বিজ্ঞানকে চিনতে পড়া দরকার 'জহুরুল হক' অনূদিত 'জে ব্রনোওস্কি’ লিখিত “বিজ্ঞানের চেতনা”

বিজ্ঞানের_চেতনা-জে_ব্রনোওস্কি


এমন এক সমাজে আমাদের বসবাস যেখানে বিজ্ঞান বিষয়টির উপস্থিতি আলাদাভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানকে অনুধাবনের জন্য করণীয় নির্ধারণ বা ঠিক কোন অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞান চেতনা বলতে হবে তা নির্বাচন করে দর্শন। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাসে দর্শনের অবদান সবসময়ই লক্ষ্যযোগ্য থেকেছে। বস্তুত 'বিজ্ঞান কী' তার উত্তর সহজ নয়। এমন একটি অব্যাখ্যাত বিষয়কে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, বিস্তৃতকরণ উদাহরণসহ আলোচনা করা হয়েছে জহুরুল হক অনূদিত জে ব্রনোওস্কি (Jacob Bronowski - The Common Sense of Science- 1951) রচিত "বিজ্ঞানের চেতনা" বইতে।

বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে লেখক এবং এই বই সম্পর্কে যে কথাগুলি মুদ্রিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:

“কোনো চিন্তাশীল অবিজ্ঞানী ব্যক্তির কাছে বিজ্ঞানের প্রকৃত বক্তব্য ও গভীরতম অর্থ স্পষ্ট করে তুলে ধরতে সক্ষম এমন অর্ধ-ডজন বইয়ের নাম উল্লেখ করতে বললে আমি ব্রনোওস্কির বইয়ের নাম করবো"-- বলেছেন সি. পি. স্নো, ইংলন্ডের প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক ও বৈজ্ঞানিক। ইউরোপের রেনেসাঁ প্রভাবিত উদার মানবতাবাদী চিন্তাধারায় প্রাণিত আধুনিক পুরুষ জ্যাকব ব্রনোওস্কি ছিলেন একইসঙ্গে গণিতবিদ, আবিষ্কারক, কবি, নাট্যকার ও মানবতাবাদী। ১৯৭৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশ্বখ্যাত এক মার্জিক জীববিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন তিনি। বিভিন্ন ধরণের গবেষণাকর্মের পাশাপাশি জীবনচেতনা বিকাশে  বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর ভূমিকা এবং দায়িত্ববোধ থেকে তিনি বেশকিছু গ্রন্থেরও জনক। প্রখর বিজ্ঞানবোধ সদা তাঁর ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল বলে ব্রনোওস্কির সব বই-ই সুখপাঠ্য, সরল অভিজ্ঞতাদায়ী। তাঁর 'কমন সেন্স অব সায়েন্স' বইটি বাংলঅয় অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক জহুরুল হক। আধুনিক সমাজ ও বিজ্ঞানের জগতে যে জটিল সংকটজালের সৃষ্টি হয়েছে, তার থেকে উদ্ধার ও উত্তরণের একমাত্র পথ যে বাস্তববোধসম্পন্ন মানবতাবাধ, ব্রনোওস্কির এই উপলব্ধি জহুরুল হককে প্রাণিত করেছে এই অনুবাদকর্মে। সবধরনের পাঠকের জন্যই এই বই। এর পাঠে যেমন অর্জিত হবে দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, তেমনি পাওয়া যাবে উৎকৃষ্ট সাহিত্য পাঠেরও আনন্দ।



“এই বই সম্পর্কে" নামীয় ভূমিকা বা মুখবন্ধ থেকে এই বইয়ের চরিত্রবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা যায়। এটা বিজ্ঞানভিত্তিক বই হলেও অন্যান্য প্রচলিত ধারার বিজ্ঞানের বই নয়। তাহলে ঠিক কোন দৃষ্টিভঙ্গি এই বইয়ে উপস্থাপিত সেটা বিজ্ঞানের সেই মৌলিক প্রশ্নটির উত্তর জানার জন্য প্রয়োজন। সেজন্য এখানে বলা হয়েছে: 

 

মানুষের সভ্যতার প্রয়াসে বিজ্ঞানের আবহমান কালের ভূমিকার দিকটিতেই তাঁর লক্ষ্য ছিল। একদিকে ছিল মানুষ, মানুষের বোধশক্তি; অন্যদিকে প্রকৃতি জগতের অপার রহস্য, তার নিজের সৃষ্ট বিজ্ঞান-কীর্তি। কোথায় কোথায় ঘটেছে সঙ্গম, কোথায় সঙ্ঘাত, তারপর অগ্রগমন, উর্ধ্বগতি, আরোহণ। তাই অবশ্যম্ভাবী ছিল যে তার জীবনযাপন, আচরণ, সামাজিক কার্যকলাপ, প্রভাবিত, প্রায়শই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বিজ্ঞানের অমোধ ধারা, প্রবাহের দ্বারা। বইটিকে তাই, বিজ্ঞানের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত মানুষের সামাজিক-মানসিক আচরণের বিবরণ বিষয়ক বলাই অধিক সঙ্গত হবে। Common Sense কথাটির যথাযথ প্রতিশব্দ বাংলায় 'কাণ্ডজ্ঞান' হয়তো বলা যায়; কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় 'বোধ' শব্দটার দ্যোতনা ব্যাপকতর বলে মনে হয়েছে।


বিজ্ঞান কী, তাকে অনুধাবন করার প্রক্রিয়া কেমন?

প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মপদ্ধতি থাকে। পৃথিবীকে দেখার, বোঝার, গ্রহণের একটি নিজস্ব ভাবনাচিন্তা থাকে। যার প্রভাব পরে সরাসরি সমাজে; লোকজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, কর্মে। বিজ্ঞান থেকে ভাল কিছু গ্রহণের মনোদার্শনিক অভিব্যক্তি তৈরি হয় মানুষের মানসিক অবস্থান থেকে। বিজ্ঞানের প্রয়োগজনিত উপকার ও সুবিধাজনক ফলবস্তুতা ইউরোপীয়রা ভোগ করে, কারণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মপদ্ধতি এবং ভাল কিছু পাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে পরিচালনা করে। অনুবাদক তার "এই বই সম্পর্কে" নামের ভূমিকায় লিখেছেন:

 

একথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে নিশ্চিত আসন দখল করে নিতে বিজ্ঞানকে বহু কুসংস্কার, গোঁড়ামি, সহজাত মানসিক জাড্য--- এই সবের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে রত থাকতে হয়েছে; পৃথিবীর কোনো দেশেই এই ধরনের সংগ্রাম অনুপস্থিত ছিল না। বিজ্ঞানের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হয় নি।
এই জন্যেই বিজ্ঞানের অগ্রগমনের পথ ইতিহাসের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; পৃথক হয়েও সংশ্লিষ্ট। একথা ঠিকই, পৃথিবীর সব দেশের ইতিহাস বহুবিধ কারণে ভিন্ন ভিন্ন পথে গেছে, কিন্তু মনুষ্য স্বভাব ও সমাজ গঠন পদ্ধতির যে সামগ্রিক বিরোধিতা ছিল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের প্রতি, তা সব দেশে একই প্রকারের; চেহারায় না হলেও চরিত্রে। এই কারণেই কোনো সমাজের ইতিহাস ঐ সমাজের বৈজ্ঞানিক প্রয়োাস ও কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন বা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দেখতে চাইলে যথার্থ অগ্রগতি বা বিবর্তনের ধরন কিংবা গতিপ্রকৃতি ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুব কম।



ইতিহাস আলোচনা করে বর্তমানের অতীত সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। তাহলে বিজ্ঞানের অগ্রসরতা মানেই তো অতীতের পশ্চাৎপদতার অপসারণ বা পরিত্যাগ। বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট সামাজিক, রাষ্ট্রিয় কার্যকলাপ, প্রশাসনিক পদক্ষেপ, জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা, মানুষের প্রচলিত দার্শনিক ধারণা, যুক্তিগ্রাহ্যতা বা প্রবণতা সবকিছু আলোচিত হতে পারে। ভূমিকায় প্রদত্ত তথ্যমতে মূল লেখক মনে করেন:


একটি সমাজের 'সাংস্কৃতিক' চিন্তা এবং কার্যকলাপ প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান-প্রভাবিত চিন্তা ও কার্যপদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। একটি সমাজে যেমন 'বিশুদ্ধ' সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ অপরিহার্য (যেমন কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প, গল্প-উপন্যাস, নাটক, নৃত্য ইত্যাদি ইত্যাদি), তেমনি যথার্থভাবে, আন্তরিকতা দিয়ে, সুযুক্তির পথে বিজ্ঞাত-চর্চিত বা পালিত হলে, বিজ্ঞান-সংস্কৃতিও বিকশিত হতে পারে।


সূচিপত্র দেখলে বইয়ে আলোচ্য প্রসঙ্গের বিস্তৃতি সহজে বোঝা যাবে।

  • প্রথম অধ্যায়
    • বিজ্ঞান ও বোধ
  • দ্বিতীয় অধ্যায়
    • বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও যন্ত্র
  • তৃতীয় অধ্যায়
    • আইজাক নিউটনের ছক
  • চতুর্থ অধ্যায়
    • অষ্টাদশ শতাব্দী ও শৃঙ্খলার ধারণা
  • পঞ্চম অধ্যায়
    • ঊনবিংশ শতাব্দী এবং 'কারণ' এর ধারণা
  • ষষ্ঠ অধ্যায়
    • সম্ভাবনার ধারণা
  • সপ্তম অধ্যায়
    • বিজ্ঞানের কাণ্ডজ্ঞান
  • অষ্টম অধ্যায়
    • সত্য এবং মূল্য
  • নবম অধ্যায়
    • বিজ্ঞান: ধ্বংসের দৈত্য অথবা সৃষ্টির দেবতা



নয়টি অধ্যায়ে লেখক বিজ্ঞানকে সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের চেষ্টা যে করেছেন, তা বোঝা যায়। শুরু করেছেন 'বিজ্ঞান ও বোধ' দিয়ে। বিজ্ঞান কী, তাকে অনুধাবন করার প্রক্রিয়া কেমন? বিজ্ঞান উপভোগ করতে গিয়ে শিল্পকলার ভূমিকা, বিজ্ঞানের সাথে শিল্পকলার সম্পর্ক, প্রভাব সরাসরি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন:


এ যুগের একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক পক্ষপাতদুষ্ট কুসংস্কার এই যে আমরা ধরে নিয়েছি, শিল্পকলা আর বিজ্ঞান যেন আলাদা জাতের জিনিস, তাদের কার্যক্ষেত্র পরস্পর সঙ্গতিহীন। আমাদের স্থির একটা বিশ্বাস দাঁড়িয়ে গেছে যে, শিল্পীর মেজাজ আর বিজ্ঞানীর মেজাজ একে অপরের বিরোধী; এমন কি আমরা ধরেই নিই, একটা সৃষ্টিধর্মী, অন্যটি ত্রুটি-সন্ধানী। আমাদের সমাজের বিন্যাস যেমন, তাতে অবশ্য শ্রমের বিভাজন পদ্ধতি অবলম্বন করায় বিশেষ ধরনের কাজে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হয়ে থাকে, তাতে সুবিধাই হয়। সুবিধার জন্যে, শুধুমাত্র সুবিধার জন্যেই বিজ্ঞানের কাজ শিল্পের কাছ থেকে আলাদা হয়। একই ভাবে, চিন্তাশক্তির কাজ, অনুভবের কাজের থেকে আলাদা এবং তার পরিপূরক হয়। কিন্তু মানবজাতির একটা অংশ তো খালি 'চিন্তাশীল; আর অন্য অংশটি খালি অনুভূতিশীল হয় না। হলে মানবজাতি টিকেও থাকতে পারবে না। পৃষ্ঠা: ১৫


দ্বিতীয় প্রবন্ধ 'বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও যন্ত্র' তে জানা যায় সৌন্দর্যশাস্ত্র, তার শৈলী, অনুভূতি, বিবরণ, বিশ্লেষণ দিয়ে মানুষের উপভোগের বোধ তৈরিতে সক্রিয় থাকে। নাট্যচর্চার ঔদার্য বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতিতে গড়ে তোলে অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা। মধ্যযুগে ইউরোপের রেনেসাঁ সাংস্কৃতিক জগতের মত  প্রভাবিত করেছিল বিজ্ঞানকেও। বিজ্ঞানকে অনুধাবনভঙ্গি পাল্টে গিয়েছিল অনেকটাই।

নিউটন এবং তাঁর সমসাময়িক বন্ধুবর্গ যেমন উঁচুদরের যন্ত্রবিদ ও আবিষ্কারক ছিলেন, তেমনি দ্য ভিঞ্চিও ছিলেন। কিন্তু দ্য ভিঞ্চির কাগজপত্র এক নজর দেখলেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি প্রধানত কৌতুহলী ছিলেন প্রকৃতি জগতের বিপুল বৈচিত্র, তার সীমাহীন সামঞ্জস্য বিধান ক্ষমতা, প্রতিটি অংশের যাথার্থ ও বৈশিষ্ট্য সন্বন্ধে। অন্যদিকে নিউটনের কাছে জ্যোতির্বিজ্ঞান যে কারণে আনন্দদায়ক ছিল তা হলো তার ভিতরের ঐক্য, স্বাতন্ত্র্য, সমগ্র প্রকৃতির এমন একটা ছক যার আলাদা আলাদা অংশগুলো হলো সহজ-সরল মৌলিক কণিকাগুলোরই অন্য রূপ। দ্য ভিঞ্চি যখন একটা বিশেষ ধরনের ফলাফল চাইতেন, তখন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি পরিকল্পনাটিকে বাস্তবরূপ দেবার চেষ্টা করতেন; তার যান্ত্রিক কল্পনার মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল সেইটি। কিন্তু নিউটনের যান্ত্রিক কল্পনার উদ্দেশ্য কোনো কাম্য ফলকে কার্যকর অবস্থায় আনা-ই ছিল না বরং কিভাবে একটা ঘটনা ঘটে তা নিরীক্ষণ করাই ছিল উদ্দেশ্য। স্মরণ রাখা যেতে পারে যে, নিউটন একজন বিচক্ষণ পরীক্ষা-কার্য-বিশারদ ছিলেন, একটা বিশেষ ফলাফল দেখে তিনি ঘটনাটি সংঘটনের কারণটা খুঁজতেন। পৃষ্ঠা: ৩৩


'কারণ কী' তার স্বরূপ খোঁজেন।
“আইজাক নিউটনের ছক" প্রবন্ধে লেখক বৈজ্ঞানিক কার্যক্রমের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রত্যেকের কার্যপ্রণালীর বৈচিত্র রয়েছে। কেউ সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে পূর্বানুমানের ভিত্তিতে অগ্রসর হন, কেউবা আবার সমাধানের প্রেক্ষিতে প্রশ্নটিকে খোঁজার চেষ্টা করেন। 'কারণ কী' তার স্বরূপ খোঁজেন। একজন বিজ্ঞানী প্রাকৃতিক কোন একটি অজানা সূত্র আবিষ্কার করবেন অথবা কোন এক অজানা প্রাকৃতিক সূত্রের মর্মভেদ করবেন তা আগে থেকে আন্দাজ করা কঠিন। অভিকর্ষ, মাধ্যাকর্ষণ, জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত এসব আগে থেকেই আছে। এগুলো যেসব নির্দিষ্ট নিয়ম তথা গাণিতিক সূত্রের অধীন, তা চিরদিন অনাবিষ্কৃত থাকত না।

নিউটনের পদ্ধতির দ্বারা বিজ্ঞানের দুইটি স্রোতের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটেছিল; একটি ছিল যুক্তি-বিচারের খাত; অন্যটি, পরীক্ষালব্ধ তথ্যের। তার মধ্যে দেকার্তের ন্যায়শাস্ত্রসুলভ মনোভঙ্গির সঙ্গে বেকনের পরীক্ষা করে পাওয়া তথ্যের প্রতি গাঢ় অনুরাগ যুক্ত হয়েছিল। পৃষ্ঠা- ৪৫



‘কারণ' বিষয়েও মতৈক্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিল না। দর্শনশান্ত্রের গণ্ডি বিজ্ঞানের সেই কেন্দ্রিয় ধারণাটিকে ধীরে ধীরে অনুধাবনযোগ্য করে তুলেছিল।

মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এক ব্যাপক আলোড়ন লক্ষ্য করা যায়। ইংল্যান্ডে রয়াল সোসাইটি স্থাপিত হবার পর ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় "আকাদেমি রোইয়াল দেস মিয়াঁসেস"। সেই সময়ে বিজ্ঞানী, লেখক, শিল্পী অর্থাৎ সৃষ্টিশীল মানুষেরা দলে দলে নতুন কিছু শেখার ঔৎসুক্য প্রকাশ করেছিল।

ইংল্যান্ড রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজ দেশের মানুষদের ব্যবহারিক জীবনের উন্নতি করতে চেয়েছিল, যার প্রতিফলন ঘটে রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞানীদের চিন্তায়:


প্রথম দিকের সভাগুলোতে ব্যবহারিক বিষয়াদি সম্বন্ধে অনুসন্ধান চালানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হতো বেশি; বস্ত্ররঞ্জন, মুদ্রা নির্মাণ, কামান-বন্দুক প্রস্তুত, ধাতু বিশোধন, ডুবুরি প্রকোষ্ঠ এবং নাগরিকদের সন্বন্ধে পরিসংখ্যান। কিন্তু যদিও সমাজের এসব প্রয়োজনের কথা বুঝবার ক্ষমতা হয়েছিল, অভাবগুলো পূরণ করার সাধ্য তার ছিল না। পৃষ্ঠা- ৫০


প্রাকৃতিক নিয়মগুলোকে নিজেদের কাজে ব্যবহার যে করা যায়, তা মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শিখল। বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও হাতে-কলমে কাজ করতে গিয়ে প্রকৃতির রহস্যময় নিয়মগুলো তথা বিজ্ঞানের তত্ত্ব আবিষ্কার করতে ফেলল। শৃঙ্খলা ছাড়া প্রকৃতিতে কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে না। আর তা হবে গণিত দ্বারা পরিমাপ্য- এটা বুঝতে ইউরোপীয় বিজ্ঞানকে মধ্যযুগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

শিল্প বিপ্লব, কলকারখানা, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য সব কিছুরই একটু না একটু ভূমিকা ছিল। বিজ্ঞানকে ব্যক্তিবিযুক্ত অবস্থায় বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটরিতে বন্দী অবস্থায় ভাবলে তো চলবে না। সমাজে বিজ্ঞানের সরাসরি ভূমিকা কিরূপ তা উদ্ভাবন করতে হবে। তবেই না নাগরিক সমাজের মননে বিজ্ঞানে অবদান হাতে কলমে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।

বিজ্ঞানের দর্শন বা বিজ্ঞানের চেতনাকে বুঝতে সহায়ক হবে এমন বই বাজারে বিরল। বিজ্ঞানকে আলাদা বা অন্যকিছু একটা এমনভাবে আমাদের জীবনে উপস্থাপন করা হয়। জীবনযাত্রায় বিজ্ঞানের সহযোগিতা বা অংশগ্রহণ কতটুকু সে জ্ঞান আমাদের অনেকেরই নেই। জীবন ও তার পরিপার্শ্বের প্রতিটি মুহুর্ত যে বিজ্ঞান ছাড়া ব্যাখ্যা করা অসম্ভব, সে বোধ না থাকাটা বাংলাদেশের মত পশ্চাতপদ সমাজে স্বাভাবিক। আর সে জন্যই এই বইয়ের প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায় নি। ১৯৯৩ সালে প্রকাশের পর প্রায় ৩০ বৎসরকাল হতে চলল। এখনও সমাজের মুধ্যে বিজ্ঞানকে তার যথাযথ পরিচয়ে উপস্থাপন করা হয়ে ওঠে নি। সাধারণ মানুষের জীবনভাবনায় বিজ্ঞান একেবারে অনুপস্থিত। বস্তুত বিজ্ঞানের ধারণাটাই এখনও অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়।

বিজ্ঞানকে বুঝতে, বিজ্ঞানের পরিধিকে অনুধাবন করতে জে. ব্রনোওস্কি লিখিত বিজ্ঞানের চেতনা বই প্রয়োজনীয় পথনির্দেশনা দেবে। আগ্রহী পাঠক জানতে পারবেন বিজ্ঞান, জীবন ও প্রকৃতির যথাযথ মিথস্ক্রিয়াকে। বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সৌন্দর্য প্রভৃতি জটিল প্রসঙ্গ আলোচিত হলেও অনুবাদকের গুণে বইপাঠ স্বাচ্ছন্দ্যময়। কোথাও কোন শব্দ বা বাক্যের কারণে হোঁচট খেতে হয় না। সকলের বোধগম্য ভাষায় সহজবোধ্য করে রচিত এই বই বর্তমান সময়কালে পুনরায় বাজারে আসতে পারে।


_+_+_+_+_+_


বিজ্ঞানের চেতনা
জে ব্রনোওস্কি

অনুবাদ: জহুরুল হক


প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার
প্রকাশকাল: ১৯৯৩
প্রকাশনী: সাহিত্যপ্রকাশন, ঢাকা।
পৃষ্ঠা: ১৪২
মূল্য: আশি টাকা
ISBN: 984-465-018-6

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ