হায়াৎ মামুদ রচিত 'গিলগামেশ' সম্পর্কে অন্তর চন্দ্রের আলোচনা

হায়াৎ মামুদ রচিত 'গিলগামেশ' সম্পর্কে অন্তর চন্দ্রের আলোচনা

লেখক পরিচিতি:
হায়াৎ মামুদ ২ জুলাই ১৯৩৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার মৌড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান লেখক। তিনি একাধারে আধুনিক কবি, প্রবন্ধকার, অনুবাদক ও অধ্যাপক। "মৃত্যুচিন্তা রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জটিলতা" তার বিখ্যাত গ্রন্থ যা ১৯৬০-এর দশকে প্রকাশিত হয়ে সাড়া জাগিয়েছিল। তিনি শিশুদের জন্য অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ২০১৬ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেছেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও কবীর চৌধুরী শিশু সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি রবীন্দ্র পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।


পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মহাকাব্য বলা হয়ে থাকে 'গিলগামেশ'কে এর রচিয়তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন , এটি চার হাজার বছর আগে রচিত হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন এটিই পৃথিবীর প্রথম পুরাণ, যা মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে রচিত হয়। প্রাচীন আসিরিয়ার রাজধানী নিনেভেহ্ শহরে আসিরিয় রাজ আসুরবনিপলের এক বিরাট পাঠাগার ছিল। সেখান থেকেই ঊনবিংশ শতকের পঞ্চশ দশকে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ তা উদ্ধার করেন। সে সময় লেখার মতো কোনো কাগজ কিংবা পাথর সেখানে ছিল না, তাই তারা এঁটেল মাটির তৈরি তক্তিতে সূচালো কাঠি দিয়ে দাগ কেটে কেটে লিখতেন। তারা যে লিপিতে লেখা লিখত সেই লিপির নাম বাণমুখ বা কীলক লিপি, ইংরেজিতে কিউনিফর্ম বলে। সর্বমোট ১২ টি তক্তির উপর বাণমুখ লিপিতে এই মহাকাব্যটি লিপিবদ্ধ হয়েছিল। তখন সেই সময়কার লোকজনের মুখের ভাষা 'আক্কাদীয়' ভাষায় লেখা হয়েছিল গিলগামেশ।

সবচেয়ে দারুণ একটি গল্প উঠে এসেছে গিলগামেশ কাব্যের মধ্যদিয়ে। যা আমাদের চিন্তা-ভাবনার অনেক উর্দ্ধে। হায়াৎ মামুদ আমাদের জন্য এই কাহিনীটি খুব সহজ-সরল ভাবে শিশু-কিশোরদের জন্য উপস্থাপন করেছেন। যারা এই মহাকাব্যটি লিখেছেন তাঁরা হয়তো সাধারণ কেউ ছিলেন না। নিশ্চয়ই মহান মানুষ ছিলেন। এই উপখ্যানটি তাঁর একমাত্র প্রমাণ।

প্রেক্ষাপট :
সে সময় উরুক্ শহরে বিশাল ক্ষমতাধর, শৌর্য- বীর্জে বলীয়ান এক রাজা ছিলেন। দেখতে বেশ চমৎকার ছিল, যেন স্বর্গের দেবপুরুষ। তাঁর নাম গিলগামেশ। মাতা দেবী নিনসান্ জ্ঞানবুদ্ধির এক স্বনামধন্যা দেবী। পিতা ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ লুগালবান্দা। পিতা মানুষ এবং মা স্বর্গের দেবী অর্থাৎ গিলগামেশ অর্ধেক মানুষ অর্ধেক দেবতা । খানিকটা অর্ধনারীশ্বরের মতো। তিনি পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। প্রচুর শক্তি এবং তাঁর প্রতিপক্ষ না থাকার কারণে তার খুব অহংকার বেড়ে যায় । তিনি প্রথমদিকে খুব ভালো একজন রাজা ছিলেন। যখন তাঁর শক্তির দম্ভ বেড়ে যায় তখন রাজ্যে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে। তাঁর নির্যাতনে প্রজারা অতিষ্ঠ। তখন প্রজারা স্বর্গের দেবরাজ আনু'র নিকট পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করেন। দেবরাজ আনু'র নির্দেশে প্রজাদের রক্ষার্থে দেবী আরুরু মাটি ছেনে গিলগামেশের মতো বড় ভীষণ সুন্দর মূর্তি তৈরি করলেন। তাঁর নাম দিলেন এনকিদু। প্রজাদের রক্ষার জন্য তাঁর জন্ম হলো এক গভীর অরণ্যে , সেখানে হিংস্র পশুর-পাখি ছাড়া কেউ থাকে না। এনকিদু সারা শরীর ছিল লম্বা লোমদ্বারা আবর্তিত। গভীর অরণ্যের মধ্যে তার বেড়ে উঠা শুরু হলো। একদিন হঠাৎ উরুকের এক অধিবাসী শিকারী বনে গিয়েছিলেন শিকার করতে গিয়ে দেখতে পেলেন কী ভীষণা এক জন্তু যা আগে কখনো দেখেননি। কিছুটা মানুষের আকৃতি কিছুটা বন্য পশুর মতো, ভয়ে শিকারি পালিয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো আমার স্বপ্ন ছিল, অন্ধকারে ঠিক দেখতে পাইনি। পরদিন আবার যখন শিকারের জন্য ফাঁদ পেতে রেখে এসেছিলেন। কিছুক্ষণ পর এসে দেখতে পান জন্তুটি তার ফাঁদ থেকে সকল প্রাণীকে রক্ষা করছেন। এ খবর পৌঁছে দিতে হবে রাজার কাছে! তখন রাজার কাছে এই খবর দেওয়া হয়। রাজার নির্দেশে নগরনটী দ্বারা এনকেদুকে নগরে নিয়ে আসা হয়। এদিকে গিলগামেশ স্বপ্নে দেখলেন 

" আকাশ থেকে একটি তারা খসে পড়ছে, সারা উরুকের লোক তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে হৈ হুল্লোড় করে আনন্দ করছে। ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারলাম, বড় হিংসা হচ্ছে, রাগ হচ্ছে। যখন ওটাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও ফেলে দিব কিন্তু ক্রমশ শক্তি ক্ষয় হতে লাগল, ওটাকে ওঠাতে পর্যন্ত পারলাম না।"

এই স্বপ্নের উত্তর খোঁজার জন্য তার মা নিনসানের কাছে যান তার মা কিছুক্ষণ পর বলেন...

"যে তারাটা খসে পড়ল সে তোমার সমকক্ষ । স্বর্গ থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে। তুমি তাকে তোমার পথ থেকে সরাতে চাইবে কিন্তু পারবে না।  এই হলো তোমার স্বপ্নের অর্থ।"

 

এদিকে এনকিদু গিলগামেশের সকল অন্যায় দূর করার জন্য উরুক নগরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেদিন ছিল নববর্ষ। গিলগামেশ বিয়ে করবেন একজন অবিবাহিত মেয়েকে। সে রাজ্যের নিয়ম ছিল কেউ যদি কোনো মেয়েকে বিয়ে করে তবে তার আগে সেই মেয়ের সাথে রাজার আগে বিয়ে হবে। তারপর রাজার সেবা যত্ন কিছুদিন করার পর  মেয়েটির সাথে অন্য কারো বিয়ে হবে। এ অন্যায় কখনও মেনে নেওয়ার মতো নয়। এমন সময় উপস্থিত হলেন এনকিদু ভীষণ পরাক্রমশালী। কুমারী প্রাসাদে অবিবাহিত মেয়েদের জামায়েত করা হয়েছে সেখান থেকে রাজা একজন মেয়েকে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করবেন। এনকিদু পথ আটকে দাঁড়িয়ে পরলেন। তারপর গিলগামেশ এবং এনকিদু'র মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ লেগে যায়। এ যুদ্ধ চলল সারাদিন, সারারাত, দুপুর গড়িয়ে, সন্ধ্যা হয়ে এলো , এমন সময় দু'জন, দুজনকে দেখে একে অপরের মুখ দেখতে লাগলেন একই রকম দেখাচ্ছে। এতক্ষণ যুদ্ধের ঘোরে কেউ কাউকে দেখতে পায়নি । দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে হা হা করে হাসতে লাগলেন। তখন থেকেই তাদের বন্ধুত্ব শুরু হল।

তারা একদিন শিকারের জন্য  বনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। এ যে সে বন নয়, সাত পাহাড়ের ওপারে দেওদার বনে। সেখানে একটা দেওদার গাছ আছে সেটা কেটে আনব। স্বর্গের দেবতাদের পবিত্র এ গাছ। এই গাছ পাহারা দেন ভয়ঙ্কর সব দৈত্য। সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। এনকিদু এতে সম্মত হলেন না, দেবতা এনজিন তার মনিব, হুম্বাবা তাঁরই  হুকুমে সেখানে পাহারা দিচ্ছে। গিলগামেশ হা হা করে হেসে উঠলেন। সে নাছোড়বান্দা যে করেই হোক সে সেখানে যাবে। সে সেইসব দৈত্যদের পরাজিত করে জগৎতের মধ্যে তাঁর অক্ষয়কীর্তি স্থাপন করবে। গিলগামেশ সবাইকে রাজি করে এখন হুম্বাবাকে বধ করার জন্য যাবেন‌। তাঁর মা দেবী নিনসানের আশীর্বাদ নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। নিনসানের অনুরোধে সূর্যদেব শামাশ রইলেন তাদের সাথে উপর থেকেই তিনি সব পরিচালনা করেছেন। তাঁর মা জানতেন সূর্যদেবের সাহায্য ছাড়া কেউ সেই স্বর্গ দৈত্যকে বধ করতে পারবে না। সামনে এগিয়ে চলছে এনকিদু  তাঁর আগে থেকেই এই পথগুলো চেনা ছিল। কারণ তাঁর জন্মের ঊষা লগ্ন থেকেই তিনি এই জঙ্গলে ছিলেন। তিন দিন তিন রাত ধরে তাঁরা পথ চললেন, দীর্ঘ ছয় সপ্তাহের পথ অতিক্রম করে দেওদার বনে এসে পৌঁছলেন। সাহসী গিলগামেশ  ভয়ে বুক ধক ধক করে উঠলো।  এদিকে মানুষ বনে আসার খবর পৌঁছে গেল হুম্বাবার কাণে। দিন যায়। তাঁরা সবুজ পাহাড়ের নিকট এসে দাঁড়িয়েছেন। সেই পাহাড়ের মাথায় দেওদারের সারি; দেবতারা সেখানে এসে সভা করেন। তাঁরা সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন কুড়ুল হাতে নিয়ে তাঁরা সোজা চলে গেলেন দেওদার গাছের কাছে। সজোরে কোপ দিলেন গাছের গোড়ায়, কিছুক্ষণ পর প্রচণ্ড শব্দে বিশাল গাছটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বনদৈত্য আওয়াজ শুনে দৌড়ে আসলেন। তীব্র গর্জন, ভয়াল, ভীষণদর্শন। তাঁরা দুজন ভয় পেয়ে গেলেন , দৈত্যের কাছে তাদের শক্তি তুচ্ছ। তখন তাঁরা প্রার্থনা জানালেন সূর্যদেব শামাশ এর কাছে, তৎক্ষণাৎ তীব্র বাতাস ঘনিয়ে এলো, হুম্বাবা চোখ মেলে তাকাতে পারলেন না। সেই সুযোগে গিলগামেশ কুড়ল দিয়ে হুম্বাবার মাথা কেটে ফেলেন। এভাবেই দৈত্য হুম্বাবার বধ হয়।

প্রেমের ও যুদ্ধের দেবী ইশতার গিলগামেশ কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এতে করে গিলগামেশ রাগান্বিত হয়ে,তাকে বুড়ি বলে গালি দেয়। দেবী ইশতার অপমানের কথা কথা তাঁর বাবা আনু'র নিকট বলেন। তখন মেয়ের চোখের জল দেখে বাবা মেয়ের প্রতি প্রসন্ন হয়ে বলেন, এখন কি করতে হবে? দেবী ইশতার স্বর্গবৃষকে গিলগামেশের পিছনে লাগিয়ে দিতে বললেন। স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে এলো স্বর্গবৃষ। তৎক্ষণাৎ হত্যা করল তিনশত লোককে। তাঁর চোখে আগুন, দু কশে ফেনা, নাক দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে ভীষণ রবে। দাঁড়িয়ে পড়লেন গিলগামেশ‌ এনকিদু'র সামনে। তাঁদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হল। এনকিদু নিরবে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় বুদ্ধি এলো এবার লেজ ধরতে হবে। এনকিদু অমনি লেজ ধরে, ষাঁড়ের কাতুকুতু লেগেছিল। সেই সময় ষাঁড়ের দুটো শিং ধরে আরেক হাতে ছোরা আমূল ঢুকিয়ে দিল ঘাড়ের তলা দিয়ে হৎপিণ্ডে। স্বর্গবৃষের মৃত্যু হল। এদিকে ইশতার জ্বলে পুড়ে আগুন।

স্বর্গবৃষ বধ করবার পর সেদিন রাত থেকেই এনকিদু'র আঘাত পাওয়ার হাতের যন্ত্রণায়, জ্বর এসে গেল ‌। জীবন যায়যায় অবস্থা। তাঁরা বুঝতে পারলেন হুম্বাবা ও স্বর্গবৃষ বধ করে তাঁরা অপরাধ করেছেন। এদিকে দীর্ঘ ন'দিন  তীব্র জ্বরে এনকিদু'র মৃত্যু হল। বন্ধুর মৃত্যু গিলগামেশ মেনে নিতে পারলেন না । তিনি ভাবলেন কীভাবে আমার বন্ধুর প্রাণ ফিরিয়ে আনা যায়। হঠাৎ মনে পড়ল, উৎনা পিশতিমের কথা, তিনিই একমাত্র লোক যে কিনা মানুষ হয়েও অমর। লোক মুখে শুনেছেন, পৃথিবীর শেষ প্রান্তের একটি দ্বীপে তাঁর আবাস। বন্ধুর মৃতদেহ নিয়ে উৎনা পিশতিমের উদ্দ্যেশ্যে ছুটলেন। আর মনে রইল না উরুক নগরের কথা, পড়ে রইল রাজ্য ও রাজাকার্য। এভাবেই চলতে চলতে তিনি একদিন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছলেন। মাটি ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল পর্বত মাশু। পূর্বে- পশ্চিমে তাঁর দেহ বিস্তৃত, সেই পাহাড়ের তোরণদ্বারে বৃশ্চিকমানব দ্বাররক্ষী। তাঁদের দেহ অর্ধেক কাঁকড়াবিছে, বাকি অর্ধেকটা মানুষ। সেই দ্বাররক্ষীদের মানা শর্তেও তিনি পাহাড় অতিক্রম করে, প্রচণ্ড অন্ধকার পেরিয়ে চমৎকার একটি জায়গায় এসে দাঁড়ান। সূর্যদেব শামশ আর এগোতে মানা করেন কিন্তু গিলগামেশ থামবার পাত্র নয়। যে করেই হোক উৎনা পিশতিমকে খুঁজে বের করতে হবে। এভাবেই একদিন সিদুরির সারাইখানাই গিয়ে উঠেন। সেখানে থেকেই জানতে পারেন উৎনা পিশতিম কোথায় থাকেন? তিনি মৃত্যুসায়র নদীর ঐপারে থাকেন।

সেই নদীর একমাত্র মাঝি ঊর্শানাবি কিন্তু তিনি কখনোই গিলগামেশকে সেই নদী পার করবেন না। তখন তিনি গিলগামেশকে গাছ কেটে ভেলা তৈরি করতে বলেন। কুড়ুল দিয়ে গাছ কেটে ভেলা সাজিয়ে , নদী পার হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন এবং ইচ্ছাশক্তির জোরে নদী পার হয়ে যান। উৎনা পিশতিমকে দেখে গিলগামেশ খুশি হলেন কিন্তু তিনি তাঁর বন্ধুকে বাঁচাতে পারলেন না।

তখন তিনি উৎনা পিশতিমকে জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে আপনি অমর হয়ে আছেন। তখন উৎনা পিশতিম বলেন, সে এক জনের জন্যই আমি বেঁচে আছি। ইউফ্রেতিস্ নদের ধারে একটা শহর ছিল। তাঁর নাম শুররুপাক। সেখানে থেকেই দেবতারা পৃথিবী পরিচালনা করেন। তাঁদের একদিন মনে হলো পৃথিবী ডুবে যাক ভয়াবহ বন্যায় , এরকম একটা দূর্যোগ সৃষ্টি করলে কেমন হয়? সবাই তাতে সায় দিলেন। উৎনা পিশতিম ছিল দেবতা এয়ার খুব পছন্দের মানুষ। তাই তিনি আগাম খবর উৎনা পিশতিমকে জানালেন এবং তীব্র বন্যায় বেঁচে থাকার জন্য নৌকা তৈরি করতে বললেন। সাত তলা নৌকা তৈরি করলেন উৎনা পিশতিম, প্রত্যেক তলায় নয়টি করে ঘর। তার পছন্দের জিনিসগুলো সেখানে তুললেন। এরপর শুরু হলো তীব্র বজ্রপাত , প্রবল বর্ষণ। মহাপ্লাবন এসে গেল। মানুষ, জীব-জন্তু সবাই মারা গেলেন। পৃথিবীর পালনকারী দেবী ইশতার দুঃখে কাতর হয়ে গেলেন। এমন দৃশ্য দেবতারাও আগে কখনো দেখেননি। ভয়ানক বৃষ্টি পড়তে লাগলো, চৌদিকে জল আর জল নৌকায় ভেসে রইলেন উৎনা পিশতিম ও তার সঙ্গিরা। এভাবেই সাত দিনের দিন একটা পাহাড়ের নিকট এসে নৌকা পৌঁছে গেল। কিন্তু সেখানে নামা যাবে না তাঁদের প্রয়োজন ডাঙা । অনেক খোঁজাখুঁজির পর, কাকের মাধ্যমে ডাঙার সন্ধান পেলেন এবং নৌকার সমস্ত লোকজন নেমে গেলেন কিন্তু উৎনা পিশতিম নামলেন না । পবনদেব এনলিল সতর্ক করলেন ,

"তোমরা স্বামী ও স্ত্রী এখানে নামবে না। তোমরা অমরত্ব লাভ করেছ। এই জলে ভাসতে ভাসতে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে একটা দ্বীপ পাবে এবং সেখানেই থাকবে।"


গিলগামেশ এই ইতিহাস শুনে বড় একাত্ব বোধ করলেন।  এতদিনের শ্রম ছিল বৃথা। বন্ধু এনকিদুকে পুড়িয়ে ফেলা হলো , তার সব স্মৃতি মুছে ফেলা হলো। সাতদিন সাতরাতের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন গিলগামেশ। তাঁর মনেই হলো না এতদিন ঘুমিয়েছেন । এখন বাড়ি ফেরার পালা এমন সময় উৎনা পিশতিমের স্ত্রীর অনুরোধে তিনি গিলগামেশকে মৃত্যসায়রের তলায় জীয়নলতার খবর দেন। যা খেলে মানুষ অমরত্ব লাভ করে। এবং সেই নদ থেকে জীয়নলতা তুলে এনে তাঁর রাজ্যের প্রজাদের জন্য নিয়ে গেলেন। হঠাৎ পথে ক্লান্তি এসে গেল, কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন, পাশেই রাখলেন জীয়নলতা। ঘুম থেকে উঠে দেখেন একটা সাপ সেটা খেয়ে তাঁর জীর্ণ খোলস রেখে চলে গেছেন। সব চেষ্টা এভাবেই ব্যার্থ হল, নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন গিলগামেশ।

উপসংহার:
মানুষ আজন্ম বেঁচে থাকার জন্য কত কিছুই না করেছে। এটা জেনেও যে, তাকে একদিন নয়তো একদিন মরতে হবে। আজীবন বেঁচে থাকার জন্য এ পণ্ডশ্রম। কতকিছুই না মানুষ চায়। গিলগামেশ শেষ পর্যন্ত সেই ব্যর্থ চেষ্টাই করে গেলেন। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কেউ নয়__ এটাই বাস্তবতা।

আমার দুটি কথা:
চারহাজার বছর আগের এই মহাকাব্যটি সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে বাংলায় অনুবাদ করে লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী হায়াৎ মামুদ শিশু-কিশোরদের গল্পের উপযোগী করে তুলেন। বইটি তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখলেও তা বড়দের জন্যও বেশ উপভোগ্য। এ মহাকাব্যের রচয়িতার কে ? তা কেউ জানে না! তাঁর ভাষ্যের মাধ্যমে গিলগামেশ প্রতিটি মানুষের মননরেখায় গেঁথে গেছে। বইটিতে রয়েছে একের পর এক চমক। যা মানুষকে  কখনো আনন্দ দেয়, কখনো দুঃখ দেয়, অনুভব করতে শেখায়। সে সময়কার দিনের স্মৃতি চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠে। বইটি পড়লে মনে হয় , আমি যেন উরুক শহরে কিংবা পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে পালাতে চায়। এই গল্প‌টি প্রমাণ করে যে, মানুষ চিরকাল শুধু এই পণ্ডশ্রম করেই চলেছে। গিলগামেশ বিষয়ে আরও কিছু জানতে গিয়ে ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল প্রকাশিত 'আনন্দবাজার পত্রিকায়' পেলাম

"২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ইউফ্রেটিস নদীর তীরে উরুক নগর-রাষ্ট্রে গিলগামেশ নামে সত্যিই এক রাজা ছিলেন। তিনি সম্ভবত পঞ্চম সুমেরীয় নৃপতি, যিনি তাঁর প্রতিপত্তিবলে পরে দেবতা হিসেবেই পূজিত হতে থাকেন। তাঁর নামে প্রচলিত নানান বীরগাথা আনুমানিক ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে লেখা শুরু হয়। লিখিত এই কাহিনিগুলিই সঙ্কলিত হয়ে জন্ম নিল পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’।"


চারহাজার বছর আগে গিলগামেশ মহাকাব্য যারা লিখেছেন তাঁদের মাথায় সেসময় এই কথাগুলো কোত্থেকে এসেছে তা সত্যিই অভাবনীয়। এই বইটি মানুষকে ভাবতে শেখায়, সেদিনের সেইসব কথা। পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর মতোই এখানে মহাপ্লাবনের কথা উঠে এসেছে। সেসময়কার সবচেয়ে বিপর্যয় অবস্থা ‌। আবার দেখা যাচ্ছে, মরা নিয়ে নদীতে ভাসার কথা। খানিকটা বাংলার বেহুলা - লক্ষ্মীন্দরের মতো। যে বিভীষিকার কথা শুনলে মন নাড়া দিয়ে ওঠে! লেখক মহাশয় যেটুকু আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, আমার মনে হয় তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে।  সব মিলিয়ে অসাধারণ।

-0-0-0-0-0-0-0-0

গ্রন্থ : গিলগামেশ
লেখক : হায়াৎ মামুদ
আলোচক : অন্তর চন্দ্র
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০০০
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : ধ্রুব এষ
পৃষ্ঠা : ৭৬
মূল্য : ১২৫ টাকা
ISBN : 984 _ 415 _ 104 _ X

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ