আসিফ নজরুলের 'মানবাধিকার' বইটি নিয়ে নুসরাত জাহানের আলোচনা

আসিফ নজরুলের 'মানবাধিকার' বইটি নিয়ে নুসরাত জাহানের আলোচনা


আলোচনা:
বর্তমান সময়ের বহুল উচ্চারিত এবং আলোচিত শব্দগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানবাধিকার। দেশিও কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেকোনো সংকট কিংবা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে হরহামেশাই আমরা মানবাধিকারের বিষয়টি উত্থাপন করি। মানবাধিকার ব্যপারটি আমাদের সকলের প্রথমিক জানা থাকলেও এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট এবং যথাযথ ধারণা খুব কম মানুষেরই আছে। এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান চর্চাও সীমিত। এই জায়গায় দাড়িয়ে বিশিষ্ট কলামিস্ট আসিফ নজরুল তার 'মানবাধিকার' বইটিতে অত্যন্ত সহজ-সাবলীল ভাষায় প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন, যথাযথ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট উদাহরণ টেনে মানবাধিকার সম্পর্কে পাঠককে সুস্পষ্ট ধারণা দেবার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি মোটামুটি সফল হয়েছেন বলে মনে হয়।

বইটি হাতে নিলেই রেনেসাঁর লাল রঙে আবছা 'HUMAN RIGHTS' লেখা বহু মানুষের প্রতিচ্ছবিতে উর্ধ্বগামী দু-হাতের মাঝে স্থান পাওয়া শিরোনাম সংবলিত প্রচ্ছদ যেন কোন বিশেষ ইঙ্গিতই বহন করে। সূচীপত্রে গিয়ে পরিচ্ছেদ গুলোর শিরোনামও বেশ আগ্রহ জাগায়৷ নয়টি পরিচ্ছদের শিরোনাম গুলো হচ্ছে যথাক্রমে- প্রশ্ন দিয়ে শুরু; পশু বা ক্রীতদাস নয়, মানুষ!; জাতিসংঘ ও সর্বজনীন মানবাধিকার ধারণা; প্রধান দুটি মানবাধিকার চুক্তি; আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার চুক্তি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বাস্তবায়ন পদ্ধতি; মানবাধিকার বাস্তবায়নের দেশীয় ব্যবস্থাসমূহ; বাংলাদেশে মানবাধিকার; মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ। সর্বশেষে পরিশিষ্ট অংশে আছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং গ্রন্থপঞ্জি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল। পেশাগত জীবনে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার দ্বারাই বইটির প্রথম পরিচ্ছদের সূচনা। নবীন শিক্ষার্থীদের সাথে মানবাধিকার নিয়ে কথোপকথন তুলে ধরে শুরুতেই সুস্পষ্ট করা হয় মানবাধিকারের সংজ্ঞা। লেখকের ভাষ্যে,

"শুধু মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার কারণে যেসব অধিকার পৃথিবীর যে কারও প্রাপ্য, সেটাকেই আমরা মানবাধিকার বলি।" 


এর পরেই মানবাধিকারের কিছু উদাহরণ এবং বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। মানবাধিকারের সঙ্গে অন্য অধিকারগুলোর মূল পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটি সর্বজনীন। অন্যটি যেকোনো মানুষের প্রাপ্য নয়। এসব অধিকার অর্জনের জন্য কোন না কোন যোগ্যতা থাকতে হয়। উভয়ের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে উদাহরণ স্বরূপ লেখক বলেছেন, 

"গুলশান বড়লোকের থাকার যায়গা। সেখানে থাকতে গেলে অর্থনৈতিক সক্ষমতায় বাড়ি কিনতে অথবা ভাড়া নিতে হবে। কিন্তু সেখানকার মসজিদে যেকোনো মানুষেরই নামাজ পড়ার অধিকার আছে।"


মানবাধিকারের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি হস্তান্তরযোগ্য নয়। একে মানুষের সহজাত অধিকার হিসেবে দেখা হয়। মানবাধিকার বিষয়টি সর্বজনীন, কিন্তু তা সব ক্ষেত্রে সীমাহীন নয়। এই অধিকার নিয়ন্ত্রণ যোগ্য। যেমন, সংগঠন করার অধিকার সব মানুষের আছে। কিন্তু আইনে আছে কোন জঙ্গি সংগঠন করা যাবে না। এখন যদি কোন সংগঠন জঙ্গিবাদে লিপ্ত হয়, তাহলে রাষ্ট্র সেই সংগঠন কে নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। তখন আর ওই সংগঠনটি করার অধিকার কারোর থাকবে না। এমনিভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার সবার আছে, কিন্তু তাই বলে অপরাধ উসকে দেওয়ার মতো মতামত প্রকাশ করা যাবে না।

মানবাধিকার ধারণার একটা লিখিত রূপ প্রথমে হাম্বুরাবি কোডে পাওয়া যায়। কিন্তু হাম্বুরাবি কোড থেকে অনেক উন্নততর মানবাধিকার ধারণা পাওয়া যায় ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে। কোরআন শরিফ, বাইবেল, বেদ ও পরে কনফুসিয়াসের বাণীসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও রীতিশাস্ত্রে কিছু বিধান রয়েছে, যা মানবাধিকার ধারণার বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। এরপর লেখক আধুনিক মানবাধিকার ধারণার বিকাশ, তাত্ত্বিকদের চিন্তাধারা এবং মানবাধিকার ধারণা প্রসারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতা ও ভূমিকা উপস্থাপন করেছেন। 'জাতিসংঘ ও সর্বজনীন মানবাধিকার ধারণা' পরিচ্ছদে লেখক আটলান্টিক চার্টার ও জাতিসংঘ, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, রাজনৈতিক বনাম অর্থনৈতিক অধিকার ইত্যাদি ব্যখ্যা করেছেন। মানবাধিকার ঘোষণার তাৎপর্য ব্যখ্যা করতে গিয়ে লেখক বলেন, 

"মানবাধিকার ঘোষণাটি ছিল যুগান্তকারী একটি অর্জন। এটি মানবাধিকার সম্পর্কে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। আমাদের দেশের নাগরিকদের সঙ্গে কী ব্যবহার করছি, তা আমার বিষয় বা তাদের প্রতি অন্যায় করছি নাকি করছি না এটা অন্যরা বলার কে --- রাষ্ট্রগুলোর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়।"


প্রধান দুটি মানবাধিকার চুক্তি সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বাস্তবায়ন পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চুক্তি অনুসমর্থন এবং একটি অনিচ্ছুক দেশের উদাহরণ দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। পাকিস্তান আমলে মৌলিক অধিকার দলনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন গণপরিষদ সংবিধানে মানবাধিকারের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এর কিছু প্রতিফলনও তুলে ধরেছেন লেখক। এরপর উঠে এসেছে বাংলাদেশর সংবিধানে মানবাধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার অংশে আলোচিত হয়েছে সমতার অধিকার, গ্রেপ্তার ও বিচারকালীন অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং অন্যান্য অধিকার। সমতার অধিকারে যেমন কিছু বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তেমনি কিছু বৈষম্যকে মেনেও নেওয়া হয়েছে। যেমন মুসলিম পারিবারিক আইনে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অর্ধেক সম্পত্তি পায়। হিন্দু পারিবারিক আইনে মেয়েরা পিতার সম্পত্তির মালিকানাই পেতে পারে না। কেবল জীবনকালে তা ভোগ করতে পারে৷ সংবিধান এসব পারিবারিক আইন নিয়ে মাথা ঘামায় না। আবার সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাথে কিছু ব্যতিক্রমের কথাও বলা আছে। যেমন কিছু বিশেষ চাকরির প্রকৃতি অনুসারে তা শুধু বিশেষ ধর্মের জন্য নির্দিষ্ট রাখলে তা বৈষম্য হবে না। যেমন মুসলমানদের জন্য সরকারি মসজিদে ইমামের চাকরি বা হিন্দুদের জন্য তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাকুরী। আবার সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে তাদের কোটা রাখলে তা বৈষম্য হবে না। বর্ণনা করা হয়েছে বাংলাদেশে মানবাধিকার বাস্তবায়নে সংসদীয় কমিটি, উচ্চ আদালত, মানবাধিকার কমিশন বা তথ্য কমিশন এবং বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনের ভূমিকা।

মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ আলোচনা করতে গিয়ে লেখক প্রশ্ন তোলেন, মানবাধিকার সুশক্ত হচ্ছে কি? তুলে ধরেন নতুন বিশ্বব্যবস্থার সংকট এবং নতুন নতুন অধিকার। শেষে মানবাধিকার বাস্তবায়নের কিছু বৈশ্বিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং মানবাধিকারের জন্য সংগ্রামে মানুষ জয়ী হবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করে ইতি টানেন। আসলে মানবাধিকার কী, সর্বপ্রথম এ ধারণার উদ্ভব, বিবর্তন, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতে এটি কিরূপ হতে পারে -সর্বপরি মানবাধিকার সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট এবং যথাযথ ধারণা পেতে এটি একটি সুখপাঠ্য এবং যথার্থ বই বলে আমার মনে হয়।


******** বই সমাচার__

বই: মানবাধিকার
লেখক: আসিফ নজরুল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: এরফান উদ্দিন আহমেদ
মুদ্রিত মূল্য: ২০০টাকা
পৃষ্ঠা: ৯৩

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ