সাজ্জাদ সাঈফের "বহুদিন ব্যাকফুটে এসে" : শব্দ ও স্বপ্নের মিথস্ক্রিয়া - বরুণ কুমার বিশ্বাস

সাজ্জাদ সাঈফের কবিতাবই "বহুদিন ব্যাকফুটে এসে"

সমকালের আলোচিত কবি সাজ্জাদ সাঈফের নতুন কবিতা বই "বহুদিন ব্যাকফুটে এসে" প্রকাশকালে গ্রন্থগত সাইটে লেখকের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। আজ কবি, কথাসাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী বরুণ কুমার বিশ্বাসের ভাষ্যে সেই বইয়ের আলোচনা প্রকাশ করা হল।

 

বর্তমান সময়ের অন্যতম জাতকবি সাজ্জাদ সাইফ। পেশায় চিকিৎসক আর প্যাশনে কবি। তবে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, তিনি সমকালিন অনেক কবিদের প্রিয় কবি। তাঁকে "কবিপ্রিয়কবি" অভিধায়ও ডেকে থাকি, মনে মনে। কবিতার সাথে তাঁর ঘর-গেরস্থালি নিত্যদিনের। ভাব, ভাষা, উপমা, ইশারা কিংবা কবিতার শরীর নির্মাণে ভীষণ কুশলি তাঁর কলম। ক্রমশ কবিতা বয়নে তিনি যেন সূক্ষ্ম মসলিনের একজন নিভৃত কারিগর কিংবা কবিতা বয়ানে আড়ংয়ের বায়স্কোপের একজন অভিজ্ঞ গায়েন। তাঁর কাব্যরস এবং কাব্যভাবনা সুনির্দিষ্টভাবেই অনন্য সে বিষয়ে দ্বিধা নেই। কবি বলেই রক্তের ভেতরে দ্রোহ-বিদ্রোহ, প্রেম-প্রতিবাদ, সংবরণ-ক্ষরণ ইত্যাদি আবেগের রসায়ন খেলা করে। আর এরই ভেতরে মন ও মননের উৎকর্ষে লিখে ফেলেন অসাধারণ সব কবিতা। সেই কবিতার জৌলুসে তরঙ্গায়িত হয় এই মামুলি পাঠকের অন্তর। গত কয়দিন ধরেই এমন কবিতাপ্রবাহের দুরন্ত ঘোরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ২০২০ এর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় কবি সাজ্জাদ সাইফের "বহুদিন ব্যাকফুটে এসে"; এই নিয়ে দু'বার পড়লাম। তাঁর কবিতার কোনো ব্যাখা নয় বরং কয়েকটি কবিতা থেকে কোট করে, যেসকল প্রশ্নের বিদ্যুৎ নিউরনে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেগুলো কবিতাপ্রেমী বন্ধুদের উদ্দেশে ছেড়ে দেবো।

"পিতার কফিন সয়নি যে কাঁধ/কোনও বাক্যই তাকে দিতে পারে না গন্তব্যের খোঁজ/ মনে হচ্ছে  পেশির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে পেশি, হাড়ের ভিতর হাড়/একদিন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে ফুটে উঠবে জন্মদাগ, পিতার পরশ" (পিতার ডাক। পৃষ্ঠা -১৩)

"সময় যেন সেই বৃদ্ধ গ্যালিলিও, গৃহবন্দিত্বের দুপুরবেলায়/যার দরজায় এসে থামে পদাতিক সৈন্য/গুপ্তহত্যার আগে বুক ধড়ফড় দ্রুতগামী হয় পৃথিবীর" (ক্রুসেড।পৃষ্ঠা - ২৭)

"সুনীতির শাঁস খেয়ে গেছে চালাক বাদুড়ে, তবু দেখি তুমি / পৃথিবীকে ডাকো আনন্দ - নার্সারি/ মনে হয় ডুব দিয়ে থাকি, মনে হয় পাক খেয়ে পড়ি/সকল তটিনী হতে ফিরে যাবে হাওয়া, এরকম চতুরতা পেলে/মনে হয় গলা কেটে মরি, তোমাদের ভিটায়" (বাদুড়। পৃষ্ঠা -১৪)

আরো এমন অনেক উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে পুরো কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা থেকে। কবিতার সাথে একজন কবির যে সংযোগ, সেটি মূলত ঐশ্বরিক এবং সেই ক্ষমতায় কবির আঙুলে এসে প্রাণ পায় কালোরঙা শব্দের-ফোটন। এ বইটিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। দেশ, সময়, সমাজ কিংবা সমসাময়িক সহযোদ্ধাদের উৎসর্গ করে লেখা কবিতাগুলো ভীষণ হার্দিক দ্যোদতনার জন্ম দেয়, নিমিষেই। তবে প্রেম এসেও বহুবার দেখা দিয়েছে তাঁর কবিতায়।

"আর কি-যে ফিরে চাও তুমি গানের খাতায়?/ স্নান পেয়ে আধুলির মতো জল/ নাকি জলের কবিতা এসে দোদুল্যমান/তোমার শরীরে? " (প্রেমের কবিতা। পৃষ্ঠা - ৩১)


নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্য ও সৌকর্যের আয়নায় ধরা পড়া কবি সাজ্জাদ সাঈফের কবিতার সুষমা সম্পূর্ণভাবেই তাঁর নিজস্ব ঢঙের। সমকালের শ্বাসকে যতোটা জরুরীভাবে কবিতায় বিন্যস্ত করা যায় তার সবটুকু মোহই দিতে চেয়েছেন পঙক্তিতে পঙক্তিতে।

"একট ভীষণ খারাপ সময়ের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে / ভাত-শালিকের সাথে দেখা/ তার চোখে নাই গ্লানিবোধ কোনো, পালক-বোঝাই ঈশারা সবুজ!/ চারপাশে জ্যাম, সমস্ত রীতিকে সাইড দিয়ে দিয়ে / সামনে আগায় স্মৃতি ও শ্লোগান!" (এখন উনিশ সাল। পৃষ্ঠা - ১৭)


কবি সাজ্জাদ সাঈফ চিকিৎসা পেশার মানুষ বলে শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়েছে নিবিড়ভাবে। শব্দগুলো কবির ভাবনা ও অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন বলে তা পাঠকের কাছে ভিন্ন কিছু মনে নাও হতে পারে এবং এই সহজাত প্রবৃত্তির মুন্সিয়ানা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন কবিতায়।

"যেভাবে ডিপ্রেশন এসে হাড়ের গলিতে বসে প্রাণায়াম করে/ঝারবাতিগুলি জ্বলে ওঠে সন্ধ্যায়, সে-রকম সান্নিধ্য চাই তোমার "(সুইসাইড নোট। পৃষ্ঠা -২০)


অনবদ্য জীবনদর্শন এ কবির কবিতায় বার বার ধরা দিয়েছে। কিংবা মানুষে মানুষে বিভাজন যেন তাকেও নিরন্তর ভাবায়, কাঁপায়।

"বাঁ-দিকে শ্রমিক, না খেতে পাওয়া শিশুর জন্য কাঁদে/ডানে এক বিষণ্ণ পয়সার গায়, মালিকের লাল বুট যেনো/ পিষে মারে গরীবি হালত!" (বাংলাদেশ-১৮ইং। পৃষ্ঠা - ২৮)


শব্দগুলো কবির ভাবনা ও অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন বলে তা পাঠকের কাছে ভিন্ন কিছু মনে নাও হতে পারে এবং এই সহজাত প্রবৃত্তির মুন্সিয়ানা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন কবিতায়।

প্রাসঙ্গিকভাবে একটি বিষয় অবশ্যই বলে রাখি, "বহুদিন ব্যাকফুটে এসে" কাব্যগ্রন্থে অহেতুক কোনো দুর্বোধ্য শব্দের ঝনঝনানি নেই। এমনকি, অপ্রচলিত শব্দের বাহুল্য বর্জিত। পারিপার্শ্বিককে সহজভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ভীষণ সচেতন এ কবি। কোথাও সেই প্রতিশ্রুতি থেকে একটুকুও সরেছেন বলে আমার মনে হয় না। বরং কবিতায় আধুনিকতা, গতিশীলতা বরাবরই অটুট রেখেছেন।

কবি তার কবিতায় শুধু ভাব ও ভাবনা চিরায়ত কোলাজে সীমাবদ্ধ না থেকে সুস্পষ্ট বৈচিত্র্যতার মেলট্রেনে পরিভ্রমণ করেছেন দশদিকেই এবং সেই শব্দদৃশ্যে ক্রমাগত আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে পাঠককে আঁকড়ে ধরে রাখতে প্রয়াসী হয়েছেন। তবে এ কথা ঠিক, বহুমাত্রিক বিষয় নির্বাচনের প্রাচুর্যই কবি সাজ্জাদ সাঈফের অন্যতম কবিতাশক্তি।

শেষমেষ, কিছু আফসোস নিয়ে "বহুদিন ব্যাকফুটে এসে" পড়া শেষ করতে হয়, আরো কিছু কবিতা পাওয়ার আশায়। যাইহোক, ঠিক পাঠপ্রতিক্রিয়া বলতে যা বোঝায় আমার এ লেখাটি তা হয়েছে কিনা জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, কবিতাগুলো পড়তে গেলে কিছু ক্রিয়া বুকের ভেতরে ঘটে যাবে। এমনও হতে পারে কোনো ম্যাজিশিয়ানের কসরতের মতো চোখের পলকে বইয়ের পাতাগুলো ফুরিয়ে যাবে।


* আরও পড়ুন বহুদিন ব্যাকফুটে এসে" কাব্যগ্রন্থের লেখক কবি সাজ্জাদ সাঈফের সাক্ষাৎকার

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ