ক্রীতদাসের হাসি - শওকত ওসমান: মানব জীবনের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি | নুসরাত জাহান

ক্রীতদাসের হাসি - শওকত ওসমান

হাসি, মানব জীবনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। এমিলি ডিকিনসনের মতে 'হাসি নির্মলতার চিঠি'। জীবনে সুখ-দুঃখ আপেক্ষিক বিষয়। আর এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে হাসি-কান্না নামক অভিব্যক্তিতে। হৃদয়ে ধারণ কিংবা অন্তরে অনুভব করা ছাড়া এই অভিব্যক্তি যে কতটা দুষ্প্রাপ্য সেটা খুব বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮) রচিত 'ক্রীতদাসের হাসি' উপন্যাসে।

উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হাবশি গোলাম তাতরী। আব্বাসীয় খলিফা হারুণ অর রশিদের হাবসি ক্রীতদাস ও আর্মেনীয় দাসী মেহেরজানের প্রেমের স্বীকৃতি দেন খলিফার স্ত্রী জুবায়দা। খলিফার অজান্তেই রাজমহিষী তাদের দুজনের বিবাহ দেন। বিবি জুবায়দার অনুমতিক্রমেই প্রতি রাতে নির্ধারিত স্থানে তারা দেখা করত।

খলিফা হারুনুর রশিদ বাগদাদের অধিপতি। উজিরে আজম জাফর বার্মাকির হত্যার আদেশ কার্যকর হওয়ার পর তার মধ্যে মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। একদিন রাতে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নির্মল হাসির শব্দ শুনতে পান তিনি। মুহূর্তেই তার হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে সেই হাসির শব্দ। এই হাসির উৎস খুঁজতে গিয়েই তিনি দেখতে পান গোলাম তাতারী ও তার স্ত্রী মেহেরজানের প্রণয়দৃশ্য এবং শোনেন তাতারীর প্রাণখোলা হাসি। ক্রীতদাস পল্লীতে চরম দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস করলেও তাদের এই হাসি থামে না।

বাদশাহ হারুন রূপবতী দাসী মেহেরজানকে রানীর মর্যাদা দিয়ে প্রাসাদে নিয়ে আসেন। তাতারীকে একটি রাজ্যের রাজত্ব দেয়া হলো। অন্য আরো সুবিধা দিয়ে বলা হলো এর বিনিময়ে খলিফা প্রাণখোলা হাসি শুনতে চান কিন্তু তাতারী আর হাসে না। তাতারীর প্রাণখোলা হাসির উৎস ছিল প্রিয় মেহেরজান। সে এখন খলিফার রানী। প্রিয়া বিরহে তাতারী প্রাণখোলা হাসি তো দূরের কথা, সামান্য হাসিও হাসতে পারে না। এতে খলিফা অপমানিত বোধ করেন। হাসি শোনানোর জন্য তাতারীকে বারংবার  সময় দেয়া হয়। বাগদাদের সবচেয়ে সুন্দরী ও আবেদনময়ী নর্তকীকে তাতারীর মহলে পাঠানো হয়। কিন্তু সে তাতারীকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়। বরং তাতারীর নৈতিকতার কাছে পরাজিত হয়ে সে আত্মহত্যা করে। এ আত্মহত্যাকে হত্যা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে তাতারীর ওপর এর দায় চাপানো হয়। তার বিচার হয়।


সাহিত্যে সমাজের অনিয়ম, অনাচার ফুটে ওঠে। আর এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন লেখক, কবি, সাহিত্যিকেরা। এখানেও খলিফার নির্দয়তায় আপত্তি তোলেন কবি নওয়াস। ফলে তাকে রাজদরবার থেকে বহিষ্কারও হতে হয়।

তাতারীকে হাসাতে ব্যর্থ হয়ে খলিফা তার ওপর নির্যাতন শুরু করেন। তাতেও কাজ হয় না। সকল প্রকার অত্যাচার নির্যাতনে সে নীরব থাকে। অতঃপর সর্বশেষ কৌশল হিসেবে মেহেরজানকে তাতারীর কাছে নিয়ে আসা হয়।

কিন্তু মেহেরজান এখন তাতারীর প্রেমিকা নেই, এখন সে খলিফার রানী। প্রথমে মেহেরজান তাতারীকে চিনতেই পারে না। পরে চিনতে পারলেও প্রাক্তন প্রেমিককে সে কোনো কথাই বলাতে পারেনি। শত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে খলিফা হারুন দুঃখে, ক্ষোভে চরম উত্তেজিত হয়ে তাতারীকে চাবুক মারার আদেশ দেন। মেহেরজান চলে যাওয়া শুরু করলে তাতারী মুখ খোলে। মেহেরজানকে পিছু ডাক দেয় এবং খলিফাকে বলে-

শোন, হারুনর রশিদ। দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব! কিন্ত ক্রীতদাসদের হাসি না।


এ উক্তিই উপন্যাসের জীবনদর্শন। এ পর্যায়ে কবি নওয়াস প্রবেশ করে মন্তব্য করেন-

আমিরুল মোমেনিন, হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি।


কবি নওয়াসের কণ্ঠে অসাধারণ এ উক্তিটির মাধ্যমে উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে।    

'ক্রীতদাসের হাসি' উপন্যাসটি আরব্য রজনী আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা-এর শেষ গল্প 'জাহাকুল আবদ'- এর অনুবাদ। ভূমিকা অংশের পরেই পান্ডুলিপি আবিষ্কারের ঘটনার খুব চমৎকার বর্ণনা দেওয়া আছে। রচনা এবং প্রকাশকাল অনুযায়ী ধারণা করা হয় এ উপন্যাসে রূপকারের আইয়ুবি স্বৈরশাসনের স্বরূপ এবং পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের অন্তর্সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে উপন্যাসটি যেন মানব জীবনের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।    

জীবনবাদী কথাশিল্পী শওকত ওসমানের রূপকধর্মী এ উপন্যাসটি ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। সময় প্রকাশন - এর প্রকাশক ফরিদ আহমেদ কর্তৃক প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। ৮০পৃষ্ঠা সংবলিত এ বইটির বাজারমূল্য ১০০টাকা মাত্র।

মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

  1. সময় থেকে প্রকাশিত বইয়ের প্রকাশকাল কত তা লেখা উচিত ছিল। না হলে মনে হচ্ছে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত বইয়ের দাম ১০০ টাকা, এটা আলোচক আপুর বোঝা উচিত ছিল।

    উত্তরমুছুন

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম