মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞান কল্পকাহিনি "জলজ": রহস্যময় পাঁচ গল্পের পঞ্চ-স্বাদ - সৌমেন দেবনাথ

মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞান কল্পকাহিনি "জলজ" বইয়ের আলোচনা- সৌমেন দেবনাথ

মুহম্মদ জাফর ইকবাল (জন্ম: ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৫২, সিলেট) হলেন একজন বাংলাদেশী কথাসাহিত্য ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক, কলাম লেখক, পদার্থবিদ, শিক্ষাবিদ ও আন্দোলনকর্মী। তাঁর লেখা কিছু উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত একই বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। দাম্পত্যসঙ্গী- ড. ইয়াসমীন হক, সন্তান- নাবিল ইকবাল (পুত্র), ইয়েশিম ইকবাল (কন্যা), আত্মীয়- হুমায়ূন আহমেদ (ভাই), আহসান হাবীব (ভাই)। তাঁর পিতা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। বাবা ফয়জুর রহমান আহমদের পুলিশের চাকরির সুবাদে তাঁর ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল। পিতা লেখালেখির চর্চা করতেন এবং পরিবারের এই সাহিত্যমনস্ক পরিবেশে জাফর ইকবাল খুব অল্প বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন। তিনি তাঁর প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন সাত বছর বয়সে। ১৯৭১ সালের ৫ মে পাকিস্তানী আর্মি এক নদীর ধারে তাঁর পিতাকে গুলি করে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া জাফর ইকবালকে পিতার কবর খুঁড়ে তাঁর মাকে স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারটি বিশ্বাস করাতে হয়েছিল। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বড় ভাই এবং রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদের সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট, সাহিত্যিক আহসান হাবীব তাঁর ছোট ভাই। তাঁর বোন তিনজন- সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহীদ ও রুখসানা আহমেদ। কন্যা ইয়েশিম ইকবাল তাঁর কিশোর উপন্যাস 'আমার বন্ধু রাশেদ' ইংরেজিতে রূপান্তর করেছেন Rashed, my friend নামে। জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই লেখালেখি করেন। তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক গল্প 'কপোট্রনিক ভালোবাসা' সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি পড়ে একজন পাঠক দাবি করেন সেটি বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা। এর উত্তর হিসেবে তিনি একই ধরনের বেশ কয়েকটি বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায় লিখে পাঠান। তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে এই গল্পগুলো নিয়ে 'কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এই বইটি পড়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম প্রশংসা করেন। আমেরিকাতে বসেই তিনি বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনা করেন। দেশে ফিরে এসেও তিনি নিয়মিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লিখে যাচ্ছেন, প্রতি বইমেলাতে তাঁর নতুন সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী প্রকাশিত হয়। (তথ্য-উইকিপিডিয়া)

তাঁর রচিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি "জলজ" এ পাঁচটি গল্প রয়েছে। পাঁচটি গল্পের মূল কাহিনি তুলে ধরলাম।


ড. ট্রিপল-এ (পেজ ৭-৪৫)

কাহিনি সংক্ষেপ:

আবিদ হাসান প্রজেক্ট ম্যানেজার একটি সফটওয়্যার কোম্পানীর। তাঁর স্ত্রী মুনিরা হাসান গৃহিণী। তাঁদের বারো বছরের মেয়ে নীলা কুকুর পুষবে বাহানা ধরে। বাবা মায়ের রাজি করায়। আবিদ মেয়েকে নিয়ে কাটাবন কুকুর কিনতে যান। কুকুর পছন্দ হয় না। জানতে পারেন টঙ্গীতে ভালো কুকুর পাওয়া যাবে। নীলাকে নিয়ে আবিদ টঙ্গীতে যান। কিন্তু প্রথমে দারোয়ান ঢুকতে দেয় না। 'পেট ওয়াল্ড' এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ওয়াকি টকিতে দারোয়ানকে নির্দেশ দেন আবিদ ও তাঁর মেয়েকে প্রবেশের। রিসিপশনিস্ট জেরিন দুজনকে ডক্টর ট্রিপল-এ অর্থাৎ ডক্টর আসিফ আহমেদ আজহারের কাছে নিয়ে যান। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে পোষা পশু-পাখির বিশাল মার্কেট তাই এক্সোপোর্টের জন্য আজহার এই 'পেট ওয়ার্ল্ড' খুলেছেন (আমেরিকার অর্থায়নে) সাড়ে তিন বিলিওন ডলার খরচ করে। জেনেটিং ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে অসাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কুকুর তৈরি করা এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য। এসবের উপর আজহার গবেষণা করেছেন, তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো, 'আইসোলেশান অফ জিন্স রেসপন্সিবল অফ ইনটেলিজেন্স ইন কেনাইন ফেমিলি'।

অসাধারণ বুদ্ধিমান কুকুর তৈরি করায় তাঁর একটা পেটেন্ট আছে। নীলার কুকুর পোষার আবদার আজহার সাহেব পূরণ করেন একটি আইরিশ টেরিয়ার কুকুর দিয়ে, যার নাম দেয় নীলা 'টুইটি'। কিন্তু কুকুরটি নীলাকে দেয়া হয় বিনামূল্যে যার দাম সাড়ে সাত হাজার ডলার। বিনামূল্যে দেয়া হয় কারণ কুকুরটি পরীক্ষামূলক তৈরি করা হয়েছে, মানুষের সাথে কেমন আচরণ করে তা জানার নিমিত্তে। টুইটির অস্বাভাবিক বুদ্ধিতে আবিদ, মুনিরা ও নীলা বিস্ময় প্রকাশ করতে থাকে। একদিন আবিদ কুকুরটির মাথায় হাত দিয়ে দেখে কুকুরটির মাথায় অপারেশন রয়েছে। আবিদের সন্দেহ হয়। তিনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে জানতে পারেন জেনেটিং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আজহার সাহেবের কোন পেটেন্ট নেই। তাঁর পেটেন্টের বিষয়, 'এক প্রজাতির প্রাণীর ভেতরে অন্য প্রজাতির প্রাণীর টিস্যু বসানো' এর উপর। আবিদ ধরে ফেলেন সাধারণ একটি কুকুরের মাথায় মানুষের মস্তিষ্ক লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে ডক্টর আজহার যে দাতব্য সেবা প্রতিষ্ঠানে প্রসূতি মায়েদের সেবা দিতো মূলত সেখান থেকে ভ্রূণ সংগ্রহ করে কুকুরের মস্তিষ্কে লাগানো হতো। আবিদ বিষয়টি সব জেনে গেছে বলে আজহার তাঁকে খুন করার জন্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের দুজন খুনীকে পাঠান। পালায়ে বাঁচেন আবিদ। রমনা থানা অভিমুখে যাত্রা করলে এক মেক্সিকান সন্ত্রাস রিভলবার ঠেকিয়ে তাঁকে উঠিয়ে আনে। আজহার বন্দি আবিদকে মেরে অপচয় না করে তাঁর মস্তিষ্কটা কাজে লাগাতে চান। বিশাল কুকুর 'গ্রেট ডেন' এর মস্তিষ্ক ট্রান্সপ্লান্ট করবেন আবিদের মস্তিষ্ক দিয়ে। আবিদ ভয় পেয়ে যান। সিরিঞ্জে ওষুধ টেনে আবিদকে অজ্ঞান করতে গেলে আবিদ রড দিয়ে আজহারকে আঘাত করে সেই সিরিঞ্জ আজহারকেই পুশ করে পালিয়ে চলে যান।

বছর দুয়েক পর সার্কাসের বিজ্ঞাপন দেখে আবিদ 'বুদ্ধিমান-কুকুরের কলা-কৌশল' শীর্ষক সার্কাস দেখতে যান। গ্রেট ডেন কুকুর খেলা দেখায়। কুকুরটি আবিদকে দেখেই ক্ষেপে যায়, আবিদও কুকুরটিকে ড. ট্রিপল-এ ডেকে রসিকতা করে।


দ্বিতীয় জীবন (পেজ ৪৬-৫৭)

কাহিনি সংক্ষেপ:

ভাড়াটে খুনী মাজহার। দুই হাজার টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করে। কয়েসের বড় কোন অপরাধ নেই, তবুও তাকে কে বা কারা খুন করতে বলেছে সে জানে না। মাজহার তাকে কনুইয়ে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে হত্যার জন্য নির্জন নদী পাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েস বাঁচার আকুতি করে, স্ত্রী, দুই বছরের ছেলের কথা বলে, আল্লাহর কসম দিয়ে বাঁচতে চায়। নিষ্ঠুর মাজহার কয়েসের পিঠে লাথি মারে, হা হা করে হাসে। কয়েসকে মাজহার দুই হাজার টাকার বিনিময়ে কেনো মারবে, তাই সে পঞ্চাশ হাজার টাকা অফার করে, যেনো সে তাকে না মারে। মাজহার দায়িত্বশীল ব্যক্তি, পার্টির প্রতি অনুগত, বেঈমানি করবে না, তাই বড় লোভনীয় অফার পেয়েও তাকে বেঢপ টাইপের রিভলবার দিয়ে মেরে ফেলে।

কয়েস মারা যাওয়ার পর কয়েস জানতে পারে তাকে যে হত্যা করেছে সে আসলে মাজহার নয়, সে মাওলা বকশ। কিন্তু সে জানছে কি করে? কয়েস জানতে পারছে মাওলা বকশ ট্রিগার টেনে তাকে মেরেছে। অশরীরী আত্মারা এসে কয়েসের প্রশ্নের উত্তর দেয়,

'তুমি আমি বলে কিছু নেই, সবাই এক'।

কিন্তু কয়েস কাউকে দেখতে পায় না। কয়েস দেখতে চাইলো, পুরো পৃথিবী তার সামনে স্পষ্ট হলো। পৃথিবী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েস মাজহারকে দেখতে চাইলো, দেখতে পেলো মাথায় সে রিভলবার ধরে আছে। তাহলে কি আমি মরে গেছি? অশরীরী আত্মার উত্তর,

'আসলে জন্ম-মৃত্যু বলেও কিছু নেই। এখানে সবাই মিলে একটি প্রাণ। একটি অস্তিত্ব। একটি প্রক্রিয়া'।

কয়েস মাজহারকে বুঝতে চায়। মাজহার হচ্ছে একটি ছোট পরীক্ষার নাম। ছোট কৃত্রিম পরীক্ষা। অপ্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া, মূল্যহীন প্রক্রিয়া। মাজহারকে বুঝতে যেয়ে কয়েস মাজহার হয়ে যায়। সে জুটমিলের মেকানিক। কম বয়েসী স্ত্রী আছে, বখে যাওয়া পুত্র আছে, তার শৈশবের দুঃসহ জীবন, অমানুষিক নির্যাতন, বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা আছে। কয়েস চেতনার আনাচে কানাচে ঘুরে বলে আমি মাজহারকে আর বুঝতে চাই না। কয়েস এবার নিজকে নিয়ে থাকতে চায়। অশরীরী আত্মার উত্তর,

'নিজ বলে কিছু নেই। তোমার মুক্তি হয়েছে। তুমি এখন সব। তুমি এখন আমার বিশাল অস্তিত্বের অংশ '।

কয়েস এবার পিছনে ফিরে যেতে চান, যখন তাকে মাজহার হত্যা করে ঐ অংশটুকু দেখবে তাই। কয়েস সব দেখতে পায়। মাথায় তাক করে রিভলবার ধরে আছে মাজহার। কয়েস বলে,

'আপনার আসল নাম মাওলা বকশ'।

মাজহার আশ্চর্য হয়ে বলে,

'তুই কি করে আমার নাম জানিস?'

কয়েস বলে,

'আমি জানি। আপনি আর আমি তো আসলে একই মানুষ'।

দ্বিতীয় জীবন গল্পে কয়েসের মৃত্যুর পূর্বে কিভাবে তাকে মারা হয় অর্থাৎ পার্থিব জীবনের চিত্র আছে। আর কয়েসের মৃত্যুর পর কয়েসের আত্মার জাগ্রত রূপ চিত্রিত যেখানে কতিপয় অশরীরী আত্মার সাথে তার কথা হয়। মৃত্যু আসলে তুচ্ছ, মহাঅস্তিত্বে মিশে যাওয়ার একটি অংশ।


সোলায়মান আহমেদ ও মহাজাগতিক প্রাণী (পেজ ৫৮-৬০)

কাহিনি সংক্ষেপ:

দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি সোলায়মান আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে চল্লিশজন সাংবাদিককে ডেকে ব্রিফ করছিলেন যে, কোন এক মহাজাগতিক প্রাণী তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। সাংবাদিকরা উৎসুকের সাথে সোলায়মান সাহেবের কথা শোনেন আর ছবি তুলতে থাকেন। কিভাবে ধরে নিয়ে গেলো, কোথায় ধরে নিয়ে গেলো, সেখান থেকে পৃথিবী দেখা যায় কিনা, মহাকাশযানের কোন ছবি, কোনো জিনিস, কোনো তথ্য আছে কিনা সাংবাদিকরা জানতে চান। সোলায়মান সাহেব কিছুই বলতে পারেন না, শুধু বলেন,

'আমার কাছে কোন তথ্য নেই, তবে আমার পকেটে যে নোটবই ছিলো সেই নোটবইয়ে আমার বলপয়েন্ট কলম দিয়ে আমি সেই মহাজাগতিক প্রাণীর একটা ছবি এঁকেছিলাম। ভরশূন্য অবস্থায় ভাসছিলাম বলে ছবিটা ভালো হয়নি। কিন্তু সেটা একমাত্র তথ্য'।

এক সাংবাদিকের ছেলে নাম সাগর, স্কুল আগে ছুটি হওয়ায় বাবার সাথে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকে। বাবাকে বাড়ি যেতে তাগাদা দেয়, কেননা সোলায়মান সাহেব গোল মারছেন। সাংবাদিকরা ছোট শিশু সাগরকে এবার প্রশ্ন করেন, কেনো তার মনে হলো সোলায়মান সাহেব মিথ্যা বলছেন? উত্তরে সাগর বললো,

ভরশূন্য জায়গায় বলপয়েন্ট কলম দিয়ে লেখা যায় না। কালিটা নিচে চুইয়ে আসতে হয়-খাড়া দেয়ালেও লেখা যায় না-আসলে উল্টো করে ধরলেও লেখা যায় না-'

শিশুটির কথা শুনে বিশিষ্ট শিল্পপতি সোলায়মান আহমেদ ধরা খেয়ে যান এবং সাংবাদিকদের সামনে থেকে পালিয়ে যান। সাংবাদিকরা হাসাহাসি করতে থাকেন।


মহাজাগতিক কিউরেটর (পেজ ৬১-৬৫)

কাহিনি সংক্ষেপ

মহাজাগতিক কাউন্সিল দুটি প্রাণীকে কিউরেটরের দায়িত্ব দিয়ে গ্রহ নক্ষত্রে ভ্রমণ করে করে সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীদের সংগ্রহ করতে বলা হয়। তাই প্রাণী দুটি সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ অর্থাৎ পৃথিবীতে আসে, এসে দ্বিধায় পড়ে বুদ্ধিমান প্রাণী না খুঁজতে পেরে। তারা প্রথমে ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া নিতে চায় কিন্তু তাদের গঠন সহজ আর তাদের মাঝে বৈচিত্র্য না থাকায় নিলো না। পরে হাতি বা নীল তিমি নিতে চায়, কিন্তু আকারে বড় এবং সংরক্ষণ করা কঠিন বলে নিলো না। এরপর সাপ নিতে চায় কিন্তু সরীসৃপ সাপ দেহের তাপ নিযন্ত্রণ করতে পারে না, ঠাণ্ডায় স্থবির হয়ে পড়ে, এবং প্রাণীজগতে পিছিয়ে পড়া প্রাণী বলে নিলো না। পরে পাখি নিতে চায়, কিন্তু পাখিদের বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন নেই বলে নিলো না। এরপর স্তন্যপায়ী প্রাণী বাঘ নিতে চাইলো কিন্তু বাঘ একা থাকতে পছন্দ করে এবং তারা সামাজিক প্রাণী নয় বলে নিলো না। পরে কুকুর নিতে চাইলো, কুকুরকে মানুষ পোষ মানিয়েছে, তার স্বকীয়তা লোপ পেয়েছে বলে নিলো না। পরে তৃণভোজী হরিণকে নিতে চাইলো, কিন্তু তৃণভোজী প্রাণী দীর্ঘক্ষণ লতাপাতা, ঘাস খায় বলে নিলো না। এরপর মানুষ নিতে চাইলো, মানুষ বুদ্ধিমান, শ্রমিক, সৈনিক, শহর-বন্দর, নগর, বিশাল বিশাল অট্টালিকা করছে, চাষাবাদ করছে, পশুপালন করছে, দলবদ্ধভাবে থাকে। কিন্তু তারা সভ্যতা ধ্বংস করছে, দূষিত করছে, তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়াচ্ছে, ওজন স্তর শেষ করছে, বনভূমি কাটছে, নিউক্লিয়ার বোমা ফেলেছে, যুদ্ধ করছে, এরা বুদ্ধিমান প্রাণী নয়। তাই মানুষকেও নিলো না।

পরে তারা একটি বুদ্ধিমান প্রাণী খুঁজে পেলো, যারা সামাজিক প্রাণী, দলবেঁধে থাকে, শ্রমিকও সৈনিকও, বংশ বিস্তার করে, বিশাল বাসস্থান তৈরি করে, সুশৃঙ্খলভাবে থাকে, বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আত্মদান করে, ঝগড়া বিবাদ করে না, সুবিবেচক, খাবার জমিয়ে রাখে দুর্দিনের জন্য, দিশেহারা হয় না, প্রকৃতির ক্ষতি করে না, পরিশ্রমী, নিজের শরীরের চেয়ে দশগুণ ওজনের জিনিস বহন করতে পারে। ডাইনোসরের যুগ থেকে বেঁচে আছে, পৃথিবী ধ্বংসের পরও বেঁচে থাকবে। দুজন মহাজাগতিক কিউরেটর সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ থেকে কয়েকটি পিঁপড়া তুলে গ্যালাক্সীর অন্য নক্ষত্রে রওনা দিলো।


জলজ (পেজ ৬৬-৯৪)

কাহিনি সংক্ষেপ:

ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জের বিজ্ঞান একাডেমি থেকে রোবট ক্রন, আধা জৈবিক আধা বায়োবট কীশ ও ক্রোমিয়াম ক্যাপসুলে মোড়া মানুষ য়ুলকে সাথে করে ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে সূর্য নামক সাদামাটা একটি নক্ষত্রের কক্ষপথে আটকে পড়া সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবীতে আসে গবেষণার জন্য। যে পৃথিবীতে য়ুলের পূর্বপুরুষের জন্ম হয়েছিলো  সেই পৃথিবীতে প্রাণের কোন চিহ্ন নেই, মানুষ অবিচকের মতো নিজেদের ধ্বংস করে ফেলেছে। পৃথিবীতে শুধু আছে কীছু কীটপতঙ্গ, অত্যন্ত নিম্নশ্রেণির সরীসৃপ, শৈবাল ও ফার্ন জাতীয় কিছু উদ্ভিদ। শহরঘাটে ফাটল, দালান ধসে আছে, রাস্তাঘাটে ফাটল, ভয়ংকর মন খারাপ করা দৃশ্য। মহাকাশযানে ক্রন থেকে, কীশ ও য়ুলকে বিদায় দেয়, কীশ এবং য়ুল আন্তঃগ্রহ নভোযানে করে ভেসে ভূ-পৃষ্ঠে চলে আসে। কীশ একটি ক্রিস্টাল ডিস্ক খুঁজে পায়, যাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে কি হয়েছিলো তার আভাস আছে। বাতাসে  বিষক্রিয়া, পারমাণবিক বিস্ফোরণ, বিষাক্ত গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য মানুষ কি করেছিলো তা আছে। কীশ আরো বিস্তারিত জানার জন্য ধ্বংসস্তূপের মাঝে যায় আর য়ুল সমুদ্রপৃষ্ঠে থেকে গেলো, যোগাযোগ মডিউলে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হবে। য়ুল একা একা হাটতে হাটতে পাথরে হেলান দিয়ে বসতে গেলে নুড়ি  পাথরে পা হড়কে পাথরের গা ঘেঁষে গভীর সমুদ্রে তলদেশে যেয়ে পড়ে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে য়ুল কীশকে ধন্যবাদ দেয়। কিন্তু কীশ য়ুলকে সমুদ্র গভীর থেকে বাঁচায়নি। তবে কে বাঁচায়, য়ুলের শরীরে যোগাযোগ মডিউলে তা রেকর্ড হয়, নভোযানের যোগাযোগ কেন্দ্রে সুইচ স্পর্শ করতেই তা দৃশ্যত হয়। সমুদ্র তলে নিরাভরণ দেহে জলচর মানব মানবীর দেখা গেলো। তারমধ্যে তিনা নামের এক জলজ মানবী য়ুলের মুখে মুখে মুখ রেখে অক্সিজেন সরবরাহ করে য়ুলকে রক্ষা করে। সমুদ্র তলে প্রাণের স্পন্দন আছে এখনো, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে সমুদ্রের পানি থেকে দূরীভূত অক্সিজেন নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে তারা সমুদ্র তলে বসত গড়েছে।

পরবর্তীতে য়ুল তাপ নিরোধক পলিমার যোগে, পানির নিচে পরিষ্কার দেখার জন্য কন্ট্রাক্ট লেন্স নিয়ে, কোমরের ব্যাগে আলোর জন্যে ফ্লেয়ার নিয়ে, জলজ মানব মানবীদের সাথে কথা বলার জন্য অনুবাদক যন্ত্র নিয়ে, অক্সিজেন সিলিন্ডার আর বিপদ থেকে রক্ষার জন্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সমুদ্র তলে যায়। জলজ মানব মানবীরা প্রথমে ভয় পেলেও পরে য়ুলের সাথে স্বাভাবিক হয়। জলজ মানবী তিনার জন্য য়ুলের অনুভূতি গাঢ় হয়, রক্তচাপ বাড়ে, হৃদস্পন্দন  বাড়ে। ভাসমান যানে ফিরে এসে কীশকে সব বলে। পরে য়ুল আরো একবার সমুদ্রতলে যায় তিনার কাছ থেকে বিদায় নিতে কারণ ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু য়ুল আর ফিরে যাবে না, কীশকে আপ্রাণ বুঝিয়ে রাজী করায়। য়ুল যাতে এই পৃথিবীতে একা বেঁচে থাকতে পারে তার সব ব্যবস্থা করে কীশ। যেমন- ছোট দ্বীপ খোঁজে, সেখানে বাসস্থান তৈরি করে, জলজ মানব মানবীদের জিনেটিক নমুনা সংগ্রহ করে যাতে তাদের ফুসফুসের মতো য়ুলের ফুসফুসে পরিবর্তন করা যায়। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস থেকে সাবধানে থাকতে বলে, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহারে জলজ মানব মানবীরা তাকে অলৌকিক পুরুষ বা স্বর্গের দেবতা ভাবতে পারে তাও সতর্ক করে দেয়। আর পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের সব তথ্যের জন্য গ্যালাষ্টিক সাইক্লোপিডিয়া রেখে কীশ ক্রনকে নিয়ে নভোযানে করে ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জে চলে যায়। পৃথিবীর সমুদ্র পৃষ্ঠে হাটতে থাকে য়ুল। সমুদ্রের বালুবেলায় তার পায়ের চিহ্ন ঢেউ এসে মুছে দিতে থাকে।

=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=

জলজ
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

স্বত্ব- ড. ইয়াসমিন হক
প্রকাশনি- দিব্য প্রকাশ
প্রচ্ছদ- ধ্রুব এষ
প্রথম প্রকাশ- ফেব্রুয়ারি -২০০০
পাঠ - ষষ্ঠ মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর -২০০২
পৃষ্ঠা- ৯৪
মূল্য- ৬৫ টাকা
ISBN- 984 483 039 7

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ