'ধু ধু' ও চঞ্চল নাঈম - হিম ঋতব্রত

'ধু ধু' - চঞ্চল নাঈম - হিম ঋতব্রত


এ-ই মাত্র কদিন আগে নানা স্থান ঘুরে ঘুরে আমার কাছে এলো 'ধু ধু'(২০২১)। তারপর পড়ে ফেলা... পড়ার কি শেষ আছে?

এ-ই 'ধু ধু' পড়ার পর বুকের ভেতর হঠাৎ কোনও তোলপাড় শুরু হয় না; ভীষণ স্থির— হেলে দুলে কাছিম গতিতে এর স্বাদ নেয় মন। কবির জীবন ও যাপনের কোন গহীনে চলে যায়... জলে, বাতাসে, সবুজে সাঁতরে বেড়ায় এই দেহপাখি।

কবিতাবইটির মলাট খুলে কয়েকপৃষ্ঠা উল্টাতেই যে ভূমিকাটুকু রয়েছে, তা-ই যেন সব আলো কেড়ে নেয়। আহা! যখন এমন করে বলা হয়,

'গাছের পাতার রঙ যদি কোনো দিন, সকল সবুজ থেকে হলুদাভ হতে শুরু করে, সেই দিন বুঝবে তুমিও, শুরু থেকে শেষ কিংবা শেষ থেকে সম্প্রতি পাতার নিবিড় কাহিনী। সেদিন গাছের মগ ডালে পাখিরাও শিস দিয়ে শোনাবে ফুলের সকল কলহ, সেই দিন মৌমাছি নির্মম ফুলের রহস্যে ভেসে যাবে আর পৃথিবী-আঁধার যেন টলোমল মৌচাক খোঁচাবে।

হয়তো পাখিরা ভাবতে ভাবতে দিন, এক দিন শেষ হবে। মেঘের সূর্যাস্ত লাল রঙ জলের উপর ঢেউ খেলে মেলে যাবে মেঘের গহীন। গুড়ি গুড়ি মেঘের আঁচড়ে তোমারও চোখ, চোখের পাঁপড়িরা অনেক অনেক ব্যাথা ক'রে উঠবে তখন, দেখবে তুমিও বৃক্ষ-ছাল বাকল শুধুই ফেঁটে কী সব ঝরবে!

শুধু বিষাদের কান্না কিংবা পাতাটির হলুদ নকশা পাখিদের আঙ্গুলের চাপে ছিঁড়ে-ফুঁড়ে যাবে, তখন পাতার দেহ ঘেঁষে দীর্ঘশ্বাসে কী সব ঝরবে...!



তখন এ-ই লেখায়, ভাবনায়, পাতায় ও প্রকৃতিতে ডুবে যেতে কার না ভালো লাগে! এবং কবি যখন আঁকেন— কী অদ্ভুত ও আশ্চর্য তাঁর জীবন রেখা। আর কবিতাকে যখন জীবনের মতো দেখা যায়, অনুভব করা যায়, বোঝা যায় এর ভেতর রয়েছে 'সম্পর্কের নৈশব্দ' কিংবা 'বুদবুদ সম্পর্ক'; জীবনের সকল সম্পর্কই তখন যেন পূর্নতা পায় মৃত্যুতে... আর তা-ই তো আমরা 'মৃত্যু' দিয়েই জীবনের শেষ পৃষ্ঠাটি উল্টাই তারপর বন্ধ করি মলাট!

কবির হৃদয় থেকে টুপটুপ কবিতা ঝরে। আর কবিতা যখন কবিতার মতো সুন্দর হয়, তখনই তো তাকে আমাদের ভালো লাগে।


এ-ই যেমন,  

হাঁ-নৈঃশব্দ

বুনো ভ্রূণের রক্তাভ দেহ ছুঁয়ে-টুঁয়ে মাকড়সাও
পচা-ছেঁড়া পাতার ভেতর মাথা ঠুঁকতে-ঠুঁকতে
পিঁপড়েদের ভ্রূণের গহ্বর ধ্বংস করে; হাঁ-নৈশব্দে
ন্যাঙরা দু’জন সর্পী ঝুরঝুরে ঢিবি পার হ’য়ে
কালো অন্ধকার ব্যবধানে অনিশ্চিত মিশে যায়
একঝাঁক যাযাবর বিষাদ হাঁ-করা প্রাকৃতিক
গহ্বরের মধ্যে প্রশ্ন রেখে জেগে ওঠে জলহীন
রৌদ্রলতাহীন । নুনহীন। তিক্তমধু।তুমি-আমি?



বেদনা

পুঁইপাতাগুলো ঘিরে একটা ফড়িঙ আরেকটা ফড়িঙের মাথার উপর ভনভন আওয়াজে উল্লাসে উড়ছে; পুঁইগাছের গোড়ায় ঝরাপাতা, হলুদপাতা বিষাদে শুয়ে আছে জড়াজড়ি। হঠাৎ ফড়িঙের পায়ের প্রবল আঁচড়ে একটা সবুজাভপাতা ঝরে গেলো! বিষণ্ণ পাতাটি ছায়ায় এলিয়ে পরিপূর্ণ । এরপর সন্ধ্যাস্মৃতি, ঘনরাত, সকাল কুয়াশা, সূর্যালোক-দেহ আর সবুজ পাতাটি হলুদ আবর্ণ নিয়ে— আমি দেখি পাতাটির চোখ-মুখে অথই অশ্রুর গূঢ়মৃত্যু, আবছা আলোক। আর্তনাদে আজ সজীব বুকের, হলুদপাতার শরীরের হাড়গোড় ভেঙে গেলো। যেন তার আত্ম-অনুরাগ, দীর্ঘশ্বাস, অশ্রুগুলো সবুজ বর্ণে আর ফিরে এলো না। শুকিয়ে গেলো।


মৃত্যু


যেন নিভৃতে মৃত্যুর কাছাকাছি থাকি

আমার নিথর দেহ থেকে মৃত্যু সুঘ্রাণ ছড়ায়
তখন শুধুই বিছানার এক কোনে জড়োসড়ো
মৃতের দেহের বেশে ছটাং পড়ে থাকি
চিন্তার সুড়ঙ্গ চারপাশে কোন কান্নার কঙ্কালে রোল নেই, রেখা নেই
কোন শব্দ নেই
অসংখ্য আয়োজন, নিঃশব্দ ইঙ্গিত


কবির স্বভাবের মতোই তাঁর কবিতার স্বভাব— গভীর, শান্ত, স্নিগ্ধ ও সুন্দর।
ভালো লেগেছে আরও কিছু কবিতার কিছু পঙক্তি... আমার কাছে বইটির যেটুকু মন্দ তা ঢেকে রেখেছে অই এক অপূর্ব ভূমিকা আর এ-ই কটি কবিতা।

-0-0-0-0-0-
কবিতাবই : ধু ধু
কবি : চঞ্চল নাঈম
প্রচ্ছদ : মোজাই জীবন সাফরী
প্রকাশ : জুন, ২০২১
প্রকাশক : প্রতিশিল্প

মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

  1. কবির স্বভাবের মতোই তাঁর কবিতার স্বভাব— গভীর, শান্ত, স্নিগ্ধ ও সুন্দর।

    উত্তরমুছুন

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম