কবি লেখেন,

'মুহূর্তে মনে আতঙ্ক কি যেন হয়/ মনুষ্য সভ্য সমাজে শুকরের বাস/ সমাজ আজ অবরুদ্ধ/ কুকুরের বিষদাঁতের সামনে'। (সভ্য সমাজ)

 

রাজপথে সংগ্রামরত মানুষের নির্মম মৃত্যুর একটা চিত্র আছে 'তীব্র ভুলগুলো' কবিতায়। হরতালে বাঁধা জনজীবন। সড়কে বেরিকেড। পড়ে আছে রাস্তায় লাশের স্তূপ। সেদিকে চেয়ে কবি লেখেন,

'রক্তমাখা চোখে চেয়ে আছি/ ভাবছি/ আমার তীব্র ভুলগুলো'। (তীব্র ভুলগুলো)

 

পরিশেষে বলবো, কবি হাসান রুহুল ও কবি জিহাদ হোসেন একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। উভয়ের কবিতাতেই রয়েছে বজ্র-বারুদ নিনাদ চিন্তা, বিদ্রোহের তেজ, তেমনি রয়েছে কোমল মনের প্রকাশ। উভয়ের কবিতাতে রয়েছে উপমার বলিষ্ঠ প্রয়োগ, সময়োচিত চিন্তা, সমসাময়িক দৃশ্যপটের নান্দনিক প্রকাশ এবং সমাজকে ধাক্কা দেয়ার প্রয়াস। উভয় কবিই তরুণ, তরুণদের রক্ত কত বেশি ঝাঁঝালো তা তাঁদের কবিতা পড়লে বোধগম্য হয়। উভয় কবিই সমাজকে কষাঘাত করেছেন, রাজনীতিবিদদের দিকে তীর ছুঁড়ে মেরেছেন, অপশক্তির প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কবিদ্বয়ের কবিতা পড়ে বোধগম্য হয়েছে যে, তরুণরাই সমাজকে বদলে দেবে একদিন। কবিদ্বয়ের প্রতি শুভকামনা থাকলো এবং তাঁদের কাব্যজীবন বর্ণিল হোক এ প্রার্থনা থাকলো।

===================
লাল রঙের সুখ
কবিদ্বয়- হাসান রুহুল ও জিহাদ হোসেন
প্রচ্ছদ- নাসির আহমেদ নাইস
প্রকাশনি-সৃষ্টি প্রকাশন, বগুড়া
প্রথম প্রকাশ- একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৪
স্বত্ব- কবিদ্বয়
পৃষ্ঠা-৫৬
মূল্য-১৫০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ