মণিকা চক্রবর্তী রচিত 'যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্র ঝিনুক' উপন্যাসের আলোচনা : আহসান হাবিব

মণিকা চক্রবর্তী রচিত 'যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্র ঝিনুক' উপন্যাসের আলোচনা : আহসান হাবিব

প্রিয় ষড়ৈশ্বর্য

এই শুক্রবারের আগের শুক্রবারের আগের শুক্রবার আপনি আমাকে একটি উপন্যাস দিয়েছিলেন। শুধু আমাকে নয়, ডঃ সাইম রানাকেও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন 'অসাধারণ একটি উপন্যাস'।
শিল্প সাহিত্য বিষয়ে আপনার বোধ আমাদের কাছে প্রশ্নাতীত। বাসায় এসে পড়তে শুরু করলাম।



পাঠ শেষ হলে ভাবলাম একটা প্রতিক্রিয়া লিখি। একবার মনে হলো থাক। শেষে লিখছি।

উপন্যাস বলতেই মানুষ বোঝে একটা আখ্যান। এবিষয়ে আমার মতানৈক্য আছে। আমি বলি আখ্যান থাকতেই হবে এমন কথা নেই। আমার কাছে মনে হয় আখ্যানের যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি, এখন নিরেট ব্যক্তি কিভাবে তার জীবনকে যাপন করছে, তার চিন্তা, তার দর্শন, তার রাজনীতি, তার চারপাশের মানুষের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত, তার বয়ানই হচ্ছ এই সময়ের উপন্যাস। কিন্তু এই উপন্যাসে একটি আখ্যান আছে। তাতে কোন ক্ষতি নেই।

তাহসিন নামের একটি তরুণ বাংলাদেশ থেকে প্যারিস গেছে ডিজাইন নিয়ে পড়তে। আখ্যনটা তাকে ঘিরে। প্যারিস হচ্ছে পৃথিবীর সেই স্থান যা শিল্প সাহিত্যের পীঠস্থান বলেই আমরা জানি। এই হয়ে ওঠার পেছনে আছে ঐতিহাসিক কারণ। পৃথিবীর প্রথম বুর্জোয়া বিপ্লব এখানে সম্পাদিত হয়েছিল, ধর্মের সামন্তবাদী নিগড় থেকে মুক্তি পেয়েছিল মানুষ এবং এই বিপ্লব ব্যক্তি মানুষের মুক্তির জয়গান গেয়েছিল, যদিও মানুষ আবার বন্দী হয়ে পড়েছিল মজুরি দাসত্বে। তথাপি সেই থেকে প্যারিস জন্ম দিয়ে চলেছে আধুনিক শিল্প সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সব সৃষ্টি। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন মানুষের চিন্তায় যে বদল ঘটায়, তার প্রকাশ ঘটে সংস্কৃতিতে আর শিল্প হচ্ছে সংস্কৃতির রূপায়ণ।

তাহসিন একজন বাংলাদেশি তরুণ হওয়াই পাঠক হিসেবে আমাদের কৌতুহল জেগে থাকে এই ভেবে যে ভিন্ন সংস্কৃতিতে গিয়ে সে কিভাবে নিজেকে অভিযোজিত করে। এটা একটা প্রধান দ্বন্দ্ব। ইনফ্যাক্ট এই উপন্যাসটি ভিন্ন দুই সংস্কৃতির যে দ্বন্দ্ব তা প্রকটিত হয়েছে। তাহসিন সেই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পায়নি। কারণ এখনো সে এমন একজন সঙ্গী খুঁজছে যে হবে গভীর অন্তর্ভেদী। এই চাওয়া কিংবা বাসনা তার শ্রেণীদ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ।

তাহসিন প্যারিসের যে ডরমিটরিতে থাকে সেখানে ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতির ছেলেও থাকে। তাদের সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে কিন্তু এই সখ্য কোন দ্বন্দ্বের দিক উন্মোচন করে না। করে তখনই যখন দেখলাম সুজান নামের তার সিনিয়র এক ফরাসি তরুণীর সংগে সম্পর্ক হয়। সম্পর্ক মানে জৈবিক সম্পর্ক। নারী পুরুষের সম্পর্ক যদি জৈবিকতায় না গড়ায়, আমরা সম্পর্কের কোন স্বরূপ বুঝে উঠতে পারি না। কারণ যৌনতা এমন এক রাজনৈতিক সম্পর্ক যা কেবল সংস্কৃতি নয়, তার দার্শনিক দিকটিকেও উন্মোচন করে।

তাহসিন এবং সুজানের সম্পর্ক যৌনতায় রূপ নেয়। তখনই আমরা তাহসিনের সাংস্কৃতিক চিন্তাটি ধরতে পারি। সে সুজানের সংগ এড়াতে পারে না কিন্তু তার প্রতি সাড়া দিতে ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করে না। একটা দূরত্ব থেকে যায়। অন্যদিকে সুজান তাকে ভালোবাসে এবং যৌনতাকে সে উপভোগ করতে চায় উদ্দামভাবে। এক্ষেত্রে সুজানকে মনে হয় এমন একজন যে সংস্কৃতি, জাতীয়তা, বর্ণ ইত্যাদি ভেদক সূচকগুলিকে অতিক্রম করে শুধু মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির ধারক হিসেবে। আবার ডিজাইন সম্পর্কে তার যে সূক্ষ্ম আধুনিক চিন্তা তা বিকশিত মানুষের শৈল্পিক ভাবনাকেই চিহ্নিত করে। তাহসিন তার এই শৈল্পিক চিন্তাকে সমীহ করে। সুজানের শারীরিক সৌন্দর্যেও সে মোহিত। কিন্তু ভেতর থেকে সে সাড়া পায় না।

এই সাড়া না পাওয়ার একটাই কারণ- সাংস্কৃতিক পার্থক্য।

প্রিয় মুহম্মদ

ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই সম্পর্ক শীতল হয়ে আসে। সুজান একজন বুদ্ধিদীপ্ত নারী, বুঝে ফেলে। আমরা তাহসিনের এই দ্বন্দ্বের স্বরূপটি পরিষ্কার বুঝতে পারি যখন সে এক বন্ধুর সংগে একটা বাসায় বেড়াতে গিয়ে নেহা নামের এক সতের বছর বয়স্কা তরুণীর দেখা পায়। তাকে দেখেই তার ভেতরে এক ধরণের নৈকট্য অনুভব করে যদিও সে তখনো জানে না নেহা আসলে একজন বাঙালি তরুণী।

এই নেহাই হচ্ছে এই উপন্যাসের প্রধান কুশীলব যার মধ্য দিয়ে আমরা অচিরেই তার এবং তাহসিনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবো।

এবার নেহার গল্পে মনযোগ দেয়া যাক।

নেহা, বলা যায় এক ছিন্নমূল মেয়ে। বন্যায় বাবামাকে হারিয়ে ফেললে ফুফুর কাছে মানুষ, ঢাকায়। সে ফুল বিক্রি করতো ঢাকার রাস্তায়। নেহা দেখতে খুবই সুশ্রী, মনকাড়া। একদিন এক প্যারিস দম্পতি তাকে দেখতে পায় এবং দত্তক নেয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। তার আশা পূর্ণ হয়। নেহা প্যারিস চলে আসে। প্যারিসে এসে বড় হতে থাকে তার দত্তক পিতামাতা বিশেষত মায়ের অনুশাসনে। অনুশাসন মানে ফরাসী সাংস্কৃতিক কায়দায়। তারা নেহার মূল সাংস্কৃতিক শেকড়ের বিপরীতে একজন খাঁটি ফরাসি নারী এবং তাদের নিজের সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এখানে আমরা আবার সেই আইডেন্টিটির প্রশ্নের মুখোমুখি হই। দত্তক মায়ের মানসিক জটিলতা এবং নেহার ফেলে যাওয়া সংস্কৃতি- উভয়ে মিলে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়। নেহা হাপিয়ে ওঠে। কিন্তু নেহা এখান থেকে বের হওয়ার কোন পথ খুঁজে পায় না।

যখন সে তার বাসায় এই তাহসিনকে দেখে, তখন একটা আলোর রেখা দেখতে পায় যদিও সে তার সংগে কথা বলতে পারেনি মায়ের ভয়ে। পরে তার সংগে হঠাৎ দেখা হয় এবং তারা দুজনে প্রাণখুলে কথা বলে। আসলে নেহাই তার জীবনের কথা বলে যা একটু আগে বললাম।

তাহসিনের ভাল লেগে যায় নেহাকে। কিন্তু নেহাকে সে কথা সে বলে না। নেহারও ভাল লাগে কিন্তু তার উদ্দেশ্য থাকে ভিন্ন। সে একবার বাংলাদেশ আসতে চায় যেখানে তার শেকড় রয়েছে। এখানে এসে সে তার বাবামাকে খুঁজবে, পরিবারকে খুঁজবে।

নুহা যোগাযোগের জন্য তাহসিনের ফোন নম্বর নেয়, কিন্তু তাহসিন কখনোই নুহার কাছ থেকে ফোনকল পায়নি। কেন পায়নি তা তাহসিন কখনোই জানতে পারেনি, আমরাও পারিনি। আমরা শুধু কল্পনা করতে পারি এটি তার দত্তক মায়ের সংগে তার টানাপোড়নের গল্প।

নুহার প্রতি তাহসিন কেন আকর্ষণ বোধ করলো? কেন সুজানের প্রতি নয়? সুজান তো অসাধারণ আধুনিক বুদ্ধিদীপ্ত তরুণী যে ডিজাইনের মত আর্ট মাধ্যমেরও একজন ভাল ছাত্রী? কি সেই বাধা?

সাংস্কৃতিক পার্থক্যই এখানে প্রধান বাধা। তাহসিন তার সংস্কৃতির বাইরে যেতে পারেনি, যদিও সে নিজ দেশ ছেড়ে বিদেশে পড়তে গেছে। কিন্তু মানুষের সংগে সম্পর্কে যেতে তার রক্ষণশীলতা কাজ করেছে। সে পেতে চেয়েছে একজন খাঁটি বাঙালি। তবে এমন একজন যে তার ভাষায় গভীর অন্তর্ভেদী। নেহা সেই তার কাঙ্খিত জন কিন্তু তাকেও সে পায়নি। আমার প্রশ্ন সুজান কি অন্তর্ভেদী নয়, সে কি কেবলি যৌনবাদী? বরং সে জীবনকে উপভোগ করতে চায় কোন বিভেদকে তোয়াক্কা না করেই এবং ডিজাইনের মত আধুনিক একটি শিল্প মাধ্যমের প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে।

তাহলে? তাহলে কে চিন্তার দিক থেকে বিকশিত এবং অগ্রগামী মানুষ? সজান না তাহসিন? সুজান।

প্রিয় ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ


এই যে আমরা শেকড় শেকড় করি, এটা কি আমাদের আধুনিক চিন্তা না সামন্তীয় চিন্তা? সংস্কৃতি কি এক জায়গায় স্থির কোন বিষয়? একদম নয়। আগেই বলেছি উৎপাদন ব্যবস্থা বদলে গেলে সংস্কৃতি তার রূপ পাল্টায়। সামন্তীয় সংস্কৃতি পুঁজিবাদী সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু আমরা সব সময় পেছনের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই। এটা রূপান্তরশীল সমাজের একটা দ্বন্দ্ব।

তাহসিনের ভেতরে দুই ধরণের দ্বন্দ্বের দেখা পাচ্ছি। একটা হচ্ছে নিজেকে সবচেয়ে বিকশিত সংস্কৃতির শিল্পকে আয়ত্ত করা আর একটা হচ্ছে তার শেকড়ের বা নিজ সংস্কৃতির প্রতি টান। এই টানাপোড়নে বিক্ষত সে। তাই সে খুঁজে চলেছে এখনো তার কাঙ্খিত সংগী।

আমি ইচ্ছা করেই গল্পের নাটকীয় বা সিনেমাটিক অংশটির বর্ণনা বা ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। এই সারপ্রাইজটুকু পাঠকদের জন্য থাকুক।

আপনি ঠিকই বলেছিলেন এটি একটি চমৎকার উপন্যাস। একজন কথাসাহিত্যিকের কাজ হলো আমার মতে সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরা এক অনন্য ভাষায়। মণিকা চক্রবর্তীর ভাষা অসাধারণ। আধুনিক, নির্মেদ এবং শিল্প গুণসম্পন্ন।

ভাষার ভেতরেও রয়েছে একটা চমৎকার দ্বন্দ্ব। তিনি আধুনিক ভাষায় বলছেন এমন একটি গল্প যেখানে প্রধান চরিত্রের মননে রয়েছে রক্ষণশীলতার পিছুটান। এই কৃতিত্ব কথাসাহিত্যিকের। কারণ দ্বন্দ্ব শনাক্ত এবং তাকে হাজির করতে পারায় লেখকের মুন্সিয়ানা।

আপনি আমার প্রীতি নিন এবং 'যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্র ঝিনুক' উপন্যাসের লেখিকা মণিকা চক্রবর্তীকে আমার শুভেচ্ছা দিন।

************

যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্র ঝিনুক
মণিকা চক্রবর্তী


প্রকাশক: উজান প্রকাশন, বাংলাদেশ
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য: ২২০ টাকা।
পৃষ্ঠা: ১০৪
ISBN: 978-984-93669-5-9

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ