'আহমদ ছফা' রচিত 'যদ্যপি আমার গুরু' আলোচনা করলেন মোছা. নুসরাত জাহান

যদ্যপি আমার গুরু - আহমদ ছফা


জ্ঞানী-গুণি মানুষের সান্নিধ্য ব্যক্তির জ্ঞানের বিকাশকে আরও ত্বরান্বিত করে। আর এই সান্নিধ্যের মাধ্যম যদি হয় গুরুশিষ্য সম্পর্ক তাহলে তো কথাই নেই। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাই আমরা সক্রেটিসের সান্নিধ্যে প্লেটো, প্লেটোর সান্নিধ্যে এরিস্টটল, এরিস্টটলের সান্নিধ্যে আলেকজান্ডার এর মতো মানুষ গড়ে ওঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থেকে।  

তেমনি 'যদ্যপি আমার গুরু' বইটিতে একজন শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আন্তঃসম্পর্কের প্রকাশ ঘটেছে। বইটিতে লেখক আহমদ ছফা স্মৃতি হাতড়ে তার প্রিয় শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এবং তার কথোপকথন তুলে ধরেছেন ব্যাখ্যা করেছেন, উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন, প্রয়োজনে প্রতিবাদ করেছেন। যার মাধ্যমে পাঠক আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের মনীষা এবং তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে।

১৯৭০ সালের শেষের দিকে একটি গবেষণার সুপারভাইজার হওয়ার অনুরোধ নিয়ে আহমদ ছফা আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। বন্ধুবান্ধব তাকে আগেই হুঁশিয়ারি করেন যে রাজ্জাক সাহেবে বেশ নাক-উঁচু স্বভাবের। যার কারনে বাঘা বাঘা লোকেরাও তার কাছে ঘেঁষতে ভয় পান। এক প্রকার সাহস সঞ্চার করেই তিনি রাজ্জাক সাহেবের সাথে দেখা করেন। প্রথম পরিচয়ে আহমদ ছফা তার যে তিনটি বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল তা হল তার চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, অবলীলায় ঢাকাইয়া বুলির ব্যবহার, এবং আহমদ ছফাকে তিনি 'মৌলবি আহমদ ছফা' বলে ডাকতেন। তারপর বইটির পাতায় পাতায় কাহিনি পরম্পরায় এগিয়ে চলে তাদের গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক।

আহমদ ছফা তার প্রিয় শিক্ষকের ঘরে প্রবেশের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন,  
 

ঘরটিতে একটি মাত্র খাট, না, খাট বলা ঠিক হবে না, চৌকি। চৌকিটার আবার একটি পায়া নেই। সেই জায়গায় বইয়ের উপর বই রেখে ফাঁকটুকু ভরাট করা হয়েছে। চমৎকার ব্যবস্থা। পুরনো বইপত্রের আলাদা একটা গন্ধ আছে। আমি সেই বইপত্রের জঞ্জালে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।


দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট প্রাপ্ত, হ্যারল্ড লাস্কির ছাত্র জ্ঞানকোষ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষায় আহমদ ছফাকে দেওয়া প্রথম উপদেশ,

যখন কোনো নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। অই জায়গার মানুষ কি খায়। আর পড়ালেখা কি করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কি করে, হেইডা জাননের লাইগ্যা।


তিনি আহমদ ছফাকে প্রচুর বই পড়তে বলতেন এবং বইটির প্রতিটি কথা অনুধাবন অর্থাৎ রিভিউয়ের ওপর জোর দেন। বই যেভাবে  পড়তে হবে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে-বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার না পারেন, ধইর‍্যা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।


ময়লা পাঞ্জাবি, ছেঁড়া গেঞ্জি পড়া মলিন মানুষটি চার দশক ধরে কিভাবে তরুণ শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে হয়েছেন, সেই কথাই আহমদ ছফা প্রথম পুরুষে তুলে ধরেছেন তার 'যদ্যপি আমার গুরু' বইটিতে। আব্দুর রাজ্জাক সাহেব প্রায়ই আহমদ ছফা কে বলতেন,

আমরা শিক্ষকেরা প্রতি বছরই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটি নতুন বছরে আমাদের কাছে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এসে হাজির হয়। এই তরুণদের চাহিদা,চাওয়া-পাওয়ার খবর আমাদের মতো লোলচর্মের বৃদ্ধদের জানার কথা নয়। এটাই হলো শিক্ষক জীবনের সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডি।


তবে আফসোসের বিষয় এটাই যে, যে শিক্ষক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রতিটি বাক্যে আহমদ ছফা পাঠকের মনে নেশা জাগিয়ে তুলেছেন সেই শিক্ষক কখনই কলম ধরেননি। অথচ অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মত মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। শুধু এগুলোই নয় হেনরি কিসিঞ্জার, লেনিন-মার্ক্স, ধর্মনিরপেক্ষতা- এসবই উঠে এসেছে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বুলিতে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শেক্সপিয়ারের লেখার সমালোচনা এবং জসীম উদ্দীনের সঙ্গে রাজ্জাক সাহেবের স্মৃতিকথাও উঠে এসেছে বইটিতে। জসীম উদ্দীন কে নিয়ে গুরু শিষ্যের কথা উঠলে রাজ্জাক সাহেব বললেন,

একসময় কলকাতায় আমি আর জসীমুদ্দীন এক বাড়িতে থাকতাম। একদিন জসীমুদ্দীন আমাকে কাপড়চোপড় পইর‍্যা তাড়াতাড়ি তৈয়ার অইবার তাগাদা দিতে লাগলেন। আমি জিগাইলাম, কই যাইবার চান। জসীমুদ্দীন কইলেন, এক জায়গায় জাওন লাগবো। কাপড়চোপড় পইর‍্যা তার লগে হাইট্যা হাইট্যা যখন এসপ্লানেডে আইলাম, জসীমুদ্দীন ঘাড় চুলকাইয়া কইলেন, কও দেখি এখন কই জাওন যায়? এইরকম কান্ড তিনি প্রায়ই করতেন।


 'যদ্যপি আমার গুরু' মূলত একটি স্মৃতিচারণ মূলক গ্রন্থ। যার প্রতিটি লাইন পাঠের মাধ্যমে সাহিত্যের প্রতি যেমন মোহ জন্মাবে পাঠক মনে তেমনি আরও শত শত বই পড়ার আগ্রহও সৃষ্টি হবে। তবে বইটি পড়ে লেখক এবং যার সম্পর্কে লেখা হয়েছে, কে বেশি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য সে বিষয়ে হয়তো কনফিউশান থেকেই যাবে পাঠক হৃদয়ে।


মাওলা ব্রাদার্স কতৃক বইটি ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম প্রকাশিত হয়। কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদকৃত বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১০। যার বাজারমূল্য ১৭৫টাকা মাত্র।  

মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম