আকাশ যারা করলো জয় – অনুবাদ: মোহাম্মদ নাসির আলী

আকাশ যারা করলো জয় – অনুবাদ: মোহাম্মদ নাসির আলী


মানুষ কয়েক হাজার বৎসর আগে থেকেই আকাশে উড়তে চেয়েছে। পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে মানুষের আকাশে উড়ে বেড়াবার অনেক কাহিনী জানা যায়। পাখির মত বাধাহীনভাবে আকাশে উড়ে বেড়াবার চেষ্টা আসলে মানুষের স্বাধীন হবার ইচ্ছার প্রতিফলন। যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের হাজার বছরের চেষ্টা সফল হয়। আকাশের নিঃসীম সীমানা মানুষের হাতের নাগালে আসে। মানুষ স্বাধীনভাবে দ্বিগ্বিদিক উড়ে যাবার অধিকার পেয়ে যায়। এই সফলতা যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাস্তবরূপ পায় তারা হলেন উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট।

সার্কাসের অন্যতম আকর্ষণ নিজে নিজে চলতে থাকা ঘোড়াবিহীন গাড়ি।
বেলুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা প্রথম সফল হয়। গ্লাইডার এনে দেয় গতিবেগ। কিন্তু দুটোই ছিল অনিয়ন্ত্রিত। বেলুন চলতো বাতাসের প্রবাহের উপর নির্ভর করে। বাতাস থাকলে চলবে, না থাকলে চলবে না। বায়ুর চেয়ে হাল্‌কা হবার কারণে বায়ুর উপর বেলুনের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। গ্লাইডারের গতিপথ ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। তীব্রবেগে একমুখী হয়ে ছুটতে থাকে। আর এইসব সমস্যা সমাধান হয়েছে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের হাত ধরে।

আজকের আলোচ্য বইয়ের নাম "আকাশ যারা করলো জয়"। নামেই বইয়ের পরিচয় প্রতিফলিত। এই বই আকাশ জয়ের গল্প নয়, বরং আকাশ যারা জয় করেছে তাদের গল্প। ঠিক জীবনীর মত নয়, তবে জীবনেরই নানা ঘটনার বিবরণ।

উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট দুই ভাই। পিতা ধর্মযাজক, মাতা গৃহিনী। এক বোন নিয়ে গতানুগতিক পরিবার। তাদের মা ছিলেন অন্যরকম মানসিকতার। সন্তানদের কল্পনা, ইচ্ছা ও ভাবনাতে খুব উৎসাহ দিতেন। তাদের সমস্ত কৌতুহলকে প্রশ্রয় দিতেন আনন্দের সাথে। বুদ্ধিদীপ্ত জীবন ছিল তাঁর। সেজন্য ছেলেরাও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছিল। একবার অরভিলের পাখির মত উড়বার ইচ্ছা শুনে মা তাকে খুব উৎসাহ দেন। এই প্রসঙ্গে মা সুসান রাইট সম্পর্কে লেখকের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য এমন-

এই ছিল সুসান রাইটের আরেকটি গুণ। অন্য অনেক মায়েরা এসবকে মনে করবে, আবোল-তাবোল কথা। তারা হয়তো তখন বলে উঠবে, আঃ, বোকার মতো কথা বলো না। কিন্তু সুসান রাইট তা করতেন না। তিনি জানতেন, এগার বছরের ছেলেরও নিজের একটা আইডিয়া থাকতে পারে। এগার বছরের ছেলের মাথা থেকে এসেছে বলেই সে আইডিয়া বোকার কাণ্ড হয় না। তিনি তাঁর ছেলেদের শিশু বলে একেবারে তুচ্ছ করতেন না। পৃষ্ঠা- ১১


তাদের কৈশোর থেকে শুরু হয়েছে এই বই। নিজে নিজে দুইজনে তৈরি করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। মায়ের কাছ থেকে শিখেছে নকশা আঁকা। বুঝতে পেরেছে মাপমতো সঠিকভাবে নকশা আঁকতে পারলে মূল কাজ ত্রুটিমুক্ত হয়। একে একে স্লেজগাড়ি, ঠেলাগাড়ি, মায়ের জন্য চেয়ার তৈরি করতে করতে তারা যন্ত্র তৈরিতে হাত পাকিয়ে ফেলে। সমসাময়িক সময়ে সাইকেল আবিষ্কার হয়েছে। ঘোড়ার বদলে ইঞ্জিন চালিত গাড়ি তৈরি হয়েছে দু'একটি। সার্কাসের অন্যতম আকর্ষণ এই নিজে নিজে চলতে থাকা ঘোড়াবিহীন গাড়ি। যন্ত্র দিয়ে নৌকা চালাবার ঘটনাও শোনা গেছে। উন্নতমানের ইঞ্জিন তৈরির গবেষণাও চলছিল সমান তালে। এমনই এক উন্নততর প্রযুক্তি সুবিধাবিহীন সময়ে রাইট ভাইয়েরা মানুষের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নকে সত্যি করে তুলেছিল। কয়েক বৎসরের নিরন্তর চেষ্টা সফল হয় ১৯০৩ সালের ১৭ই ডিসেম্বর। বইয়ের পাতায় পাতায় আছে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের ব্যাপক পড়াশোনা, চিন্তা, উদগ্র আকাঙ্ক্ষা, পরিশ্রম, ভুল, ব্যর্থতা, সংশোধন ও সফলতার কাহিনী। লেখক খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকেও গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করেছেন।

আসলে এই বই এক অভিযাত্রার গল্প। বিজ্ঞানী হয়ে উঠবার ধাপগুলো সরল নয়। নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হলে চাই নতুন ভাবনা ভাববার সামর্থ। সেই ভাবনাকে যুক্তির নিরিখে পরিমাপ করার জন্য দরকার প্রাথমিক গণিতের ধারণা। সাথে যদি মেশে কৌতুহল ও অভিজ্ঞ কারও মানবিক ও বুদ্ধিদীপ্ত নির্দেশনা, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। আবিষ্কারের গল্পের সাথে সাথে আবিষ্কারকদের জীবনযাত্রার গল্প জানাও প্রয়োজন। তাহলে গবেষণার প্রক্রিয়াগুলো অপরিচিত থাকেনা।

আলোচ্য বই Quentine Reyaolds এর লেখা The Wright Brothers বইয়ের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। বইয়ের “শিরোনাম পৃষ্ঠায়” তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে এই তথ্য লেখা রয়েছে। তথ্যটুকুর উল্লেখ না থাকলে একথা বোঝা কঠিন হত। কারণ বইয়ের ভাষারীতি কোথাও প্রচলিত অনুবাদের মত রসহীন যান্ত্রিক নয়। সাবলীলভাবে একটার পর একটা ঘটনা সামনে আসতে থাকে। পাঠক আনমনা হয়ে এগিয়ে যেতে থাকে পরের পাতার দিকে। বাক্যভঙ্গী, শব্দচয়ন, উপমা, উদাহরণ সবক্ষেত্রে লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। অনুবাদ সাহিত্যকে এতটা মুখরোচক করতে পারা অনুবাদক মোহাম্মদ নাসির আলী'র সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার ও সাহিত্যবোধের পরিচায়ক।

ছোটদের উপযোগী বইয়ের যে বৈশিষ্ট্য, তা এই বইয়ে রক্ষিত হয়েছে। সরল শব্দ, ছোট ছোট আকর্ষণীয় বাক্য পড়তে ও বুঝতে কোন কষ্ট হয়না। নমুনা হিসেবে কয়েকটি বাক্য উল্লেখ করা যেতেই পারে।

তখনও অবধি তাদের পরিকল্পনাটি ছিলো লোকচক্ষুর অন্তরালে। মানুষ উড়ে বেড়াতে পারবে একথা ১৯০০ সালে কেউ বললেও লোকে তাকে উপহাস করেছে। বৈজ্ঞানিকরা অবধি এ প্রচেষ্টাকে উপহাস করেছেন। একজন বৈজ্ঞানিক তো এক প্রবন্ধে লিখেই ফেললেন, হাজার বছর পরেও মানুষ উড়তে পারবে না। পৃষ্ঠা- ৯৭

বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োজনীয় ছবি রয়েছে। পুরনো প্রযুক্তিতে ছাপানোর কারণে ছবিগুলো মান হয়তো আধুনিক কালের মত নিখুঁত ও স্পষ্টতর নয়, কিন্তু তরুণ পাঠকের মনে কৌতুহল ও উৎসাহ জাগাতে সক্ষম।

আকাশ যারা করলো জয় – অনুবাদ: মোহাম্মদ নাসির আলী নমুনা ছবি
'আকাশ যারা করলো জয়' বইয়ের নমুনা ছবি
বইয়ের প্রথম প্রকাশকাল ১৯৬৩ সাল। হাতের বইটি ১৯৮৮ সালের ষষ্ঠ প্রকাশ। নিউজপ্রিন্টে ছাপা বই প্রকাশ করেছে বিখ্যাত ও অধুনাবিলুপ্ত 'মুক্তধারা প্রকাশনী'। এই ধরণের বুদ্ধিদীপ্ত বই প্রকাশে মুক্তধারা প্রকাশনী সবসময় অগ্রণী ভূমিকায় ছিল। আলোচ্য বইটি বর্তমানকালের শিশু-কিশোরদের পড়া উচিত। সে লক্ষ্যে কোন একজন আধুনিক প্রকাশক এগিয়ে এলে ছোটদের বিজ্ঞানচিন্তা সমৃদ্ধ হবে।

≈~≈~≈~≈~≈~≈~≈~≈~≈
আকাশ যারা করলো জয়
মোহাম্মদ নাসির আলী


প্রচ্ছদ-শিল্পী: বীরেন সান্যাল
গ্রন্থ-চিত্রণ শিল্পী: জ্যাকব ন্যানডাও

প্রকাশক: মুক্তধারা, ঢাকা।

প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৩
ষষ্ঠ প্রকাশ: ১৯৮৮

পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১১৪
মূল্য: লেখক কাগজ: ২৭.০০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ