কাব্য সমালোচনা: বনলতা সেন - গুঞ্জন রহমান

জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' কাব্যের আলোচনা গুঞ্জন রহমান


হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।


বনলতা সেন কবিতাটিকে আমি বলি বাংলা কবিতার মোনালিসা। যেভাবে দ্য ভিঞ্চির অমর পেইন্টিংয়ের সৌন্দর্যের যতটা না আকর্ষণ, তার চেয়েও দুর্নিবার আকর্ষণ এর রহস্যময়তার; একইভাবে, বনলতা সেন কবিতার সৌন্দর্য যতটা, এর রহস্যময়তা তার চেয়েও অনেক অনেক। মোনালিসার মিষ্টি হাসির সাথে অসামান্য চোখের যে সংমিশ্রণ, তাকে উতুঙ্গ মাত্রায় নিয়ে যায় ছবিটার পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ড। ফোরগ্রাউন্ডের মোনালিসার পেছনে যে ব্যাকগ্রাউন্ড লিওনার্দো এঁকেছেন, তা কোনো মাস্টার পেইন্টারও আঁকতে পারেন না, এর জন্য দরকার হয় গ্র্যান্ডমাস্টারের। একইভাবে, জীবনানন্দ কেবল স্তবকের পর স্তবক লিখে গিয়ে এক কল্পিত নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন তাই নয়, সেই সব স্তবক, চরণ, পদ, মাত্রা, ছন্দ, অন্ত্যমিল... সবকিছুতেই নিয়ম মেনেছেন কবিতার ব্যাকরণ থেকে। নিয়ম মেনেছেন, তেমনি নিয়ম ভেঙ্গেছেনও!

অক্ষরবৃত্তে লেখা এই কবিতা অমিত্রাক্ষর না হয়েও অমিত্রাক্ষরের নিয়ম অনুসরণ করে গেছে – পদ, স্তবক বা চরণের শেষে বাক্য সমাপ্ত না করে বক্তব্যের শেষে সমাপ্ত করেছে, যার কারণে পরের চরণে চলে যেতেও দ্বিধা করেনি। এবং কবি দ্বিধা করেননি সনেট বা অমিত্রাক্ষরের মাত্রা ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও। ছন্দ না ভেঙ্গে তিনি মাত্রা নিয়ে খেলেছেন নিজের নিয়মে। কোথাও ৮+৮+৬ ধরে এগিয়েছেন,

হাজার বছর ধ’রে | আমি পথ হাঁটিতেছি | পৃথিবীর পথে, (৮+৮+৬)
সিংহল সমুদ্র থেকে | নিশীথের অন্ধকারে | মালয় সাগরে (৮+৮+৬)
অনেক ঘুরেছি আমি; | বিম্বিসার অশোকের | ধূসর জগতে (৮+৮+৬)
সেখানে ছিলাম আমি; | আরো দূর অন্ধকারে | বিদর্ভ নগরে; (৮+৮+৬)
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, | চারিদিকে জীবনের | সমুদ্র সফেন, (৮+৮+৬)
আমারে দু-দণ্ড শান্তি | দিয়েছিলো নাটোরের | বনলতা সেন। (৮+৮+৬)


আবার কোথাও হিসাবের গরমিল করেছেন বারবার। তবে অক্ষরবৃত্ত ভাঙ্গেননি তাই বলে। লাইনপ্রতি বরাবরের ২২ মাত্রা ভেঙ্গে এই স্তবকের প্রথম চরণে ১৮ মাত্রা ব্যবহার করেছেন, ৮ মাত্রা ও ৬ মাত্রার পদের সাথে প্রথমবার তিনি ২ মাত্রার পদও ব্যবহার করেছেন এখানে। আবার একই স্তবকে ১৮ আর ২২ মাত্রার চরণ ব্যবহার করেছেন, সম্পূর্ণ পদের সাথে অসম্পূর্ণ পদও ব্যবহার করেছেন, দুটি চরণে তো ১০ মাত্রার পদও লিখেছেন, যে চরণ দুটি শেষ পর্যন্ত হয়ে গেছে ২৬ মাত্রার!

চুল তার কবেকার | অন্ধকার বিদিশার | নিশা, (৮+৮+২)
মুখ তার শ্রাবস্তীর | কারুকার্য; অতিদূর | সমুদ্রের ’পর (৮+৮+৬)
হাল ভেঙে যে-নাবিক | হারায়েছে দিশা (৮+৬)
সবুজ ঘাসের দেশ | যখন সে চোখে দেখে | দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, (৮+৮+১০)
তেমনি দেখেছি তারে | অন্ধকারে; বলেছে সে, | ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ (৮+৮+১০)
পাখির নীড়ের মতো | চোখ তুলে নাটোরের | বনলতা সেন। (৮+৮+৬)
সমস্ত দিনের শেষে | শিশিরের | শব্দের মতন (৮+৪+৬)
সন্ধ্যা আসে; | ডানার রৌদ্রের গন্ধ | মুছে ফেলে চিল; (৪+৮+৬)
পৃথিবীর সব রঙ | নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি | করে আয়োজন (৮+৮+৬)
তখন গল্পের তরে | জোনাকির রঙে ঝিল | মিল; (৮+৮+২)
সব পাখি ঘরে আসে| — সব নদী— ফুরায় এ- | জীবনের সব লেনদেন; (৮+৮+১০)
থাকে শুধু অন্ধকার, | মুখোমুখি বসিবার | বনলতা সেন। (৮+৮+৬)


যাহোক, এগুলো হলো ছন্দ বা মাত্রা তথা কবিতার ব্যাকরণগত গবেষণার বিষয়। কিন্তু আমি ঠিক সে বিষয়ে লিখতে চাইনি, বরং বলতে চেয়েছি কবিতাটার ভাবগত দিকটা নিয়ে।

জীবনানন্দ তাঁর অনেক কবিতায় বা অধিকাংশ কবিতাতেই অদ্ভুত কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন, উপমা ব্যবহার করেছেন, সমসাময়িক বিবেচনায় কিছু অপ্রচলিত বিশেষ্যপদও হাজির করেছেন প্রায়শ। শব্দ নিয়ে খেলা সাধারণত ছড়াকারদের প্রিয় বিষয়, যেমন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বা সুকুমার রায়ের কবিতায় বা ছড়ায় শব্দের ব্যবহার পাঠককে চমকিত করে থাকে। তবে সে সবই প্রচলিত বা খুব জানাশোনা শব্দকেই বিচিত্রভাবে ব্যবহার করার নৈপূণ্য। কিন্তু জীবনানন্দ শব্দ নিয়ে খেলতে গিয়ে প্রায়শ অপ্রচলিত শব্দকে বেছে নিয়েছেন। তা করতে গিয়ে সেই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দ্যোতনা কবিতাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কবিতাটি পড়তে পড়তে যে ভাবের ভেতর দিয়ে চালিত হচ্ছিলেন পাঠক, ওই অজানা বা কম শোনা শব্দটি আচমকা যখন হাজির হয়, পাঠক তখন ওই ভাবটি থেকে ক্ষণিকের জন্য বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন। কবিতার ভাবের চেয়ে ওই শব্দটিই তাঁকে তখন দোলায় বেশি।

শব্দের মতো উপমা বা মেটাফোর ব্যবহারেও জীবনানন্দ তাঁর কবিতার পাঠককে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা বারংবার করে গেছেন। যেমন, ‘আট বছর আগের এক দিন’ কবিতাটির কথা ধরুন। এখানে তিনি কবিতার প্রধান চরিত্রটির মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে হঠাৎ করে লিখলেন ‘উটের গ্রীবার মতো’ নিস্তব্ধতা! আরেক জায়গায় লিখলেন ‘চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা’! সেইভাবে, ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে? / চমৎকার! /ধরা যাক্ দু-একটা ইঁদুর এবার—’ এই মেটাফোরও পাঠককে চমকে দেয়, থমকে দেয়। এবং খানিকটা বিভ্রান্তও করে, কবিতার শেষভাগে হঠাৎ করে কবি যখন নিজেই প্রবেশ করেন তাঁর কবিতার কল্প-গল্প-চিত্রায়নের একদম ভেতরে –

 ‘আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো— বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো / কালীদহে বেনোজলে পার; / আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’।

তো এই বিভ্রান্তির খেলা, পাঠককে চমকে দেয়ার কিংবা বিভ্রান্ত করার খেলাটা জীবনানন্দ প্রাণভরে খেলেছেন এই কবিতাতেও। গোটা কবিতাটিতে কবি নিজেকে স্থাপন করেছেন একজন নাবিকের চরিত্রে, অথচ কবিতাটির শুরুই করেছেন হাঁটার কথা দিয়ে। নাবিক তো জলে ভাসবে, সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াবে পৃথিবীর এক মেরু থেকে অন্য মেরু অব্দি। কিন্তু তিনি নাবিক হয়েও হাঁটছেন পৃথিবীর পথে। লক্ষ করুন– পথে কিন্তু, জলে নয় বা সাগরে নয়। এর পরে কয়েকটি সাগরের কথা উল্লেখ আছে যদিও কবিতায়। উল্লেখ আছে ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক মিলিয়ে কয়েকটি নগরের কথাও। যে নাবিক হাজার বছর ধরে পরিব্রাজন করে যাচ্ছেন, তাঁর পক্ষে এসব নগরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির খোঁজ রাখারই কথা। কিন্তু খটকা লাগে তখনই, যখন তিনি কয়েক হাজার বছরের সভ্যতা-সংস্কৃতি, ভূগোল ও কিংবদন্তি ঘেঁটে এসে দুদণ্ড শান্তি পান “নাটোরের” বনলতা সেনের কাছে। নাটোর এমন কোনো ঐতিহাসিক নগর নয়, প্রাচীন বা মধ্যযুগের কিংবা আধুনিককালের কোনো সভ্যতাতেই নাটোরের সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ নেই। বনলতা সেনের চরিত্রটিতেও ‘নাটোরের’ হওয়ার কারণে এমন কিছু আলাদা তাৎপর্য যুক্ত হয়নি। যেভাবে কুইন অব সেবা, হেলেন অব ট্রয়, ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈ... ইত্যাদি নামের সাথে সেইসব চরিত্রের দেশ/নগরের নাম যুক্ত হওয়ায় তাঁদের চরিত্রের আলাদা একটি মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে, বনলতা সেন নাটোরের হওয়ার কারণে তাঁর চরিত্রের এমন কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য কি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়? নাটোর বৃটিশ ভারতের প্রাচীন একটি জেলা শহর, এখানকার বিখ্যাত স্থাপনা হলো বৃটিশ আমলে তৈরি একটি প্যালেস, যা দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি (অধুনা উত্তরা গণভবন) নামে সমোধিক পরিচিত। আর বিখ্যাত নাটোরের কাঁচাগোল্লা। তাছাড়া আর কোনো তাৎপর্য এই নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলে আমার জানা নেই, তবে জীবনানন্দের জানা থাকতেও পারে। তবে এই কবিতার কারণে উল্টো নাটোরেরই পরিচিতি ঘটে গেছে বনলতা সেনের ঠিকানা হিসেবে। ... এ হলো জীবনানন্দীয় গিমিক।

আরেকটা ব্যাপারও লক্ষণীয়। এই কবিতায় কবি যেখানে নিজেকে নাবিকের বেশে উপস্থাপন করছেন, নানান বন্দর নগরীর নাম উল্লেখ করছেন, সাগর ও দ্বীপের কথা বলছেন, সেখানে বনলতা সেনের বাড়ি নাটোর কিন্তু কোনো বন্দর নগরী নয়। সমুদ্র তীরবর্তী স্থান নয়, কোনো দ্বীপ নয়, নয় কোনো প্রাচীন সভ্যতায় উল্লেখ থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শন। তথাপি নাবিক কবির সাথে তাঁর পরিচয়ের যোগসূত্র কী?

তো সরাসরি চলে আসি বনলতা সেনের সাথে কবিতার কথকের সম্পর্ক নিয়ে। কথক সে নারীর সৌন্দর্যের বর্ণনা দিচ্ছেন প্রাচীনকালের ঐতিহাসিক নগরীর ভুলে যাওয়া কিংবা কখনো না-জানা সব মেটাফোর থেকে। বিদিশার নিশা, শ্রাবস্তীর কারুকার্য, দারুচিনি দ্বীপের ভেতরের সবুজ ঘাসের দেশ... বনলতা সেনের বাহ্যিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় এই সব নগরীর বর্ণনা এবং তারও আগে কথক তাঁর নিজের পরিচিতি বা নিজের পরিব্রাজনের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে যে নগরগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন – একটু খেয়াল করলেই লক্ষ্য করবেন, প্রতিটি জায়গায় তিনি রাতের বর্ণনা দিয়েছেন। অন্ধকারের, অস্পষ্টতার, রহস্যময়তার কথা বলেছেন। ‘নিশীথের অন্ধকারে’, ‘ধূসর জগতে’, ‘আরও দূর অন্ধকারে’, ‘অন্ধকার’ বিদিশার ‘নিশা’, ‘তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে’, ‘দিনের শেষে’, ‘সন্ধ্যা আসে’, ‘থাকে শুধু অন্ধকার’ ... এভাবে বারবার কেবল অন্ধকারের বর্ণনাই দিয়ে গেছেন কবি/কথক। তিনি বনলতাকে প্রথমবার দেখেছেনও অন্ধকারেই! সেই সাক্ষাতেই কিংবা পরবর্তী সাক্ষাতে যখন অন্তরঙ্গ আলাপে মুখোমুখি বসার কথা, সেই অ্যারেঞ্জমেন্টও কিন্তু হয়েছে অন্ধকারেই, একদম শেষ লাইনে যে কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু এই অন্ধকারের চেয়েও রহস্যময় যে বিষয়টা, তা হলো তাঁর প্রতি বনলতা সেনের বলা প্রথম (এবং আমাদের জানামতে একমাত্র) উক্তিটি – ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ ভেবে দেখুন, জগৎসংসার ভেজে খেয়ে শেষ করা এই অস্থির “ক্লান্ত প্রাণ এক” নাবিক শেষ পর্যন্ত স্থির শান্ত হয়ে গেলেন যে নারীকে দেখে, তাঁর প্রতি সে নারীর প্রথম উক্তিটি ‘আপনি’ সম্বোধনে! আর এইখানেই দাশবাবুর আসল মুন্সীয়ানা।

এত কিছু থাকতে চোখের উপমা কেন পাখির বাসার সাথে দিলেন কবি?
তার আগে আরেকটি উপমা নিয়ে একটু ভাবি। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’। এত কিছু থাকতে চোখের উপমা কেন পাখির বাসার সাথে দিলেন কবি? আমাকে অনেকেই বলেছেন যে, পাখির নীড় বলতে কবি এখানে ঠিকানা বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ বনলতা সেনের চোখে কবি তাঁর ঠিকানা দেখতে পেয়েছেন। সারা পৃথিবী ঘুরে এসে তিনি ওই চোখেই নিজের শেষ ঠিকানা বা স্থায়ী আবাস খুঁজে পেয়েছেন। ... আচ্ছা, পাখির বাসা কি খুব স্থায়ী কোনো নিবাস? পাখিরা কি একটা বাড়িতে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর থেকে যায়? সারা জীবন কি একই বাসায় কাটায় একটা বা এক জোড়া পাখি? মোটেই নয়। পাখি কেবল ডিম দেয়ার জন্য বাসা বানায়। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুলে এবং সেই বাচ্চা উড়তে শিখলেই সে বাড়ির কথা ভুলে যায় পাখি। তাই পাখির নীড় কোনো স্থায়ী ঠিকানা বা স্থায়িত্বের প্রতীক বা থিতু হওয়ার মেটাফোর হতে পারে না। বরং লক্ষ করলে দেখবেন, পাখির বাসা খুব অগোছালো একটা বাসা। বাবুই ছাড়া আর প্রায় কোনো পাখিই খুব গুছিয়ে বাসা বানাতে পারে না। ছন্নছাড়া, অগোছালো, ভঙ্গুর একটা বাসা। আর ঠিক এই অর্থেই উপমাটিকে বেছে নিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। বনলতা যখন কবিকে বা এই কবিতার কথককে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর দৃষ্টি তখন ভাসা ভাসা, অগোছালো, এলোমেলো। ওই দৃষ্টিতে গভীরতা নেই, স্থিরতা নেই। বরং এক ধরনের উদ্ভ্রান্ত অভিব্যক্তি থেকে থাকবে। দিশেহারা একটা অবস্থা। এবং সেই চোখ তুলে মেয়েটি তাঁর দিকে তাকিয়ে শুরুতেই বললেন – ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ বাক্যটা হতে পারতো এতদিন কোথায় ‘ছিলে’? অথবা, ‘আপনি কোথায় ছিলেন?’ কিংবা ‘এতক্ষণ’ কোথায় ছিলেন? কিন্তু বললেন, ‘এতদিন’। কেন? এতদিন শব্দটার মধ্যে এক ধরনের অপেক্ষা জড়িয়ে আছে, প্রতীক্ষা মিশে আছে। কেউ যখন কাউকে বলে এতদিন কোথায় ছিলে, তার মানে এতদিন ধরে বা অনেক দিন ধরে তার জন্য সে অপেক্ষা করছে, প্রতীক্ষা করে আছে। যার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে অপেক্ষা করে থাকা যায়, সে তো তার খুব কাছের কেউ, খুব চেনা কেউ, তাই না? তো সেই কাছের মানুষ, খুব চেনা মানুষকে কেউ ‘আপনি’ সম্বোধন করবে কেন? আমি মনে করি, এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে।

প্রথম কারণ: মেয়েটির তিনি খুব চেনা, খুব কাছের মানুষ বলেই তাঁর জন্য মেয়েটি ‘এতদিন’ ধরে অপেক্ষায় কিংবা প্রতীক্ষায় আছে এটা যেমন ঠিক; তেমনি যতই কাছের মানুষ হোক বা চেনা হোক না কেন, বাস্তবে ওই সাক্ষাতটাই তাঁদের জীবনের প্রথম সাক্ষাত। ‘মুখোমুখি বসিবার’ প্রথম ঘটনা। আর তাই অনোভ্যাসগত জড়তা থেকে সম্বোধনের ‘আপনি’ থেকে গেছে। ... কিন্তু, এটা যদি প্রথম সাক্ষাত হয়, তাহলে আবার খুব চেনা হলেন কী করে? কারণ, তাঁদের চেনা-জানা বা বোঝাপড়ার মাধ্যম ছিলো– চিঠি। সাগর-মহাসাগরে ঘুরে বেড়ানো এই নাবিকের সাথে বনলতা সেনের পরিচয় পত্রালাপে। সারাদিন জাহাজের কাজে ব্যস্ত থাকা নাবিক রাতের অন্ধকারেই কেবল অবসর পেতেন সেসব চিঠি পড়বার কিংবা চিঠির উত্তর লিখবার, তাই কবিতায় বনলতাকে ঘিরে সব বর্ণনা, সব মেটাফোর অন্ধকারের। সেইসব চিঠিতে চিঠিতেই তাঁদের প্রেম, তাঁদের একে-অপরকে জানা। আর তারপর যখন প্রথম সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক হলো, বনলতা অপেক্ষায় ছিলেন আগে থেকে তাঁর। কবি পৌঁছুতেই সেই উদ্ভ্রান্ত, দিশেহারা চোখ তুলে কবিকে দেখলেন তিনি এবং বুঝতে পারলেন – এই সেই মানুষ, তাঁর একদম নিজের মানুষ, যার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি জীবনভর। আর তাই, বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে তাঁর ওই প্রথম উচ্চারণ – ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

দ্বিতীয় কারণটি অপেক্ষাকৃত সহজ। এবং আমার ধারণা এই কারণটাই সঠিক, এটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। সেটা আর কিছুই নয়, পরের বাক্যে সেন-এর সঙ্গে অন্তমিল দেবেন বলেই এতদিন কোথায় ছিলে না লিখে ছিলেন লিখেন, এর বেশি কিছু না। এ নিয়ে এত গবেষণার কিছু নেই।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ