হাসান তারেক চৌধুরীর বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ‘‘সময়:বিজ্ঞান ও অনুভবে”

হাসান তারেক চৌধুরীর বিজ্ঞান বই‘‘সময়:বিজ্ঞান ও অনুভবে”

খান আলাউদ্দিন


Time , you old gipsy man
Will you not stay
Put up your caravan
Just for one day ?

_ Ralph Hodgson .

সময় কি? কারো মতে ইল্যুশন, কারো মতে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার মতো চতুর্থ মাত্রা (সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে)। সময় নিজেই ধাঁধাঁ, প্রহেলিকাপূর্ণ, যা আমাদের নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে স্পষ্ট হচ্ছে। একদিকে স্ট্রিং তত্ত্ব বলছে সময়ের শুরু বা শেষ নেই, অন্যদিকে হকিংয়ের ভাষ্যমতে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সময়ের সূচনা হয়েছিলো এবং সেই সময় -রথ আজো থামেনি। ফলে সময়কে কবি দূরগামী বৃদ্ধ জিপসিরূপে ভিজুয়ালাইজ করতেই পারেন। একই সুর আমরা জীবনানন্দের কন্ঠেও ধ্বনিত হতে শুনি,

অনেক মূহুর্ত আমি ক্ষয় করে ফেলে বুঝেছি সময় যদিও অনন্ত তবু প্রেম অনন্ত নিয়ে নয়।


হাসান তারেক চৌধুরী একজন প্যারাসাইকোলজিক্যাল উপন্যাস রচয়িতা । ‘সময় বিজ্ঞান ও অনুভবে’ বইয়ের মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রবন্ধকার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করলেন। প্রতিষ্ঠিত বলছি, কেননা উল্লেখিত বইয়ের পরতে পরতে লেখকের বিস্তৃত পঠন-পাঠন, সহজ সরল ভাষার উপস্থাপন, সময় সম্পর্কিত একদম আপডেট রেফারেন্সের ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

সময় বলতে আমরা শুধু ঘড়ির মাধ্যমে নির্ণীত বাহ্যিক সময় বুঝে থাকি। এছাড়াও প্রাণীর আভ্যন্তরীণ সময়েরও অস্তিত্ব রয়েছে। গবেষকেরা যার নাম দিয়েছেন সার্কাডিয়ান ক্লক বা দেহ ঘড়ি। এই আভ্যন্তরীণ সময়-চেতনা পুরোটাই জিন (period) নিয়ন্ত্রিত। সার্কাডিয়ান ক্লক সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা এবং প্রাণীদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব নিয়ে লেখক বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। বর্ণনা করেছেন সময় নিয়ে দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় অবস্থান, সময়-ইতিহাস, মিনকোয়স্কি স্পেস-টাইম কন্টিনিউয়াম, বিভিন্ন হাইপোথিসিস।
 
১৮৯৫ সাল, বিখ্যাত সাইন্সফিকশন লেখক এইচ. জি. ওয়েলস তার সময়-ভ্রমণ সংক্রান্ত বই ‘দ্য টাইম মেশিন’ প্রকাশ করলেন। এর দশ বছর পর ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হলো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। আর পাল্টে গেলো সময় নিয়ে পূর্ববর্তী ধ্যান ধ্যারণা। সূচনা হলো সময়ের অতীত ভ্রমণের প্যারাডক্স বা স্ব-বিরোধিতার। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব সময়কে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে বাধ্য করল বিজ্ঞানীদের- -জটিল জৈব গঠনের অধিকারী মানব মস্তিষ্কই কি শুধু সময় অনুভব করার জন্য উপযুক্ত? অন্য প্রাণীরা কি সময় বুঝতে পারে? বেগজনিত এবং মাধ্যাকর্ষণজনিত কারণে কেন কাল দীর্ঘায়ণ ঘটে? সময় নিয়ে রজার পেনরোজ, এডিংটনের ভাবনা কি? অতিভারী ব্ল্যাকহোল যার ভেতর থেকে কোনো কিছ্ইু বের হয়ে আসতে পারেনা এমনকি আলোও নয়, সেই singularity-তে যেখানে বস্তুর ঘনত্ব, স্থানের বক্রতা, তাপমাত্রা অসীম সেখানে সময়ের রুপ কেমন? ব্ল্যাকহোলের ভেতরে কি স্থান-কাল বলে কিছু আছে? কোনো ভরবিশিষ্ট  বস্তু কি আলোর সমান বেগ অর্জন করতে পারবে? এমনই সব তত্ত্ব, তথ্য, বিশ্লেষণে পূর্ণ বইটি।


তাপবলবিদ্যার ২য় সূত্রমতে, তাপ সর্বদা উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নিম্ন তাপমাত্রায় প্রবাহিত হয়। হাবলের পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো আরো দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থ্যাৎ ক্যাওস বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণেই একটা ভাঙা গ্লাস ভেঙে গেলে ভাঙা টুকরোগুলো আর একত্রিত হয়না। সময়ও কি এমন একমুখী? বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন  arrow of time। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বে এমন জগৎকে কল্পনা করা হয়েছে, যে জগতে সময় আমাদের জগতের সময়ের উল্টোদিকে প্রবাহিত হচ্ছে।

ব্ইটি পাঠ করে সময়কে ডেডেলাসের গোলকধাঁধাঁর মতই মনে হতে পারে পাঠকের কাছে। যতদিন না গ্রান্ড ইউনিফায়েড থিওরি আবিষ্কার হয় ততদিন সময় নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাচ্ছে না ।

-*-*-*-*-
সময়: বিজ্ঞান ও অনুভবে
হাসান তারেক চৌধুরী

প্রকাশনী : ভাষাচিত্র
প্রকাশকাল : কলকাতা বাংলাদেশ বইমেলা ২০১৯
প্রচ্ছদ : খন্দকার সোহেল
মূল্য : ৩৯৯ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ