সাইফুল আহসান বুলবুল রচিত "বাংলাদেশের সমতল ভূমির নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী" বইয়ের আলোচনা - শামছি আরা পারভীন

সাইফুল আহসান বুলবুল রচিত "বাংলাদেশের সমতল ভূমির নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী" বইয়ের প্রচ্ছদ

 

লেখক পরিচিতি

বাংলাদেশের সমতল ভূমির নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী গ্রন্থের লেখক সাইফুল আহসান বুলবুল এর জন্ম ১৯৫০ সালের এপ্রিলে বরিশালের পৈত্রিক বাড়িতে। সেখানেই বেড়ে ওঠা ও বসবাস। লেখাপড়া, রাজনীতি ও ব্যবসা নিয়ে বর্ণিল কর্মজীবন। প্রথম লেখা বরিশাল থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত 'যুগবাণী' পত্রিকায়। কাব্য গ্রন্থ, কিশোর উপন্যাস, ছড়া, গল্পগ্রন্থ ছাড়াও অসংখ্য মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। আজীবন সম্মাননা ২০০৮ ছাড়াও অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত এই খ্যাতিমান লেখক।

সূচনা

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতি সমৃদ্ধ একটি দেশ। প্রধান জনগোষ্ঠী বাঙালির পাশাপাশি রয়েছে প্রায় অর্ধশত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই রয়েছে (প্রায়) স্বতন্ত্র্য পরিচয়, নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনাচার। এই বৈচিত্র্য ও জাতীয় একতার মেলবন্ধন দেশীয় সংস্কৃতি যে কতটা বর্ণময় করে তুলেছে তারই স্বচ্ছ দর্পণস্বরূপ হচ্ছে প্রখ্যাত গবেষক ও প্রথিতযশা কথাশিল্পী 'সাইফুল আহসান বুলবুল' রচিত "বাংলাদেশের সমতল ভূমির নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী" গ্রন্থটি। বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বলয়ের ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ ও যুগযুগান্তরের নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনা দেশীয় ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। গ্রন্থটির আলোচিত বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন্ত সমাজ, ধর্মকর্ম ও ধন-সম্পদ। ছড়া, প্রবাদ, লোকসংস্কৃতি প্রভৃতি নানাবিধ ঐতিহ্য। প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ সাইফুল হাসান বুলবুলের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় লিখিত এই গ্রন্থটির মাধ্যমে কিছুটা হলেও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ঐতিহ্যের নিগূঢ় তত্ত্ব ও অজানা রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। লেখকের মতে -

'সংখ্যালঘু এই সম্প্রদায়ভূক্তরা সবাই বহিরাগত এবং সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় অতি সামান্য"


লেখক এই গ্রন্থে চট্টগ্রাম বিভাগ ব্যতিরেকে সমতলভূমিতে বসবাসরত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বংশপরম্পরায় বহন করা সংস্কৃতি ও নিজস্ব ভাষার ব্যবহার, জীবনাচার, সামাজিক রীতিনীতি প্রভৃতি নিপুণ হাতের তুলিতে এঁকেছেন। খুব কাছের অথচ বহু দূরের এই জনজীবনের সাথে দেশের বৃহত্তম অধিবাসীদের সামান্য হলেও পরিচয় করে দেয়াই এই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য।

আলোচ্য

এই গ্রন্থটিতে লেখক সমতলভূমির ১২টি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন। যেমন:

  • ক) সাঁওতাল: লেখকের মতানুযায়ী সাঁওতালরা অস্ট্রিকগোষ্ঠীভূক্ত এবং ১২টি গোত্রে বিভক্ত। পিতৃতান্ত্রিক সাঁওতালদের ধর্ম হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মিল থাকলেও কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। শ্রেষ্ঠ উৎসব সোহরাই।
  • খ) ওঁরাওঁ: অস্ট্রেলিও গোষ্ঠীভূক্ত জড়োপাসক ওঁরাওঁদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি ফাগুয়া এবং বাসন্তী উৎসব সারহুল নামে পরিচিত। ওঁরাওঁ পরিবারে নবজাতকের আগমনকে বাজনা বাজিয়ে জানান দেয়া হয়। চুক্তিভিত্তিক ও মহামিলন এই দুধরনের বিয়ের রীতি প্রচলিত। শাদরী ও কুরুখ এই দুইভাষায় এরা কথা বলে।
  • গ) রাজবংশী: কোচরাজার বংশধর দ্রাবিড়ভাষী রাজবংশীরা জড়োপাসক হলেও কেউ কেউ মুসলমানও আছে।
  • ঘ) মাহলে: উত্তরাঞ্চলে বসবাস, উল্কির প্রচলন রয়েছে। বুধবার তাদের বিশেষ দিন। জিতিয়া অন্যতম উৎসব।
  • ঙ) মানতা: স্বভাবে যাযাবর, বরিশালের ৬টি জেলায় বাস করে, সাতটি সম্প্রদায় রয়েছে। মূলত মুসলমান হলেও মনসা ও মঙ্গলচণ্ডী ষষ্ঠীব্রত পালন করে।
  • চ) গারো: মাতৃতান্ত্রিক মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভূক্ত গারোরা ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে বাস বেশী। নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করে। জড়োবাদী লোককাহিনী নির্ভর গারোরা শোকের গান ও নাচ করে থাকে। প্রধান উৎসব ওয়ানগালা।
  • ছ) হাজং: আসামের আদি অধিবাসী, হিন্দু ধর্মাবলম্বী, বসবাস ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
  • জ) পাত্র: সিলেটে বাস, ঘরজামাই প্রথা বিদ্যমান। লোকসাহিত্য ও অন্যান্য শাখা সম্পর্কে তথ্য উদ্ধার সম্ভব হয় নি। লেখক এই লালেং নামে পরিচিত পাত্র সম্প্রদায়ের অচিরেই বিলুপ্তির সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছেন।
  • ঝ) খাসি: মাতৃতান্ত্রিক খাসিদের বাস সিলেটে, মূলকাজ মৌমাছি পালন। লোকসাহিত্য, ছড়া, ধাঁধাঁ, প্রবাদ, প্রবচন অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
  • ঞ) মণিপুরি: মৈতৈরা চীন থেকে আগত, বাস সিলেটে। মুসলমানরা পাঙন ও হিন্দুরা বিষ্ণুপ্রিয়া নামে পরিচিত।
  • ট) মুন্ডা: আদি অস্ট্রালয়েড, বসবাস খুলনা, দিনাজপুর, নওগাঁ, সাতক্ষীরায়। ধর্ম সনাতন, ভাষা মুন্ডারী। ছড়া, গান, ধাঁধা, লোকসংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
  • ঠ) রাখাইন: মগ নামে পরিচিত হলেও এই নামে তারা পরিচিত হতে ঘৃণাবোধ করে। ২০টিরও অধিক গোত্র রয়েছে। কৃষিকাজ প্রধান পেশা। ছেলেদের নামের পূর্বে উ এবং মেয়েদের নামের পূর্বে মা ব্যবহার প্রচলিত। বৌদ্ধ ধর্মানুসারী, ভাষা লিখিত। বৈশাখী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা প্রধান উৎসব।

গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য

গ্রন্থটি মূলত গবেষণাধর্মী। লেখক এই গ্রন্থে সহজ অর্থে সমতলভূমি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। গ্রন্থে সহজ অর্থে সমতলভূমি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। গ্রন্থটির প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন: রাজবংশী এবং বর্মণ; সাঁওতাল এবং খেরওয়ার প্রভৃতি। আবার বর্তমানের হৃদি জনগোষ্ঠী একসময় গারো সম্প্রদায়ভূক্ত ছিল বলে জানা যায়। লেখক তাঁর সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে আলব্ধ গবেষণা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সমতলভূমির নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সমাজ ও জীবনের নানা অজানা তথ্য উন্মোচন করেছেন।


প্রাসঙ্গিক আলোচনা ও উদাহরণ

লেখক নৃ-তাত্ত্বিকজনগোষ্ঠীর ব্যক্তি ও সমাজের ভেতর-বাহিরের গভীর তথ্য উন্মোচনে বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। গ্রন্থটি একজন প্রতিভাবান শিল্পীর দুঃসাহসী প্রচেষ্টার সার্থক ফসল। পরিসর ছোট হলেও গ্রন্থনা, বিন্যাস, তথ্য, উপাত্ত অত্যন্ত মজবুত ও তাৎপর্যপূর্ণ। লেখকের নিজস্ব কৌশল বা পদ্ধতি গ্রন্থটিকে স্বতন্ত্র্য মর্যাদায় উন্নীত করেছে বলে মনে করি। গ্রন্থটির মূল উপজীব্য সমতলভূমির নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনাচারণ। তাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্তই ধারাবাহিকভাবে সংস্কৃতি আকারে বিশ্লেষণ করে ফুটিয়ে তুলতে লেখক অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। লেখকের গবেষণা অনুসারে রাখাইনদের কিছু প্রবাদ প্রবচনের সাথে বাংলা ভাষার মিল লক্ষণীয়। যেমন-

(ক)
মা তি থা
রাঃ আয়ু মাহ
অনুবাদ: অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী

(খ)
প্রং গ্যে ক্রে গে
প্রাগো ম্রাং রে
অনুবাদ: উঠন্ত বৃক্ষ পত্তনেই চেনা যায়।

ধাঁধাঁ:
অ্যাপা ঠেকা আছি
আছি ঠেকা অ্যাপা
অনুবাদ: কোন গাছে উপরে ফল; ফলের উপরে গাছ?
উত্তর: আনারস

নামকরণ

গ্রন্থটির নামকরণে লেখক অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পরিশেষে বলা যায়, বিভিন্ন তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্ত, ভাষা প্রভৃতি দৃষ্টিকোণ থেকে লেখক সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন এবং বাংলা সাহিত্যে এই গবেষণামূলক গ্রন্থটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে স্থান দখল করে আছে বলে মনে করি। তবে লেখক নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত দুঃখ, দূর্দশা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক সংকট, সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতি নিয়ে আরও তথ্যবহুল গবেষণা উপস্থাপন করলে গ্রন্থটি অধিক সমৃদ্ধশালী হতো বলে মনে করি। খ্যাতিমান লেখক আব্দুস সাত্তার কর্তৃক রচিত 'আরণ্য জনপদ' গ্রন্থটির প্রভাব এই পুস্তকে পরিলক্ষিত এবং উক্ত গ্রন্থটির বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষাপটের সহিত অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে।

উপসংহার

গ্রন্থটি পঠনের মাধ্যমে সহজেই বোধগম্য হয়, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের পালিত ও লালিত নিজস্ব সংস্কৃতি, জীবনাচার ও পরিচয় একান্তই স্বতন্ত্র্য। বহুবছর ধরে তারা এদেশে বসবাস করে আসছে এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বতন্ত্র্যভাবে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, রীতিনীতি, আচার, অনুষ্ঠান পালন ও ধারণ করে আসছে। সহজ কথায় বলা যায় যে, বাঙালিদের সাথে ঐক্য ও একতার মাধ্যমে তারা গড়ে তুলেছে শত শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য যা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে, করেছে আরও বৈচিত্র্যময় ও বর্ণিল। এছাড়া এই গ্রন্থের মাধ্যমে সহজেই অনুমেয়- এই ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। গ্রন্থটি আবহমান নৃ-গোষ্ঠীর জীবন-প্রবাহের এক অনন্য দলিল।

০-০-০-০-০
বাংলাদেশের সমতল ভূমির নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী
সাইফুল আহসান বুলবুল


প্রচ্ছদ: সজিব খাঁন
প্রকাশকাল: ২০১৫
প্রকাশনী: শোভা প্রকাশ, ঢাকা।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ